রূপবানের শ্যামবতী পর্ব ২৯

রূপবানের শ্যামবতী পর্ব ২৯
এম এ নিশী

ফারনাজকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তার অবস্থা বিশেষ ভালো নয়। বাড়ির বাকি লোকদের খবর দেওয়ার কথা বলেছে ডক্টর। নাদিম তাই নিজের বাড়ির লোকদের সাথে সাথে ফারনাজের বাড়ির লোকদেরও খবর জানিয়ে দিয়েছে। একজন আদর্শ স্বামীর দায়িত্ব পালন করছে সে।

যখন যা যা প্রয়োজন ছুটে ছুটে সব জোগাড় করে আনছে। অস্থিরতার সাথে পায়চারি করছে অপারেশন থিয়েটারের সামনে। যখনই কেউ বের হচ্ছে তাকেই চেপে ধরে জানতে চাচ্ছে নিজের স্ত্রীর অবস্থা সম্পর্কে। এক অদ্ভুত পাগলামি দেখা যাচ্ছে নাদিমের মাঝে। যেন স্ত্রীর চিন্তায় চিন্তায় তার শ্বাস ফেলারও জো নেই। সত্যিই কি তাই? নাকি সবটাই লোক দেখানো?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কিছু সময়ের মধ্যেই তার মা, বাবা, বোন আর ছোটো ভাই এসে হাজির। নাদিম সকলের সামনে নিজেকে শোকে পাগলপ্রায় হিসবে উপস্থাপন করে। অশ্রু বিসর্জন দিতে দিতে আপনমনে কিসব বিরবির করতে লাগলো। ধীরে ধীরে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গেলো। সকলে ভাবলো বেচারা খুব মানসিক চাপের মধ্যে পড়ে গেছে। এখানে আর থাকতে পারছেনা তাই বাইরে গেলো। কেউ ঘুনাক্ষরেও টের পেলো না তার দুরভিসন্ধি কত ভয়াবহ।

ফারনাজের খবরটা শোনার পর থেকেই ফারজানা হাওমাও করে কেঁদেই যাচ্ছেন। খান বাড়ির পরিস্থিতি থমথমে হয়ে গিয়েছে। গতকাল আহরারের ওমন দূর্ঘটনা আজ ফারনাজের এমন খবর। সকলকে স্তব্ধ করে রেখেছে। ফারনাজ, খান বাড়ির বড় মেয়ে। বড় আদরের মেয়ে। কত আদর, যত্ন, স্নেহ, মমতায় আগলে মেয়েটাকে মানুষ করা হয়েছে। মেয়েটা বড্ড ভালো মনের মেয়ে তাদের। কখনো কারো সাথে কোনোপ্রকার উচ্চবাচ্য তো দূর, কারো সাথে চোখ তুলেও কথা বলেনা। নম্রতা তার অন্যতম গুণাবলি। এই মেয়েটার সাথে এতোবড় দূর্ঘটনা কেউ সহজে মানতে পারছেন না। আফজাল সাহেবের মতো শক্ত মানুষও মেয়ের এমন অবস্থা শুনে ভেঙে পড়েছেন।

সকলেই হসপিটালের উদ্দেশ্যে বেরোনোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবে গুলবাহার যেতে পারবেন না। তাই অরুনিকা থেকে গেলো তার সাথে। আহরারকেও যেতে মানা করেছে সকলে। যেহেতু তার শরীরটাও ঠিক নেই। কিন্তু আহরার সে কথা শুনতে নারাজ। বোনের এমন খবর তাকে কিছুতেই বাড়িতে বসে স্থির থাকতে দিবেনা। বাধ্য হয়ে আর কেউ বারণ করতে পারলোনা। সকলেই বেরিয়ে গেলো। আহরার সবার শেষে বেরোলো। বেরোনোর আগে অরুনিকাকে বলে গেলো,

–সাবধানে থেকো অরু। নিজের আর দাদীজানের খেয়াল রেখো। আমি না ফিরলেও বাকিরা ফিরে আসবে। তাই মন খারাপ করো না বা ভয় পেও না। আজ আমেনাও নেই। তোমাকে এভাবে একা রেখে যেতে মন সায় দিচ্ছে না।
আহরারের কথা শুনে অরুনিকা হাসলো।

–এতো চিন্তা করবেন না। আপনি যান। আর আপুর খবরাখবর আমাকে ফোন করে জানাতে থাকবেন কিন্তু।
আহরার হালকা হেসে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার সময় দরজার কাছে গিয়ে কি মনে করে যেন দাঁড়িয়ে পড়লো। ঘাড় ঘুরিয়ে অরুনিকার দিকে চাইলো। একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে আজ তার। কিছু একটা মিল পাচ্ছে। মনে হচ্ছে কোনো এক ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।

কিন্তু কি সেই ঘটনা? কি মিল পাচ্ছে? বুঝতে পারছেনা। হুট করে মনটা কেন যেন সায় দিচ্ছে না তার অরুনিকাকে রেখে যেতে। ওদিকে গাড়ির হর্ণ কানে বাজতেই আহরার নিজের চিন্তা ছাড়লো। হাত নেড়ে অরুকে বিদায় দিয়ে দ্রুত গাড়িতে গিয়ে উঠে বসলো। যতক্ষণ পর্যন্ত গাড়িটা দেখা গেলো অরুনিকা চেয়ে থাকলো। গাড়ি দৃষ্টির আড়াল হতেই দরজা আটকে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো সে। গুলবাহারের দুপুরের খাবারটা রেডি করার উদ্দেশ্যে।

গুলবাহারের জার্নি করে যাওয়াটা শরীরে সয় না আজকাল। সামান্য জার্নির ধকলও তিনি নিতে পারেন না। তাই নাতনিকে দেখতে যাওয়ার এতো ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও যেতে পারেননি। বিছানায় আাধাশোয়া হয়ে দোয়া দরূদ পড়ছেন তিনি। আর মনে মনে কেবল আল্লাহকে বলছেন, যেন তার নাতনিটার কিছু না হয়। মেয়েটা সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে যেন বাড়ি ফিরতে পারে।
আচমকা ফোনের ক্যাটক্যাটে রিংটোনটা বেজে ওঠায় তার দোয়ায় ব্যাঘাত ঘটে। স্ক্রিনে তাকিয়ে কলকারীর নামটা পড়া মাত্রই হুড়মুড় করে ফোনটা হাতে নিয়ে রিসিভ করেন,

–হ্যা..হ্যালো.. হ্যালো.. আমার ফারনাজ দাদুমনি ঠিক আছে তো?
কিছু সময় নীরব থেকে অপর পাশ হতে আসা উত্তর শুনলেন তিনি। মুহুর্তেই তার মুখবিবরে দুঃশ্চিন্তার ছাপ সরে গিয়ে বিস্ময়ের রেখা দেখা দিলো। অবাকসুরে বললেন,

–কি বলছো? আজই? ফারনাজের এমন অবস্থা.. তুমি এসব চিন্তা করছো?
–ফারনাজের কিচ্ছু হবেনা। ও ঠিক হয়ে যাবে। তবে অরুনিকাকে সরানোর জন্য আজকের মতো সুযোগ আর হবে কিনা তাই ভাবুন দাদীজান। ভালো করে ভাবুন। ভেবে আমাকে জানান। আপনি যা বলবেন তাই হবে।
লাইনটা কেটে গেলো। গুলবাহার কান থেকে ফোনটা নামিয়ে রাখেন। দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে ভাবতে থাকেন, কি করবেন।
ঠকঠক করে দরজায় আওয়াজ হতেই চমকে ওঠেন তিনি। দরজার ওপাশ হতে অরুনিকা মিহিসুরে বলে ওঠে,

–দাদীজান।
বিরক্তিতে ভ্রুঁ কুঁচকে আসে গুলবাহারের। মুখ দিয়ে “চ” জাতীয় শব্দ করেন। খরখরে আওয়াজে জবাব দেন,
–ভেতরে এসো।
দরজাটা হালকা ঠেলে মাথাটা সামান্য গলিয়ে দাঁড়ায় অরুনিকা। পুরোপুরি ভেতরে প্রবেশ করেনা সে। মৃদু হেসে বলে,
–আপনার খাবারটা কি এখানেই নিয়ে আসবো দাদীজান? নাকি ডাইনিং এ দিবো?
চোখেমুখে বিরক্তি ভাব বজায় রেখেই উত্তর করেন গুলবাহার,

–অদ্ভুত মেয়ে তো তুমি। বাড়িতে কেউ নেই, শুধু শুধু ডাইনিং এ গিয়ে কেন খাবো? এখানে নিয়ে এসো।
শেষ কথাটুকু খানিকটা ধমকের সুরেই বলেন তিনি। অরুনিকার খারাপ লাগেনা। সে নিজেকে অভ্যস্ত করে নিয়েছে গুলবাহারের এমন ব্যাবহারে। তাই আর কথা না বাড়িয়ে দ্রুত খাবারটা নিয়ে আসতে গেলো। এদিকে গুলবাহার নিজের ভাবনার ফলাফল নিশ্চিত করেছেন। ফোনটা হাতে নিয়ে একটু আগে আসা কলনাম্বারে পুনরায় কল লাগান। রিসিভ হতেই বলে ওঠেন,

–ঠিকআছে। কাজটা তাহলে আজই করো। সত্যিই এমন সুযোগ আর আসবে না।
ফোনের ওপারে, এপারে দুজনের ঠোঁটেই ফুটে ওঠে ক্রুর হাসি।
গুলবাহারের ঘরে খাবারটা রেখে অরুনিকা রান্নাঘরের বাকি কাজগুলো সারতে চলে গেলো। হঠাৎই লাগাতার কলিং বেলের আওয়াজে উদ্বিগ্ন অরু ছুটে গেলো দরজার কাছে। কেউ ফিরে এলো নাকি? সব ঠিক আছে তো? ভাবতে ভাবতে দরজা খুলতেই অবাক হলো সে। বাইরেটা ফাঁকা।

কেউ নেই। তবে বেল বাজালো কে? অরু বেরিয়ে এসে চারিদিকে ভালোভাবে নজর বুলালো। নাহ! কেউ নেই। মেইন গেটের দিকে উঁকি দিয়ে দেখলো গেট লাগানো। তবে কে করলো এমন কাজ? আশ্চর্য! নাকি অরু ভুল শুনলো? আর কিছু না ভেবে ভেতরে ঢুকে দরজা আটকে দিলো সে। রান্নাঘরে এসে পুনরায় নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়তেই ওপর থেকে ঝনঝন করে কিছু ভাঙার আওয়াজ ভেসে এলো।

অরুনিকা ভাবলো দাদীজানের কোনো সমস্যা হলো না তো? তাড়াহুড়ো করে ছুট লাগালো গুলবাহারের ঘরের দিকে। দরজা খুলে উঁকি দিতেই দেখতে পেলো গুলবাহার গভীর ঘুমে মগ্ন। অরু ধীরপায়ে ভেতরে প্রবেশ করে খাবারের প্লেট, গ্লাসগুলো হাতে তুলে নিলো। রুম থেকে বেরিয়ে দরজাটা ভালোভাবে চাপিয়ে চলে গেলো। অরু চলে যেতেই ঝট করে চোখ মেলে তাকান গুলবাহার। ক্রুর হাসি হেসে কাত হয়ে শুয়ে আরামে চোখ বুজেন পুনরায়।

অরুনিকার ছটফট লাগছে। মনে হচ্ছে বাড়ির পরিবেশটা ঠিক নেই। অদ্ভুত কিছু টের পাচ্ছে সে। কিন্তু কি? সেটাই বুঝতে পারছেনা। কাজকর্ম শেষ করে নিজের ঘরের দিকে এগোতে এগোতে এসবই ভাবছিলো। আচমকা ধুপ করে হওয়া এক শব্দে চমকে ওঠে সে। মনে হলো কেউ যেন লাফিয়ে পড়লো তার খুব কাছেই। দ্রুত চারপাশ খুঁজে দেখলো। কিন্তু সন্দেহজনক কোনোকিছুই চোখে পড়লো না তার। একবার মনে হলো পুরো বাড়িটা খুঁজে দেখা উচিত। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। একে একে প্রতিটা ঘর, বারান্দা, ডাইনিং, ড্রয়িং সবজায়গা তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখলো তবে এমন আজব আজব শব্দ হওয়ার কোনো উৎস খুঁজে পেলোনা সে।

স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অরু। তার মাথায় খেলে গেলো এক অদ্ভুত ভাবনা যা তাকে স্থির করে দিয়েছে। শান্ত চোখজোড়া চারিদিকে ঘোরাতে ঘোরাতে ভাবতে লাগলো সে, তানিশার মৃত্যুর দিনও তো পরিস্থিতিটা ঠিক এমনই ছিলো। ফারনাজের ডেলিভারি ছিলো সেদিন। সকলে ওখানেই গিয়েছিলো। সেদিনও তো বাড়িতে শুধু তানিশা আর গুলবাহারই ছিলেন। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। তবে কি অরুনিকার পরিণতিও তানিশার মতোই হবে?

ধরাম করে বিকট এক শব্দে লাফিয়ে ওঠে অরু। কন্ঠস্বর গলে বের হয় চাপা চিৎকার। শব্দটা এসেছে ছাদ থেকে। মনে হলো প্রচন্ড জোরে দরজাটা লাগিয়ে দিলো কেউ। অরুনিকা ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সিঁড়ির দিকে। মনে হচ্ছে এখনি কেউ নেমে আসবে ছাদ থেকে। নড়াচড়া ভুলে রোবটের মতো কাঠকাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অরুনিকা। ঘনঘন ঢোক গিলছে সে। নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসছে। যদি কেউ নেমে আসে, কি করবে সে? এই ভয়ে দম আটকে চেয়ে আছে সিঁড়ির দিকে। ৫ মিনিট, ১০ মিনিট, ১৫ মিনিট পেরিয়ে গেলেও কেউ নামলো না।

অরুনিকা ঝট করে পাশের জানালা গলে বাইরে নজর ফেলে। হ্যা! বাতাসের তীব্রতা বোঝা যাচ্ছে বেশ। তার মানে জোরে হাওয়া এসে দরজা ভিড়িয়ে দিয়েছে তাই এমন শব্দ। হালকা স্বস্তির শ্বাস ফেলে মনকে শান্তনা দিলো অরু। পরক্ষণেই মনে হলো সমস্ত দরজা – জানালা ভালোভাবে আটকে রেখেছে সে কিন্তু ছাদের দরজা খোলা। দরজাটা আটকে দিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে বসে থাকবে। যতক্ষণ না বাড়ির লোকেরা ফিরবে সে বেরোবে না কিছুতেই। কিন্তু দাদীজান? দাদীজান তো ঘরে একা। তাহলে বরং দাদীজানের ঘরেই বসে থাকবে সে।

যতক্ষণ তিনি ঘুমোবেন অরু ঘরের এক কোণে বসে থাকবে, তার ঘুম ভাঙলেই না হয় বেরিয়ে যাবে। ভাবনা সমাপ্ত করে সিঁড়ি ভেঙে ছাদের দরজার দিকে এগিয়ে গেলো অরু। যতই দরজার দিকে এগোচ্ছে একটা ভয় ক্রমশ তাকে আঁকড়ে ধরছে চারদিক থেকে। ছাদে কেউ নেই তো? এই ভরদুপুরে কেমন গা ছমছমে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে চারপাশে। নিরব, শান্ত, নেই কোনো কোলাহল, কোনো শব্দ।

দিনের আলোতেও যেন ভুতুড়ে পরিবেশে পরিণত হয়েছে। হাতের উল্টো পিঠে কপাল ও ঠোঁটের চারপাশে জমা ঘামটুকু মুছে নেয় অরু। শুকনো ঢোক গিলে এক পা এক পা করে এগিয়ে গেলো ছাদের দরজার দিকে। কাছাকাছি আসতেই তাড়াহুড়ো করে দরজাটা লাগিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে টেনে ধরলো দরজা। যখনই ভিড়াতে যাবে ওমনি তার নজর সামনের দিকে পড়তেই চিৎকার করে ছিটকে সরে গেলো সে। ঠিক সামনেই, মুখোমুখি রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে কেউ একজন। অদ্ভুত পোশাক তার। উল্টো ফিরে থাকায় মুখ দেখা যাচ্ছে না। অরুনিকা সাহস করে খানিকটা উঁচু স্বরে বলে ওঠে,

–কে আপনি? এখানে কি করছেন?
লোকটা ঘুরে দাঁড়ালো। ছ্যাঁত করে উঠলো অরুনিকার বুক। ভয়ংকর মুখোশ পরিহিত লোকটা ঠিক পোশাকের সাথে মিলিয়েই। দেখে মনে হচ্ছে মানুষরূপী এক দানব দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। লোকটার হাতে কি যেন চকচক করছে। ভালো করে খেয়াল করতেই অরু বুঝতে পারে ওটা একটা ছুরি। এক হাত লম্বা, ধারালো ছুরি হাতে লোকটা অরুনিকার দিকে এগোতে থাকে।

অরুনিকা যেন জমে পাথর হয়ে গেছে। চোখ দুটো কোটর ছেড়ে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। মুখ হা করে শ্বাস নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে সে। গলা শুকিয়ে খাঁ খাঁ করছে। ঢোক গিলে গলা ভেজানোর চেষ্টা টুকুও সম্ভব হচ্ছে না। এই মুহূর্তে তার ছুটে পালানো উচিত। কিন্তু সে পারছেনা এক পা ও নড়তে। ভয়ের চোটে শরীর অবশ হয়ে আসছে তার। লোকটা খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। অরুনিকার অবচেতন মন তাকে বারবার তাগিদ দিচ্ছে, “পালা অরু, পালা।”

ফারনাজের অপারেশন ভালোভাবেই শেষ হয়েছে। সদ্য সৃষ্টি হওয়া আড়াই মাসের ভ্রুণটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। অপারেশনের মাধ্যমে সেসব ক্লিন করা হয়েছে। কেবিনে শিফট করতেই সকলে গিয়ে দেখে আসছে তাকে। জ্ঞান নেই ফারনাজের। ফিরতে কিছুটা সময় লাগবে। সকলেই ব্যথিত মন নিয়ে দেখে যাচ্ছে ফারনাজকে। যে পরিমাণ র ক্তক্ষরণ হয়েছিলো তাতে ডক্টরদের ধারণা ছিলো বোধহয় তার লাইফ রিস্কে পড়ে যাবে। তবে সৃষ্টিকর্তার অসীম দয়ায় সকল বিপদ কাটিয়ে উঠেছে মেয়েটি।

মেয়ের মাথার কাছে বসে ফারজানা নিরবে চোখের জল ফেলছেন। তাসফিয়া কাঁধে হাত রেখে শান্তনা দিচ্ছেন তবুও তাকে শান্ত করা যাচ্ছে না। আহিয়া দূরে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। আর মনে মনে তার ফারহাপুর কথা স্মরণ করছে। সে যে নেই এখানে।
আহরারের বিয়ের কিছুদিন পর একপ্রকার জেদাজেদি করেই আবারো অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে গেছে ফারহা। এদিকে আয়মান ভাইটাও নেই।

চার সন্তানের মধ্যে দুটো সন্তান কাছে আছে ফারজানার। তাদের মধ্যে একজনের এই হাল। সন্তানদের নিয়ে এতো যন্ত্রণা আর নিতে পারছেন না তিনি। আয়াজ চুপচাপ দাঁড়িয়ে নিজের মাকে দেখছে আর এসবই ভাবছে। সকলেই থম মেরে আছে। কারো মনে শান্তি নেই।

আয়াজ! সে তো যন্ত্রণার বিশাল এক পাহাড় নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একে তো পরিবারে আসা এই ঝড়, অপরদিকে বিরহ ব্যথা। কিসের বিরহ? তা কি কেউ জানে? দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বুজে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আয়াজ। বুকে ব্যথা হচ্ছে তার। ভিষণ ব্যথা।

আফজাল সাহেব বাইরে বসে আছেন স্থির হয়ে। তার চোখেও অশ্রুরা ভিড় জমাচ্ছে বারবার। পাশে বসেই আফতাব বড় ভাইকে শান্তনা দিচ্ছেন, “সব ঠিক হয়ে যাবে, ভাইজান। ফারনাজ মা সুস্থ হয়ে যাবে।”

আহরার ফারনাজকে এক নজর দেখে বাইরে এসে দাঁড়ায়। তার মনটা ছটফট করছে খুব। অরুর জন্য। আসার সময় বারবার তার মন অরুকে ফেলে আসতে চাইছিলো না। কিছু একটার আঁচ করছিলো সে বারবার। এখন সেই ছটফটানি দ্বিগুণ বেড়ে গেছে তার। হসপিটালের করিডোর এমাথা থেকে ওমাথা চিন্তিত ভঙ্গিতে পায়চারি করছে কেবল। একবার অরুকে ফোন করার কথা মাথায় আসতেই চট করে ফোন বের করে ডায়াল করে অরুর নাম্বারে। রিং হতে থাকে..

নিস্তব্ধ পরিবেশে বিকট শব্দে ফোনের রিংটোন বেজে উঠতেই ঘোর কাটে অরুর। ফোন বাজছে। নিশ্চয়ই আহরার ফোন করেছে। আহরারের কথা ভাবতেই নিমিষেই নিজের হারানো শক্তি ফিরে পায় অরু। ক্ষিপ্র গতিতে ছুটে নেমে যায় সে। ফোনের কাছে গিয়ে রিসিভ করতেই আহরারকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে থাকে অরু,
–খান সাহেব, আমাকে বাঁচান। একটা লোক.. একটা ভয়ংকর লোক.. ছুরি নিয়ে..

আর কিছু বলতে পারলো না অরু। লোকটাকে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসতে দেখে ফোনটা হাত থেকে পড়ে যায়।
ওদিকে আহরার “হ্যালো, হ্যালো” করতে থাকে। অরুর আর কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে আর এক মুহুর্ত দেরি করলো না সে। হসপিটাল থেকে বেরিয়ে গাড়ি নিয়ে ছুটলো বাড়ির উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যেই তার মাথা খুলে গেলো। মনে পড়ে গেলো আজ থেকে ৫ বছর আগের কথা। তানিশার মৃ ত্যুর দিন সবকিছু ঠিক এমনই ছিলো। সে-ই একই ঘটনা। কিন্তু তানিশার মতো অরুনিকার কোনো ক্ষতি সে হতে দিবেনা। কিছুতেই না।

হাই স্পিডে গাড়ি ঝড়ের বেগে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আহরার।
অরুনিকা কি করবে না করবে দিশেহারা হয়ে চারিদিকে তাকাতেই সামনেই তার শ্বাশুড়ির ঘর চোখে পড়ে। ছুটে গিয়ে ঢুকে পড়ে ঘরটায়। দরজা আটকে হাঁপাতে থাকে।জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে সে। দীর্ঘক্ষণ আটকে রাখা শ্বাস। গলা ফেটে যাচ্ছে তৃষ্ণায়। পানি, একটু পানি খাওয়া প্রয়োজন। ঘরে রাখা জগটা হাতে নিতেই দেখে খালি। পানি নেই। অরুর কান্না পাচ্ছে ভিষণ। কি করবে সে? কিভাবে বাঁচাবে নিজেকে? এই লোকটাই বা কে? কেন তাকে মারতে চায়ছে? আচ্ছা, তানিশার মৃত্যুর পিছনে এই লোকটার হাত নেই তো?

হুট করে গুলবাহারের কথা মনে পড়তেই ভয়ের শীতল স্রোত বয়ে গেলো তার। দাদীজান! দাদীজান একা ঘরে। যদি লোকটা তার কোনো ক্ষতি করে দেয়। অরু আর নিজের কথা ভাবতে পারলোনা। দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। গুলবাহারের ঘরের দিকে যাওয়ার আগেই দেখতে পেলো লোকটা বসে আছে সিঙ্গেল সোফাটায়। পায়ের ওপর পা তুলে আয়েশি ভঙ্গিতে বসে অরুনিকার দিকেই তাকিয়ে আছে।

লোকটাকে টপকে তাকে গুলবাহারের ঘরের দিকে যেতে হবে। লোকটার হাতে অস্ত্র। এভাবে ফাঁকা হাতে অরু কিভাবে লোকটার সাথে পেরে উঠবে? অরু অত্যন্ত সাহসিকতার সাথেই লোকটাকে টপকে এগিয়ে যেতেই লোকটা উঠে দাঁড়ালো। সাথে সাথে অরু আরো একটি দুঃসাহসিক কাজ করে ফেললো। তার হাতে থাকা জগটি দিয়ে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে লোকটার মাথায় বারি দিয়ে বসলো। লোকটা মাথায় হাত দিয়ে আর্তনাদ করে পিছিয়ে গেলো। সেই সুযোগে অরু ছুট লাগায়। তবে লোকটার দম আছে অনেক।

ওমন অবস্থায়ও সে অরুর পিছু নিলো এবং ধরেও ফেললো। অরু লোকটার পা বরাবর লাথি দিতেই লোকটা মাটিতে পড়ে যায়। অরু পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু পারেনা। লোকটা অরুর এক পা টেনে ধরে তাকেও মাটিতে ফেলে দেয়। মুখ থুবড়ে পড়ে অরু। বুকে প্রচন্ড ব্যথা পায় সে। লোকটা উঠে এসে অরুকে সোজা করে গাল চেপে ধরে তার। নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ছটফট করতে থাকে অরু। কেমন ফ্যাসফ্যাসে গলায় লোকটা রাগান্বিত স্বরে বলে ওঠে,

–কোথায় পালাচ্ছিস? তোর পালানোর কোনো পথ নেই আজ। আজই তোর শেষ দিন। মরার জন্য প্রস্তুত হ।
অরু লোকটাকে কিল,ঘুষি, থাপ্পড় যা পারছে যেভাবে পারছে মারছে। তবে তাতে লোকটার কিছুই হচ্ছে না। লোকটা একহাতেই অরুর দুইহাত মুঠোবন্দি করে শক্ত করে চেপে ধরে থাকে। নিজের পা দ্বারা অরুর পা দুটো চেপে রেখেছে। অরুর নড়াচড়া আটকে দিয়ে অপর হাতে তুলে ধরে সেই চকচকে ধারালো ছুরি। অরু বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে দেখে। ভয়ে কলিজা শুকিয়ে আসছে তার। চিৎকার করার কথাও ভুলে গেছে সে। কেবল মনে হতে থাকে, সত্যিই বোধহয় আজই তার শেষ দিন।

রূপবানের শ্যামবতী পর্ব ২৮

লোকটা ছুরিটা ওপরে তুলতেই চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে নেয় অরু। শরীরে ধারালো ছুরির আঘাতে হওয়া বিষাক্ত যন্ত্রণার অপেক্ষা করতে লাগলো…

রূপবানের শ্যামবতী পর্ব ৩০