লীলাবালি পর্ব ৭৩

লীলাবালি পর্ব ৭৩
আফনান লারা

ডাক্তারের কথা শুনে ভীষণ খারাপ লাগা নিয়ে বসে আছে সবাই।তার মতে চিকিৎসাতে কোনো ভাল লক্ষণ দেখা যাচ্ছেনা।বাসায় রাখলে যেটা হতো এখনও তাই।
এর চেয়ে বাসায় থাকা ভাল মনে করে অর্ণব ওকে বাসায় নিয়ে এসেছে।তার বাবা মা আর কুসুমের বাবা মা রওনা হয়েছেন ঢাকার উদ্দেশ্যে।এতক্ষণ বাসায় মৃদুলের গোটা পরিবার থাকলেও এখন কেউ নেই।দুজন একা।

কুসুম হাতে পোড়া রুটি নিয়ে দেখছিল,অর্ণব বানিয়েছে।ও বাহিরের খাবার আনতে বলেছিল কিন্তু কুসুমই মানা করেছে।এদিকে মৃদুলেরা যে খাবার পাঠিয়েছে তা কুসুম খাবেনা।খাসির মাংস আর চালের গুড়া দিয়ে রুটি।এগুলো কুসুম খায়না।
অর্ণব তাই কাঁচা হাতে গমের আটার রুটি বানিয়েছিল।তাও পুড়িয়ে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তারপরেও কুসুুম হাসি মুখে রুটিটা হাতে নিছে খাবে বলে।অথচ রুটির চেহারা দেখে তার খেতে মন চাইছেনা।কিন্তু অর্ণবের ঘাম ঝরা মুখ দেখে এক টুকরো রুটি মুখে তুললো সে।অর্ণব ওর থেকে কেড়ে নিতে চাইলো রুটিটা কিন্তু সে দিলো না।সে খাবেই।
কপালের ঘাম মুছতে গিয়ে ওর চোখ গেলো কুসুমের জট বাঁধা চুলের দিকে।কাঁপা হাতে চিরুনিটা নিয়ে বসে গেলো ওর ঠিক পেছনে।ধীরে ধীরে মাথায় চিরুনি দিয়ে আঁচড়ে জট খুলছিল সে।যেন আঁচড়ে ওর মাথা খালি করা হচ্ছে।

মোটা করে চুল ছুটে আসে সব।এসব দেখে অর্ণব হাত থেকে চিরুনি ফেলে দিলো।কুসুম রুটি চিবোতে চিবোতে বললো,’মেহমান আসবে বাসায় তাই চিরুনি পড়ে গেছে’
অর্ণব উত্তর দিল না।আবারও চিরুনিটা তুলে আঁচড়াচ্ছে।এত সুন্দর চুল কগুলোকে ঝরে পড়তে দেখে মোটেও ভাল লাগছেনা তার।কুসুম রুটি রেখে কাছ থেকে বইখাতা গুলোকে টেনে এনে পাতা উল্টাচ্ছে।অর্ণব আস্তে আস্তে সব জট খুলে সুন্দর করে বেনি করে দিছে ওর চুলে।তার কাজ শেষ হতেই কুসুম ওর দিকে ফিরে বসে বললো,’আমাকে একটু পড়াবেন?আমাকে চিঠি লেখা শিখিয়ে দেবেন?খুব দরকার’

অর্ণব এখন আর ওর কোনোকিছুতে না বলার সাহস পায়না।কুসুমের এই আবদারটাও সে ফেললোনা।বই হাতে নিয়ে ওকে পড়াতে চাইলো অথচ তার পড়ানো হচ্ছেনা।মন খারাপ নিয়ে কাউকে পড়ানো গেলেও বোঝানো সম্ভব নাহ।কুসুমকে সে বোঝাতে পারছেনা কিছু তার পরেও কুসুম মনযোগ সহকারে ওর পড়াগুলো রপ্ত করছে।যেন মুখস্ত গণিতের মতন।

অর্ণব আধ ঘন্টার মতন পড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেছে।কুসুম নিজে নিজে লেখার চেষ্টা করছে এবার।
মমর আজকে এঙ্গেজমেন্ট হবার কথা ছিল,কিন্তু কুসুমের শরীর খারাপ নিয়ে পুরো বাড়িতে অসুখের ছায়া পড়ায় তারা কোনো অনুষ্ঠানে জড়াতে চাইলেননা,মানাও করলেননা।বললেন এক সপ্তাহ কেটে যাক,সবাই আয়োজন করুক।

গুছিয়ে নিক তারপর নাহয় হবে।তাড়াহুড়োর কিছু নেই।জিসানের পরিবারও মেনে নিলো।
অর্ণব বারান্দার ফ্লোরে বসে জবা গাছটা দেখছে।চোখ গাছটার দিকে রইলেও তার মন রয়ে গেছে রুমটার দিকে,কুসুমের ওপর।

কি করলে তাকে আগের জীবন দেওয়া যেতে পারে তার কোনো সমাধান খুঁজে পাওয়া না গেলেও সে সারাটাক্ষণ ভাবে কি করে আশ্চর্য ঘটনা ঘটানো যায়।যেটা কেউ ভাবতে পারবেনা সেটা।
অর্ণবের বাবা মা আর কুসুমের বাবা মা তখন মৃদুলদের বাসার সামনে গেট দিয়ে ঢুকছিলেন।তারা সবাই ওকে দেখেছেন বারান্দায় বসা অবস্থায়।তার ফ্যাকাসে মুখ দেখে সবার মনে ভয় জাগলো কুসুমকে নিয়ে।দেরি না করে পা চালিয়ে দ্রুত হেঁটে তারা দোতলায় চলে আসলো।কলিংবেলে চাপ দেওয়ার পর সেই আওয়াজ অর্ণব না শুনলেও কুসুম শুনেছে। সে ধীর পায়ে এসে দরজা খুলে দিলো।

ওর মা ওকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছেন।কান্নার ঢল লেগে গেলো সম্পূর্ন দোতলা জুড়ে।অর্ণব এখনও মনমরা হয়ে বসে আছে আগের জায়গায়।জাহান এত কান্নার আওয়াজ শুনতে পেয়ে অর্ধেক সিঁড়ি পর্যন্ত উঠে এসেছে দেখবে বলে।

মানুষের কান্নার আওয়াজে এক রকম বস্তু আছে যেটা কিনা চারপাশটাকে স্তব্দ করে ফেলতে পারে।চারপাশের মানুষের হাসি কেড়ে নিতে পারে।কারোর ডুকরে কান্না দেখে আপনি কখনওই হাসতে পারবেননা।জোর করে হাসলে সেটা অন্য কথা।কিন্তু মন থেকে হাসি আপনার আসবেনা।কারণ আপনি মানুষ,সেও মানুষ।

মানুষের কান্নায় আপনি হাসতে পারবেননা।সবসময় হাসিখুশি থাকা জাহান মেয়েটার বয়স পনেরো বছর।তার বাবা মা আছে তবে অনেকদূরে থাকে।ঈদের সময় সে তাদের দেখতে যায়।
কাজল দেওয়া খুব পছন্দ তার।এই কাজলই তার মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখে সবসময়।কিন্তু আজ সকাল থেকে তার একবারও কাজল দেওয়া হয়নি।যার কারণে কান্নার দৃশ্য দেখে দেখে ওর মুখের হাসি গায়েব হয়ে গেছে।উপরের সিঁড়িতে আর গেলোনা।বরং পিছিয়ে গেলো।চুলায় ডাল বসিয়েছে।ওটা ফুলে ফেঁপে পড়ে গেলে বসে বসে চুলা মাজতে হবে।ঝামেলা হবে ভেবে দেরি না করে সে চলে গেলো।

খাবার নিয়ে আর ভাবতে হচ্ছেনা অর্ণবকে।রান্নাঘরটাকে ব্যস্ত করে তুলেছেন দুজন মা মিলে।
অর্ণব কারোর সাথেই কথা বলছেনা।এমন কি কুসুমের সাথেওনা।ওর একটা অসুখ পুরো বদলে দিলো তার ব্যবহারের আকার আকৃতি।

এরকম নিশ্চুপ সে কখনওই ছিলনা।কুসুম একবার রান্নাঘরে তো একবার বাবার কোলে নয়ত কলির সাথে হাসির গল্প জুড়িয়ে নিলেও শেষটাতে অর্ণবের সাথে দু দণ্ড কথা বলার কমতি অনুভব করে।কয়েকবার পেছন থেকে দেখেও এসেছে। তার খুব করে ইচ্ছে হয় ওর সামনে থাকতে কিন্তু যেহেতু ওর এই ইচ্ছেটা নেই তাই সে আর বিরক্ত করেনা।দূর থেকেই দেখে।
দুপুরে সবাই একসাথে খেতে বসে ওকেও ডেকেছিল।সাড়া না পেয়ে মা কুসুমের হাতে প্লেট দিয়ে বললেন ওর কাছে যেতে।

মা বললে সে নানান বাহানা দিয়ে খাবারটা আর খাবেনা। তাই কুসুম মায়ের কথামতন প্লেট নিয়ে ওর কাছে এসেছে।নিরামিষ তরকারি,ডাল আর বড় মাছের ঝোল।সব একসাথে সাজানো প্লেটতাতে।সুগন্ধ ছড়িয়ে গেছে গোটা বারান্দায়।কুসুম ওর পাশে নিচে বসে ঘ্রান নিয়ে বললো,’এই ঝোলটা আমার মা করেছে,কারণ গোটা গোল মরিচ দেয়া।মা ঝোল করলে গোটা গোলমরিচ দেয়।
আর নিরামিষটা মনে হয় আপনার মা করেছেন,সেটা বোঝারও উপায় আছে।তা হলো হলুদ দেননি।তিনি নিরামিষ তরকারিতে হলুদ দেননা জানি।’

এরপর নিরামিষ তরকারিতে বেগুনের টুকরোর সাইজ দেখে কুুসুম হেসে ফেললো।এই তরকারিটা নিশ্চয় কলি কেটেছে।ও এমন ত্যাড়াব্যাঁকা করে সবজি কাটে।অর্ণব ওর দিকে ফিরে বললো,’আমি খাইয়ে দেবো?’
‘এটা আপনার জন্য এনেছি’
‘আমার তো খিধে নেই’

‘আপনার চোখের নিচের কালি দাগ তুলে আমি কাজল লাগাতে পারবো।ভাবুন আপনার কি হাল হয়েছে না খেয়ে,না ঘুমিয়ে।আমি খাইয়ে দিই আপনাকে?’
‘লাগবেনা।দাও আমি তোমায় খাইয়ে দিচ্ছি’
‘কাতল মাছ পছন্দ নাহ আমার।এই সাজানো প্লেট আপনার জন্য আনা।আমি খাইয়ে দিই?’
অর্ণব আর কিছু বললোনা।কুসুম নিরবতাকে সাঁই মনে করে লোকমা সাজিয়ে ওর মুখের সামনে ধরেছে।

ডিভানে চিৎ হয়ে শুয়ে হাতে ম্যাগাজিন নিয়ে সেটার কাহিনীতে ডুবে ছিল জুথি।নানু ওর মাথায় কিসের যেন ক্যামিকেল লাগিয়ে দিয়েছেন।এটা দিলে নাকি চুল সিল্কি থাকে।
আর মা রান্নাঘরে।
ম্যাগাজিনের পাতা উল্টিয়ে জুথি বললো,”মা জানো,মোরকো আমায় প্রোপোজ করলো’
‘তাই নাকি!তা আমার মেয়ে কি বলেছে?’

‘দেশে একটাকে রেখে এসেছি।মোরকোকে মেনে নিলে সেই পাগল এবার পাগল হওয়াতে শ্রেষ্ঠ পাগল হবার এওয়ার্ড জিতে নেবে’
‘তাহলে কি করবেন আপনি ম্যাডাম?’
‘কাউকেই মেনে নিচ্ছিনা আপাতত। আমি নিজেকে নিয়ে ভাল থাকতে চাই।নিজে ভাল থাকলে আরেকজনকে ভালবাসতে পারবো অনায়াসে।তাছাড়া নিজের দেশের ছেলে বেশি ভাল হবে আমার জন্য।’

‘তোর তো নিজের বলতে দেশ আবার দুটো।মায়ের পক্ষের আর বাবার পক্ষের।
কোনটার ছেলে বেছে নিবি?’
জুথি ম্যগাাজিন রেখে নিজের রুমের দিকে যেতে যেতে বললো,’মৃদুল ভাইয়াকে পাগল হওয়ার এওয়ার্ড জিততে দেবোনা’

“লিখ…মৃদুল ভাইয়া।আমার রক্তের সম্পর্কের ভাই।কলিজার টুকরা,জানের জান!এই মানুষটাকে নিয়ে যত বেশি বলা হবে ততই কম মনে হবে।মানে এটা কি!!এত ভাল মানুষ হয়!
যার কপালে জুটবে সে জিতবে।’
মম কপাল কুঁচকে বললো,’আমি তোর এত কমপ্লিমেন্ট দিতাম?এর বদলে কি দিবি আমায়?’
‘পোস্ট দে।তারপর বলছি’

‘আগে ডিল’
‘একটা প্যাকেজ দেখেছিলাম।লাল শাড়ী,লাল চুড়ি,লাল টিপ,লাল কানের দুল।ঐ সেটটা তোর নামে অর্ডার করে দিব।এবার পোস্ট দে’
‘ মৃন্ময়ীকে ট্যাগ দেবো?’
“তুই কি ছ্যাসড়া?ও কি ভাববে!’

‘এই যে আমাকে দিয়ে পোস্ট দেওয়াচ্ছিস এটা তো ছ্যাসড়ামি আল্ট্রা প্রো ম্যাক্স হলো তাহলে’
‘চুপ থাক।একদম জিসানকে বলে দেবো তুই ১০বছর বয়স পর্যন্ত রাতে ডায়পার পরতি’
‘ভাইয়া তুই একটা!!’
মৃদুল দাঁত কেলিয়ে ছুটলো বাহিরের দিকে।

‘আপনি কি আমার উপর রেগে আছেন?’
“রাগ হবার তো কিছু নেই’
‘তবে দূরত্ব বজায় রাখার কারণ কি?আগে তো এমন ছিলেননা।আমি কি কোনো ভুল করেছি?’
‘তোমায় বোঝানোর ক্ষমতা আমার নেই।চেয়েও সঠিক সংজ্ঞায় বোঝাতে পারবোনা বলে বোঝাতে আসিনা।জানি তুমি ভুলটাই বুঝবে।তবে আমি তোমার দোষে দূরে থাকছিনা।আমার নিজের দোষে থাকছি”

লীলাবালি পর্ব ৭২

‘আপনার কি দোষ?’
‘আমার দোষ হলো, আমি তোমার অসুখের ব্যাপারটা নিতে পারছিনা।আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে,স্বাভাবিক হতে পারছিনা।’

লীলাবালি পর্ব ৭৪