অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ৩৬

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ৩৬
ইফা আমহৃদ

“এত সাজ কিসের? হলুদ কি তোমার? অভিজ্ঞ মহিলারা দেখলে আদ্রুকে রেখে তোমায় হলুদ দিতে চলে আসবে। যাও, দ্রুত মুখ ধুয়ে এসো।”
তথাপি পা জোড়া গতিশীল। ক্রমশ এগুতে এগুতে উক্ত কথাটি বলেন। আমি পিছানো থামিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। ভ্রু কুঁচকে সোজাসাপ্টা বললাম,
“কোথায় সেজেছি। এটাকে সাজ মনে হচ্ছে আপনার? চোখ না-কি চুলা? সরুন।”
পাশ কাটিয়ে যাওয়ার প্রয়াস করতেই হাত টেনে ধরল। দেয়ালের সাথে চেপে ধরে দু’পাশে হাত দিয়ে আবদ্ধ করে দাঁড়ালেন। নাকের ডগার সাথে আমার নাক ঘষলেন। আদুরে গলায় বললেন, “তুমি তো ই’বলি’শ। বুঝ না কেন? তোমার এই সাধারণ সাজেই আমি ঘায়েল হয়ে যাই। তাই এত সাজের দরকার হয় না। বুঝেছ?”

উষ্ণ ওষ্ঠদ্বয় কিঞ্চিৎ স্পর্শ করলেন আমার ওষ্ঠদ্বয়ে। বিনিময়ে সরে গেলাম আমি। মাথা ধরে উঠল। তিঁতকুটে ঢেকুর উঠল। রৌধিকের শার্ট ধরে শরীরের ভারসাম্য রাখলাম। ক্রমশ হিম দিকে প্রবাহিত হচ্ছে দেহ। আমাকে এভাবে দেখে বিচলিত হয়ে গেল রৌধিক। দ্রুত চেপে ধরলেন। কোলে তুলে বেডের উপর বসিয়ে দিলেন। সাবধানে বালিশে মাথা রাখলেন। উত্তেজিত হয়ে বলল,
“ওয়াট হ্যাপেণ্ড, জোনাকি? কী হয়েছে, এমন করছ কেন?”
বেডশিট আঁকড়ে ধরে ব্যথায় ছটফট করছি আমি। হুট করে ব্যথার কারণ খুঁজে পেলাম না। ধৈর্য হারা হয়ে বলি,
“জানি না। হয়তো আপনার শরীর থেকে আঁশটে গন্ধ আসছে।”
রৌধিক নিজের শার্ট শুকলেন। কিন্তু তিনি মাছের আশেপাশে যায়নি। রান্নার তদারকি করছিলেন, দূরে দাঁড়িয়ে। তাহলে কীভাবে সম্ভব? রৌধিক মেঝেতে কিয়ৎক্ষণ পদচারণ করলেন। অতঃপর রিনরিনে গলায় বলল, “আমি মাকে ডেকে আনছি।”
“না, আপনি মাকে ডাকবেন না। নিচে অনুষ্ঠান চলছে। আমি চাইনা, আমার জন্য নষ্ট হোক। আপনি বরং একগ্লাস পানি দিন। পানি খেয়ে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করি।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

বলা বাহুল্য কিন্তু পানি এগিয়ে দিতে সময় লাগল না। তড়িৎ গতিতে পানি ঢেলে নিজেই আমাকে খাইয়ে দিলেন। কোমরে বাঁধা গামছাটা দ্রুত পানি ঢেলে ভিজিয়ে ললাটের উপর রাখলেন। হাঁটু ভাঁজ করে বসলেন সন্নিকটে। চুল ভেদ করে তালুতে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। আমাকে নিদ্রামগ্ন হতে বললেন। আমিও তার কথ্যমত প্রয়াস করলাম। মিনিট কয়েক পেরুবার পূর্বেই গভীরতর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হলাম। কতক্ষণ নিদ্রাঘোরে ছিলাম, জানা নেই। নেত্রযুগল উন্মীলিত করতেই চলন্ত সিলিং ফ্যান দৃষ্টিতে হানা দিল। রক্ত বর্ণ সূর্য মামা ততক্ষণে অন্তরিক্ষের বক্ষ থেকে বিদায় নিয়েছে। আরমোড়া ভেঙ্গে উঠতেই আদ্রুপুকে নজরে এলো, তিনি ফোনে কথা বলছেন। কোমল তুলতুলে ওষ্ঠদ্বয় নাড়িয়ে ধীরে ধীরে কথা বলছেন। আমি জানালার বাইরে দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। লাল নীল আলো জ্বলছে। একটু পরই মেহেদির রঙে হাতের করতল সেজে উঠবে। এতক্ষণ জ্ঞানহীন অবস্থায় ছিলাম ভাবতেই কান্না পাচ্ছে। বিরক্ত নিয়ে আদ্রুপুর সামনে গিয়ে অভিমানী সুরে বলি,

“তুমি আমাকে ডাকলে না কেন, আদ্রুপু? আমার একদম ভালো লাগছে না। এত সাজ সব বৃথা। আমি আর সাজবই না।”
চটজলদি ফোনের লাইন কেটে বেডের পাশে রাখলেন। কিছুটা নত স্বরে বললেন, ” আমি ডাকতে এসেছিলাম তোকে। কিন্তু ভাই ডাকতে বারণ করেছে। তুই না-কি অসুস্থ। তুই অসুস্থ তাও কাউকে বলেনি। ভেবে দেখ একবার। আমাকে এই রুমে তোকে পাহারা দিতে রেখেছে, যাতে কেউ না আসে।
মন খারাপ করিস নে। একটু পর মেহেদি অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে। তুই তখন মজা করিস।”
প্রত্যুত্তর করলাম না। শব্দহীন পা জোড়া টেনে টেনে নিজের জন্য বরাদ্দকৃত কামরার দিকে অগ্ৰসর হলাম।
গোছানো পরিপাটি ঘর। আজ অতিশয় বেশিই পরিচ্ছন্ন। আমার অনুপস্থিতিতে রৌধিকের কর্মকাণ্ড, তা বুঝতে আমায় বেগ পেতে হয় নি। শরীর টা মেচমেচ করছে। ঘণ্টা কয়েক এমন ভারী মেকআপে থাকার ফলে স্ক্রিনটা জ্বলছে। শাওয়ার না নিলে চলবে না। একটা গোলাপি রঙের চুরিদার নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালাম।

টুলের উপর বসলাম। রৌধিক ওয়াশরুমের অভ্যন্তরীণ অন্যরকম ভাবে সাজিয়েছে। সেদিনের পর থেকে শুয়ে থাকা তো দূরের কথা বসার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ জায়গাটাও নেই। আজ শরীরটা ভালো নেই। তাই বাথটাবে পানি ভর্তি করলাম। হ্যান্ড শাওয়ার চালু করলাম। ধীরে ধীরে উপরে উঠলাম। বাথটাবের পানিতে পা রাখতেই কেঁপে উঠলাম আমি। বিদ্যুৎ প্রবাহিত হলো। খিঁচুনি দিয়ে উঠল। প্রবল মাত্রায় ঝাঁকুনি অনুভব করলাম। মাত্র পাঁচ সেকেন্ড স্থায়ী হলো সেই যাতনা। আমি বুঝতে ব্যর্থ হলাম সবকিছু, তার পূর্বেই জড়থড় হয়ে নিচে পড়ে গেলাম। জ্ঞানহীন হলাম, তবে বাইরে থেকে কেউ ক্রমাগত চিৎকার করে যাচ্ছে। কিন্তু তার কথায় সাড়া দেওয়ার ন্যায় শক্তিটুকু অবশিষ্ট নেই দেহে। অনেকক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পরে বুঝতে পারলাম, ইনি আর কেউ নয় রৌধিক। ভেতর থেকে মেঝেতে আঘাত করছি। শব্দহীন কণ্ঠে ডাকছি তাকে। তিনি শুনতে পারছেন না। আর তার কণ্ঠ আমি স্পষ্ট শুনতে পারছি। অতঃপর আর কিছু মনে নেই। অবশিষ্ট শক্তিটুকু সেখানেই লোপ পেল। আঁধারে আবৃত হলো আমার অচেতন মস্তিষ্ক। নেত্রযুগলও আঁধারে আবৃত হল।

বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। পাতার উপর পড়তেই ছমছম শব্দ হচ্ছে। জনশূন্য নির্জন রাস্তাঘাট। হাত জোড়া বন্ধ কোনো দৃঢ় বাঁধনে। আমি নিভু নিভু চোখে অবলোকন করলাম। শরীরটা দূর্বল লাগছে। অচেনা জায়গা। পাশে অবলোকন করলেই দেখতে পেলাম রৌধিকের ঘুমন্ত মুখশ্রী। আমার বামহাত ধরে ঘুমিয়ে আছে। মাথা বেডের সাথে হেলেছে। আমি হাত ছাড়ানোর প্রয়াস করতেই নড়চড়ে উঠলেন। থেমে গেলাম। চারদিকে অবলোকন করে বোধগম্য হলো, হসপিটালে আমি। আমি অন্য হাত তার মাথায় লাগলাম। রৌধিক ধরফরিয়ে উঠলেন। বিচলিত কণ্ঠে বললেন, “কী হয়েছে, জোনাকি?”
“শান্ত হোন। আমার কিছু হয়নি। কিন্তু আমরা এখানে কী করছি।”
“কিছু না।” একরোখা জবাব তার।

বলেই প্রস্থান করলেন। পা জোড়া শূন্য। জুতা কোথায়। আমার চিন্তায় জুতার কথা ভুলে গেছেন। দ্বি মুহূর্ত অতিবাহিত হওয়ার পূর্বেই নার্স সমেত হাজির হলেন। নার্স আমাকে চ্যাক করলেন। স্যালাইনের ক্যানেল খুলে দিলেন। আমি কথা বলতে চাইলে, থামিয়ে দিলেন। সোজাসাপ্টা বললেন,
“কথা বলবেন না। এতক্ষণ স্যালাইন না চলাই ভালো। জ্ঞান ফিরেছে, কিছু খাইয়ে দিন। কেউ দেখা করতে চাইলে দেখা করে নিন। শরীর দুর্বল, ঘুমের ইনজেকশন পুশ করব। সো কুইক।”
বলেই চলে গেলেন। রৌধিক পকেট হাতরে ফোন বের করে কল করলেন কাউকে। হুড়মুড়িয়ে হাজির হলেন বাড়ির লোক। যেন হসপিটালেই ছিলেন। মায়ের চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। কেঁদেছেন নিশ্চয়ই। হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে ফিরে পেয়েছেন, তারমধ্যে এতবড় দূর্ঘটনা। আদ্রুপু, ইভু ভাইয়া, বাড়ি সবাই থমথমে। আমার জন্য তাদের আনন্দ মাটি হয়েছে। কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
“সোনা মেয়ে আমার। খুব কষ্ট হয়েছে তোর।‌”

“না, আমি ঠিক আছি। কিন্তু হয়েছেটা কী, সেটা তো বলবে?”
রৌধিক মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, “সেটা তোমাকে বুঝতে হবে না। আগে সুস্থ হও।
তোমার আশেপাশে শত্রুর অভাব নেই, তবুও এতটা কেয়ার-ল্যাস কেন তুমি?”
“কী হয়ে..
“চুপ, বলেছি না, আগে সুস্থ হও।”
হুরমুড়িয়ে প্রবেশ করলেন ইয়ানাত। আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। তার চোখজোড়া ছলছল অশ্রুতে। মা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। ইয়ানাতকে চড় মারলেন। রাগান্বিত কণ্ঠে বললেন, “তুই আবার এসেছিস। তোকে যেতে বলেছি না।”

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ৩৫

“মা। আমি সত্যি অনুতপ্ত। আমি বুঝতে পারিনি।”
“তাহলে আমিও বুঝতে চাইছি না। যা এখান থেকে।”
টানতে টানতে বের করে দিলেন। বেশ খারাপ লাগল তাকে দেখে। রৌধিক নিশ্চয়ই তাকে বলে দিয়েছেন, আমি তার বোন হই। এরজন্যই হয়ত তিনি এতটা হাইপার। তাকে দেখে এটা বেশ বুঝতে পারছি, তিনিই কিছু করেছেন‌। কিন্তু করেছেন টা কী? আমার অসুস্থ হওয়ার পেছনে তার কোনো হাত নেই তো!

অনুবদ্ধ আয়াস শেষ পর্ব