অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ১৪

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ১৪
ইফা আমহৃদ

পায়ের উপর কাঁচের টুকরো পড়তেই পিছিয়ে গেলাম আমি। ফিকনি দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে পা থেকে। রক্ত দেখে ক্রমশ আমার শরীর দূর্বল হয়ে পড়ছে। রৌধিক কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। হাতেও রক্ত। কাঁচের টুকরো হাতে ঢুকে গেছে। রেস্টুরেন্টের সবাই দাঁড়িয়ে গেছে। আমার আর রৌধিকের দিকে তাকিয়ে আছে।

পরীক্ষা দিয়ে কিয়ৎক্ষণ আগে বের হয়েছি আমরা। বেশ ভালো হয়েছে পরীক্ষা। পরীক্ষার সময় পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। দুপুর হওয়াতে পেটেও বেশ ক্ষুধা লেগেছে। তাই রেস্টুরেন্টে খেতে আসলাম আমি আর অহি। সেখানে এসেই বাঁধল বিপত্তি। ভেতর থেকে চ্যাঁচামেচির আওয়াজ পাচ্ছি। গন্ডগোল হচ্ছে। তাই ভেতরে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হবে না। বাধ্য হয়ে আমি আর অহি ফিরে আসার জন্য পা বাড়ালাম। তদানীং শ্রবণ হলো অতি পরিচিত কন্ঠস্বর। রৌধিক চেঁচিয়ে বলছে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“আমার সাথে কন্টাক্ট করেছেন। সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। এমন আপনারা ডিলটা ক্যান্সেল করছেন কিভাবে?”
থেমে গেল চরণ। আমি পেছনে ফিরলাম। স্টার্ফদের বাঁধা অগ্রাহ্য করে ছুটে গেলাম ফেলতে। সেখানে যেতেই দেখতে পেলাম রৌধিক তার ক্লাইন্ট দের সাথে কথা কাটাকাটি করছে। একপর্যায়ে ভেতরের ক্ষোভ সংযত করতে ব্যর্থ হয়ে কাঁচের গ্লাস চেপে ধরলেন। পরক্ষণেই বিকট শব্দে ভেঙে গেল। কেঁপে উঠলো সকলে। রৌধিকের চোখ অসম্ভব লাল হয়ে আছে। যখন তখন সবকিছু ভস্ব করে দিতে পারে। আমি এগিয়ে গেলাম তাদের দিকে। তার আগেই নিজের হাতের ভাঙা কাঁচের টুকরো টা ছুঁড়ে মা’রলো। চেঁচিয়ে বললেন,
“ডিল ক্যান্সেল।”
তার হাতের কাঁচের টুকরো সোজা আমার পায়ে পড়ল। গাঢ় কন্ঠে আহ্ করে উঠলাম আমি। সবাই ফিরে চাইলো।

বসে পড়লাম আছি। কাঁচ টেনে বের করার চেষ্টা করলাম। বিনিময়ে আরো কুঁকড়ে উঠলাম। মনে হলো, বেশ কিছুটা অংশ ভেতরে ঢুকে গেছে। চোখ জোড়া বন্ধ হয়ে গেল। অধরে অধরে চেপে সহ্য করার চেষ্টা করলাম। অহি পাশে বসে পড়লো। আমার হাত ধরে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করল,
“জোনাকি থাম। হাত লাগাস না। ইনফেকশন হতে পারে। কাঁচের টুকরো এগুলো। ভেঙ্গে খন্ড যদি ভেতরে থেকে যায় তাহলে?”

আমি চোখ জোড়া মেলে তাকালাম। মুহুর্তেই চোখের কার্নিশ বেয়ে জলকণা গড়িয়ে পড়লো। অহি নিজের ব্যাগ থেকে স্কার্ফ বের করে আমার পায়ে পেঁচিয়ে দিল। রৌধিক ছুটে এলো। ঝাপটে ধরল আমায়। থমকালাম আমি, ভিশন চমকালাম। রৌধিক নির্বিকার। আমি নিজের হাতটা রৌধিকের পিঠের উপর রেখে ধীরে ধীরে বললাম,
“শুনছেন? সবাই দেখছে?”
“বিলিভ মি, আমি ইচ্ছে করে এটা করি নি।”

রৌধিক মাথা তুলে তাকালো। আমি পূর্বের ন্যায় চেয়ে আছি রৌধিকের দিকে। রৌধিকের চাইনি পড়তেই চোখাচোখি হলো দুজনার। নেত্র যুগল খানিকটা সময়ের জন্য স্থির হয়ে রইল।
ডাক পড়ল অহির। মিনমিনিয়ে বলল, “ভাইয়া, চলুন। রক্ত পড়া থেমে গেছে‌। বেশিক্ষণ এমন থাকলে ইনফেকশন হয়ে যেতে পারে।”

রৌধিক দৃষ্টি ফেরালো। রক্ত স্কার্ফের অনেকটা ভিজে গেছে। এখন শুকিয়ে দানা বেঁধে গেছে। আলতো হাতে পায়ের ব্যাথার্ত স্থানে হাত বুলিয়ে দিল। কেঁপে উঠলাম আমি। তবে ব্যাথায় নয়। তার স্পর্শে। রৌধিক নিচ থেকে আমার ফাইলপত্র তুলে অহির দিকে এগিয়ে দিল। পেছনে ফিরে স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,

“মিস্ আরু, আপনি এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী দেখছেন? ওয়ার্ট? তাড়াতাড়ি ড্রাইভার কে গাড়ি বের করতে বলুন।”
“জ্বি স্যার! কিন্তু মিটিং।”
“জ্বি স্যার নয়। যান এখান থেকে! মিটিং আর হবে না। এখানেই শেষ। তারা ডিল করতে চাইছে না। ব্যস! এখানেই শেষ। কাউকে জোর করে কিছু করা যায় না, না আমি এটাকে সাপোর্ট করি। নাও গো..

“ইয়েস স্যার।” বলে বেরিয়ে গেল আরু নামক মেয়েটা। তিনি অফিসের নতুন ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছেন। সেদিনের পর আর অফিসে যাই নি, তাই জানি না।
রৌধিক পেঁচিয়ে রাখা স্কার্ফটা খুলে ফেললো ধীরে ধীরে। উষ্ণ গরম ফুঁ দিলো। নিজের হাতে পেঁচিয়ে নিল।‌ এসে বলে কোলে তুলে নিলো আমায়।

সোজাসুজি হসপিটালে নিয়ে এসেছে আমায়। ডাক্তার আরেকজনকে চেকআপ করছে। রৌধিক আমাকে ধরে বসে আছে। অহি আমার অন্যপাশে। আরু নামক মেয়েটা বাইরে। ডাক্তার আমার সোজাসুজি বসলেন। পায়ে হাত দিতেই ছিটকে গেলাম আমি। মৃদু স্বরে বললাম,
“ক-কি করছেন? পায়ে হাত কেন দিচ্ছেন?”

“পায়ে হাত না দিলে কাঁচ টা কীভাবে গেঁথেছে বুঝবো কীভাবে?” বিরাগী হয়ে বললেন তিনি।
আমি থেমে গেলাম। হাত পা ধরে বেডে শুইয়ে দিলেন আমায়। ইনজেকশন নিয়ে এলেন যাতে কাঁটা ছেঁড়া করলে বুঝতে না পারি। ইনজেকশন দেখেই গলা ফাটিয়ে এক চিৎকার দিলাম আমি। ডাক্তার সাহেব রৌধিককে আমাকে সামলাতে বললেন। রৌধিক হাত ধরলেন আমার। আমাকে নিজের বক্ষ মাঝারে টেনে নিলেন। ফিসফিসিয়ে বললেন,

“জোনাকি মাথা রাখো আমার বুকে। দেখো তোমার একটুও ভয় করবে না। একটা ম্যাজিক শুনতে পারবে।”
আমি অস্বস্তি নিয়ে রৌধিকের বুকে মুখ গুঁজলাম। একদম বাম পাশে। ধুকপুক করছে। রীতিমত মিউজিক বাজছে। আমার তো হেব্বি নাচতে ইচ্ছে করছে। ইংলিশ গান বাজছে। আচ্ছা উনি কি ইংলিশ গান শুনতেন। নিশ্চয়ই শুনতেন। নাহলে কেন ইংলিশ গান বাজবে। আমার ভাবনার মাঝেই অহি বলল,
“এভাবে নড়াচড়া করছিস কেন জোনাকি? ডাক্তারকে অন্তত তার কাজটা করতে দে। মনে হচ্ছে, তুই জামাইয়ের কোলে উঠে শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেছিস।”

বাড়িতে প্রবেশ করতেই সম্মুখীন হলাম আরো বড় কিছুর। রৌধিকের বন্ধুরা এসেছে। তাদের দেখে রৌধিকের মুখটা একদম ছোট হয়ে গেল। রৌধিক কোল থেকে আমাকে একদম সোফায় বসিয়ে দিল। সার্ভেন্ট রা আমার অবস্থা দেখে মৌনতা আন্টিকে এবং আদ্রিতাকে ডেকে নিয়ে এলেন। কী হয়েছে জানতে চাইলেন। রৌধিক কাউকে কিছু বললেন না। কারণ এর সাথে অফিসের ঘটনা জড়িত। পরে বললেন।

আন্টিও আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। স্টার্ফদের লেবুর জুস করে আনতে বললেন। তারা নিয়ে আসতেই আন্টি আগে আমাকে খাইয়ে দিলেন। আমি পলকহীন চোখে চেয়ে রইলাম। নিজের মায়ের ছায়া দেখতে পেলাম। জ্ঞান হওয়ার আগেই মারা গেছেন তিনি।‌ বাবা তখন আমাদের সব আবদার পূরণ করেছেন। কিডনি সুস্থ হওয়ার পর, আর কোনো অবদান পূরণ করতে পারে নি। তখন পরিবারের বড় মেয়ে হিসেবে, আমাকেই দায়িত্ব নিতে হয়েছে। ভালো ভাবে কখনো যত্ন নেওয়া হয় নি। বাবা তখন আমার কষ্ট হবে ভেবে, বাড়ির কাজ করে রাখতেন।

দীর্ঘ শ্বাস ফেললাম আমি। মৌমিতা আন্টি বললেন,
“মায়ের কথা মনে পড়ছে, বুঝি?”
“আমার মা নেই!” সোজাসাপ্টা উত্তর আমার।
“আ’ম স্যরি জোনাকি, আমি আসলে বুঝতে পারি নি।”
“আন্টি প্লীজ এভাবে বলবেন না।”
আন্টি মুচকি হেঁসে জড়িয়ে ধরলেন আমায়।

রৌধিকের চারজন বন্ধু এবং তিনজন বান্ধবী এসেছে। আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“রৌদু, কে এই মেয়েটা? তোর বোন তো এই মেয়েটা (আদ্রিতাকে উদ্দেশ্য করে)। তুই আর শেফা কোথায় গেছিস, আদ্রিতাকে জিজ্ঞাসা করার পর ও কিছু বলেনি।”

রৌধিক কিছু বললেন না। দূর্বল হাসলেন। আদ্রিতাকে আমাকে ঘরে নিয়ে যেতে বললেন। হয়তো শেফার কথা শুনে, প্রচন্ড মিস্ করছে তাকে। সে কোনো কথা বলবে না, এতে অনড়। মৌমিতা আন্টি আর আদ্রিতা আমাকে ধরলো। উপরে নিয়ে যেতে লাগলেন। পেছন থেকে ওদের গলা একটু শুনতে পাচ্ছি। ওদের ভেতরে একজন ছেলে বলছে,

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ১৩

“এই মেয়েটা কে রৌদু। শেফা কোথায়?”
“ওর প্রতি সবাই এতো কেয়ারিং কেন? বাই এনি চান্স ও তোর বউ নাকি?”
“মেয়েটা কোনো কারসাজি করে তোকে বিয়ে করেনি তো?”
রৌধিক সবাইকে বসতে বলল। অতঃপর বলতে শুরু করল,
” শেফা পালিয়ে গেছে। নিজের সম্মান বাঁচাতে, বাবা জোর করে এই অচেনা মেয়েটার সাথে আমার বিয়ে দিয়েছে।”

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ১৫