লীলাবালি পর্ব ৮৯

লীলাবালি পর্ব ৮৯
আফনান লারা

ভাইয়ারা আসতে সেদিন অনেক দেরি করেছিল,বলতে গেলে রাত দশটা বাজিয়ে ফেলেছে।
কত সুন্দর ছিল সেই রাত।দশটা অবধি আমার প্রেম রাত।আমার লীলাবালিকে আমি সেদিন সাহস এনে ছুঁয়েছিলাম।সে জানতো না তাকে আমি আজই ছুঁবো।সে শুধু জানতো আমি তারে সুন্দর কিছু মূহুর্ত উপহার দেবো।সেই মূহুর্ত গুলো কিরুপ হবে সেটা সে জানতোনা।

আমার লীলাবালি ছিল স্বচ্ছ কাঁচের মতন, তার ভেতরটা সামনে থেকে বোঝা যেতো।আফসোস!এই স্বচ্ছ শব্দটাকে উপলব্ধি করতে আমার বড্ড দেরি হয়ে গেলো!
তাকে একবার ছুঁয়ে আমি আরও কতবার যে ছুঁয়েছি!কারণে!অকারণে।
সে লজ্জা পেতো,ভীষণ লজ্জা পেতো।যার হাত ধরলে গাল দুটো তার লাল হয়ে আসতো তাকে সম্পূর্ণটা ছুঁলে তার কি অবস্থা হতে পারে আমি কল্পনাও করিনি।যেটা কল্পনা করেছি তার চেয়ে বেশিই দেখেছিলাম।সে অনেক বেশি লাজুক।আমার লাজুক হওয়ার কাছে তার ঐ লাজুকতা বিশাল।
তাকে আপন করে নেবার সেই দিনটি ছিল ১৪তারিখ।এরপর আমি তারে বহুবার ভালবেসেছি।নানা কারণ দেখিয়ে তাকে ভালবেসেছি।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

১৪ তিনগুনে কত হয়?৪২ হয়।প্রায় ৪২ টা দিনের মতন তাকে আমি নানারকম ভাবে ভালবেসেছি।যেন বৃদ্ধ বয়স হবা অবধি মানুষ যতটা ভালবাসে তার সঙ্গীকে আমি ঐ ৪২দিনে তাকে প্রাণ উজাড় করে বেসে গেছি।যেন আমি জানতাম সে আমার থাকবেনা।এই রুমের দোলনায় আর সে দুলবেনা!তার ঠোঁটের স্বাদ আমার আর কোনোদিন নেওয়া হবেনা।আমার না এত বেশি কষ্ট হতো না!!একটু কম কষ্ট হতো যদি না জানতাম তার পেটে আমার অনাগত সন্তান ছিল।তার বয়স কত হবে?জানিনা!১৪তারিখের প্রেমের ফল হিসেবে সে কবে এসেছিল কে জানে!কুসুম কবে জেনেছিল হয়ত সেটাও জানিনা।মিশু ভাবী ওর প্রেগন্যান্ট হবার খবর আমায় আজই দিলো।আশ্চর্য কর হলেও সত্যি যে আমি খুশি হইনি, একটুও হইনি।

কুসুম জানেনা প্রেগনেন্সি কিটে ঐ দুটো লাল দাগের মানে কি!
বমি হওয়া তো শুরু থেকেই ছিল,কিন্তু তার শরীর তাকে অন্য কিছু বলতো সারাক্ষণ। এর উত্তর সে জানতে চাইলো মিশু ভাবীর থেকে।ভাবী মুচকি হেসে তাকে প্রেগনেন্সি কিট ধরিয়ে দিয়েছিলেন।নিয়ম মত সে টেস্ট ও করিয়েছিল।আমার পাগলামো আর বাসার কাজের ব্যস্ততা তাকে ঐ কিট আলমারিতে তুলে রাখতে বাধ্য করেছিল।সে জানেও না ঐ কিটের অর্থ কি।যদি একবার আমায় বলতো!!

হাহ!!বললেও কি!আমি কারে ধরে রাখতে পারতাম?এত কষ্ট একদিনে কেনোই বা পেলাম?কি দোষ করেছিলাম আমি?তারে ছাড়া আমার দম বন্ধ হয়ে আছে সে কি তা জানেনা?তাহলে কেন সে চলে গেলো?তার নিথর দেহটা কেন সবাই বারবার ঢেকে দিচ্ছে।আমি তাকে কেন ছোঁয়ার সাহস আজ পাচ্ছিনা।অথচ সেদিন সাহস করে ছুঁয়েছিলাম,,তাহলে আজ আমার ঐ সাহস আসছেনা কেন?

পাসপোর্ট তো এসে যাবে কাল পরশু শুনলাম।তাহলে আর কটাদিন সে বেঁচে থাকলে কি হতো?
কেন সে আমার বুকটা জ্বালিয়ে চলে গেলো!!তাও এভাবে!আমার তাকে চাই।সে যেন নাটক বন্ধ করে আমার সামনে এসে মাথায় হাত বুলায়।আমি তার চলে যাওয়া মেনে নিতে পারছিনা।আমার সন্তানের এভাবে চলে যাওয়া আমি কিছুতেই মানতে পারছিনা!

মিশু ভাবী কাঁদতে কাঁদতে বাবা মায়ের সামনে পানির গ্লাসের ট্রে রেখে বললো,’মা!জানাজা তো কিছু সময় পর।
অর্ণব ভাই কি মুখে কিছুই দেবেননা?উনার তো কিছু খাওয়া হয়নি ভোর থেকে।’
মা মলিন মুখে একবার রুমের দিকে তাকালো।অর্ণব কুসুমের দেহটাকে কাউকে ছুঁতে দিচ্ছেনা।তার সামনে বসে আছে মূর্তির মতন।
সেসব দেখে মা আঁচল দিয়ে মুখ মুছে বললেন,’ও কিছু খাবেনা।তুমি কুসুমের মাকে কিছু খাওয়াতে পারো কিনা দেখো।উনি তো প্রায় পাগল হয়ে যাচ্ছেন’

‘আমি জানি তুমি ঘুমাচ্ছো।এখনই উঠবে আর হাসবে।জবা ফুল ছিঁড়ে কানে দেবে।কি হলো দেবে না?জানো আমি কাল গাছে একটা বড় জবার সন্ধান পেয়েছি।ডখনও ভালমতন ফোটেনি বলে আমি ছিঁড়ে আনিনি।এখন হয়ত ফুটেছে।তুমি উঠে বসো,আমি এক্ষুনি নিয়ে আসছি’
অর্ণব চট করে উঠে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে ছুটে গেলো বাগানের দিকে।গাছের ফুলটা ছিঁড়ে দ্রুত আসতে গিয়ে পড়ে গেলো সিঁড়িতে

মৃদুল ওর বুক চেপে ধরে দাঁড় করিয়ে বললো,’ভাই শান্ত হ।এভাবে করলে তুই নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়বি’
অর্ণব মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,’তাই হোক।আমি চাই আমার অসুখ হোক।মরণব্যাধি হোক।আমি চলে গিয়ে তারে আরও একটিবার দেখবো।তার চোখের পলক ফেলা দেখবো।আমার যে এখনও তাকে দেখার সাধ পূর্ণ হয়নি।তার আগেই সে চলে গেছে।এটা ঠিক হয়নি।আমি আরও ভাল করে তাকে দেখবো,তার জন্য আমায় মরতে হবে মৃদুল’
অর্ণব হাতটাকে মৃদুলের থেকে ছাড়িয়ে চলে গেলো।জুথি সেসময়ে এসেছে।মৃদুল ওকে দেখে কিছু বললো না।অর্ণবের অবস্থা সে দূর থেকে দেখছিল এতক্ষণ।

মৃদুলের কাছে এসে বললো,’আমার কি যাওয়া ঠিক হবে এখন?’
‘কয়েক মিনিট পরে যেও।জানিনা ও কখন নিজেকে সামলে নিতে পারবে।কুসুম প্রেগন্যান্ট ছিল এ কথা জানার পর থেকে পাগলামো করছে।আমরা কেউ ওকে সামলে নিতে পারছিনা।’
‘বাহিরে জবা গাছটার নিচে দেখলাম কবরের জায়গা তৈরি করা হচ্ছে।ওখানে কবর দেবে?’

‘হুম।কুসুমের ইচ্ছে ছিল সেটা।মেয়েটা খুব মায়া দিয়ে গেলো তাই না?আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে।আফসোস আমি কাঁদতে জানিনা।মনে হয় আমার রক্তের সম্পর্কের কেউ মারা গেলো।ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে’
জুথি মৃদুলের মুখে দিকে চেয়ে বললো,’আমিও ঠিক আপনার মতন।কাঁদতে চেয়েও পারছিনা।তবে ভেতরটা পুড়ছে।কুসুমকে কখনও খারাপ ভাবিনি,ওর সাথে কোনো শত্রুতাও ছিলনা।মেয়েটা ভীষণ ভাল ছিল।ভালোদের সাথে এমন কেন হয়?।বিদেশে গেলে রোগটা ভাল হয়ে যেতো নিশ্চিত।’

‘আমি ভাবছি অর্ণবের কথা।তার অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। ওর এভাবে ভেঙ্গে পড়া আমি মেনে নিতে পারছিনা।ও আমাদের কাউকে নিজের ধারে কাছেও ঘেঁষতে দিচ্ছেনা।’

‘কাল রাতেও তো মেয়েটা আমার হাতে ভাত খেয়েছে আপা!তাহলে সকালের রুটিটা খাওয়া পর্যন্ত কেন থাকলোনা আপা!!আমার মেয়েটার কপালে এটা কেন ছিল!!আমার মেয়ের এই রোগ কেন হতে গেলো আপা একবার বলবেন?আমি যে আর সইতে পারতেছিনা’

অর্ণবের মা কুসুমের মায়ের মাথায় হাত রেখে চুপ করে আছেন।সকাল থেকে হাজারটা সান্ত্বনা দিয়েও কোনো লাভ হয়নি।সবার এক কথা।কুসুমের এভাবে চলে যাওয়া ঠিক হলোনা।একদম ঠিক হলোনা।
কলি অর্ণবের রুমের দরজার কিণারায় দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ যাবত।ভেতরে ফ্লোরে অর্ণব বসে কুসুমের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ফিসফিস করে কিসব বলছে।বুবুকে শেষবারের মতন জড়িয়ে ধরতে অনেক ইচ্ছে হচ্ছিল কলির।কিন্তু অর্ণবের কারণো রুমে পা রাখতে পারছেনা।ওকে সবসময় সে ভয় করে।

কিন্তু কুসুমের ফ্যাকাসে মুখ তাকে আর বাহিরে থাকতে দেয়নি।ছুটে এসে মেঝেতে বসে পড়লো সে।ওর বুকে মাথা রেখে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো। অর্ণব কলির কান্না দেখে বললো,’কাঁদো,বেশি করে কাঁদো।তোমায় কুসুম অনেক ভালবাসে।সে নিশ্চয় নাটক করা বন্ধ করে হাসিমুখে তোমায় জড়িয়ে ধরবে এখন।জোরে কাঁদো কলি।দেখো আমি জবাটা ওর কানে গুজে দিচ্ছি কিন্তু থাকছেনা।বারবার পড়ে যাচ্ছে।তুমি চেষ্টা করে দেখো তো কুসুমের মান ভাঙতে পারো কিনা?সে মনে হয় জবাটা নিতে চাইছেনা’

কলির আরও বেশি কষ্ট হচ্ছে অর্ণবের পাগলামো দেখে।অর্ণব যেন তার বোধজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।কিরকম উদ্ভট কথা বলছে।ওর এই হাল দেখে কলির আরও বেশি খারাপ লাগলো।
কুসুমের মৃত্যু আরও বেশি করে আঘাত হেনেছে অর্ণবের বাবার উপর।এই সহজ,সরল অবুঝ মেয়েটাকে নিজের ঘরের আলো করে আনতে সবচাইতে বেশি যদি কেউ লড়ে থাকে তবে সেটা তিনি।ওর মৃত্যু তাকে এমন চমকে দিয়েছে যে শুরুতে যে জায়গায় তিনি ছিলেন ঐ জায়গাতেই বসে আছেন এখনও।তার বিশ্বাস হচ্ছেনা কিছু।কাল বিকেলে এই মেয়েটা তাকে চা করে খাইয়েছিল।চিনি অনেক কম দিয়েছিল তার উত্তরে তিনি বলেছিলেন এ বয়সে চিনি কম খাওয়াই ভালো।সে যেন চিনি কন দিছে বলে নিজেকে দোষারোপ না করে।

দরজার ওপারে জুথিকে দেখে কলি চিনতে পারেনি।তাও আত্নীয় ভেবে সরে দাঁড়িয়ে জায়গা করে দিলো ওকে।জুথি অর্ণবের পাশে মেঝেতে বসে কুসুমের মুখ থেকে চাদরটা সরাতে যাওয়া ধরতেই অর্ণব ওর হাত আটকে ফেললো।তারপর জুথির মুখ দেখে হাত ছেড়ে দিয়ে একটু সরে বসলো।জুথি জানলোনা ও কেন প্রথমে আটকেছিল।সে কুসুমের মুখের দিকে তাকিয়ে আর কান্না ধরে রাখতে পারেনি।নিঃশব্দে কেঁদে ফেলেছে।কেঁদে কেঁদে বললো,’কেমন করে হলো এসব?’

অর্ণব যেন ওর কথা শোনেনি।সে কুসুমের আলতা রাঙা পা জোড়া দেখছিল মনযোগে।মৃদুল তখন দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিল, সে বললো,’ভোরে অর্ণবের চিৎকার শুনে সবাই একজোট হবার পর জানতে পারলাম কুসুম চোখ খুলছেনা,সারা শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আছে।হার্টবিট অফ।ডাক্তার ডেকে জানতে পারলাম…..
কালকেও বেশ ভাল ছিল।।মৃত্যুর আগে মানুষ হঠাৎ সুস্থ হয়ে যায়।তারপর মারা যায় হঠাৎ করে।এই সত্যটা আমরা ভুলে গিয়েছিলাম।ভেবেছি রোগ সেরে যাবে অনায়াসেই।

এভাবে কুসুম চলে যাবে আমরা কেউ স্বপ্নেও কল্পনা করিনি।ভেবেছি বিদেশী চিকিৎসায় সব ঠিক হয়ে যাবে।এভাবে জীবন থেকে একজনের চলে যাওয়া মেনে নিতে গিয়ে মনে হয় সব কল্পনা’
অর্ণব ঘাড় ঘুরিয়ে বললো,’একজন না তো!দুজন।
তারা দুজন চলে গেছে একসাথে।আর আমায় রেখে গেছে স্মৃতি নিয়ে যুদ্ধ করতে ‘

লীলাবালি পর্ব ৮৮

(যদিও এটা শেষ পর্ব না তাও বলছি হ্যাপি ইন্ডিং দিলে এই উপন্যাসের মাধুর্যতা কমে যেতো।কারণ শুরু থেকে এই বিচ্ছেদ আসবে বলেই প্রতিটি পর্ব তৈরি হচ্ছিল।
কিছু সুন্দর বিচ্ছেদের কারণে আসে।আশা করি আপনারা বুঝতে পারবেন।)

লীলাবালি পর্ব ৯০

1 COMMENT

Comments are closed.