নয়নে লাগিল নেশা পর্ব ৪১

নয়নে লাগিল নেশা পর্ব ৪১
Mousumi Akter

বাড়িতে এসে থম মেরে ফ্লোরে বসে আছে রজনি। খাটের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দুই হাঁটুর মাঝে মাথা গুজে নিশ্চুপ আছে। মস্তিষ্ক ক্রমশ ফাঁকা হয়ে আসছে তার। মস্তিষ্কে সারাক্ষণ প্রান্তিকের দুষ্টুমি, খুনসুটি ভালবাসার স্মৃতিগুলো ভেষে উঠছে।ক্ষণে ক্ষণে কাঁন্না পাচ্ছে তার। হাঁটুর ভাজ থেকে মাথা তুলল।

ঘরের চারদিকে তাকাল। ওয়ালে কোল্ড ড্রিংক্স হাতে থ্রি কোয়ার্টার পরা সমুদ্র পাড়ে দাঁড়ানো প্রান্তিকের ছবি। এলোমেলো চুলে অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছে প্রান্তিক কে। তার পাশের রজনির কাঁধে হাত রেখে রজনির কানে কানে কিছু বলছে প্রান্তিক।সেখানে দুজনের ই হাসি মাখা ছবি। তার অন্য পাশে রজনিগন্ধ্যার বাগানে রজনি ছুটছে প্রান্তিক পিছ পিছ ছুটছে সাডেন ক্লিক করা একটা ছবি। ছবিটা প্রকৃতির মত সুন্দর।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এই রুমের চারদিক শুধু প্রান্তিকের শরীরের গন্ধ।রজনি আবার ও হু হু করে কেদে উঠল।কাঁন্নায় বুক ভেঙে চুরে আসছে তার। প্রান্তিকের কিছু হলে সে এক সেকেন্ড ও বাঁচতে পারবেনা।রজনির আঁখিপটে ভেষে উঠছে বিভিন্ন স্মৃতি। বিয়ের পর একটা দিন ও রজনিকে একা ছাড়েনি প্রান্তিক। যদি রজনি বাবার বাড়ি গিয়েছে প্রান্তিক ও সাথে গিয়েছে। রজনি যে কয়দিন থেকেছে প্রান্তিক ও সে কয়দিন থেকেছে। রজনি কখনো রাগ করলে বলত, ” তোমাকে জড়িয়ে না ধরলে আমার ঘুম ই আসেনা রজনিগন্ধ্যা। তুমি না হয় রোজ নিশিতে নিদ্রা হয়ে আমার চোখে নামো। আমার মুঘের ওষুধ তুমি।”

এই মানুষটার পা’ গ’ লা’ মি হাজার ও স্মৃতি।যাকে ছাড়া রজনির এখন একটা সেকেন্ড ও বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।
রজনি কাদতে কাদতে বলছে, “আল্লাহ ওই মানুষটাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না। ওর মত করে কেউ আমাকে বোঝেনা।আমার জ্বর হলে উ’ন্মা’দ হয়ে যায় ওই মানুষটা। আমার ক্ষুদা লাগলে সবার আগে আমাকে খাইয়ে দেয়, আমার ঘুম পেলে বিছানা ঠিক করে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়,আমার ফেলে রাখা পোশাক ধুয়ে দেয়।

একবিন্দু পরিমান কষ্ট আমাকে করতে দেয়না।যার ভালবাসায় আমি সুখ খজে পায়।যে আমার জীবনে আসার পরে মনে হয়েছে ভালবাসার চেয়ে সুখ শান্তি এই পৃথিবীতে আর কিছুতে নেই।যে মানুষের চোখের চাহনি আমাকে পা’গ’ল করে দেয়, যে মানুষের উষ্ণতা আমাকে এলোমেলো করে দেয়, যে মানুষের স্পর্শ আমাকে অন্যরকম কিছু অনুভব করায় যে মানুষের আদুরে ডাক আমাকে অন্য কোনো পৃথিবীতে নিয়ে যায় সেই মানুষকে ছাড়া আমি কীভাবে বাঁচব।

যদি আগে পরেই যাওয়ার নিয়ম করবে তাহলে কেনো তার বাম পাঁজরের হাঁড়ে আমাকে তৈরি করলে? কেনোই বা সময়ের আগে তাকে আমার থেকে নিয়ে যাবে। হয় আমাদের আয়ু সমান করে দাও নয় ওর সাথেই আমাকে নিয়ে যাও। তা না হলে অনিয়ম করে আমাকেও ওর সাথে চলে যেতে হবে।আমি কল্পনাও করতে পারছিনা আমি মাটির উপরে থাকব আর ও নিচে থাকবে।যে মাটির গন্ধে আমি ওকে খুজে পায়। ও ছাড়া আমার কেউ নেই, কেউ না।”

রজনি কাদছে আর মনের গহীন থেকে আল্লাহর কাছে প্রান্তিকের জন্য প্রার্থনা করছে।এই পৃথিবীর সব কিছুর বিনিময়ে যেন সে প্রান্তিক কে ফিরে পায়।
এমন সময় শিষ দিতে দিতে প্রান্তিক নিজের রুমে প্রবেশ করল। হাতে এক গুচ্ছ রজনিগন্ধ্যা ফুল।রজনিকে ওভাবে ফ্লোরে বসে থাকতে দেখে প্রান্তিকের দু’পা থমকে গেল।প্রান্তিক খুব মোলায়েম কন্ঠে ডাকল, ” রজনিগন্ধ্যা।”

প্রান্তিকের কন্ঠস্বর কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই রজনি প্রান্তিকের দিকে তাকাল।চোখ দুটো কাঁন্নার জন্য লাল রক্তজবার মত হয়ে আছে।প্রান্তিক খালি পায়ে,খালি গায়ে শুধু একটা থ্রি কোয়ার্টার পরে দাঁড়িয়ে আছে।ফর্সা আগে খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে যেন এক সুদর্শন যুবক। রজনির পৃথিবীর শ্রেষ্ট সুদর্শন পুরুষ প্রান্তিক চৌধুরী। পৃথিবীর শ্রেষ্ট প্রেমিক পুরুষ প্রান্তিক চৌধুরী।

তার মত করে কেউ ভালবাসতে পারেনা,তারমত করে কেউ ভালবাসার মানুষের যত্ন নিতে জানেনা।রজনি প্রান্তিকের দিকে তাকাতেই যেন ভেতর থেকে আরো জোরে কাঁন্না আসছে।রজনির এ অবস্থা দেখে প্রান্তিকের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে এল।সব ঝামেলা মিটে যাওয়ার পরেও কেনো রজনি কাদছে। প্রান্তিক মলিন মুখে বলল, ” কি হয়েছে আমার রজনিগন্ধ্যার।”
রজনি উঠে ছুটে গেল প্রান্তিকের কাছে। প্রান্তিকের উন্মুক্ত বুকে মুখ গুজে হাউ মাউ করে কাঁন্নায় ভেঙে পড়ল।প্রান্তিক অবাক হয়ে গেল। এই কাঁন্নার কারণ সে বুঝে উঠতে৷ পারছে না। প্রান্তিক নিজের দুই কান ধরে বলল,

” এইযে দেখো! তাকাও আমার দিকে সুইটহার্ট।কোনো ভুল করলে ক্ষমা করে দাও আমাকে। আমি জানিনা কি অন্যায় করেছি। কিভাবে আমার প্রাণপাখিটাকে আহত করেছি। আমার অজানা ভুলের জন্য আই আম রিয়েলি সরি। তুমি ভাইলে আমি তোমার সামনে সারা শহরের মানুষের সামনে কান ধরব। ”

রজনি আরো জোরে কেদে দিয়ে বলল,” আপনাকে আমি ভালবাসি প্রান্তিক চৌধুরি। নিজের চেয়েও বেশী ভালবাসি। আপনি ছাড়া চারদিক শূন্য লাগে আমার। আমাকে রেখে কোথায় চলে গেছিলেন আপনি।”
প্রান্তিক রজনিকে শক্তভাবে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল, ” ভাবলাম কি অন্যায় করে ফেললাম আমার রানির কাছে। একদম ই ভ-য় পেয়ে গেছিলাম। আমিতো এর চেয়ে আরো বেশী সময় ও বাসার বাইরে থাকি রজনিগন্ধ্যা। কই তুমিতো তখন রাগ করোনা।আজ সামান্য দুই ঘন্টার জন্য এভাবে কাঁন্নাকাটি করছো কেনো?”

” আপনি এক সেকেন্ড ও দূরে যাবেন না আমার থেকে।আমি আপনাকে দূরে যেতে দিবনা।”
” উফস! এইভাবে জড়িয়ে ধরে কাঁন্নাকাটি করে ভালবাসি বললে পা-গ-ল হয়ে যাবোতো রজনিগন্ধ্যা।তোমার চোখের দিকে একবার তাকালেই যেখানে প্রান্তিক চৌধুরী নেশাক্ত হয়ে যায় সেখানে তুমি এভাবে জাপটে ধরে ভালবাসি বললে প্রান্তিক চৌধুরী নির্ঘাত পা-গ-ল হয়ে যাবে।”

প্রান্তিকের কথা শেষ হতেই রজনি দুই পায়ের বুড়ি আঙুল ভর দিয়ে প্রান্তিকের গালে,ওষ্টে বেসামালভাবে চুমু দিয়ে বলল, “আমাকে কথা দিন আমাকে কখনো একা করে হারিয়ে যাবেন না। আমি তাহলে ম’ রে যাবো।”
রজনির আবেগ ভরা কন্ঠে প্রান্তিকের হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করল।রজনি তাকে এত ভালবাসে সে কখনো টের ও পায়নি।আচমকা রজনির এই জড়িয়ে ধরা,চুমু দেওয়া সব ই যেন অদ্ভুত লাগছে প্রান্তিকের কাছে।রজনিকে একটা চুমু দিতে কত কৌশল করা লাগে প্রান্তিকের।একটু জড়িয়ে ধরতে কত রাগ দেখা লাগে।সেই মেয়েটার আজ এত পা-গ-লামি।এই পা-গ-লা-মির জন্য প্রান্তিক বলল,

“আমার যা সর্বনাশ বাকি ছিল তা আজ হয়ে গিয়েছে রজনিগন্ধ্যা। দূর্বলতার যেটুকু কমতি ছিল তা আজ পূর্ণ হল। তোমার ছোঁয়ার যাদু আছে রজনিগন্ধ্যা, তোমার ভালবাসায় মাদকতার ছোঁয়া আছে যা সিগারেটের চেয়েও নেশাক্ত।”
রজনি হুহু করে কাদছে। প্রান্তিক রজনিকে পাজা কোলে তুলে বিছানায় বসিয়ে দিল।রজনির সামনে বসে ওর চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,” যে চোখের চাহনি প্রান্তিক চৌধুরীকে বারংবার এলোমেলো করে দেয় সেই চোখের অশ্রু প্রান্তিক চৌধুরীকে মৃত্যু যন্ত্রণা দেয়।শ্বাসরুদ্ধকর যন্ত্রণা দেয় রজনিগন্ধ্যা।আই লাভ ইউ রজনিগন্ধ্যা।”

রজনি প্রান্তিকের হাত দু’টো শক্ত করে ধরে বলল,
” এত ভালবাসা কি আমার কপালে সইবে? ”
প্রান্তিক রজনিগন্ধ্যার ফুলের তোড়া রজনির হাতে দিয়ে বলল, ” সইবে! তুমি চাইলে সম্ভব হলে আকাশের চাঁদ ও এনে দিতাম।”

” কিচ্ছু দিতে হবেনা।শুধু কথা দিন আমার হাত ধরে বৃদ্ধ হবেন আপনি। আপনার বুকে মাথা রেখে যেন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারি।”
প্রান্তিক রজনির কপালে চুমু দিয়ে বলল,
” কথা দিলাম বৃদ্ধ হবো তোমার সাথে।” রজনি প্রান্তিকের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলছে, ” আপনার এই সরল স্বীকরোক্তি কি আপনি রাখতে পারবেন? আপনি কি জানেন আপনার ভেতরে মরণ ব্যাধি ক্যান্সার। এই ভয়ানক কথাটা আপনাকে আমি জানতে দিবনা।”

তখন বিকাল।প্রান্তিক শ্রাবণের নাম্বারের ফোন দিচ্ছে।ফোনটা সুইচ অফ বলছে।কোথায় গেল শ্রাবণ? শ্রাবণ ছাড়া জীবনের একটা পা ও যেন প্রান্তিক চলতে পারেনা।শ্রাবণের প্রতি যে ভীষন ভালবাসা প্রান্তিকের শ্রাবণ নিজেও জানেনা।শ্রাবণের জন্য তৈরি করা বিশাল আলিশান বাড়ি করেছে প্রান্তিক।শ্রাবণ তখন জানত ও না বাড়িটা কার জন্য। শ্রাবণ ভেবেছিল বাড়িটা প্রান্তিক নিজের জন্য বানাচ্ছে।প্রান্তিক শ্রাবণের পছন্দেই বাড়িটা বানিয়েছিলো।সুন্দর একটা ডুপ্লেক্স বাড়ি। বাড়িটা করার সময় শ্রাবণ বলল,

নয়নে লাগিল নেশা পর্ব ৪০

” ভাই যেদিন অনেক টাকা হবে আমিও এমন একটা বাড়ি বানাব।বাড়ি বানিয়ে বউ নিয়ে থাকব।”
প্রান্তিক তখন মনে মনে হাসত আর বলত কি সারপ্রাইজ দিই তোকে দেখিস।আজ সেই বাড়িটা সম্পূর্ণ হয়েছে বাড়ির নাম দিয়েছে শ্রাবণ কটেজ।বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে প্রান্তিকের আজ ভীষণ মন খারাপ।শ্রাবণ যদি না দেখে এই বাড়িটা তার জন্য তাহলে সব কষ্টই বৃথা যাবে।বাড়িটার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল প্রান্তিক।

নয়নে লাগিল নেশা পর্ব ৪২