পূর্ণিমাতিথি পর্ব ৩৭

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ৩৭
লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া

তোমার আমাকে মানুষ মনে হয় না। আমার সাথে যা ইচ্ছে তাই করা যায় তাই না? তুমি কেনো বুঝতে পারো না তোমার জন্য কারো চিন্তা হয়। তোমার চিন্তায় কেউ অস্থির হয়ে ওঠে। তোমাকে এক মুহূর্ত দেখতে না পারলে আমার বক্ষঃস্থল চিন চিন ব্যথা হয়। চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসে। সারা পৃথিবী এলোমেলো হয়ে যায়।

প্রথম দিকের কথাগুলো উনি রেগে বললেও পরে উনার কন্ঠে রাগের কোনো অস্তিত্বই ছিল না। এক রাশ ভালোবাসার অনুভূতি। অপ্রকাশিত ভালোবাসা। ভালোবাসলেই তা মুখে বলতে হবে তা নয়। নিজের কর্মের মাধ্যমে অপর পাশের ব্যক্তিটাকে নিজের ভালোবাসা বুঝানো সম্ভব। আমার এক হাত উনার বুকের বা পাশে রাখলাম। এবার উনি একদম স্থির হয়ে গেলেন। অনিমেষ তাকিয়ে আছেন আমার চোখের দিকে। পলক ফেলতেও যেনো ভুলে গেলেন।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

গত দশ মিনিট যাবৎ ইফাদ স্যারের রুমে বসে আছি। কিন্তু স্যার আসার কোনো খবর নাই। ইফাদ স্যার উনার এসিস্ট্যান্টকে দিয়ে আমাকে ডেকে নিয়ে আসছেন। উনার এসিস্ট্যান্ট আমাকে এখানে বসতে বলে চলে গেছেন। স্যার একটা ইমপর্টেন্ট কাজে গিয়েছে এখনি চলে আসবে। আমাকে অপেক্ষা করতে বলছে। এই দশ মিনিটেই আমি বিরক্ত হয়ে গিয়েছি। সারা রুম জুড়ে পায়চারি করছি। আজকে ত্রয়ীটাও আসেনি। তাই আমার একা একাই বোর হতে হচ্ছে। ত্রয়ী এখানে থাকলে স্যারের রুমটাকেও বাজার বানিয়ে ফেলতো। আরো মিনিট পাঁচেকের মতো অপেক্ষা করার পর স্যারের দেখা পেলাম।

স্যারকে দেখা আর ঘোড়ার ডিম দেখা আমার কাছে এক মনে হচ্ছে। অপেক্ষা জিনিসটা আমার বরাবরই বিরক্ত লাগে। স্যার কেবিনের দরজা ঠেলে ঢুকতে ঢুকতে বলে,
সরি সরি ফর লেইট। সরি এগেইন তোমাকে অপেক্ষা করানোর জন্য। একটা কাজে আটকে গিয়েছিলাম।
আমি নিজের বিরক্তিটা প্রকাশ না করে আলতো হেসে বললাম, ইট’স ওকে স্যার। সরি বলার দরকার নেই। কাজ তো থাকতেই পারে।

স্যার নিজের গায়ের এপ্রোনটা খুলতে খুলতে বললেন, এই জন্যই তোমাকে এতোটা ভালো লাগে। তুমি সব পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নাও। অন্যের সুবিধা অসুবিধা বুঝার চেষ্টা করো।
ইফাদ স্যারের কথা শুনে আমি একটু অস্বস্থিতে পড়ে গেলাম। তবুও মেকি হেসে বললাম, স্যার কেনো ডেকেছিলেন?
ও হ্যাঁ বসো বলছি।

আমি ইফাদ স্যারের বিপরীত পাশের চেয়ারটা টেনে বসে পড়লাম।
তুমি হয়তো ভুলে গেছো তুমি আমাকে একটা টপিক বুঝিয়ে দেওয়ার কথা বলেছিলে। আমি সময়ের অভাবে ঐ টপিকটা নিয়ে আলোচনা করার সময় পাইনি। তো গতকাল আমি ঐ টপিকটা নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। কিন্তু তুমি প্রেজেন্ট ছিলে না। স্টুডেন্ট কোনো টপিক বুঝতে না পারলে সেটা বুঝিয়ে দেওয়া আমার কর্তব্য। তোমাকে ঐ বিষয়টা বুঝানোর জন্যই ডাকা।

ধন্যবাদ স্যার। আমি ঐ টপিকের কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম।
চলো ক্যান্টিনে যাই।
কেনো স্যার?
সকাল থেকে এখনো খাওয়া হয় নাই। লাঞ্চ করতে করতে না হয় তোমাকে পড়াটা বুঝিয়ে দিব। তোমার কোনো সমস্যা আছে?

আমি এবার অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। এভাবে একজন টিচারের সাথে তো ক্যান্টিনে বসা যায়। ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে অস্বস্তিকর। যদি রুদ্র আমাদের দুজনকে এক সাথে ক্যান্টিনে দেখে তাহলে তো তুলকালাম কান্ড বাধিয়ে দিবে। তৎক্ষণাত রিয়েক্ট না করলেও পরে আমার ওপর ঘূর্ণিঝড় চালিয়ে দিবে। স্যারকে না করে দিব। কিন্তু স্যারের মুখের ওপর তো এভাবে না করা যায় না। এটা বেয়াদবি হয়ে যাবে। অগত্যা স্যারের সাথে ক্যান্টিনে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম।

খুব মনোযোগ দিয়ে স্যারের কথাগুলো শুনছিলাম। হুট করে আমার ফোনটা বেজে ওঠায় আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে দেখি রুদ্র কল দিয়েছে। কলটা কেটে দেওয়ার সাথে সাথেই আবার বেজে ওঠে। আমি স্যারের দিকে তাকাতেই স্যার ইশারায় ফোনটা রিসিভ করতে বললো। আমি জোর পূর্বক হেসে ফোনটা রিসিভ করে হ্যালো বলতেই অপর পাশ থেকে রুদ্রর কর্কশ কন্ঠ কর্ণগোচর হলো।

তোমার সাহস হলো কী করে আমার ফোন কেটে দেওয়ার। ক্যান্টিনে বসে দাঁত কেলানোর সাহস আমি বের করবো। পাঁচ মিনিটের মাঝে আমি তোমাকে আমার গাড়ির ভিতর দেখতে চাই।
কথাগুলো বলতে দেরি হলো কিন্তু উনার ফোনটা কাটতে দেরি হলো না। আমি ফোনের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। উনি যে আমার ওপর ভীষণ রেগে আছেন সেটা উনার কণ্ঠস্বর শুনেই বুঝা গেছে। উনি আমাদের দুজনকে এক সাথে দেখে জেলাসিতে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছেন। ইফাদ স্যারের প্রশ্ন শুনে বিষ্মিত হলাম।
বয়ফ্রেন্ড ফোন দিয়েছিল?

মুখ দিয়ে হুট করে বেরিয়ে এলো ‘না’ বোধক শব্দটা। নিজের দেওয়া উত্তরে নিজেই চমকে ওঠলাম। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলাম। কারণ আমি তো মিথ্যা বলি নাই। রুদ্র তো আমার বয়ফ্রেন্ড নয় হাজবেন্ড। ইফাদ স্যার আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। উনার দিকে তাকাতেই আমি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। অস্বস্তি নিয়ে এদিক ওদিক তাকালাম। অস্বস্তি নিয়েই ফট করে দাঁড়িয়ে গেলাম। অতঃপর আমতা আমতা করে বললাম,

স্যার আজকে আমি আসি। এমনিতেই অনেকটা দেরি হয়ে গেছে পড়ে। আরো দেরি হয়ে গেলে মামুনি টেনশন করবে। স্যার তাহলে আমি আসি।
আচ্ছা যাও।
আসসালামু আলাইকুম।
আমি উনার কথা না শুনেই ব্যাগটা নিয়ে এক ছুটে ক্যান্টিন থেকে চলে এলাম।

এতো কীসের হাসাহাসি ড. ইফাদের সাথে? আমার সাথে যখন কথা বলো তখন মনে হয় মুখে করলা দিয়ে রাখছে। ত্যাড়া কথা ছাড়া ভালো কথা বেরই হয় না। তুমি ইফাদের সাথে ক্যান্টিনে কেনো বসেছিল? আন্সার মি।
আমি উনার এক হাতের ওপর হাত রেখে বললাম, আমাকে নিয়ে জেলাস ফিল করার দরকার নেই। আমি তো আপনারই। ইফাদ স্যার শুধু আমাকে একটা টপিক বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। এছাড়া আর কিছু না।
ইফাদের কাছে কেনো তুমি পড়া বুঝবে? আমাকে বললে আমি পড়া বুঝিয়ে দিতাম না।
আমার নিজের কপাল নিজেরই চাপড়াতে ইচ্ছে করছে। উনি রাগে হিতাহিত ঙ্গান শুন্য হয়ে পড়েছেন। উনি ভুলেই গিয়েছেন ইফাদ স্যার আর উনি দুজন আলাদা দুই সাবজেক্ট এর টিচার।

উনি কলেজে বিষয়টা নিয়ে এখনো রেগে আছেন। একটু আগেও ধমকে টমকে রেখে গেলেন। আমাদের কাজিন মহলের সবচেয়ে বেশি ঘাড়ত্যাড়া উনি। একবার যে বিষয়টা ঠিক করেন বা কোনো কিছুতে না করলে সেটার হ্যাঁ করার সাধ্য কারো নেই। ইফাদ স্যারের কাছ থেকে দুরত্ব বজায়া রেখে চলতে হবে। নাহলে রুদ্র আবার রিয়েক্ট করে বসবে।
আনমনে বইয়ের পাতায় নজর দিচ্ছিলাম। রুদ্রও ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে। টাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বেলকনিতে চলে যায়। বেলকনিতে টাওয়ালটা রেখে আবার রুমে আসেন। আমি উনাকে দেখে বলে ওঠলাম,
ডাক্তারবাবু আপনার মনে হয় না আপনি দিন দিন হিংসুটে হয়ে যাচ্ছেন।

উনি কিছু না বলে আমার হাত থেকে টান দিয়ে বইটা নিয়ে নিলেন সন্তপণে বইটা টেবিলের ওপর রেখে দিলেন। কোনো রকম বাক্য ব্যয় না করেই ধপ করে আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লেন। আকস্মিক ঘটনায় আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। কিছু বলার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেললাম।

আমি আমার বউকে নিয়ে হিংসা করছি অন্যের বউকে নিয়ে নয়। নিজের বউকে নিয়ে হিংসা না করে কী বন্ধুর বউকে নিয়ে হিংসা করব? সুন্দরী বউকে অন্য কারো পাশে দেখলে তো হিংসা হবেই।

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ৩৬

উনি আমার হাতটা নিয়ে উনার মাথার ওপর রাখলেন। নিভৃতে আমার উদরে মুখ গুঁজে দিলেন। আকস্মিক উনার স্পর্শে আমি বরফের মতো জমে গেলাম। নড়াচড়া করার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেললাম। উনার প্রতিটা নিশ্বাস আমার উদর ছুঁয়ে যাচ্ছে। আমার দৃষ্টি এলোমেলো হয়ে আসছে। উনার বাকি কথাগুলো আর কর্ণপাত হলো না।

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ৩৮

1 COMMENT

Comments are closed.