পূর্ণিমাতিথি পর্ব ৩৯

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ৩৯
লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া

ভাবি আমার আর তর সইছে না। কবে যে বাচ্চাটা পৃথিবীতে আসবে আর আমি ওকে নিয়ে খেলবো। প্রহর যেনো কাটছেই না। এখনি তো নাতি নাতনি নিয়ে খেলার বয়স।
আর আমার মায়ের এখন তার বাচ্চা বউমাকে নিয়ে খেলার সময়।
উনি চুলে হাত চালিয়ে সোফায় আয়েশ ভঙ্গিতে বসতে বসতে কথাটা বললেন। আমি উনার কথাটা শোনা মাত্রই রাগে ফুসে ওঠলাম। রাগে নাক ফুলিয়ে বললাম,

আমাকে একদম বাচ্চা বলবেন না। আমি মোটেও বাচ্চা নই।
তুমি তো বাচ্চাই। তুমি জানো না ১৮ বছরের নিচে সবাই শিশু।
আমার বয়স মোটেও ১৮ বছরের নিচে না। আমার বয়স ১৮ বছর ১০ মাস ২৮ দিন ৪ঘন্টা।
মাঝখান থেকে ইলান ভাইয়া রসিকতার সুরে বলে, তুমি বাচ্চা হবে কেনো? তুমি তো ৪৫ বছরের যুবতি।
আমি গাল ফুলিয়ে ইলান ভাইয়ার দিকে তাকাই। তারপর ধুপ ধাপ পা ফেলে নিজের রুমে চলে আসি।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ছাদের রেলিংয়ের ওপর বসে আছি। আমার দৃষ্টি ঐ দূর আকাশের জলমল করা তারার দিকে। ইলান ভাইয়ারা কিছুক্ষণ আগেই চলে গেছে। আমার পিছনে রুদ্রর উপস্থিতি অনুভব করতে পারছি। রুদ্র আমার হাত ধরে ফেললেন। আমাকে রেলিং থেকে নামানোর আগেই বলে ওঠলাম,
প্লিজ একটু থাকি না। প্রতিদিন তো আর বসি না। আমার নিজের ওপর ভরসা আছে। এখান থেকে পড়বো না।
উনি নিঃশব্দে পিছন থেকে এক হাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি উনার কাজে মুচকি হাসলাম। উনার দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারছি উনি আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন। উনি গলার স্বর নিচু করে বললেন,

মন খারাপ?
উহু।
তাহলে এমন করছো কেনো? কেমন উদাসীন নিস্তব্ধ। আমি জানি তোমার মন খারাপ থাকলেই এখানে এসে এভাবে বসে থাকো।
আজকে আমার মন একটুও খারাপ না। আমি তো নিজের জীবনের হিসেব মিলাতে ব্যস্ত। জানেন জীবনটা অনেকটা অংকের মতো। অংকে যেমন একটু ভুল করলেই অংক শেষ। জীবনেও একটু ভুল করলে সেই ভুলটাই পারে আপনার জীবন ধ্বংস করে দিতে। অংকে যেমন প্রথম একটু ভুল হলে শেষে আর হিসাব মিলানো সম্ভব হয় না। তেমনি জীবন গঠনের শুরুতেই যদি ভুল করা হয়। তাহলে সেই জীবনের হিসাব কখনোই মিলবে না।

কী ব্যাপার আজকে এতো গম্ভীর টাইপ কথা বার্তা? বাচ্চাটা আজকে বড় মানুষের মতো কথা বলছে।
বাদ দেন এসব কথা। রুনা আপুকে কি কিউট লাগে তাই না? দিনকে দিন যেনো রুনা আপুর সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। আচ্ছা আমি যদি প্রেগনেন্ট হই তাহলে আমাকেও কী রুনা আপুর মতোই গুলুমুলু লাগবে?
তোমার মাথায় যেসব ভাবনা চিন্তা ঘুরছে সেগুলো ঝেড়ে ফেলে দাও। বাচ্চা-কাচ্চার কথা মাথাতেও আনবে না। তোমার এখনো বেবি নেওয়ার বয়স হয়নি। বাচ্চা বাচ্চার মতোই থাকো। একদম বড় হওয়ার চেষ্টা করবে না আর নিজের ক্যারিয়ারের দিকে ফোকাস করো।

আপনার মনে হয় না আপনি একটু বেশিই ভাবছেন? আদোও কী আমাদের মাঝে বেবি নেওয়ার সম্পর্ক আছে? থাক বাদ দেন সেসব কথা। আমি কিছুদিনের জন্য বাসায় যেতে চাই।
তুমি কী এখন রাস্তায় আছো?
বুঝতে পারলাম উনি ফাজলামো করছেন। আমি সিরিয়াস হয়ে বললাম,
দেখুন আমি মোটেও মজা করার মুডে নাই। আমি সিরিয়াস। প্লিজ না করবেন না। যাস্ট কয়েকটা দিনের জন্য যাব। এখানে আর ভালো লাগছে না। কিছুদিন নিজের মতো থাকতে চাই। প্লিজ যেতে দিন না।
উনি কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,

আচ্ছা যাও।
সত্যি?
হুম।
ধন্যবাদ।
আমি এক দৌড়ে নিচে চলে যেতে গিয়েও ছাদের দরজার কাছ থেকে ফিরে এলাম। উনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললাম,
আপনাকে একটা কথা জিঙ্গেস করি?
বল।

প্রীলিয়া আপুর মৃত্যুটা কী নিতান্তই এক্সিডেন্ট নাকি এখানে অন্য কোনো রহস্য আছে?
কিছু কথা না জানাই ভালো। কিছু জিনিস আড়ালে থাকাই ভালো। রহস্যময় জিনিস সামনে চলে আসলে অনেকের জীবন ধ্বংস হয়ে যায়। তুমি নিচে যাও।
আমি আর কথা বাড়ালাম না। উনি যেটা ডিসাইড করেন বলবেন নাহ সেটা সারাদিন জিঙ্গেস করলেও বললবেন না। তাই উনার সাথে বেকার কথা না বাড়িয়ে নিচে চলে এলাম। নিজের সমস্ত জিনিস গুছিয়ে নিলাম। আগামীকাল শুক্রবার থাকাই কলেজ নেই। সকাল সকাল ঐ বাসাই চলে যাব।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অনবরত কলিংবেল বাজিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু কেউ দরজা খুলে দিচ্ছে না। একটু আগেই রুদ্র আমাকে নামিয়ে দিয়ে গেছে। উনাকে বাসায় আসতে বললে উনি বলেন উনার কার সাথে দেখা করার কথা আছে। তাই আমি আর কথা বাড়ালাম না। উনাকে জোড় করে যে কোনো কাজ করানো যাবে না সেটা এতোদিনে আমি বুঝে গেছি। যখনি দরজাই পাঞ্চ মারতে যাব ঠিক তখনি দরজাটা খুলে যায় আর পাঞ্চটা লাগে সোজা ভাইয়ার নাকে। ভাইয়া নাকে ধরে চিৎকার মারে আর আমি হা করে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আছি। কয়েক সেকেন্ড লাগলো আমার ব্যাপারটা বুঝতে। আমি কোনো রকম বিচলিত হলাম না। ভাইয়াকে পাশ কাটিয়ে ভিতরে যেতে যেতে মুখ ভেংচিয়ে বললাম,

রং টাইমে রং জায়গাই এন্ট্রি নিলে এমনি হবে। বলদ একটা।
খালাতো ভাইয়ের সাথে বিয়ে হয়েছে বলে বেঁচে গেছিস। শ্বাশুড়িটা যদি খালামনি না হয়ে অন্য কেউ হতো। তাহলে তোকে শ্বশুর বাড়ির সামনের দরজা দিয়ে ঢুকিয়ে পিছনের দরজা দিয়ে বের করে দিতো।
আমি ইন্টিলিজেন্ট বুঝছো। তাই এমন একটা বাসার বউ হইছি যে বাসার পিছনের দরজা নাই। তাই বাসা থেকে বের করে দেওয়ারও টেনশন নাই। চোখের সামনে থেকে বিদায় হও তো। তোমাকে দেখে আমার নাক চুলকাচ্ছে।
মানুষ ঠিকই বলে শয়তান কোনোদিন ভালো হয় না। কয়লা ধুলে যেমন ময়লা যায় না তেমনি শয়তানকে যতই ভালো মানুষের গলায় ঝুলিয়ে দাও না কেনো সে কখনো ভালো হবে না। আমার নাকটা ভেঙে দিলি না। আমি আজকে একটা অভিশাপ দিলাম তোকে তোর ছেলের নাক বুচা হবে।

আমি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে ভেংচি কেটে বললাম, শকুনের দোয়ায় গরু মরে না। আম্মু কই?
তুই নিজে খোঁজে নে। আমার ঠেকা পড়ছে না বলতে।
ভাইয়া হাত দিয়ে নাক ঘষতে ঘষতে রুমে চলে গেলো। আমি ভাইয়ার যাওয়ার দিকে বিরক্তকর চাহনি নিক্ষেপ করে আম্মুকে ডাকতে শুরু করলাম।
আম্মু, আম্মু, আম্মু।
আম্মু তড়িঘড়ি করে রুম থেকে বের হয়ে এলো।
রিয়া কখন এলি। কেমন আছিস? আজকে আসবি আমাকে আগে বলবি না। তোর স্বাভাবটা এখনো চেইন্জ হলো না। বাসায় আসলেই আগে আমাকে চাই।

আমার এই বাজে স্বভাব কোনো দিন যাবে না। তোমারও তো এক সাথে একশটা প্রশ্ন করা অভ্যাসটা এখনো পরিবর্তন হয়নি। আমি আসছি অনেকক্ষণ। কিন্তু তোমারই তো পাত্তা নাই।
আমি ওয়াশরুমে ছিলাম।
আমি যদি আগে বলে দিতাম তাহলে তো আর তুমি এতোটা সারপ্রাইজড হতে না। আমি তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম। আর আমি অনেক ভালো আছি। তুমি কেমন আছো।
তোকে দেখার পর খারাপ থাকি কীভাবে? কতদিন ধরে তোকে দেখি না। কিছু দিন ধরে তোকে দেখার জন্য মনটা আনচান করছিল।
আমি তোমার মন পড়তে পারি। তাই তো তোমার মন পড়ে চলে এসেছি। তোমার সাথে আমার অনেক কথা আছি।
আগে ফ্রেশ হয় কিছু খেয়ে নে। তারপর তোর কথা শুনবো।

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ৩৮

ভাইয়া আমার বিছানার ওপর পায়ের ওপর পা তুলে শুয়ে সাউন্ড দিয়ে গান শুনছে। গানের তালে তালে পা নাচাচ্ছে। আমি কিছুক্ষণ পর পর বিরক্তিকর চাহনি নিক্ষেপ করছি ভাইয়ার দিকে। কিন্তু সেদিকে ভাইয়ার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
ভাইয়া তুমি যাবে এখান থেকে। নাহলে মোবাইল ছুড়ে মেরে তোমার মাথা ফাটিয়ে দিব।
ফোনটা হাতে নিতেই ফোনটা বেজে ওঠে। আমি ফোন রিসিভ করতে নিলেই ভাইয়া বলে ওঠে,
তোর লজ্জা সরম নাই। ভাইয়ের সামনে জামাইয়ের সাথে কথা বলবি। আমি তোর গুরুজন। আমাকে রেসপেক্ট করে এখান থেকে বিদায় হ।
আমি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে রাগে কটমট করতে করতে চলে গেলাম।

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ৪০