রাঙিয়ে দিয়ে যাও পর্ব ২০

রাঙিয়ে দিয়ে যাও পর্ব ২০
লেখনীতে:অনুসা রাত(ছদ্মনাম)

অয়নের কেবিনের সামনে আসতেই সবাইকে বসে থাকতে দেখতে পেলাম আমি আর সাদি।অয়নের মা-বাবা থেকে শুরু করে বন্ধু-বান্ধব সবাইকেই।প্রান্তি আমাকে দেখে এগিয়ে এলো। কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
___” আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না যে অয়ন আমাদের মাঝে আর থাকবে না।”
___” মানে? থাকবে না কেন?”(অবাক হয়ে)
সাদিও তাল মিলিয়ে বললো,

___” হ্যা। আর ওর সাথে তো দুপুরেও আমাদের কথা হলো।তখন তো সুস্থই ছিলো।”
আমি সবার দিকে এগিয়ে গেলাম। মিশমি এক পাশের চেয়ারে বসে মাতয় হাত দিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে।রুশ আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
___” অয়নের জ্ঞান ফিরেনি।”
আমি আটকে আসা কন্ঠে বললাম,
___” কিভাবে কি হল!”
মিশমি এবার মাথা তুললো। কান্না ভেজা গলায় বলে উঠলো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

___” সকাল থেকে বাসা ছিলো না। কোথায় যেন গিয়েছিল।বলেও যায়নি।বাসায় আসার পর পরই মাথায় ব্যাথা শুরু হয়। পরে অজ্ঞান হয়ে যায়। আর তারপর হাসপাতালে আনা হয়।”
সাদি আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
___” হঠাৎ মাথাব্যাথা? এটা কি প্রায়শই হয়? নাকি আজ হঠাৎ । ”
মিশমি আবারো কান্নাভেজা গলায় বললো,
___”আমার সামনে আজই প্রথম।কিন্তু আগে হত নাকি এটা আমি জানি না।”
আমি অবাক হয়ে বললাম,

___” কই আমার সামনে তো কখনো হয়নি।”
সাদিও সায় দিয়ে বললো,
___” ওর হঠাৎ মাথায় সমস্যা কবে থেকে?”
মিশমি কিছু বলতে যাবে তার আগেই পিছন থেকে প্রান্তি বলতে লাগলো,
___” তোমাদের না অয়নের সাথে সকালে কথা হয়েছিল? তোমরা জানো না ওর হঠাৎ কেন মাথা ব্যাথা উঠে গেছে? ”
আমি না’বোধক মাথা নাড়ালাম। তারপর সবাইকে আস্তে আস্তে করে সব ঘটনা খুলে বললাম। আংকেল-আন্টিকে মিশমির মা-বাবা স্বান্তনা দিচ্ছেন। তাই তারা আমাদের থেকে দূরে অবস্থান করছেন। আমি আর সাদি ওদেরকে ধীর-স্থির অবস্থায় সমস্ত ঘটনা খুলে বললাম। ভেবেছিলাম মিশমি রাগ করবে। কিন্তু তেমন কিছুই না। মিশমি চোখ মুছতে মুছতে আমাকে উদ্দ্যেশ্য করে বললো,

___” অনু, তুমি যা জানো সবটাই মিথ্যা। অয়নের সাজানো সব মিথ্যা কথা।”
মিশমির কথা শুনে আমি আর সাদি একে-অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছি।
___”অয়ন মিথ্যা বলেছে? কেন?”
আমার প্রশ্নের জবাবে মিশমি বলতে শুরু করে,
___” ডাক্তারের কথায় অয়নের ব্রেন টিউমার রয়েছে।এ ধরণের পেশেন্ট বরাবর বাঁচে না। আর অয়নের ব্রেনে থাকা টিউমারটা দিনে দিনে বেশ বড় হচ্ছিল। অয়ন তোমাকে ভালোবাসতো অনু। এদিকে আমিও অয়নকে ভালোবাসতাম কিন্তু ওর এই সমস্যাটার কথা জানতে পেরে ও তোমার জীবন নষ্ট করতে চায়নি।

আর সবচেয়ে বড় কথা হলো আমি ওকে টাকা দিই ওর চিকিৎসার জন্যে। তুমি হয়ত জানো না, ওর বড় দুই ভাইয়ের মধ্যে একজনের সাথে ওর ভিতরে ভিতরে ঝগড়া চলছে। ওর বাবাও এখন রিটায়ার্ড। আর বড় ভাই আলাদা হয়ে যাওয়ার দরুণ ওর টাকা ছিল না। একজনের টাকায় সংসার চলত।আমি এটারই সুযোগ কাজে লাগাই আর ওকে টাকার অফার করি।এদিকে ওর এসব অসুস্থতার কথা শুনে আংকেলও হার্ট অ্যাটাক করেন।পরে অয়নকে আমার সাহায্য নিতে হয়।”
বলতে বলতে ও আমার হাত ধরে ফেলে। আমি চুপ করে বসে আছি। ও আমার হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো,

___” আমি যে তোমাকে এত গালি-গালাজ করেছি, সেগুলো আমার মুখ থেকে বেড়িয়ে গেছে। এগুলো অয়নের কথা ছিলো না। অয়ন বলেনি এসব বলতে। আমিই বলেছি। কারণ তোমার উপর আমার একটা চাপা রাগ ছিলো। অয়ন কেন তোমায় ভালোবাসবে? আমার মধ্যে কিসের কমতি? এটা ভেবেই আমি তোমাকে যা নয় তাই বলেছি। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও অনু।প্লিজ।”
আমি কিছু বলছি না। মিশমি এবার সাদির দিকে তাকিয়ে বললো,

___” ভাইয়া আপনিও আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন। আমি না বুঝে আপনাকেও অনেক কথা বলে ফেলেছি।”
সাদি হ্যাবোধক মাথা নাড়ালেন শুধু। মিশমি আবারো আমাকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলো,
___” অয়ন ভেবেছিল আমাকে বিয়ে করার একটা নাটক করে তোমার থেকে দূরে সরে যাবে। কারণ ওর ধারণা,ও তো মরেই যাবে তাহলে আমার লাইফটা কেন ধ্বংস করবে? কিন্তু আমিও যে ওকে ভালোবাসতাম। তাই আমি ওকে আসল বিয়েই করতে বলি। কিন্তু ও করতে চায় না।

কিন্তু আমি টাকা ফেরত দেয়ার জন্য ব্লেকমেইল করি। কারণ আমিওকে আগের থেকেই বিয়ে করতে চাইতাম। পছন্দ করতাম।তারপর আমরা সত্যিকারের বিয়ে করি। তারপর চট্টগ্রাম চলে যাই। প্রতিদিন ওকে তোমার জন্য কষ্ট পেতে দেখেছি আমি। একটা মানুষ লুকিয়ে এত ভালোবাসতে পারে?কিন্তু আমার এসব সহ্য হয়নি। তাই যথাসম্ভব ওকে আমার দিকে টানার চেষ্টা করি। তখন হয়ত তোমার মনে ওর জন্য ঘৃণা জমছিলো। জমারি কথা। তারপর প্রান্তিরা জোর করে সবাই মিলে ঘুরতে যেতে। তখনো আমি ওকে নিষেধ করি।কিন্তু ও তোমায় একবার দেখতে চেয়েছিল। তাই ও রাজি হয়ে যায়। আমারো কিছু বলার থাকে না।”

আমি এখনো চুপ করে বসে আছি। এগুলো কি সব সত্যি নাকি আমি স্বপ্নে আছি সেটা জানি না। অয়ন তারমানে আমাকেই ভালোবাসতো?সাদি কাঁধে হাত রাখতেই ধ্যান ভাঙে আমার। আমি পিছনে ফিরে বললাম,
___” শুনলেন?”
সাদি হ্যা বোধক মাথা নাড়ালেন। আমাকে উঠিয়ে বুকে জড়িয়ে বললেন,
___” শান্ত হ। অয়নের সাথে কথা বলতে হবে তো।”
আমি চুপ করে ওনার বুকে মাথা রেখে আছি। কিযে হচ্ছে সব আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।অয়ন কি পাগল? কেন এত বড় নাটক করলো ও?
আমি প্রান্তির দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললাম,

___” তোরা সব জানতি? কিন্তু আমায় জানালি না কেন?”
সানিয়া নিম্ন স্বরে বললো,
___” আমরাই মাত্র জানতে পেরেছি।”
এরপর আর কিছু বললাম না আমি। চুপ হয়ে গেলাম। মিশমি মুখ চেপে কান্না করছে। মেয়েটা আমার জন্য খারাপ,তাতে কি? অয়নকে তো ভালোবেসে গেছে।কিন্তু ওরও এখানে দোষ রয়েছে। অয়নের অসহায়ত্ব কে কাজে লাগিয়ে ও অয়নকে কাছে টানার চেষ্টা করেছে।কিন্তু তবুও,ভালোবাসে তো।ওর জন্যে আমার খারাপ লাগতে শুরু করলো।

অয়নের সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি। ওর জ্ঞান ফিরেছে। একটু আগেই সবার সাথে কথা বলেছে। এখন সবাইকে বাইরে রেখে আমাকে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। অবশ্য এটা অয়নের অনুরোধ। ও নাকি আমার সাথে কিছু কথা বলতে চায়। আমারো যে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। সাদি আমার পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে। অয়ন চোখ বন্ধ করে আছে। আমি পিছনে ফিরে সাদির দিকে তাকালাম। সাদি সম্মতি দিলো।আমি ওকে আস্তে করে ডাকলাম,

___” অয়ন..”
অয়ন চোখ খুললো। মলিন হেসে বললো,
___” এসেছিস?”
আমি কিছু বললাম না। ওর পাশের চেয়ারে বসে পড়লাম। অয়ন পিছনে থাকা সাদির দিকে তাকিয়ে বললো,
___” ভাইয়া প্লিজ ভিতরে আসুন।”
সাদি ভিতরে এলেন। আমার পাশের চেয়ারে বসে অয়নকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
___” কি অবস্থা?”
অয়ন হাসলো। সাদিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
___” আল্লাহ যেমন রাখছেন।”

সাদি কিছু বলার আগেই আমি হঠাৎ বলে উঠলাম,
___” আমাকে মিথ্যা বললি কেন অয়ন?”
অয়ন অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো,
___” কিসের মিথ্যা?”
___” নাটক করিস না। দুপুরে যা বলেছিলি সবটাই মিথ্যা।”
অয়ন জানালার দিকে তাকিয়ে বললো,
___” মিশমি সব বলে দিয়েছে? ”

___” হ্যা বলে দিয়েছে। বল কেন এত বড় নাটকটা করলি আমার সাথে? কি দোষ ছিলো আমার? অন্তত তোর যাওয়ার আগ অবধি তোর সাথে থাকতাম আমি।কিন্তু এখন এসব বলেই বা কি লাভ? এখন আমি অন্যকাউকে ভালোবাসি। কিন্তু আমি শুধু এটা জানতে চাই যে,তুই মিথ্যাটা কেন বললি? খুব কি দরকার ছিলো?”(ছলছল নয়নে)
সাদি চুপ করে বসে আছেন। আমি ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
___” আপনার কি আনকমফোরটেবল ফিল হচ্ছে? ”
সাদি হেসে বললেন,

___” জেলাসি হচ্ছে অনু।”
আমি থতমত খেয়ে গেলাম। অয়ন হেসে বললো,
___” স্বাভাবিক। কিন্তু জেলাসির কিছু নেই সাদি সাহেব। এখন অনু শুধুই আপনার। আর অনুও আপনাকেই ভালোবাসে।আমিও যে মিশমিকে ভালোবাসি।কখন ভালোবেসে ফেলেছি নিজেও বুঝতে পারিনি। অনু এখন আমার অতীত আর মিশমি বর্তমান এবং ভবিষ্যত।”
ওর শেষ কথাটা শুনে কেন যেন মনটা ভীষণ হালকা লাগছে।এতক্ষণের অপরাধবোধটা আর হচ্ছে না। কারণ অয়নও ওর মনের মত মানুষ পেয়েছে।
সাদি হেসে বললেন,

___” অনু আমাকে ভালোবাসে। এতে কোনো সন্দেহ নেই।কিন্তু তোমার বিষয়টা নিয়ে আমিও বেশ শোকাহত। মিথ্যাটা বলার কি খুব দরকার ছিলো? অনুও কষ্ট পেয়েছিল।”
আমি ওনার কথা মাঝখান থেকে বলে উঠলাম,
___” কিন্তু আমার জন্য সাদিকেই তৈরী করা হয়েছিল আর সাদির জন্য আমাকে। তাই হাজার কষ্টের পরও সাদি আমাকে আপন করে নিয়েছিল।”
অয়ন মলিন হেসে বললো,

___” তুই তখন আমাকে মন থেকে ক্ষমা করতে পারিসনি। তাই না অনু? ভেবেছিলি ক্ষমার কথা বললেই আমি চলে যাব তোর থেকে দূরে। তাই মুখেই শুধু বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছিলি।”
আমি চুপ হয়ে আছি।কি বলবো? ও তো মিথ্যা বলছে না। আর ও যা করেছিলো তারপর ওকে মাফ করাটা তো আমার পক্ষে অসম্ভবই ছিল। তাও ভেবেছিলাম ও দূরে সরে যাবে।তাই মাফ করে দিয়েছিলাম। অয়নের কথায় ভাবনায় ছেদ ঘটে আমার।

___” মরবার আগে একটা জিনিসই চাই অনু। আমাকে মাফ করে দে তুই। আর তোকে কিডন্যাপ করে যা যা বলেছি সব মিথ্যা এটা তো জানিসই। আমি চেয়েছিলাম তুই আমাকে ঘৃণা করবি। তাই আমি এতকিছু করেছি।আমাকে মাফ করে দিস অনু। পৃথিবীতে আমার দিন তো শেষই। তুই আমাকে মাফ করে দিলে আমার আত্মা শান্তি পাবে।”
___” কিসের জন্য মাফ করবো আমি তোকে? যেখানে তোর কোনো অন্যায়ই নেই। এখানে তোর অন্যায়টা হচ্ছে তুই আমাকে মিথ্যা বলে এত বড় নাটকটা করলি। এটাই তোর অপরাধ।”
___” এটার জন্যই সরি। প্লিজ ফরগিভ মি।”
আমি সাদির দিকে তাকালাম। উনি সম্মতি দিলেন। আমি অয়নকে উদ্দেশ্য করে বললাম,

___” নিজের যত্ন নে। সেড়ে উঠ।”
অয়ন হালকা হাসলো। আমার হাতটা সাদির হাতের ভাজে দিয়ে বললো,
___” সারাজীবন সুখে থাক অনু। তোর যেন একটা সুন্দর রাজকন্যা হয়। আর সাদি ভাই? আমার বান্ধবীর এভাবেই খেয়াল রাখবেন কিন্তু। নয়ত খবর আছে।”
সাদি হেসে মাথা চুলকালেন। অয়নের মাথায় হাত দিয়ে বললেন,
___” তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠো ছোটে।”
অয়ন আবারো জানালার দিকে তাকালো। হয়ত অশ্রু লোকানোর চেষ্টা। তারপর বলে উঠলো,

___” আমার মনে হয় আর উঠা হবে না।”
হঠাৎ পিছন থেকে মিশমি বলে উঠলো,
___” একদম বেশি কথা বলবে না। উঠা হবে না মানে?”
আমরা সবাই পিছনে ফিরে ডতাকালাম। মিশমি অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে অয়নের দিকে। হাতে খাবারের ট্রে। আমরা উঠে দাঁড়ালাম। মিশমি অয়নকে উদ্দেশ্য করে বললো,
___” তোমাকে সুস্থ হতেই হবে। যত টাকা লাগবে লাগুক। আমরা সবাই তোমার পাশে আছি। আমার ভালোবাসা তোমার পাশে আছে।”
অয়ন হেসে বললো,

___” দেখা যাক।”
মিশমি অয়নকে হালকা পাতলা বকে বকে খাবার খাওয়াচ্ছে। আমি আর সাদি তা দূর থেকে দেখে হাসছি। আমি সাদির দিকে তাকিয়ে বললাম,
___” মাঝে কি হয়েছে সেটার থেকে বড় কথা হলো কে কার সাথে ভালো থাকবে। অতীতটাকে চাপা দিলাম। বর্তমানটাকে বের করলাম। দেখুন! সবাই কত সুখে আছে।”
সাদি আমায় আবারো বুকে জড়িয়ে বললেন,
___” অয়ন মিশমির জন্যই। আর তুই আমার জন্য। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন।”

রাঙিয়ে দিয়ে যাও পর্ব ১৯

আমি হ্যাবোধক মাথা নাড়ালাম।আসলেই তাই! আল্লাহ আমাদের সবার জন্যই জুটি বানিয়ে রেখেছেন। আমি সাদির জন্য তৈরী। আর অয়ন মিশমির জন্য।অতীতে কি হয়েছে সেটা দেখার বিষয় না। এখন কি হচ্ছে এটাই দেখবার বিষয়। এটাই বাস্তবতা। আমি সাদিকে ভালোবাসি। অয়নও মিশমিকে ভালোবাসে এরচেয়ে বেশি আর কি? আমি শুধু এটা চাই যেন আল্লাহ অয়নকে বাঁচার আরেকটা সুযোগ দেন। আল্লাহ চাইলে তো মিরাকলও হয়। হয় না?

রাঙিয়ে দিয়ে যাও শেষ পর্ব