রূপবানের শ্যামবতী পর্ব ১৪

রূপবানের শ্যামবতী পর্ব ১৪
এম এ নিশী

প্রাতঃকালীন ভ্রমণ শেষে ড্রয়িং রুমে এসে বসলেন গুলবাহার। তিনি বসতে না বসতেই তার মধু দেওয়া গরম পানি নিয়ে হাজির হন তাসফিয়া। গুলবাহারের দৈনন্দিন রুটিন এর একটি অংশ যা কোনদিন হের ফের হয় না। আর এসব কিছুর খেয়াল রাখেন তাসফিয়া নিজেই। গ্লাস হাতে নিয়ে গুলবাহার ধীরে ধীরে খাচ্ছেন। পাশে দাঁড়িয়ে তাসফিয়া কিছুটা সময় অপেক্ষা করে নিচু স্বরে বলে ওঠেন,

–আজ সকালের নাস্তায় কি বানাবো আম্মা?
বাড়িতে অনেক সার্ভেন্ট থাকা সত্ত্বেও রান্নাবান্নার সমস্ত কাজ বাড়ির বউদের করা বাঞ্ছনীয় । বিশেষ করে তাসফিয়াকে তো সব কাজে নিজের হাতেই করা লাগে। নইলে শাশুড়ির কঠিন তোঁপের মুখে পড়তে হয়। প্রতিদিন তিন বেলা কি কি রান্না করতে হবে তা শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করেই রান্না করতে হয়। তাই আজও সকালের রান্নার তালিকা জেনে নিতেই শ্বাশুড়িকে প্রশ্ন করা। কিন্তু এই সহজ স্বাভাবিক কথাতেও তিনি বিরক্ত হলেন। একপ্রকার তেঁতে উঠেই বলেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

–তুমি কি জানোনা ছোটো বউ, প্রতিদিন কে কি খায়? আমার জন্য রুটি, ছেলেদের জন্য পরোটা আর নাতি, নাতনিদের জন্য পাস্তা। রোজ রোজ কি বানাবো কি বানাবো বলে ঘ্যান ঘ্যান করবে না তো।
–না, আসলে আম্মা আপনিই তো বলেছেন আপনার কাছ থেকে জেনেই সবকিছু করতে।
এমনিতেই আহরারের বিষয়টা নিয়ে মেজাজ বিক্ষিপ্ত তারওপর তাসফিয়াকে আরো অসহ্য লাগছে তার। এদিকে পাল্টা জবাব শুনে আরো বেশি রাগে ফেটে পড়েন। কর্কশ স্বরে বলে ওঠেন,

–মুখে মুখে তর্ক তোমার…
বলতে বলতে হুট করে মাঝপথে থেমে যান তিনি। কারণটা আহরার। ওপর থেকে নামছে সে। হাতে নিজের ব্যাগপত্র। আজই রওনা দিবে সে। আহরারকে দেখে গুলবাহার দমে গেলেন। শান্ত করে নিলেন নিজেকে। ছেলের সামনে তার মাকে কিছু বলার দুঃসাহস তিনি রাখেননা। আহরার এসে তার মাকে জড়িয়ে ধরে বললো,

–আসছি মা। নিজের খেয়াল রেখো।
–ওমা সেকি। তুই এখনি বেরোচ্ছিস। খাবি না?
–না মা, খাওয়ার সময় নেই এখন। আমি খেয়ে নিবো তুমি চিন্তা করোনা। এখন আসি।
তাসফিয়া ছেলের গালে, মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
–সাবধানে থাকিস বাবা। আর একদম সতর্ক হয়ে চলবি। প্রয়োজন ছাড়া কারো সাথে খুব বেশি কথা বলার বা মেলামেশার প্রয়োজন নেই। ঠিকাছে?
–জি একদম ঠিকাছে আম্মাজান।

এই বলে মায়ের গাল টেনে দেয় আহরার। হেসে ওঠেন তাসফিয়া। আহরারও তাল মিলিয়ে হাসতে থাকে। এদিকে গুলবাহারের গা পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। তাসফিয়ার বলা কথাগুলো তিনি মোটেও পছন্দ করছেন না। তাছাড়া তাসফিয়ার সাথে আহরারের সখ্যতাও তার পছন্দ নয়। বহুবার মায়ের কাছ থেকে আহরারকে দূরে সরানোর চেষ্টা করেছিলেন তিনি কিন্তু বারবার ব্যর্থ হয়েছেন। আর তার ঝাঁঝও তিনি প্রায়সময় বিভিন্ন বাহানায় তাসফিয়ার ওপর ঝাড়েন যা আহরারের সম্পূর্ণ অজানা। ধূর্ত গুলবাহার নাতির সামনে সর্বদা আদর্শবান সেজে চলেন। তাই তো শত রাগ হওয়া সত্ত্বেও এখন চুপ করে হজম করে আছেন। আহরার না থাকলে এতোক্ষণ দু চার কথা শুনিয়ে দিতেন তিনি তাসফিয়াকে।

–দাদীজান আমি আসি তাহলে।
নাতির কথায় ভাবনা ছেড়ে বেরোলেন গুলবাহার। বিস্তৃত হেসে নাতির পিঠে হাত বুলিয়ে দেন তিনি। তারপর আদুরে কন্ঠে বলেন,
–যাও দাদুভাই। ভালোই ভালোই কাজ সেরে ফিরে এসো।
বিদায় নিয়ে আহরার বেরিয়ে যেতেই গুলবাহার যেন এবার ঝাপিয়ে পড়বেন তাসফিয়ার ওপর। আর তা বুঝতে পেরেই তাড়াহুড়ো করে তাসফিয়া বলে ওঠেন,
–আমি বরং যাই। সকালের খাবারের ব্যবস্থা করি।
এই বলে দ্রুতপায়ে রান্নাঘরের দিকে ছুটলেন তিনি। তা দেখে গুলবাহার রাগে বিরবির করতে করতে নিজের ঘরে চলে যান।

আজ রোদের তেজ বড্ড বেশি। কেবল সকাল ৯ টা তাতেই যেন ঝাঁ ঝাঁ করছে গরমে। বেলা গড়াতে গড়াতে আজ তাপের প্রখরতায় প্রাণ ওষ্ঠাগত করে ছাড়বে।
কলেজের পথে এগোচ্ছে দুই বোন। মাথার ওপরে ছাতা ধরে রোদের ঝাঁঝ থেকে বাঁচার ক্ষীন প্রচেষ্টা চালাচ্ছে আদ্রিকা। তারপরও অরুনিকা ঘেমে নেয়ে একাকার।

–বুবু আজ প্রচন্ড গরম হবে। কলেজ যাওয়া উচিত হচ্ছে না।
অাদ্রিকার কথা শুনে তার মাথায় আলতো চাটি মারে অরুনিকা। শাসনের সুরে বলে উঠে,
–পাজি মেয়ে, কলেজ কামাই করার ধান্দা।
–ধুর! এতো পড়াশোনা করে কি হবে?
–এখন বুঝবিনা। ভবিষ্যতে হারে হারে টের পাবি।
কথা বলতে বলতে আনমনে একবার সামনের দিকে তাকায় অরু। পরপরই চোখ ফিরিয়ে নিয়ে সামনে এগিয়ে যায়। দু কদম যেতেই হুট করে থেমে যায়। ঝট করে পেছনে ফিরে এদিক ওদিক দেখতে থাকে।

–বুবু, আজও কি মনে হচ্ছে কেউ পিছু নিচ্ছে?
–না রে, মনে হলো উনাকে দেখলাম।
–উনাকে? এই উনিটা এবার কে?
–না কেউ না। এখন চল তো তাড়াতাড়ি দেরি হয়ে যাবে।
এই বলে আদ্রিকার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। দু একবার পিছু ফিরে ফিরে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করে, সত্যিই কি তাকে দেখেছে?

আজ বোধহয় অরুর মাথায় গন্ডগোল ধরেছে। কলেজ থেকে বেরোনোর সময় ঠিক গেটের সামনেই, মনে হলো যেন আহরার দাঁড়িয়ে। কিছু সময়ের জন্য থমকে যায় অরুনিকা। কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের ভিড়ে হারিয়ে গেলো। অরু ছুটে আসে গেটের কাছ। চারিদিকে পাগলের মতো খুঁজতে থাকে। কিন্তু তার ছায়ারও দেখা মিললো না। মানুষটা কি সত্যিই ছিলো? নাকি অরুনিকার ভ্রম?
নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে অরু,
“কি হয়েছে তোর? কাকে খুঁজছিস তুই? কেনই বা খুঁজছিস? সে থাকুক বা থাকুক তোর তাতে কিছু যায় আসে না অরু। তোর একদমই মাথা ঘামানো উচিত নয়। একদম নয়।”

বিকেল বেলা ফারহাকে নিয়ে ছাদে বসে আছেন গুলবাহার। খোলা আকাশের দিকে চেয়ে কল্পনার জগতে হারিয়ে বসে আছে ফারহা। সেই কল্পনার সবটা জুড়ে কেবল আহরার। গুলবাহারও চুপচাপ আছেন। কিছুসময় পর তিনি ফারহার দিকে ফিরে চান। ফারহাকে অন্য মনস্ক দেখে তিনি মুচকি হাসেন। নাতনির মাথায় আদুরে স্পর্শ বুলিয়ে কোমলস্বরে ডেকে ওঠেন,
–ফারহা দাদুমনি।
ফারহা চোখ ফিরিয়ে দাদীজানের দিকে চাইলো। গুলবাহার বেশ শান্ত স্বরে বললেন,

–বিয়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছো তো?
ফারহা লজ্জায় মাথা নুইয়ে নিলো। জড়তা মিশ্রিত স্বরে জবাব দেয়,
–এতো তাড়াতাড়ি? আহরার ভাইয়ের মতামতটাও তো জানা হলো না।
গুলবাহার কন্ঠস্বরে খানিকটা গাম্ভীর্যতা ঢেলে বলেন,
–তুমি জানো না আহরার গুরুজনদের কথা অমান্য করেনা। এই বিয়ে নিয়ে ওর আপত্তি নেই। তুমি বরং প্রস্তুতি শুরু করে দাও।

ফারহা চোখ তুলে তাকায়। তার দৃষ্টি সামনে থাকা সারি সারি টবগুলোর দিকে। আনমনে ভাবতে থাকে সে,
“আহরার ভাই সত্যি এই বিয়েতে রাজি? সত্যি কি এবার তার ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে?”
গুলবাহারের ডাকে ধ্যান ভাঙে তার।
–শোনো দাদুমনি, আহরার তোমার অধিকার। নিজের অধিকার কখনো ছাড়বে না। আর এই অধিকারের সাথে কখনো সমঝোতাও করবে না। বুঝতে পেরেছো?
দাদীজান এমন কথা কেন বললেন তা ফারহার বোধগম্য নয়। তবুও সে আলতো হেসে মাথা নাড়িয়ে সায় জানায়। আপাতত সে কল্পনার জগতে ভেসে যেতে চায় আহরারের সাথে।

প্রতিদিন বিকেলে অরুনিকা তার শখের কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখে। তার শখ মাটির তৈরি বিভিন্ন শৌখিন জিনিসপত্র বানানো। তার হাতের কাজ এতোটাই সুন্দর হয় যে গ্রামের মানুষজন তাদের ঘর সাজানের জন্য অরুনিকার কাছ থেকে নিজের পছন্দমতো জিনিস কিনেও নিয়ে যান। ইদানীং কাজটাকে অনেকটা প্রফেশনালি নিয়েছে অরু। প্রতিদিন অনেক অনেক অর্ডার থাকে। তাই আগে শখের বশে করলেও এখন কাজের প্রয়োজনে করতে হয়। আর এসব জিনিসপত্র বানানোর জন্য তার যে মাটির প্রয়োজন হয় তা সে তার এক চাচাতো ভাই মতিনের কাছ থেকে নেয়। মতিন প্রতিদিন তাকে বড় ডালা ভর্তি মাটি দিয়ে যায়। আজও অরু অপেক্ষা করছে মতিন ভাইয়ের জন্য। তখনই বাইরে থেকে ডাক ভেসে আসে,

–মাটি এনেছি..
অরু বাইরে বেরিয়ে আসতে আসতে বলে,
–মতিন ভাই, আজ এতো দেরি করলে যে?
মতিন কিছু না বলে কেবলই শব্দ করে হাসে। অরু মাটির ডালাটা নিয়ে বলে,
–মতিন ভাই আজ একটু আমায় সাহায্য করে দিতে হবে। এসো তো..

মতিন পিছু পিছু যায়। কিন্তু কোনো কথা বলেনা। অরু ভারি আশ্চর্য হয়। সে একবার পিছু ফিরে মতিনের তাকিয়ে আবার সামনে ফিরে। হুট করে কি মনে করে যেন পুনরায় পিছু ফিরে মতিনকে দেখতে চায় তার আগেই মতিন গটগটিয়ে কাজের জায়গায় চলে যায়। মতিন ভাইকে আজ কেমন অন্যরকম লাগলো। ধবধবে সাদা ফতুয়া, সাদা লুঙ্গি আর গামছা দিয়ে মাথা, মুখ মুড়িয়ে রাখা। গলাটাও কেমন ফ্যাসফ্যাসে শোনালো।ব্যাপারটা নিয়ে কিছু সময় চিন্তা করে পরক্ষণেই তা উড়িয়ে দিলো অরু। সেও গিয়ে নিজের কাজে লেগে পড়লো।

মতিনকে সবকিছু বুঝিয়ে দিলো কি কি করতে হবে। মতিন তার মতো করতে লাগলো সবকিছু। এদিকে কাজের ফাঁকে ফাঁকে মতিনের দিকে তাকাতেই তার চোখে চোখ পড়ছে অরুনিকার। অর্থাৎ তার দৃষ্টি বেশিরভাগ সময় অরুর দিকেই নিবদ্ধ। আশ্চর্য! অরুর কেমন অস্বস্তি লাগতে শুরু করে। এ মতিন ভাই তো? চোখ গুলো কেমন যেন লাগছে। ধরতে পারছে না অরু। কেমন সব গুলিয়ে যাচ্ছে। কাজটাও ঠিকমতো হচ্ছে না।

একটা মাটির পাত্র বানাতে গিয় হিমসিম খাচ্ছে সে। বারবার পিছলে যাচ্ছে, ঘেঁটে যাচ্ছে সব। হুট করেই নিজের হাতের ওপর অন্য কারো হাতের স্পর্শ পেলো অরু। থমকে গেলো সে। লোকটা অরুর হাত দিয়েই সযত্নে মাটির ওপর আকার সৃষ্টি করছে। কে মানুষটা? এ তো মতিন ভাই নয়? লোকটা পেছন থেকেই অরুর হাত দুটো ধরে রেখেছে। মাটির পাত্রটি সঠিক আকৃতিতে আসতেই থেমে যায় হাত। কানের কাছে শুনতে পায় গুনগুনিয়ে গাওয়া কিছু লাইন,

“ভালোবেসে সখি নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো,
তোমার মনেরো মন্দিরে….”
লোকটি সরে যেতেই কিছুটা সময় নিলো অরু। নিজেকে স্থির করতে। নিজের তটস্থ ভাব কাটিয়ে ঝট করে ফিরে তাকায় সে। কিন্তু একি! কোথায় গেলো লোকটা? কেউ তো নেই। অরু উঠে দাঁড়ায়। আশেপাশে সবজায়গা, কোনায় কোনায় খুঁজে বেড়ায়। তবে লোকটার অস্তিত্বও পায় না। এখানে যে একটু আগে একজন মানুষ ছিলো তা বোঝাই গেলো না। অরু যেনো হতাশ হয়ে পড়ছে। ওই মানুষটা কি তার ধ্যান জ্ঞান সবকিছুতেই জায়গা করে নিলো? অরুর পুরো জগত জুড়ে যেন তারই দাপুটে বিচরণ চলছে। শত চেষ্টা করেও অরুনিকা আটকাতে পারছে না কিছুই। তপ্ত শ্বাস ফেলে নিজের বাকি কাজে মন দিলো অরু।

সন্ধ্যার পরপরই মতিন ভাই এসে হাজির। অরুকে এসে বলে গেলো আজ তার কিছু কাজ থাকায় সে নিজে না এসে অন্যকাওকে পাঠিয়েছে। এ কথা শুনে অরু বুঝতে পারলো তার ধারণাই ঠিক। মানুষটা মতিন ভাই ছিলো না। তবে কে ছিলো? মতিন বলছে তারই পরিচিত এক ছেলেকে পাঠিয়েছে। কিন্তু অরুর ধারনা যাকে নিয়ে, সে তো এই গ্রামের কেউ নয়। তার তো এখানে থাকারও কথা নয়। অস্থির হয়ে পড়ছে অরু। সে কোনোকিছুরই কুল কিনারা পাচ্ছে না।

নিশুতি রাতে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনতে শুনতে নিজের ভাবনার জগতে ঘুরছে অরুনিকা। তার সাথে কি হচ্ছে সে বুঝতে পারছে না। তবে তার বোঝা উচিত। তাকে ধরতে হবে সবটা। যা ঘটছে তা সত্যি নাকি ভ্রম ব্যাপারটা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত অরুর চোখে যেন ঘুম নামছে না। জানালার ধারে দাঁড়ালে বাড়ির পেছনের বাগানটা নজরে আসে অরুর। সেখানকার কিছু গাছে ফুটে থাকা ফুলগুলো একধ্যানে দেখছে সে।
“ফুলপরীর নজর যে দেখছি ফুলেরই দিকে”

চমকে ওঠে অরুনিকা। পিছিয়ে আসে সে। এই মুহূর্তে সে কার কন্ঠস্বর শুনলো? জানালা গলে বাইরে দৃষ্টি দিলেও সেখানে কারো উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে না। তবে? কোথা থেকে ভেসে আসলো এই স্বর? ধীরপায়ে পুনরায় জানালার কাছে এসে দাঁড়ায় অরুনিকা। সতর্ক দৃষ্টিতে আশপাশ দেখে। বাড়ির পেছনের এই জায়গাটিতে পাঁচিল টপকে আসা কোনো ব্যাপার নয়। তবে এমন ঘটনা ইতোপূর্বে কখনো ঘটেনি। তাই বিশ্বাস করতে পারছে না অরু এখানে কেউ আছে বা এসেছে। দু হাতে জানালার গ্রীল আঁকড়ে ধরে ভাবতে থাকে অরু,

“নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বরাবরই বেশি। অরুনিকা কখনো আহরারকে নিয়ে ভাবতে চায়না। তবুও সে মানুষটা তার ভাবনাতে এসে পড়ছে। মনের লাগাম টানতে টানতে হয়রান অরু। যা হবার নয় তা নিয়ে আগ্রহ দেখানো অনুচিত। মন ভাঙার কষ্ট ভয়াবহ। এ কষ্ট তিলে তিলে নিঃশেষ করে দেবে। তাই নিজেকে যত শক্ত ও কঠোর বানাতে পারবে তত সে এই কষ্ট থেকে নিস্তার পাবে।”
অরুনিকার ভাবনার মাঝেই আবারো সেই কণ্ঠস্বর,
“তোমার ধ্যানেজ্ঞানে, শয়নেস্বপনে, জাগ্রত কিংবা ঘুমন্ত সকল অবস্থাতেই আহরারের অস্তিত্ব খুঁজে পাবে তুমি অরুনিকা। কারণ তুমি আহারারের অরুনিকা। তুমি এই রূপবানের শ্যামবতী।”

এবার আর অরুনিকার কোনো হেলদোল দেখা গেলো না। সে নিজে নিজেকে কঠোর শাসনে ব্যস্ত, “ভ্রম, ভ্রম সবটাই ভ্রম। সবটাই কাল্পনিক। ওই মানুষটার অস্তিত্ব নেই এখানে। কোত্থাও নেই। নিজেকে সামলা অরু। সামলা। সামলা।”
ভ্রম বলে অরুনিকা যতই উড়িয়ে দিক না কেন, যতই নিজেকে শাসাক, যত কঠোরতাই আনুক নিজের মাঝে কিন্তু দিন দিন এই ব্যাপারটা যেন বেড়েই চলেছে। নিয়ম করে সে প্রতিদিন আহরারকে তার আশেপাশে দেখতে পায়। হুট করে এসে হুট করেই গায়েব। কিছুতেই তাকে ধরতে পারেনা সে।

কখনো দেখা দিয়ে গায়েব হয়, কখনো বা কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে শুনিয়ে যায় নিজের অনুভূতিতে সাজানো প্রেমকাব্য। কখনো বা আড়ালে আবডালে থেকে শুনিয়ে যায় দু চার লাইন পঙক্তি কিংবা সুরতুলে গেয়ে যায় মনের অভিব্যক্তি মেশানো গান। অরুনিকার অভ্যাসে পরিণত করে দিচ্ছে সব। মন বড় বেহায়া হয়ে পড়ছে দিনদিন। অনুভূতি হচ্ছে লাগামছাড়া। তবে কি কপালে দুঃখ বয়ে আসছে? বড়সড় কোনো দুঃখ?

যা সে চাইছে না মন বারবার সেদিকেই টানছে। অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে অরুনিকা। নিজেকে কেমন পাগল পাগল মনে হচ্ছে।
এমনই একদিন বাড়ি ফেরার পথে, নিত্যদিনকার মতো আজও কানে ভেসে এলো কিছু সুরের ছন্দ। অরুনিকা আশেপাশে তাকালো না। খুঁজলো না কাওকে। তার মাথা ঝিমঝিম করছে। পাশেই নদী। সে নদীর শান্ত পানির দিকে চেয়ে থাকে। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বেশ কিছুটা সময়। আচমকা সে ছুটে গিয়ে বসে পড়ে নদীর ধারে। দুহাত ভর্তি পানি নিয়ে মুখে মাথায় ছিটাতে থাকে আর বিরবির করে বলতে থাকে,

“না না না, এসব কিচ্ছু সত্য নয়। সব মিথ্যে, সব মিথ্যে। ভুল ভাবছিস তুই অরু। সব তোর কল্পনা। বেরিয়ে আয় তুই। বেরিয়ে আয় কল্পনা থেকে। বেরিয়ে আয়ইইই…”
কেমন যেন পাগলের প্রলাপ বকছে সে। অস্থির হয়ে শুধু পানি ছিটিয়ে যাচ্ছে। যার দরুন ভিজে গেছে তার শরীরের একাংশ। আর একটু হলেই সে পিছলে পড়ে যাবে নদীর পানিতে। সেদিকে তার ধ্যান নেয়। ধ্যান ফিরলো যখন কেউ হেঁচকা টানে তাকে সরিয়ে এনে দাঁড় করালো। চুপ হয়ে গেলো অরু। তাকিয়ে দেখলো সামনের মানুষটাকে। ভালো করে দেখলো। তারপর আবার বিরবির করে বলতে লাগলো, “না সত্যি নয় এটা। এটা সত্যি নয়।”

অরুনিকার দু বাহু ধরে ঝাঁকিয়ে আহরার তীব্র স্বরে বলে উঠে,
–অরুউউউ! এটাই সত্যি। আমি তোমার সামনে। আর এতোদিন যা তুমি তোমার কল্পনা ভেবেছো সেসবই ছিলো সত্যি। তোমার মন পাওয়ার জন্য পাগলের মতো কিসব না করে বেরিয়েছি আমি। তুমি বুঝতে পারোনা? কেন পালাতে চাচ্ছো নিজের মন থেকে, নিজের অনুভূতি থেকে? আমি জানি তুমিও আমাকে নিয়ে তাই অনুভব করো যা আমি করি। হয়তো তোমার অজান্তেই হয়েছে সবটা। কিন্তু তুমি তা মানতে চাওনা। এতো কিসের ভয় তোমার? অরু! তাকাও আমার দিকে। আমাকে একটু বিশ্বাস করো।”

দুহাতে অরুর মুখটা তুলে ধরে আহরার। করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আহত স্বরে বলতে থাকে,
“আমি তোমার বিশ্বাস ভাঙবো না অরু। আর না তো কখনো সেই বিশ্বাসের অমর্যাদা হতে দেবো। একবার বিশ্বাস তো করে দেখো। একবার আমার হাতটা ধরো। এই হাত আমি কখনো ছাড়বো না। কখনো না।”
শান্ত চোখে চেয়ে অরুনিকা সব কথা শুনলো। তারপর ধীরে ধীরে নিজের হাত দুটো তুলে আহরারের হাতের ওপর রাখলো। ছিটকে সরিয়ে দিলো আহরারের হাত। দু কদম পিছিয়ে গিয়ে শীতল কন্ঠে জবাব দেয়,

“ফিরে যান আপনি। আপনার এই আশা কখনো পূরণ হওয়ার নয়। আমি আপনাকে কখনোই গ্রহন করবো না।”
এই বলে অরুনিকা পিছু ফিরে দ্রুতপায়ে এগিয়ে যেতে থাকে। পেছন থেকে আহরার চেঁচিয়ে বলতে থাকে,
“ফিরে যাওয়ার জন্য আমি আসিনি অরু। যতদিন না তুমি আমায় গ্রহণ করছো আমি কোত্থাও যাবো না। তুমি আমাকে এভাবে ফিরিয়ে দিতে পারো না অরু…”

ততক্ষণে অরু বেশ অনেকটা দূরে চলে গিয়েছে। যদিও আহরারের বলা কথা কিছুটা তার কানে ভেসে এসেছে তবুও সে নির্দয়ের মতো এগিয়ে চললো সামনে। একবারো পিছু ফিরে চাইলো না। যদি সে চাইতো তবে দেখতে পেতো তার জন্যই আহরারের ওপরে নেমে এসেছিলো এক ভয়ানক বিপদ..
চিৎকার করে আহরার ডাকতে থাকে,
“অরু, অরু…”

আচমকা ঘাড়ের ওপর শক্ত এক লাঠির আঘাত আসতেই ছিটকে সামনে এগিয়ে গেলো আহরার। কে করলো এমন হঠাৎ আক্রমণ? ঘাড়ে হাত দিয়ে পিছু ফিরে দেখতে চাইলো আক্রমণকারীর মুখ তখনই পরপর আরো কয়েকটা আঘাত এসে পড়ে তার ওপর। পায়ের ওপর লাঠির শক্ত বারি এসে লাগতেই হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে সে। এখনো দেখতে পেলো না তাকে আঘাতকারীর মুখ। সেই মুখ দেখার চেষ্টায় আরো একবার ঘাড় ঘুরানোর প্রয়াস করতেই এবার আঘাতটা সজোরে এসে লাগে তার কপালে।

রূপবানের শ্যামবতী পর্ব ১৩

মুখ থুবড়ে পড়ে যায় সে। চোখের ওপর ভেজা ভেজা অনুভব করতেই বুঝতে পারলো র ক্ত। ব্যাথায় আর্তনাদ করতে গিয়েও করতে পারেনা সে। চারিদিক কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে তার। ঝাপসা চোখেই দেখতে পেলো কেউ একজন তার মাথার কাছে বসলো। মুখ নামিয়ে এনে দুটো বিচ্ছিরি গালি দিয়ে বলে ওঠে,
“কেমন লাগছে মার খেয়ে? সেই রাতের প্রতিশোধ আজ সুদে আসলে মিটিয়ে নিবো।”
চোখ বুজে আসলেও এটুকু বুঝতে অসুবিধা হয় না আহরারের যে লোকটা আর কেউ নয়, শাহাদাত।

রূপবানের শ্যামবতী পর্ব ১৫