পূর্ণিমাতিথি পর্ব ৩৮

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ৩৮
লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া

উনি আমার হাতটা নিয়ে উনার মাথার ওপর রাখলেন। নিভৃতে আমার উদরে মুখ গুঁজে দিলেন। আকস্মিক উনার স্পর্শে আমি বরফের মতো জমে গেলাম। নড়াচড়া করার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেললাম। উনার প্রতিটা নিশ্বাস আমার উদর ছুঁয়ে যাচ্ছে। আমার দৃষ্টি এলোমেলো হয়ে আসছে। উনার বাকি কথাগুলো আর কর্ণপাত হলো না। আমি অস্বস্তিতে হাসফাস করছি। আমি চট করে উনার মাথাটা আমার কোল থেকে নামিয়ে দূরে সরে গেলাম।

উনি শোয়া থেকে ওঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে গম্ভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ধুপধাপ পা ফেলে চলে গেলেন। আমি উনার যাওয়ার দিকে নিভৃতে তাকিয়ে আছি। উনি কী আমার ওপর রাগ করলেন? কিন্তু আমি কী করতাম? আমি তো উনার এমন স্পর্শে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলাম।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

উনি কাউচে বসে গম্ভীর মুখে কিছু পেপারস দেখছিলেন। আমি উনার পাশে বসে পড়লাম। একটু দূরত্ব রেখেই বসেছি। নানা ভাবে উনার মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করছি। কিন্তু উনি আমাকে পাত্তাই দিচ্ছেন না। উনার ধ্যান ঙ্গান সব এখন উনার হাতে থাকা পেপারসের মাঝে। আমি হালকা কেশে উনার মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু উনি ফিরেও তাকালেন না। আমি আশাহত হলাম। উনি এমন একটা হাব ভাব করছেন যেনো উনার হাতে থাকা পেপারসগুলো থেকে চোখ সরালেই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি দুজনের মাঝের দূরত্ব গুছিয়ে উনার গা ঘেষে বসে পড়লাম। উনার বাম হাতটা টেনে ধরলাম। উনি এবার আমার দিকে ফিরে তাকালেন। গম্ভীর গলায় বলে ওঠলেন,
সমস্যা কী? ডিস্টার্ভ কেনো করছো?

কথাটা বলেই উনি আমার হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিলেন। আমি উনার দিকে তাকিয়ে মলিন কন্ঠে বললাম,
আপনি আমার সাথে এমন করছেন কেনো? আপনি কী আমার ওপর রেগে আছেন?
উনি আমার দিকে না তাকিয়ে ফাইল পত্র ঘাটতে ঘাটতে উত্তর দিলেন,
হঠাৎ তোমার কেনো মনে হলো আমি তোমার ওপর রেগে আছি?
তখনকার বিষয়টা নিয়ে।

আমি আর কিছু বলার আগেই উনি বলে ওঠলেন,
আমি ছোটো-খাটো বিষয় নিয়ে রাগ করি না। এখন আর আমাকে ডিস্টার্ভ করো না যাও পড়তে বসো।
আমি বিনা বাক্য বেয়ে উনার পাশ থেকে ওঠে চলে এলাম। স্টাডি টেবিলের চেয়ারটা টেনে ধপ করে বসে পড়লাম। ভাজ করা বইয়ের মাঝ থেকে একটা বই টেনে নিলাম। ইফাদ স্যারের অর্ধেক বুঝানো টপিকটা বুঝার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু পড়াতে কিছুতেই মনোযোগ বসাতে পারছি না। উনার অবহেলাগুলো যে আমায় বড্ড পুড়ায়। উনার একটা তুচ্ছ কথাও যে আমার ভিতরটা যে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যায় সেটা কী উনি বুঝতে পারেন না?

আমি মাথা নিচু করে পড়ছিলাম। উনি নিঃশব্দে এসে আমার পাশে বসলেন। আমার সামনে থেকে বইটা টেনে নিজের কাছে নিলেন। দক্ষতার সাথে পুরো বিষয়টা আমাকে খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন। নিশ্চুপ ভঙ্গিমাতে পুরু বিষয়টা বুঝে নিলাম। আমি একবারের জন্যও উনার দিকে তাকাইনি। বুঝানো শেষ উনি গম্ভীর গলায় বললেন,
নেক্সট টাইম কোনো টপিকস না বুঝলে আমার কাছে আসবা। অন্য কোনো ছেলের আশেপাশেও ঘেষবা না। যতই সে তোমার স্যার হোক।
উনি আর কোনো বাক্য ব্যয় না করে রুম থেকে চলে গেলেন ডিনার করার জন্য। আমিও উনার পিছু পিছু ছুটলাম।

ডিনার শেষ মামুনির সাথে কিয়ৎক্ষণ কথা বলে রুমে চলে এলাম। রুমে এসে একটু বেশিই অবাক হলাম। উনি বিছানায় শুয়ে আছেন কিন্তু উনার পাশে কোনো কোলবালিশ নেই। উনি নিজে থেকে সরিয়েছেন? এটা অসম্ভব হয়তো উনি ভুলে গেছেন। আমি কাউচের ওপর থেকে কোলবালিশটা নিয়ে এসে বিছানার মাঝ বরাবর রেখে দিলাম। আমি বিছানায় ওঠে বসতেই উনি ধপ করে চোখ খুলে ফেললেন। নিজের পাশে কোলবালিশ আবিষ্কার করে হয়তো উনি ঈষৎ রেগে গেলেন। এক ঝটকায় কোলবালিশ অদূরে ছুঁড়ে মারলেন। উনার কর্ম কান্ডে আমার মুখটা হা হয়ে গেলো। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,

এটা আপনি কী করলেন? কোলবালিশটা ছুঁড়ে মারলেন কেনো?
তোমার সাহস হয় কী করে এই থার্ড পার্সনটাকে এখানে রাখার?
এতদিন তো এটাই আপনার জানু, সোনা, কলিজা ছিল। আজকে এটা থার্ড পার্সন হয়ে গেলো? আমি ভাবলাম আপনি হয়তো কোলবালিশটা মাঝখানে রাখতে ভুলে গেছেন।
তোমাকে এতো ভাবতে কে বলেছে? ভেবেছিলে যখন এটা ভাবতে পারলে না আমি ইচ্ছে করেই সরিয়ে রাখছি।
আমি…..

হুসস আর কোনো কথা নয়।
উনি আমার হাত ধরে টেনে শুইয়ে দিলেন। উনি আমার অতি সন্নিকটে এসে শুয়ে পড়েন। আরেকটু ঘনিষ্ঠ হয়ে উনি আমাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরেন। আমার শরীর বরফের ন্যায় জমে গেলো। শিঁড়দাড়া দিয়ে হিম শীতল বাতাস বয়ে গেলো। বিষ্ময়ে আমার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেছে। উনার চোখের চাহনি শীতল। উনার গাড় কালো রঙের চোখের মনির দিকে তাকিয়ে আমি সম্মোহনী হয়ে গেলাম। আমার ঘোর লেগে গেলো। উনার চোখের পলক পড়তেই আমার ঘোর কেটে গেলো। উনার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম। দৃষ্টি এলোমেলো হয়ে আসছে। দ্বিতীয় বারের মতো উনার এই বেসামাল প্রখর চোখের দিকে তাকানোর সাহস আমার নেই। উনার কাছ থেকে ছাড়া পাবার জন্য নড়াচড়া করতেই উনি প্রখর কন্ঠে বলে ওঠলেন,

একদম নড়াচড়া করবে না। যেভাবে আছো এভাবেই থাকবে। নিজেও ঘুমাও আর আমাকেও ঘুমাতে দাও।
কথাটা বলেই উনি চোখ দুটো বন্ধ করে নিলেন। কিন্তু আমার চোখ জোড়া বন্ধ হলো না। আমার দৃষ্টি উনার এলোমেলো চুল আর উনার চোখ জোড়াতেই আটকে আছে। কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হলো। সময় অতিবাহিত হচ্ছে সেই সাথে ঘুরছে ঘড়ির কাটা। ঘড়ির কাটা ১১ টার ঘর পেরিয়ে ১২ টার ঘরে পা দিয়েছে। কিন্তু আমার চোখে ঘুম নেই। আমার দৃষ্টি আটকে গেলো উনার কানের পাশের কালো কুচকুচে তিলটাই। দৃষ্টি বেসামাল হয়ে আসছে। চেয়েও চোখ ফেরাতে পারছি না।
উনি তো এখন ঘুমিয়ে আছেন। উনার তিলটা যদি একটু ছুঁয়ে দেই তাহলে কী খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে? আমার ওষ্ঠ্য জোড়া যদি উনার তিলটা স্পর্শ করে দেয় তাহলে কী খুব বড় অন্যায় হয়ে যাবে?

আজকে আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলাম না। দুজনের মাঝে দূরত্ব ক্ষীণ হয়ে আসলে। দুজন দুজনের এতোটাই কাছে যে উনার প্রতিটা নিশ্বাস প্রশ্বাস আমার নাক, মুখ, চোখ ছুঁয়ে যাচ্ছে। আমি মাথাটা উঁচু করে পর পর তিনটা চুমু খেলাম উনার কানের পাশের কালো তিলটাই। অতঃপর উনার থেকে একটু দূরত্ব বজায় শুয়ে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলাম।

ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে কলেজ থেকে ফিরেই ওয়াশরুমে চলে ওলাম শাওয়ার নেওয়ার জন্য। রুদ্র আমাকে বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে গেছেন আর উনি গিয়েছেন ইলান ভাইয়াদের বাসায়। মামুনি ইলান ভাইয়াদের পরিবারের সবাইকে লাঞ্চের করার জন্য দাওয়াত করেছেন। ইলান ভাইয়া এতদিন ধরে আসবো আসবো করেও শেষ মহুর্তে বেঁকে বসেছেন। উনি এতোটা রাস্তা ড্রাইভ করে আসতে পারবেন না। উনার হাত, পা, নাক, মুখ সব ব্যথা করছে। এতোটা রাস্তা উনার পক্ষে ড্রাইভ করে আসা অসম্ভব।

উনি যে আলসেমির জন্য আসতে চাচ্ছেন না সেটা রুদ্র ভালো করেই বুঝতে পেরেছিল। তাই তো রুদ্র আনতে গেছে। বেশ সময় নিয়ে শাওয়ার নিলাম। ওয়াশরুমের দরজায় নক পড়তেই। মাথায় টাওয়াল পেঁচিয়ে বেরিয়ে এলাম। উনি ওয়াশরুমে ঢুকতে ঢুকতে দাঁত কটমট করতে করতে কিছু একটা বললেন। কিন্তু আমার কর্ণগোচর হলো না।
আমি পরিপাটি হয়ে সবার সাথে দেখা করতে গেলাম। সবার সাথে কুশল বিনিময় করলাম। রুনা আপু ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তার দরুন রুনা আপুর পেটটা অনেকটাই ফুলে ওঠেছে।

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ৩৭

ইলান ভাইয়ার আম্মু হাসতে হাসতে মামুনিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
ভাবি আমার আর তর সইছে না। কবে যে বাচ্চাটা পৃথিবীতে আসবে আর আমি ওকে নিয়ে খেলবো। প্রহর যেনো কাটছেই না। এখনি তো নাতি নাতনি নিয়ে খেলার বয়স।

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ৩৯

1 COMMENT

Comments are closed.