রূপবানের শ্যামবতী পর্ব ৩১

রূপবানের শ্যামবতী পর্ব ৩১
এম এ নিশী

বৃদ্ধাশ্রমের সবচেয়ে খারাপ, স্যাঁতস্যাঁতে, ভাঙাচোরা ঘরটায় আশ্রয় মিলেছে গুলবাহারের। শুরুতে বেশ চিৎকার চেঁচামেচি করায় তাকে ঘরটিতে বন্দী করে রাখা হয়েছিলো। অবশ্য কিছু সময় পরেই থেমে গেছিলেন তিনি। খানিক চেঁচামেচিতেই ক্লান্ত হয়ে নেতিয়ে গেছেন। শক্তিতে কুলোয়না আর। শরীর অসাড়ের ন্যায় লেপ্টে আছে বিছানায়। ক্রমাগত চোখের জলে ভাসিয়ে নিচ্ছেন নিজেকে। আর গুনগুনিয়ে বিলাপ গাইছেন, কি করে সকলে তাকে এতোটা পর করে দিলো এই ভেবে।
দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেন জয়নাব বেগম। কর্কশ স্বরে বলে ওঠেন,

–এই যে বড়লোক বুড়ি থুক্কু বয়োজ্যেষ্ঠ খালাম্মা, শুয়ে বসে থাকলে এখানে ভাত জুটবে না। খেটে খেতে হবে। বুঝলেন?
গুলবাহারের মিইয়ে যাওয়া শক্তি যেন পুনরায় নতুন উদ্যমে ফিরে এলো। ক্ষেপাটে স্বরে একপ্রকার তেড়ে গিয়ে বলতে থাকেন,
–কি বললি? কি বললি তুই? আমাকে বুড়ি বলিস। তোর সাহস তো মন্দ না। আবার কিনা কাজ করার কথা বলছিস? আমাকে? এই গুলবাহার খানকে?
গুলবাহারের তেড়ে আসা দেখে ভয় পেয়ে কিছুটা পিছিয়ে গেলো জয়নাব। পরপরই নিজেকে সামলে দ্বিগুণ তেজে জবাব দেয়,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

–এটা আপনার বাড়ি নয়। এটা বৃদ্ধাশ্রম। আর আপনার মতো বৃদ্ধা যাদের সুখে থাকতে ভুতে কিলায় তাদের জন্যই এমন ব্যবস্থা এখানে। কয়েকটা ঘর আর বারান্দা পরিষ্কার করা লাগবে, কিছু থালাবাসন মাজা লাগবে আর বোধহয় কিছু বাসি জামাকাপড় আছে। কেঁচে দিবেন। ব্যস! আজকের মতো একটা কাজ করলেই আপনার খাওয়া জুটবে। নইলে না খেয়ে কাটাতে হবে আজ।

এই বলে জয়নাব টিটকারি মূলক হাসি ছুঁড়ে চলে যায়। গুলবাহার পারেন না তো তাকে কাঁচাই চিবিয়ে খেয়ে ফেলেন। বেশ কিছুক্ষণ বসে বসে গজগজ করলেন তিনি। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলেও যখন কেউ খাবার দিয়ে গেলো না, গুলবাহার তখন একটু একটু করে ক্ষিদে অনুভব করছেন। এপাশ ওপাশ করে শুয়ে থেকে ঘুমানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। একেতো নোংরা বিছানা, তারওপর অভুক্ত থেকে চোখে ঘুম নামানো মুশকিল।

একটাসময় আর সহ্য করতে না পেরে তিনি বেরিয়ে এলেন। জয়নাবকে দেখতে না পেয়ে অন্য একজনকে দেখতে পেলেন। তার কাছে গিয়ে কোনোরকমে নিজের ক্ষিদের কথাটা জানালেন। মেয়েটি কেমন বিদ্রুপ করে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতেই বললো,

–কাজ না করলে আপনার খাওয়া জুটবেনা দাদী। কাজগুলো শেষ করে এসে খাবার নিয়ে যান।
কথা শেষে মেয়েটিও চলে গেলো। যাওয়ার সময় আরো একবার বিদ্রুপাত্মক হাসি হাসতে ভুললো না। গুলবাহার শুধু দাঁত কিড়মিড়িয়ে দেখেন। আর কিছু বলেন না।
নিরুপায় গুলবাহার বয়সের ভারে নুইয়ে পড়া শরীরটা কোনোরকমে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে কাজগুলো শেষ করার চেষ্টা করেন। পুরোটা সময় শুধু চোখের জল ফেলেছেন।

কাজ শেষেই খাবার পেয়েছেন তিনি। চোখের সামনে খাবারের থালা পেতেই হামলে পড়েন। খেতে খেতে বুঝতে পারেন খাবারগুলো বাসি। তারপরও সেগুলোই গোগ্রাসে গিলতে থাকেন।
অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে প্রথমদিনই বিছানায় পড়ে গিয়েছেন তিনি। যদিও তাকে খুব বেশি বা ভারি কোনো কাজ দেওয়া হয়নি। তার বয়সের দিকে খেয়াল রেখেই। কিন্তু আরাম আয়েশে, বিলাসী জীবন কাটানো গুলবাহারের শরীরে এটুকু পরিশ্রমও যেন সহ্য হচ্ছে না।

ভেবেছিলো পরদিন হয়তো তার শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে তাকে ছাড় দেওয়া হবে। তবে আফসোস তার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত করে আবারো কাজের বিনিময়ে খাবারের শর্ত আরোপিত হলো।
অসুস্থ শরীর নিয়েই তাকে কাজ করতে হচ্ছে। নইলে তো খেতে পাবেন না। না খেলে চলবে কি করে? বাঁচবেন কিভাবে?
বাসন মাজতে মাজতে চোখের জল ফেলছেন গুলবাহার। তখনই জয়নাব এসে খোঁচা মেরে বলে ওঠে,

–কি গো খালাম্মা, কষ্ট হচ্ছে খুববব? এমন কষ্ট তো আপনিও দিয়েছিলেন, আপনার বাড়ির বউকে। বিনা কারণে, বিনা অপরাধে। কি বলুন তো, পাপ বাপকেও ছাড়েনা। হা হা হা…
অট্টহাসি হেসে প্রস্থান করে জয়নাব। তবে গুলবাহারের মাথায় ঘুরতে থাকে জয়নাবের বলা কথাগুলো। বড্ড মনে পড়ছে তার তাসফিয়াকে। মেয়েটাকে এতো কষ্ট দেওয়া সত্ত্বেও কখনো তার সেবাতে কার্পণ্য করেনি সে। তাসফিয়ার কষ্টগুলো যেন আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন গুলবাহার।

আশ্চর্যের ব্যাপার, ২-৩ দিনের মাথায়ই গুলবাহার বুঝতে পারেন তার মধ্য থেকে রাগ, জেদ, অহংকার সব কর্পূরের মতো গায়েব হয়ে যাচ্ছে। নিজের পরিবারের কথা ভেবে ভেবে কেবল কষ্ট হচ্ছে, যন্ত্রণা হচ্ছে বুকে। যার ফলস্বরূপ সর্বদা অশ্রুসিক্ত হয়ে থাকছে চোখজোড়া। বারবার একটা কথাই ভেবে যাচ্ছেন, তার কিচ্ছু চাইনা, কোনো কিচ্ছু না। কেবল তার পরিবারটাকে ফেরত পেতে চান। ছেলে-বউমা, নাতি-নাতনিদের নিয়ে তার ওই ভরা সংসারটা আবারো ফিরে পেতে চান। কার গায়ের রং কেমন, কার অবস্থা কেমন এসবকিছুতেই তার আর কোনো কিছু যায় আসেনা। তার শুধু বাড়ি ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে, তার ওই সুখী পরিবারটা ফিরে পাওয়ার ইচ্ছে।

খান বাড়ির পরিবেশ এখন দুঃখী দুঃখী হয়ে থাকে। গুলবাহার যতই খারাপ হন, কিন্তু বাড়ির একজন সদস্য। তাকে ছাড়া সত্যিই বাড়িটি নিষ্প্রাণ লাগছে। তাসফিয়া বারকয়েক আহরারকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন কিন্তু আহরার শুনতে নারাজ। তার এক কথা সঠিক সময় হলে সে নিজে গিয়ে গুলবাহারকে আবারো ফিরিয়ে আনবে খান ভিলায়। তাসফিয়াও তাও মানতে পারছিলেন না। নিজের স্বামী এমনকি ভাসুরের কাছেও অনুরোধ করেছে কেউই এই ব্যাপারে কথা বলতে চাননা। সবটাই ছেড়ে দিয়ে রেখেছেন আহরারের ওপর। তাই শেষ পর্যন্ত অরুনিকার কাছে অনুরোধ নিয়ে গেলে অরুনিকার জবাব,

–মা, এই যে মানুষটার জন্য কষ্ট পাচ্ছেন। আপনি কি চান না মানুষটা ভালো হয়ে যাক? তার মধ্য থেকে সমস্ত খারাপি দূর হয়ে যাক?
তাসফিয়া করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে মৃদু স্বরে জবাব দেন,
–চাই তো। কিন্তু নিজের বাড়ি ছেড়ে মানুষটা ওভাবে..
তাসফিয়াকে থামিয়ে অরুনিকা পুনরায় বলে ওঠে,

–এই যে উনি আপনাকে, আমাকে এতোটা অপছন্দ করেন। আপনি চাননা উনি মন থেকে আমাদের মেনে নিক। আমাদেরকে ভালোবেসে কাছে টেনে নিক।
তাসফিয়ার চোখজোড়া চকচক করে ওঠে৷ যেন বহুদিনের কাঙ্ক্ষিত কোনোকিছু পূরণ হওয়ার সংবাদ পেতে যাচ্ছে। উজ্জ্বল হয়ে ওঠে মুখশ্রী। ওপর নিচে মাথা দুলিয়ে বোঝান যে তিনি কতটা চান।
অরুনিকা হাসলো। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে রেখেই জবাব দিলো,

–তবে একটু অপেক্ষা করুন মা। একটা বিশুদ্ধ, পরিষ্কার মন নিয়ে একজন পবিত্র মানুষ হিসেবে এই বাড়িতে ফিরবেন দাদীজান। শুধু একটু ধৈর্য্য রাখুন।
তাসফিয়ার চোখেমুখে আবারো হতাশার ছাপ দেখা যায়। ভেতর চিঁড়ে আসা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নেড়ে সম্মতি জানান অরুনিকার কথায়।

নিকষ কালো আঁধারে ছেয়ে থাকা ঘরের মেঝেতে গুটিশুটি মেরে বসে আছে আদ্রিকা। দু হাঁটু ভাজ করে তাতে মুখ গুঁজে রেখেছে। থেকে থেকে শরীর কেঁপে উঠছে তার। ফোঁপানোর আওয়াজ ভেসে আসছে।
একা একা অন্ধকারে ভয় পাওয়া আদ্রিকা আজ ঘরে আলো জ্বালায়নি। আঁধারে নিভৃতে বসে মন খুলে কাঁদার ব্যবস্থা করে রেখেছে। এভাবেই কাটছে তার বিগত কয়েকদিন। ঘরবন্দী জীবন। সকলের গালমন্দ শোনা আর মায়ের একবুক কষ্ট থেকে বেরিয়ে আসা চোখের জল দেখে দেখে এক দমবন্ধ করা কষ্টানুভূতি নিয়ে দিন কাটাচ্ছে সে।

ক্যাচক্যাচ করে দরজা খোলার আওয়াজে কান্না থেমে যায় আদ্রিকার। তবে মাথা তুলে তাকায় না সে। আলো জ্বলে ওঠে ঘরের, সেই সাথে ধিক্কার মিশ্রিত এক কন্ঠস্বর,
–এভাবে বসে বসে শোক পালন করে কি প্রমাণ করবি তুই? নোংরামি করার আগে মাথায় রাখা উচিত ছিলো, পরিস্থিতি কেমন হতে পারে?

সেলিনার কথা শুনে মাথা তোলে আদ্রিকা। টকটকে লাল চোখ, ফোলা ফোলা মুখে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে চাচীর দিকে। তাতে সেলিনার বিন্দুমাত্র মায়া হয়না। আরো একবার মুখ ঝামটা দিয়ে বললো,
–বাপহীন মেয়ে তুই। অন্তত মায়ের কথাটা ভাবা উচিত ছিলো। যাই হোক নিজেকে যতদ্রুত পারিস সামলে নে। তোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

এই বলে সেলিনা গটগটিয়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। বাইরে থেকে আর দরজা আটকে দিলেন না। তাতে কিছুটা খুশিই হলো আদ্রিকা।
সেদিন তার ফোনটা সেলিনার হাতে পরায় সেই অপরিচিতের সাথে হওয়া সমস্ত বার্তালাপ পড়ে ফেলেন তিনি। সাথে সাথেই চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলেছেন। আরজু বেগমের সামনে অভিযোগ তুলে নানা ধরনের কটু কথা বলেছেন। কিছুসময় পর আদ্রিকা বাড়ি ফিরতেই কোনো কথা ছাড়াই তার ওপর হামলে পড়েন আরজু। ইচ্ছেমতো চড় থাপ্পড় মারতে থাকেন। একটাসময় ক্লান্ত হয়ে ধপ করে মাটিতে বসে পড়েন তিনি। হাওমাও করে কাঁদতে কাঁদতে বিলাপ করতে থাকেন। ততক্ষণে আদ্রিকা সবকিছুই জেনে-বুঝে গিয়েছে। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে কেঁদেই গেছে কেবল। মুখ ফুটে কোনো টুঁ শব্দ করেনি।

তারপর থেকেই তাকে ঘরবন্দী করে রাখেন আরজু। প্রথম দিন তাকে না খাইয়ে রেখেছিলো দুই বেলা। তারপর থেকে ঘরে কেবল খাবার দিয়ে যাওয়ার জন্যই দরজা খোলা হতো। আর পুরোটা সময় বন্দীদশায় পার করতো আদ্রিকা। কাঁদতে কাঁদতে কখনো ক্লান্ত হয়ে চুপচাপ নীরব হয়ে যেতো। কখনো হাওমাও করে কেঁদেই যেতো। এই সবকিছুর মধ্যে কেবল তার বুবুর কথাই মনে পড়তো বারবার। আজ তার বুবু থাকলে তাকে এতো কষ্ট পেতে হতোনা। আদ্রিকা কোনোভাবেই নিজেকে দোষী ভাবতে পারেনা। সে তো কেবল পছন্দ করেছে একটা ছেলেকে, এছাড়া কোনো গভীর বাক্যালাপও হয়নি তাদের মধ্যে। এতো মার্জিত সব কথাবার্তা ছিলো তাদের। তারপরও তাকে এমনভাবে দোষারোপ করা হচ্ছে যেন সে রীতিমতো খু নের আসামী।

আজ দরজা খোলা পাওয়ায় আদ্রিকার মনে হলো একবার ফোনটা খুঁজে দেখবে। যেভাবেই হোক অরুনিকার সাথে যোগাযোগ করতে চায় সে।
তাই তো ঘর থেকে বেরিয়ে সেলিনার ঘরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় সে। পথে তার দাদা জসীমউদ্দিনের ঘর থেকে চাচা জাহেদের গলার আওয়াজে থমকে গেলো পা জোড়া। তার বিয়ের আলাপ চলছে। আদ্রিকা একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে শোনার চেষ্টা করলো। জাহেদ বলেন,

–ছেলেটাতো প্রথমে রাজি ছিলোনা। কিন্তু আজ হঠাৎ সে নিজেই আমার দোকানে এসে হাজির। ভালোমন্দ কতো কথা বলে অবশেষে নিজের রাজি হওয়ার কথাটা জানিয়েই দিলো। আদ্রিকাকে বিয়ে করতে কোনো আপত্তি নেই তার। তবে সে চায় আপাতত ঘরোয়া ভাবে বিয়েটা করবে। পরে না হয় অনুষ্ঠান হবে। কাল সন্ধ্যায় বাবা-মা কে নিয়ে এসে বিয়ের কাজটা সম্পন্ন করে যেতে চাচ্ছে। আপনি কি বলেন বাবা?
জসীমউদ্দিন জবাব দেন,

–আমি আর কি বলবো? তোমরা যা ভালো বোঝো।
জাফর আরজু বেগমের উদ্দেশ্যেও একই প্রশ্ন ছুঁড়লে তারও অনুরূপ জবাবই মিলে।
আদ্রিকা বোঝার চেষ্টা করছে কার সাথে তার বিয়ের এতো তোড়জোড়।
তখনই সেলিনা বলে ওঠেন,

–যাক বাবা শাহাদাতের মতো এতো ভালো ছেলেকে জামাই হিসেবে পাওয়া বড় সৌভাগ্য হলো।
আদ্রিকার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। বিস্ফোরিত নয়নে চেয়ে থাকে সে। শাহাদাত? ওই মানুষরূপী জা নো য়ারটার সাথে তার বিয়ে দিতে চাইছে তার পরিবার। তারা তো কেউ জানেনা ওর আসল রূপ। এখন কি করবে আদ্রিকা? ভরসা কেবল তার বুবু।

আদ্রিকা ছুটে চলে যায় সেলিনার ঘরে। ওয়ারড্রবের ওপরেই কাঙ্ক্ষিত ফোনটা পেয়ে যেতেই দ্রুত সেটা হাতে নিয়ে অরুনিকার নাম্বারে ডায়াল করতে যায়। কিন্তু পারেনা। খপ করে কেউ একজন হাত ধরে ফেলে তার। তাকিয়ে দেখে সেলিনা।
–তোর সাহস তো কম নয় আদ্রি, একটু সুযোগ পেয়েছিস আর ওমনি কাজে লাগিয়ে ফেলছিস। তোকে ছেড়ে দেওয়াই ভুল হয়েছে।

এই বলে সেলিনা আদ্রিকার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যেতে থাকে। আদ্রিকা বারবার আকুতি ভরা কন্ঠে বলে যাচ্ছে,
–চাচী আমায় ছাড়ো। আমি বুবুর সাথে কথা বলবো। ওই শাহাদাত একটা বাজে ছেলে। আমি কিছুতেই ওকে বিয়ে করবোনা।
আদ্রিকাকে ঘরে ঢুকিয়ে ছিটকে ফেলে দিলো সেলিনা। রাগে গজগজ করে বলতে থাকেন,

–তুই তো এইসব কথা বলবিই। শাহাদাতের মতো ছেলেকে বাজে বলিস। তুই নিজে কি? তোর মতো মেয়ে শাহাদাতের মতো বর পাচ্ছে এই নিয়ে খুশি হ। মেনে নে। এতেই তোর মঙ্গল।
কথা শেষেই সশব্দে দরজা আটকে দেন সেলিনা। ভেতর থেকে আসা আদ্রিকার এতো কাকুতিমিনতি কোনো কিছুই কর্ণপাত করেননা।

শাহাদাত চায়না আপাতত বিয়ের ব্যাপারে কেউ জানুক। এমনকি অরুনিকাও না। বিয়েটা হয়ে গেলে অনুষ্ঠানের জন্যই সবাইকে নিমন্ত্রণ করা যাবে। সেলিনা, জাহেদ খুশিতে আটখানা থাকায় শাহাদাতের এমন শর্তগুলো অনায়াসেই মেনে নেন কোনো প্রশ্ন ছাড়াই। তাই আরজু বেগম অরুনিকাকে জানাতে চাইলেও সেলিনা বেগমের জোরদার নিষেধে আর কিছু বলতে পারেন না।

পরদিন দুপুর। বিয়েটা আটকানোর কোনো উপায়ান্তর না পেয়ে আদ্রিকা হাল ছেড়ে দেয়। মানসিক ভাবে নিজের এই বলিদানের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে সে। মেনে নেয়, তার জীবনের করুণ পরিণতি। বন্দী ঘরে বসে চুপচাপ আপনমনে নিজের কষ্টের কথা ভেবে যাচ্ছে।
হুট করে ঘরের দরজা খুলে যায়। বান্ধবী রুমকিকে ভেতরে ঢুকতে দেখে বাঁধভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। রুমকি ছুটে এসে আদ্রিকাকে জড়িয়ে ধরে শান্তনা দিতে থাকে। কিছুসময় পর কান্না থামিয়ে নিজেকে সামলে নিলো আদ্রিকা। কৌতূহলী স্বরে জিজ্ঞেস করে,

–তুই এই ঘরে আসলি কিভাবে? চাচী আসতে দিলো?
রুমকি জবাব দেয়,
–উনিই তো ডেকে পাঠিয়েছেন। তোকে ঠিকঠাক করে সাজিয়ে গুছিয়ে দেওয়ার জন্য। আর বলেছেন আমি যেন তোকে বুঝিয়ে রাজি করাই।
–কিহহ! তুলি তুই তো জানিস ওই শাহাদাত কেমন। আমি তো তোকে সব বলেছি। আমি কিভাবে..
–আমি জানি আদ্রি.. শোন
থেমে গেলো রুমকি। আশেপাশে সতর্ক দৃষ্টিতে নজর বুলিয়ে নিলো। যখন বুঝলো কেউ নেই আদ্রিকার কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলে,

–আমি লুকিয়ে একটা বাটন ফোন এনেছি। তুই অরুবুবুকে ফোন কর। তাকে জানা। সে নিশ্চয়ই কিছু না কিছু করবে। তোর জীবনটা এভাবে নষ্ট হতে দিবেনা।
রুমকির কথা শুনে আদ্রিকা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলো। চট করে উঠে গিয়ে দরজাটা আটকে দেয় সে। রুমকি তার হাতে ফোনটা দিতেই ঝটপট অরুর নাম্বার ডায়াল করে কল লাগায়। বুক কাঁপছে তার। বুবুকে সবটা বলার আগেই ধরা না পড়ে যায়। অনেকক্ষণ ধরে রিং হচ্ছে। রিসিভ হচ্ছে না। আদ্রিকা ভয়ে বারবার ঢোক গিলছে। আর মনে মনে দোয়া করছে যেন অরুনিকা ফোনটা রিসিভ করে। অবশেষে তার দোয়া কবুল হয়ে অপর পাশ থেকে অরুনিকার মিষ্টি স্বর ভেসে এলো,

–হ্যালো কে বলছেন?
অরুনিকার কন্ঠস্বর শুনতেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো আদ্রিকা। কান্নারত স্বরেই ভাঙা ভাঙা ভাবে উচ্চারণ করলো,
–বু..বুবু.. আমি.. আদ্রিকা।
আদ্রিকার কন্নামিশ্রিত স্বর শুনে ধ্বক করে ওঠে অরুনিকার বুক। তার বোন। তার আদরের বোন। এমনভাবে কাঁদছে? উদ্বিগ্ন স্বরে ছটফটিয়ে বলে ওঠে অরু,

–আদ্রি.. কি হয়েছে বোন আমার? কাঁদছিস কেন এভাবে? বুবুকে বল
–বুবু.. চাচা চাচী মিলে ওই শাহাদাতের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছে। আজ সন্ধ্যায় বিয়ে। তুমি আমায় বাঁচাও বুবু। আমি কিছুতেই এই বিয়ে করবোনা।
ভনভন করে ওঠে অরুনিকার মাথা। চক্কর আসতেই সে টাল সামলাতে বসে পড়ে বিছানায়। এসব কি শুনছে সে? ওই অমানুষটার সাথে তার বোনের বিয়ে ঠিক করেছে? এতো বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছে সকলে অথচ কেউ তাকে কিছু জানানোর প্রয়োজনবোধ করলো না।

–বুবু.. ও বুবু.. কিছু বলছো না কেন?
আদ্রিকার ডাকে সম্বিত ফেরে অরুনিকার। নিজেকে ধাতস্থ করে জবাব দেয়,
–আদ্রি একদম ভয় পাস না। তুই কোনো চিন্তা করিস না। এই বিয়ে হবে না। আমি হতে দিবো না। আমি আসছি। একটু অপেক্ষা কর। আমি আসছি। ততক্ষণ বিয়েটা ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা কর বোন।

ফোন কেটে দেয় অরুনিকা। আহরার অফিসে আছে। আজ তার কিছু জরুরি মিটিং এ থাকার কথা। ফোনে পাওয়া সম্ভব নয় জেনেও অরুনিকা ফোন দেয়। যা ভেবেছিলো তাই। ফোন বন্ধ। কি করবে না করবে ভেবে দিশেহারা অবস্থা হয়ে যাচ্ছে অরুর। কাকে বলবে? কে আছে বাড়িতে? ভাবতে ভাবতে মাথায় আসে – আয়াজ। আয়াজ আজ বাড়িতে। অফিসে যায়নি সে। অবশ্য ইদানীং তাকে খুব একটা অফিসে যেতে দেখা যায় না। বেশিরভাগ সময় বাড়িতেই থাকে। দরজা আটকে ঘরে বসে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা। কেমন একটা নিষ্প্রাণ, নির্জীবের মতো ঘুরে বেড়ায় সে।
অরুনিকা আর কিছু না ভেবে ছুটে যায় আয়াজের ঘরের সামনে। ক্রমাগত দরজা ধাক্কিয়ে উত্তেজিত স্বরে ডাকতে থাকে,

–আয়াজ ভাইয়া, দরজা খুলুন প্লিজ। আয়াজ ভাইয়া..
কয়েক সেকেন্ডের মাথায়ই দরজা খুলে দেয় আয়াজ। বিস্মিত হয়ে বলে,
–অরুভাবি, কি হয়েছে? এতো উত্তেজিত দেখাচ্ছে কেন আপনাকে? কোনো সমস্যা?
বারকয়েক ঢোক গিলে শুকনো গলা ভিজিয়ে নেয় অরু। হাঁপিয়ে ওঠা স্বরে বলে,

–আমাকে.. আমাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে চলুন ভাইয়া। প্লিজ! আমার বোনটাকে বাঁচাতে হবে।
মুহুর্তেই আয়াজের চোখেমুখে পরিবর্তন চলে আসে। যতটা উত্তেজিত অরু ছিলো ততটাই উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করে আয়াজ,
–আদ্রিকা? কি হয়েছে আদ্রিকার? ভাবি, আদ্রিকা ঠিকাছে তো?

রূপবানের শ্যামবতী পর্ব ৩০

–শাহাদাতের সাথে ওর বিয়ে ঠিক করেছে আমার বাড়ির লোক। আজ সন্ধ্যায় বিয়ে। আমাদের এই বিয়েটা আটকাতে হবে। সন্ধ্যার আগেই যেভাবেই হোক ওখানে পৌঁছাতে হবে।
আয়াজের মুখশ্রী রক্তিম হয়ে ওঠে। তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়ে সে। তবে প্রকাশ করেনা। গম্ভীর অথচ ভারি রাগত স্বরে জবাব দেয়,
–আমি গাড়ি বের করছি ভাবি। আপনি আসুন।

রূপবানের শ্যামবতী পর্ব ৩২