রূপবানের শ্যামবতী পর্ব ৩০

রূপবানের শ্যামবতী পর্ব ৩০
এম এ নিশী

লোকটা যখনই ছুরিটা ওপরে তুললো নিস্তব্ধ পরিবেশের নিস্তব্ধতা ভেঙে কলিং বেলটা বেজে উঠলো জোরে জোরে। লোকটার হাত থেমে গেলো। ঝট করে ঘুরে তাকালো দরজার দিকে। লোকটার ধ্যান সরে যাওয়ার সুযোগটা অরু বেশ ভালোভাবেই লুফে নিলো।

নিজের সর্বশক্তি দিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো লোকটিকে। এক মুহুর্ত দেরি না করে উঠে দাঁড়িয়ে ছুটে যায় দরজার দিকে। দরজা খুলতেই সামনে আহরারকে দেখে ঝাপিয়ে পড়ে অরু তার বুকে। আহরারকে আঁকড়ে ধরে হাওমাও করে কাঁদতে থাকে পাগলের মতো। প্রচন্ড ভয়ে তার শরীর এখনো কাঁপছে। আহরার দু হাতে অরুর মাথায়, পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। উদ্বিগ্ন স্বরে বলে ওঠে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

–কি হয়েছে অরু? এভাবে কাঁদছো কেন? আর কে এসেছিলো? কোন লোক? কি করেছে তোমার সাথে? বলো অরু.. বলো..
কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গিয়েছে অরুর। আহরারের বুক থেকে মাথা না তুলেই আঙুল দিয়ে ইশারা করলো বাড়ির ভেতর। আহরার অরুকে শান্তনা দিয়ে দিয়ে সোজা করে দাঁড় করালো। তারপর ভেতরে এসে ঢুকতেই দেখে ফাঁকা ঘর। কেউ নেই। অরু নিজেও অবাক হয়ে দেখছে। এইতো একটু আগেই লোকটা এখানে ছিলো। কোথায় গেলো? পালালো? কিন্তু কিভাবে?
হুট করে আহরার বলে ওঠে,

–দাদীজান? দাদীজান ঠিক আছে তো?
বলতে বলতে আহরার ছুট লাগায় গুলবাহারের ঘরে। অরুনিকাও পেছন পেছন যায়। গুলবাহারের ঘরে ঢুকতেই দেখে গুলবাহার তখনও গভীর ঘুমে মগ্ন। আহরার স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলে,
–যাক, দাদীজান ঠিক আছেন।
অরুনিকা বিস্মিত স্বরে বলে,

–এতো কিছু হয়ে গেলো, তাও উনি একটুও টের পেলেন না?
–ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমোচ্ছেন নিশ্চয়ই..। ওই লোকটা? ওই লোকটা নিশ্চয়ই বাড়ির ভেতর ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে কোথাও।

আহরার দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। অরুনিকা তখনও অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে গুলবাহারের দিকে। কারণ তার জানামতে গুলবাহারের ঘুমের ওষুধ শুধুমাত্র রাতের জন্য। দিনের বেলা কোনো ঘুমের ওষুধ নেই।
অরুনিকা রুম থেকে বেরিয়ে এলো। মনে সন্দেহ এলেও খুব বেশি নাড়াঘাঁটা করতে পারলো না তা নিয়ে। সে যখন ড্রয়িং রুমে ফিরলো আহরার তখন বাইরে থেকে ঘরে ঢুকছে। চিন্তিত মুখশ্রী তার। অরুনিকা প্রশ্ন করে,

–কি হলো? পেলেন না লোকটাকে?
আহরার মাথা নাড়িয়ে না জানায়। অরুনিকা তপ্ত শ্বাস ফেলে জবাব দেয়,
–পালিয়েছে। কৌশলে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে পারে যে তার কাছে পালানোটা এ আর এমন কি?
আহরার এগিয়ে এসে দুহাতে অরুনিকার মুখটা আগলে ধরে। কোমলস্বরে বলে,
–অরু.. তোমার কিছু হয়নি তো? তুমি ঠিক আছো?

অরু ধীরভাবে নিজের মাথাটা আহরারের বুকে ঠেকায়। ঘটনাগুলো মনে পড়তেই গায়ে কাঁটা দেয় তার। মৃদু স্বরে বলে,
–আপনি একদম সময়মতোই চলে এসেছেন খান সাহেব। নইলে আজ.. আজই হয়তো আমার অস্তিত্ব মুছে যেতো এই দুনিয়া থেকে।
অরুর কথা শুনে আহরারের বাহুবন্ধন শক্ত হয়। অরুনিকাকে নিজের বুকে চেপে রেখেই জবাব দেয়,

–আমি থাকতে তোমার কিচ্ছু হবে না অরু। আমার প্রাণ থাকতে আমি তোমার কোনো ক্ষতি হতে দিবোনা। আর কখনো তোমাকে এভাবে একা ফেলে যাব না। কক্ষনো না।

এই ঘটনা বাড়ির লোকদের জানানোর সাহস আহরার বা অরুনিকা কেউই করলো না। একেতো ফারনাজকে নিয়ে সকলের মানসিক অবস্থা খুব করুণ, এমন মনের অবস্থায় আর কাওকে বাড়তি চাপ দেওয়াটা উচিত বলে মনে করলো না তারা।
রাতেই ফারনাজকে হসপিটাল থেকে নিয়ে চলে আসা হয়েছে। যতদিন না পুরোপুরি সুস্থ হয় ফারনাজ খান বাড়িতেই থাকবে। নিজের ঘরে, নিজের বিছানায় চোখ বুজে শুয়ে আছে ফারনাজ। পাশেই ফারজানা বসে বসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। কিছু সময় পর কোমলসুরে মেয়েকে ডেকে উঠলেন,

–ফারনাজ, মা।
ফারনাজ চোখ খুলে মায়ের দিকে তাকাতেই তার মা পুনরায় বলে ওঠেন,
–এমন ঘটনা ঘটলো কি করে মা? নাদিম বললো তুই বাথরুমে পিছলে পড়েছিস.. পড়লি কিভাবে?
ফারনাজ ঢোক গিললো। চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই ভয়াবহ স্মৃতি। মুহুর্তেই চোখ অশ্রুতে ভরে গেলো তার। সাথে সাথে নিজেকে সামলেও নিলো। মনে হলো মাকে বলে দেওয়া উচিত সব কিন্তু পরপরই মনে পড়ে গেলো নাদিমের হুমকির কথা।

হসপিটালে জ্ঞান ফেরার পর সর্বপ্রথম নাদিমই দেখা করতে এসেছিলো তার সাথে। মাথার কাছে বসে যত্নশীল স্বামীর মতো মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
–জান, ভালো আছো?
ফারনাজের শরীর এতোটাই দূর্বল ছিলো যে মুখ দিয়ে আওয়াজ বের করতেও কষ্ট হচ্ছিলো তার। নাদিমকে দেখতেই চোখে মুখে ঘৃণা উপচে পড়ছিলো। মুখ ফিরিয়ে নিতে চাইলে নাদিম বাধা দেয়। শক্ত করে মুখটা চেপে ধরে তার দিকে ফিরিয়ে নিয়ে বলে,

–এখন মুখ চুপ আছে আর বাড়ির লোকদের সামনে মুখটা খুলে যাবে, তাইনা? ভুলেও এমনটা ভেবোনা সোনা। যদি ভুল করেও মুখটা খুলেছো বা কাওকে কিছু বলেছো তবে পেটের টার মতো বাইরেরটাও কিন্তু দুনিয়া ছাড়বে।
ফারনাজ বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নাদিমের দিকে। নাদিম ফিচেল হেসে বলে,
–বুঝতে পারোনি তাইনা। নিধির পরিণতিও কিন্তু একই হতে পারে।

মাথার ওপর বাজ পড়লো যেন ফারনাজের। নাদিম নিধিকে মারার কথা বলছে। সেই নিধি যে তার প্রাণের চেয়ে প্রিয়। ফারনাজের অভিব্যক্তি বুঝতে পেরে নাদিম আবারো বলে ওঠে,
–আমার কাছে প্রিয় বলে কিছু নেই। যেসব জিনিস আমার মস্তিষ্কে আঘাত করে সেসব আমি নিশ্চিহ্ন করে দেই। যদি কোনো মানুষ হয়ে থাকে তবে তাকে সরিয়ে দিতেও আমি দ্বিতীয়বার ভাবিনা। হোক সে নিজের কাছের মানুষ..

বলতে বলতে চাপা হাসিতে ফেটে পড়ে নাদিম। কি ভয়ংকর সেই হাসি। ফারনাজের মনে হলো এই ভয়ংকর লোকটার একটা ভয়ংকর মৃ ত্যু হওয়া উচিত। তিলে তিলে মা রা উচিত। কিন্তু কে করবে সে-ই কাজ? ভেতর ফুঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বের হয় তার। সেই সাথে চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু মালা।
ফারজানার ডাকে অতীত ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে ফারনাজ। মাকে সত্যিটা বলার আর সাহস হলোনা তার। আলতো করে চোখের কোণে জমা পানি টুকু মুছে নিয়ে ক্লান্ত স্বরে বলে,

–সাবান পড়ে ছিলো, তাতেই পিছলে গেছিলাম। তুমি এখন যাও তো মা। আমাকে একটু একা থাকতে দাও। আর নিধিকে একটু কষ্ট করে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দাও প্লিজ।
ফারজানা আর দ্বিরুক্তি করলেন না। মেয়ের গায়ের চাদরটা ঠিকঠাক করে দিয়ে আরো একবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন, কপালে চুমু খেলেন। তারপর ঘরের আলোটা নিভিয়ে দিয়ে দরজা চাপিয়ে বেরিয়ে গেলেন। ফারজানা বেরিয়ে যেতেই চাপা কান্নায় ভেঙে পড়লো ফারনাজ।

ডাইনিং এ রাতের খাবার সাজানোর কাজ করছেন ফারজানা। রান্নাঘরে তাসফিয়া, অরুনিকা খাবার গরম করছে। আহরার টেবিলের কাছে এসে গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে প্রশ্ন ছোঁড়ে ফারজানার উদ্দেশ্যে,
–বড়মা, দাদীজানের ঘুমের ওষুধ কয়বেলা খাওয়াতে হয়?
অত্যন্ত স্বাভাবিক আহরারের কন্ঠস্বর ও মুখভঙ্গিমা। যেন সাধারণ ভাবেই একটি প্রশ্ন করেছে। আহরার হঠাৎ এমন প্রশ্ন করায় ফারজানা খানিকটা অবাক হলেও তিনিও স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দেন,

–আম্মাজানের ঘুমের ওষুধ তো কেবল রাতের বেলায় দিতে হয়।
ততক্ষণে আহরার গ্লাসে পানি ভরে নিয়েছে। চুমুক দেওয়ার আগে পুনরায় প্রশ্ন করে,
–ওষুধের পাতায় আর কটা ওষুধ আছে?
প্রশ্ন শেষ করেই গ্লাসে চুমুক লাগায় আহরার। ফারজানা জবাব দেন,

–কালকেই তো নতুন পাতা খুললাম। একটাই খাওয়ানো হয়েছে কেবল।
পানি খাওয়া মাঝপথে থামিয়ে আহরার কৌতুহলী স্বরে বলে,
–দুপুরে যদি দাদীজান একটা খেয়ে থাকেন তবে দুটো খাওয়া হয়েছে।
–তা তো জানিনা রে বাবা। উনি শুধু শুধু দুপুরেই বা খেতে যাবেন কেন? দুপুরে তো উনি ঘুমান না। একটু বিশ্রাম নেন কেবল।

–হুম।
আহরার ছোট্টো করে জবাব দিলো। আর কিছু না বলে গ্লাসের বাকি পানিটুকু শেষ করে চলে গেলো। ফারজানা কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলেন না। কিছু না ভেবে নিজের কাজে মনোযোগ দিলেন।
একটু আগেই আহরার গুলবাহারের সাথে কথা বলে এসেছে। কৌশলে জানতে চেয়েছিলো দুপুরে কিছু হয়েছিলো কিনা? বা কিছু টের পেয়েছে কিনা? গুলবাহারও কিছু না জানার ভান ধরে, নিজের ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমানোর কথা জানিয়ে দিলেন। নিজের গা বাঁচিয়ে নিলেন।

কিন্তু আহরারের মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। কেন হয়? গুলবাহারের কথাবার্তার ধরণ তার কাছে অন্যরকম লাগে। তাই সে ফারজানার কাছে ওষুধের ব্যাপারে জানতে গিয়েছিলো। এবার আস্তেধীরে গুলবাহারের ঘরে এসে প্রবেশ করে সে। ঘরে গুলবাহার নেই। ফারনাজের কাছে আছেন। আহরার ওষুধের বক্স থেকে ঘুমের ওষুধের পাতাটা বের করলো। স্পষ্ট চোখের সামনে জ্বলজ্বল করলো একটি খালি ঘর। অর্থাৎ এই পাতা থেকে কেবল একটি ট্যাবলেটই খাওয়া হয়েছে।
গটগট পায়ে আফতাব সাহেবের ঘরের সামনে এসে পরপর দুবার টোকা মারলো আহরার। ওপাশ থেকে জবাবের অপেক্ষা না করেই গমগমে গলায় বলে ওঠে,

–বাবা, বড় আব্বুর ঘরে এসো। কথা আছে।
আফজাল সাহেবের ঘরে একপ্রকার গোপন বৈঠক বসিয়েছে আহরার। সদস্য অবশ্য কেবলই তারা তিনজন। আহরার, আফজাল ও আফতাব সাহেব। আফজাল ও আফতাব সাহেব দুজনেই সোফায় বসে আছেন কিন্তু আহরার পায়চারী করছে। দুজনে থম মেরে অনুভূতিশূণ্যের ন্যায় বসে আছেন। যেন তাদের কিছুই বলার নেই, কিছুই করার নেই। খানিকবাদে আফজাল সাহেব বলে ওঠেন,

–তবে এখন তুই কি করতে চাইছিস আহরার?
মূলত আহরার তাদের দুজনকেই সবকিছু খোলাসা করে জানিয়ে দিয়েছে। সকলেই তাই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলো কিছু সময়ের জন্য। আফজাল সাহেবের প্রশ্ন শুনে পায়চারি বন্ধ করে আহরার। সরাসরি তাকিয়ে বলে,
–আমি তো বলেই দিয়েছি বড় আব্বু, আমি কি করতে চাই।
আফজাল সাহেব আবারো বলে ওঠেন,

–তুই শিউর? এমন একটা কাজ করা কি উচিত হবে?
আহরার কোনো জবাব না দিয়ে তার বাবার কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। বাবার দুইহাত নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নিয়ে বলে,
–বাবা, মায়ের সাথে এমন কি কি ঘটতো যার জন্য মা ভীত হয়ে পড়েছিলেন অরুনিকাকে বউ হিসেবে দেখে? সবটা সত্যি বলবে বাবা..
আফতাব সাহেব ঠান্ডাসুরে জবাব দেন,

–কতো কতো বেলা কেটে গিয়েছে তোর মা কে খেতে দেয়নি, না খাইয়ে রেখেছে। অসুস্থ শরীর নিয়ে এতো খাটিয়েছিলো তিন দিন হসপিটালে ভর্তি থাকতে হয়েছিলো। উঠতে বসতে কটু কথা, খোঁচা মারা কথা শুনিয়ে কতো ছোটো করেছে কতো অপমান করেছে তার হিসেব মেলানোই দায়। একবার তো বাড়ি থেকেই বের করে দিয়েছিলো এবং আমাকে এক প্রকার বাধ্যই করা হয়েছিলো যেন তোর মাকে তালাক দিয়ে দেই। কিন্তু আমি তা করিনি।

বরং আমিও বেরিয়ে গিয়েছিলাম। তাসফিকে নিয়ে আলাদা সংসার করছিলাম। তখনই তোর আসার সুসংবাদ জানি। তাও তোর দাদীজান তোর মাকে গ্রহণ করছিলেন না, বারবার আমাকে ফিরে যাওয়ার তাগিদ দিতেন। আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে কত কি-না করেছেন। তারপর তোর জন্ম হলো। তোকে দেখতে এসে তোর দাদীজান স্থির হয়ে গিয়েছিলেন। তোর সৌন্দর্য দেখে। তিনি সৌন্দর্যের পূজারি। এতো সুন্দর বংশধর এসেছে তার ঘরে, তার জন্য হলেও তিনি তাসফিকে গ্রহণ করলেন। এবাড়িতে ফিরে এলাম আমরা আবার। তারপর থেকে তোর মাকে তেমন অত্যাচার না করলেও খোঁচা মারাটা আজও ছাড়তে পারেননি।

নত মস্তকে সমস্ত কথা শুনলো আহরার। ভিষণ শান্ত হয়ে আছে সে। এতোকিছু শুনেও প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। ধীরকন্ঠে কেবল একটা কথাই বললো,
–আশা করি আমার কাজে তোমরা কোনো বাঁধা দেবেনা।
এই বলে আহরার উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে এগোলো। পেছন থেকে আফজাল সাহেব ডেকে ওঠেন,
–দাঁড়া আহরার।

আহরার দাঁড়িয়ে পড়ে। আফজাল সাহেব উঠে এসে আহরারের কাঁধে হাত রেখে বলেন,
–বরাবরই আমি বাড়ির সব ব্যাপার থেকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতাম শুধুমাত্র নিজের মাকে কিছু বলতে পারবোনা বলে। তোর বাবাও অনেক চেষ্টা করেও কোনো সুবিধা করতে পারেনি। পারেনি নিজের মাকে বদলাতে। পারেনি তার বিরুদ্ধে উপযুক্ত কোনো ব্যবস্থা নিতে। যদি তুই মনে করে থাকিস তুই এই কাজটা যথাযথ ভাবেই করতে পারবি তবে কর। আমাদের দিক থেকে কোনো আপত্তি নেই। কিরে আফতাব তুই কি বলিস?

আফতাব সাহেবকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলতেই তিনিও মাথা নেড়ে জবাব দেন,
–জি ভাইজান, আমারো কোনো বাঁধা নেই।
আহরার কিছু বললো না। হালকা হাসলো। তার হাসির সাথে বাকি দুজনও হাসি মেলালো।

কাল থেকে নাদিমকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। আজ সকাল সকাল গুলবাহার তাই আবারো ফোন লাগালেন নাদিমকে। এবারে পাওয়া গেলো। কয়েকবার রিং হতেই রিসিভ হলো,
–জি দাদীজান..
দাঁত কিড়মিড়িয়ে গুলবাহার জবাব দেন,

–আরে রাখো তোমার দাদীজান। আমাদের কি কথা হয়েছিলো? বারবার করে বলেছিলাম, একজন বিশ্বস্ত লোককে ওই অরুনিকার ঘরে ঢুকিয়ে দিবে। তাদের কিছু ঘনিষ্ঠতার মুহূর্ত সৃষ্টি করে সেসব ছবি তুলে নিবে। বাড়ির সবাইকে তা দেখিয়ে, মেয়েটাকে দুশ্চরিত্রা প্রমাণ করে এই বাড়ি থেকে চিরকালের মতো বিদায় করবো। আর তুমি কি করলে? ওকে খু ন করার চেষ্টা করলে। দেখো নাদিম আমি মেয়েটিকে অপছন্দ করি, ওকে এই বাড়ি থেকে তাড়াতে চাই তার মানে এই নয় যে ওকে জানে মেরে ফেলার চিন্তা করবো। কাজটা তুমি একদম ঠিক করোনি। এখন কি করবে? আহরার তোমাকে ছাড়বে না কিছুতেই। পাতাল থেকে হলেও তেমাকে টেনেহিঁচড়ে বের করে আনবে। আমি তো নিজেকে বাঁচিয়ে নিয়েছি। তুমি কি করবে এবার ভাবো।

দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজে দ্রুত ফোনটা কেটে দিলেন গুলবাহার। নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করে গলা চড়িয়ে বললেন,
–কে?
–দাদীজান..
আহরারের কন্ঠস্বর শুনে মুখে হাসি ফুটলো গুলাবাহারের।
–আরে দাদুভাই, ভেতরে এসো ভেতরে এসো।
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো আহরার। গুলবাহারকে তাড়া দিয়ে বললো,
–দাদীজান জলদি রেডি হয়ে নিন। একজায়গায় যেতে হবে।
গুলবাহার কৌতুহলী স্বরে জিজ্ঞেস করেন,

–কোথায় যাব দাদুভাই?
আহরার অদ্ভুত ভাবে হাসলো। কেমন রহস্যময় ঠেকলো হাসিটা। জবাব দিলো,
–সা – র – প্রা – ই – জ!
গুলবাহার তৈরি হতেই আহরার তাকে নিয়ে গাড়ির কাছে আসলো। গুলবাহার বিরক্ত হন।
–দাদুভাই, একটু জার্নিও এখন শরীরে সয়না। গাড়ি করে কোথায় নিয়ে যাবে তুমি আমায়?
আহরার দরজা খুলতে খুলতে বলে,

–বেশিদূর না দাদীজান। ৫ মিনিটের পথ।
গুলবাহারকে ওঠার ইশারা দিতেই তিনি আর কিছু না বলে উঠে পড়েন। সত্যি সত্যি আহরার ৫ মিনিটের মাথায় তাকে নিয়ে এলো। গাড়ি থেকে নামাতেই গুলবাহার কৌতুহলী দৃষ্টিতে চারপাশ দেখছেন। এ কোথায় নিয়ে এলো আহরার তাকে? কিছু জিজ্ঞেস করবেন তার আগেই সামনে চোখ পড়লো তার। বিশাল এক ভবন, যার চূড়ায় বড় বড় অক্ষরে লিখা আছে, “মমতা বৃদ্ধাশ্রম”।

বৃদ্ধাশ্রমটি আফজাল সাহেব ও আফতাব সাহেব মিলে তৈরি করেছেন। নামটা গুলবাহার দিয়েছেন। তার মায়ের নাম- মমতা।
আহরার তাকে হঠাৎ এখানে কেন নিয়ে এসেছে বুঝতে পারছেন না তিনি। ভাবতে ভাবতেই তাকে ভেতরে নিয়ে এলো আহরার। একটা ঘরে ঢুকিয়ে বিছানার ওপর বসিয়ে দিয়ে আহরার বলে,
–আপনি এখানে বসুন, দাদীজান। আমি কিছু কাজ সেরে আসছি।
গুলবাহার কিছু বলতে চাইলেন তবে আহরার সেই সুযোগ দিলো না। দ্রুত বেরিয়ে গেলো। বৃদ্ধাশ্রমটির মূল দায়িত্বে থাকা জয়নাব বেগমের সাথে কথা বলছে আহরার।

–কাল রাতে তো সব বলেইছি আপনাকে। ঠিক যেভাবে যেভাবে, যা যা করতে বলেছি তাই তাই করবেন। মূল কথা, তাকে শান্তিতে বসতে দিবেন না।
জয়নাব বেগম গদগদ হয়ে মাথা নাড়লেন কেবল। আহরার একবার সেই ঘরটার দিকে তাকালো যেখানে গুলবাহারকে বসিয়ে রেখে এসেছে। তারপর আবারো জয়নাব বেগমের উদ্দেশ্যে বললো,
–আপনার প্রাপ্য আপনাকে যথাযথ ভাবেই মিটিয়ে দেওয়া হবে। আর হ্যা, আমি কাওকে দিয়ে উনার জিনিসপত্র গুলো পাঠিয়ে দিচ্ছি। চলি।

এই বলে আহরার বেরিয়ে গেলো। তার চোখেমুখে কঠোর অভিব্যক্তি। কিছু কিছু মানুষের ভুলের মাশুল এভাবেই দিতে হয়। আহরার নিজের গাড়ি নিয়ে চলে গেলো।
এদিকে গুলবাহার অতিষ্ঠ হয়ে বেরিয়ে আসলেন। আহরারকে খুঁজতে লাগলেন। তখনই জয়নাব বেগম সামনে এসে দাঁড়ালেন,
–কোথায় যাচ্ছেন? এখান থেকে বেরোনো নিষেধ।
গুলবাহার ক্রুদ্ধ স্বরে বলে ওঠেন,

–তোমার এতো বড় সাহস তুমি আমাকে আটকাও। তুমি জানো আমি কে? আমি এই বৃদ্ধাশ্রমের মালকিন। তোমাকে এই মুহূর্তে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারি আমি, জানো?
জয়নাব বেগম ব্যাঙ্গাত্মক হেসে বলে উঠলেন,
–বৃদ্ধাশ্রমের মালকিন এখন এই বৃদ্ধাশ্রমেই আশ্রয় নেওয়া এক বুড়ি মানে বৃদ্ধা।
গুলবাহার ফুঁসে উঠে বলেন,
–কিইইই?
–জি হ্যা। এখন থেকে আপনি এখানেই থাকবেন। আপনার নাতি আপনাকে এখানে রেখে গেছে। এই বৃদ্ধাশ্রমের বাইরে পা রাখা আপনার জন্য নিষিদ্ধ।

–নাআআআ.. এটা ভুল, এটা মিথ্যে। আমার নাতি এমনটা করতে পারেনা। আমি কথা বলবো ওর সাথে। কোথায় ও?
বলতে বলতে গুলবাহার বেরোতে চাইলে জয়নাব বেগমের ইশারায় দুজন মহিলা তাকে দুদিক থেকে ধরে আটকে দেয়। তাকে টেনেহিঁচড়ে ভেতরে নিয়ে যেতে থাকে। গুলবাহার কেবল চিৎকার করে বলে যাচ্ছেন,

রূপবানের শ্যামবতী পর্ব ২৯

–এ্যাই অসভ্যের দল ছাড় আমাকে ছাড়। তোরা জানিসনা আমি কে? দেখে নিবো তোদের। ছাড় আমাআআআয়য়য়য়…
জয়নাব বেগম খিকখিক করে হাসতে থাকেন। হাসতে হাসতে বলেন,
“বুড়ি তোর কতো তেজ এবার বের করবো দাঁড়া।”

রূপবানের শ্যামবতী পর্ব ৩১