অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ৩৪

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ৩৪
ইফা আমহৃদ

“হম, আপনি সত্যিই বাবা হতে চলেছে। ও আমাদের সন্তান। আপনার আর আমার অংশ।”
রৌধিকের পলক স্থির। কোনো শক্তপোক্ত অদৃশ্য বন্ধন দ্বারা তিনি বেষ্টিত। তিনি পেটের উপর থেকে কাপড় সরালেন। শব্দ করে ওষ্ঠদ্বয়ের শীতল স্পর্শ ছুয়ালেন। কম্পিত হলাম। হাত পা ক্রমশ বরফাচ্ছন্ন হয়ে কাঁপছে। এটা প্রথম নয়, বরাবরই এমন অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়। অস্বস্তির ইতি টেনে ওনার কাঁধে হাত রেখে বলি,
“উঠুন, রাত বাড়ছে।”
প্রতুক্তি নেই। আমার কথন তার কর্ণদ্বয় অবদি পৌঁছেছে কি-না, তার ভাবাবেগ দ্বারা বুঝা গেলা না। হুট করেই কোলে তুলে নেয়। বেডের উপর পা ঝুলিয়ে বসিয়ে দিলেন। পুনরায় হাঁটু মুড়ে বসে ধীরে ধীরে বললেন,
“জোনাকি, তোমার পেটের উপর একটু মাথা রাখব। বেশি না, একটু সময়। আমি আমাদের সন্তানের হৃদস্পন্দন গতি শুনতে চাই। প্লীজ।”

উত্তরের প্রত্যাশায় থাকলেন না। লহমায় তার মস্তিষ্ক গুঁজে দিলেন আমার পেটে। শরীর পর্যাক্রমে হিম দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। আমি টেবিলের উপর কনুই রেখে গালে হাত দিয়ে বসে রইলাম। তিনি তথাপি বলে উঠেন, ” আলফা, দেখতে পাচ্ছো প্রিন্সেস। আমি তোমার পাপা!”
“অ্যা! আলফা।” এক লহমায় নাম স্থির করে ফেললেন। ছেলে না-কি মেয়ে তাও ফ্রিক্স। কীভাবে সম্ভব? তবে ‘আলফা’ নামটা যথেষ্ট সুন্দর। একদম হার্ট টার্সিং। সন্দিহান স্বরে বললাম,
“আপনি কীভাবে জানলেন, মেয়ের হবে? ছেলেও হতে পারে মিস্টার।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“না, মেয়ে হবে। একদম তোমার মত। ছোট জোনাকি। একই নাক, একই চোখ, একই হাসি। আধো আধো স্বর। ঠিক তোমার মত? তোমার ছোটবেলা আলফার মাধ্যমে উপলব্ধি করতে চাই। জ্যোতিষী বলেছে মেয়ে হবে।”
আমার চোখ চড়কগাছ। ইতোমধ্যে তার জ্যোতিষীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। সর্বাপেক্ষা কিৎকর্তব্যবিমূঢ় বিষয় তিনি এইসব বিশ্বাস করেন। কৌতূহল দমিয়ে রাখতে ব্যর্থ হয়ে বলি,
“আপনার মত একজন ছেলে এইসবে বিশ্বাসী?”
“আমি এইসব বিশ্বাস করি না কিন্তু এককালে করতাম। তখন ছোট ছিলাম। জ্যোতিষী বলেছে, আমার একটা কিউট দেখে মেয়ে হবে। অবিকল আমার স্ত্রীর ন্যায়। তারপর থেকে সর্বদা ভাবতাম আমার মেয়ে হবে।
ইন শা আল্লাহ। আল্লাহ আমাকে নিরাশ করবেন না।”
আমি নিশ্চুপ। মানুষটা বড়ই অদ্ভুত, বুঝা কঠিন। আমাকে নিজের স্ত্রীরুপে মেনে নিতে নারাজ ছিলেন, অথচ এখন বলছেন তার মেয়ে লাগবে। আচ্ছা, তার আকাঙ্ক্ষার পূর্ণতা পাবে তো?”

বৃষ্টি পতিত হচ্ছেনা, তবে রেশ এখনো কাটেনি। দুদিন থেকে ঢেড় বজ্রসহ বৃষ্টি হচ্ছিল, তবে এখন নেই। সেদিনের পর কেটে গেছে দিন পনেরো। এখন পুরোপুরি সুস্থ রৌধিক। একদম সুস্থ। নতুন একটা জবের জন্য ট্রাই করেছেন। বিনা বিলম্বে জবটা পেয়ে গেছে। তিনদিন হল জয়েন করেছে। তিনি অফিসে থাকলেও ঘণ্টা অন্তর অন্তর ফোন করে বেবীর কথা জিজ্ঞেস করতে বিস্মৃত হয় না। ধীরে ধীরে তার পাগ’লা’মী ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। বাড়ির সকলে যোগ দিয়েছে সাথে। আগামীকাল থেকে বিয়ের তোড়জোড় শুরু হবে। রৌধিকের অ্যাক্সিডেন্টের নিমিত্তে বিয়েটা পিছিয়ে ছিল। ইতোমধ্যে গ্ৰাম থেকে সবাই চলে এসেছে। বাড়ির বাদবাকি ঘরগুলো জনমানবে পরিপূর্ণ। আমি প্রেগন্যান্ট বিধেয় এই ঘরটায় অন্য কারো প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষেধ। রৌধিক কড়াকড়ি আরোপ করেছেন।
সবে শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েছি আমি। কেশসমূহে টাওয়াল জড়াচ্ছি। ইদানিং ওয়াশরুমে একবার ঢুকলে বের হতে ইচ্ছে করে না।‌ হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকি। এইত সেদিনের কথা,

বিদ্যুৎ বিভ্রাট ছিল। তখন রাত আটটা নাগাদ। আইপিএস ডিসপ্লেতে সমস্যা ছিল। প্রচুর উষ্ণতায় আমার অবস্থা নাজেহাল। তখন আমার কি করা উচিত ছিল! সর্বোচ্চ ব্যালকেনিতে গিয়ে দাঁড়ান। নতুবা আদ্রিতাকে নিয়ে বাগানে হাঁটাহাঁটি করা। কিন্তু তেমন কিছু করিনি। ওয়াশরুমের দরজার ভিড়িয়ে বালিশে মাথায় দিয়ে ভেতরে ঘুমিয়ে ছিলাম। শাওয়ার চালু ছিল। ভিজে জবুথবু হয়ে গেছিলাম। এদিকে রৌধিক বাড়িতে এসে আমাকে খুঁজে না পেয়ে পুরো বাড়ি মাথায় করেছিলেন। সর্বস্থানে খুঁজেও মেলেনি আমার সন্ধান। চিৎকার করে ডেকেছিলেন। তাতে আমার কী?
আমি আমার মত ঘুমিয়েছি। অবশেষে রাত দুটোর দিকে নিদ্রাভঙ্গ হয়েছে আমার। জামা কাপড় চেঞ্জ না করে সেভাবে বেডের উপর শুয়ে ছিলাম। বাড়িতে তখন কেউ ছিল না। সবাই আমাকে খুঁজতে বেরিয়েছিল। অতঃপর ভেজা জামা কাপড় নিয়েই নিচে যাই, প্রচুর ক্ষুধা লেখেছিল। স্টার্ফরা আমাকে দেখে রৌধিককে ফোন করে জানায়। মিনিট দশেক পর সবাই হাজির। আমাকে দেখে ভয় জবুথবু হয়ে যায়। রৌধিক তো সবার সামনে জড়িয়ে ধরেছিল।‌ কি লজ্জা! কি লজ্জা!

কিন্তু পরক্ষণে সে লজ্জা ধুয়ে গেছিল। রৌধিকের পরপর ধমকে সেদিন এই উদ্ভর ভাবনার কথা মস্তিষ্ক হতে চিরতরে বিদায় নিয়েছে। সকালে গা কাঁপিয়ে ধুম জ্বরে আক্রান্ত হই। রৌধিকের কড়া নির্দেশ ছিল, ডাক্তার দেখান যাবে না। বিনিময়ে জ্বরের মাত্রা বাড়ছিল। জ্বরের ঘোরে অচেতন অবস্থায় ছিলাম। প্রচুর জ্বালিয়েছি তাকে, ইচ্ছাকৃত। অবশেষে নিজেই ডাক্তার ডেকে এনেছিল। কি যত্ন! আলফার জন্য বেঁচে গেছিলাম। যদি পারতেন, প্রচুর শাস্তি দিতেন।
ফোনের রিংটোনের তুমুল শব্দে ভাবনার ছেদ ঘটল।‌ ব্যালকেনি থেকে রুমে এসে দেখলাম, রৌধিক ফোন করেছেন। রিসিভ করতেই কড়া গলায় বললেন,
“তিনবার ফোন দিয়েছি। কোথায় ছিলে? কতবার বলেছি ঘর থেকে একদম বের হবে না। মনে নেই?
সূচনা হলো তার ভাষণ। কর্ণপথ থেকে ফোন সরিয়ে কিছুদূর রেখে দিলাম। কর্ণ পরিষ্কার করে কিয়ৎক্ষণ ফোন পর কর্ণের কাছে ধরলাম। তিনি বললেন,
“ধীরে ধীরে তৈরি হয়ে নিচে এসো। আদ্রুকে বলো, তোমাকে রাস্তায় দিয়ে যেতে।‌ আমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। দ্রুত..
বলেই ফোন টেনে দিলেন। আমি ফোন কানে নিয়েই ব্যালকেনিতে চলে এলাম। রৌধিকের গাড়ি দেখা যাচ্ছে। নিশ্চয়ই তিনি এসেছেন। এখন কোথায় নিয়ে যাবে?

আমি দ্রুত জামা চেঞ্জ করে নিলাম। আদ্রুপুকে নিয়ে গাড়ির কাছে গেলাম। বাবা এবং জয়াকে নিয়ে এসেছেন তিনি। ব্যাগপত্র দাড়োয়ান চাচাকে দিয়ে উপরে পাঠালেন। আদ্রুপুকে জয়াকে নিয়ে যেতে বললেন। বাবা এবং জয়ার সাথে টুকিটাকি কথা হল। বাবাকে নিয়েই কোথাও একটা যাবেন। আমি বুঝতে পারলাম না তার কথার ধরণ।
গাড়ি এসে থামল জমকালো বাড়ির সামনে। বাইরে তাকাতেই ‘আমহৃদ’ বাড়ি নজরে এলো। চমকালাম আমি। এতদিন পর হঠাৎ এখানে কেন? বাবা গাড়ি থেকে নেমে সোজা বাড়ির ভেতরে গেলেন। আমাকে ধীরে ধীরে গাড়ি থেকে নামালেন রৌধিক। আমি আহাম্মকের ন্যায় জিজ্ঞেস করি,
“আমরা এখানে কেন এসেছি? আজকের পর থেকে তারাই তো আমাদের বাড়ি যেতেন।”
“কারণ তুমি, জোনাকি! তুমি আমাকে পিতৃত্বের স্বাদ দিয়েছ। আমিও চাই, যে আমাকে এই স্বাদ দিয়েছে, তার বাবা মাকেও একই স্বাদ দিতে।”
“মানে!” না বোঝার স্বরে।
“ভেতরে চলো, বুঝতে পারবে।”
মাথা নেড়ে সম্মতি দিলাম। অতঃপর পা বাড়ালাম। ভেতরে ঢুকতেই ইমতিয়াজ আমহৃদ আর মিতা আন্টিকে বসা দেখলাম সোফায়। বাবা তার পাশে বসে আছে। রৌধিক আমাকে সবার সামনে নিয়ে দাঁড় করালেন। মিতা আন্টি উঠে এলেন আমায় দেখে। হাত হাত ছুঁয়ে বললেন,

“কেমন আছো জোনাকি? বাবু কেমন আছে?”
“বাবু নয় আলফা। তোমার নাতনি আলফা।”
মিতা আন্টি বিরবিরিয়ে করে আওয়ালেন,” আল-ফা! আল-ফা!”
নামটা তার হৃৎপিণ্ডে ছড়িয়ে গেল। অনুভূতিতে পূর্ণ হলেন। রৌধিক আমার হাতজোড়া তার হাতের মাঝে গুঁজে দিয়ে বললেন,
“তোমাকে কথা দিয়েছিলাম মামুনি। তোমার মেয়েকে তোমার হাতে তুলে দিব। এই নাও তোমার মেয়ে। আমি আমার কথা রেখেছি।”
“মা..মানে?” কাঁপা কাঁপা মিতা।
“মানে এই তোমার ছোট, ইফা! তিনবছর বয়সের হারিয়ে যাওয়া মেয়ে। এখন একটু বড় হয়েছে। তবে তোমার কাছে ছোটই আছে।”
মিতা আন্টি স্থির, কথা বলতে ভুলে গেছেন। আমিও স্থির। আমি কেন তার মেয়ে হতে যাবো। আমার মা তো নেই, গত হয়েছেন। সব প্যাঁচিয়ে যাচ্ছে।

“কিসব বলছেন আপনি। আমি জোনাকি, আমার বাবার মেয়ে। ইফা নই।”
ইমতিয়াজ আমহৃদ আবেগে আপ্লুত হলেন। তবুও তার সিদ্ধান্তে অনড়। প্রমাণ চাইলেন। রৌধিক সময় নিলেন না, আমার গলা থেকে লকেটটা খুলে তার হাতে ধরিয়ে দিলেন। এপিঠ ওপিঠ করে দেখে বললেন,
“এ এটা তো আমার মেয়ের, ওর কাছে কি করে গেল?”
“এটা আমার।” বলেই তার হাত থেকে নিয়ে নিলাম।
রৌধিক দৃঢ় প্রমাণ স্বরুপ বাবাকে দাঁড় করালেন। সন্দিহান স্বরে বললেন, “ওনাকে একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করুন, চিনতে পারছেন কি-না?”

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ৩৩

“না।” একত্রে বলে উঠে দু’জনে।
লহমায় একটা ছবি এগিয়ে দিলেন তাদের দিকে। উক্ত ছবিতে আমি বাবার কোলে। ছোট বেলার ছবি। মাথার দু’পাশে দুটো বেনুণী করা। আমি চুল ধরে আছি। ছবিতে বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
“এই মানুষটাকে চিনেন?”
বেশ কিয়ৎক্ষণ সময় নিলেন। লহমায় উত্তেজিত হয়ে উঠলেন, “এই সেই লোকটা, যার কাছে আমার মেয়েকে রেখেছিলাম।”

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ৩৫