অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ৩৩

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ৩৩
ইফা আমহৃদ

ধোঁয়া ওঠা গরম সুপ্যের বাটি টেবিলে। ওষুধের সময় দেখতে মনযোগী। অধিকতর নিদ্রাচ্ছন্ন রৌধিক। ব্যথায় টনটনে দেহখানা। নড়াচড়া করলেই তাজা হয়ে উঠে লহমায়। যাতনায় ছটফট করতে করতে সবে নিদ্রায় মগ্ন। নিদ্রাকর্ষক মুখশ্রীটা ভিন্নরকম। জেগে তোলার স্পৃহা নিমিষেই ঘুচে গেছে। অথচ করণীয় কিছু নেই। ক্ষুধার্ত রাখা যাবে না। নিজের সাথে লড়াই করে অবশেষে ডাকলাম রৌধিককে। ক্লান্ত নেত্র যুগল মেলেই আরও দৃঢ় হল নিদ্রায়। এবার শরীরে হাত দিয়ে ডাকলাম। রৌধিক নিদ্রাঘোরে ‘আহ্’ শব্দটি নির্গত করলেন। তৎক্ষণাৎ আমি হতাশাগ্ৰস্থ কণ্ঠে বলি,

“কি হয়েছে? ঠিক আছেন? ব্যথা লেগেছে?”
“বুকেও আঘাত পেয়েছি, তাই..
নতজানু করলাম মস্তিষ্ক। নিজের অগোচরেই তাকে তীব্রতর আঘাতে জর্জরিত করলাম। মিনমিনে গলায় বললাম, “স্যরি, আমি বুঝতে পারিনি।”
“ইটস্ ওকে। স্যরি বলার দরকার নেই।”
পিঠের পেছনে বালিশ দ্বারা আবৃত করলাম। অতঃপর তাকে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিলাম। ট্যাবলেট ও পানি এগিয়ে দিলাম। হাতে ব্যান্ডেজ বিধেয় ধরতে সক্ষম হলেন না। তাই আমি খাইয়ে দিলাম। স্যুপ তুলে চামচ পরিমাণ এগিয়ে দিতেই নাকচ করলেন তিনি। সোজাসাপ্টা বললেন, ” গলায় ব্যথা জোনাকি। সামান্য ট্যাবলেট খেতেই গলায় আঁটকে আসে। খেতে পারব না।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“এতবড় শক্তিশালী একজন সুদর্শন সুপুরুষের মুখে একথা মানায় না। সামান্য একটা ট্যাবলেট খেতে পারছে না। হাউ ফানি।
লোকেরা জানতে পারলে, আপনাকে মিউজিয়ামের রাখার ব্যবস্থা করবে। তার আগে চট করে খেয়ে ফেলুন তো!”
ভ্রু কুঁচকালেন তিনি। হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। পুরনো সেই দিনের মত। হাত পা যথারীতি কম্পিত লাগল। আমার হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পাল্টে দিয়ে বললেন,
“তুমি আমাকে বিদ্রুপ করছ না-কি বাচ্চা বোলাচ্ছ কোনটা বলত?”
“মিস্টার আপনি কি বাচ্চা যে, আপনাকে বোলাতে যাব।”
“তাও..

পরবর্তী শব্দটা মুখের আঁটকে রইল। নির্গত হওয়ার সময় হল না। আমি চামচ মুখে তুলে দিলাম। পরপর কয়েক চামচ খাইয়ে দিলাম। অতঃপর খাবারের পরবর্তী মেডিসিনগুলো খাইয়ে দিলাম। রৌধিক রীতিমত ঘামছেন। সর্বদা সন্ধ্যার পর মুহুর্তে কিংবা অফিস থেকে এসেই শাওয়ার নেয়। আজকে ব্যান্ডেজের কারণে পানির সংস্পর্শে অব্দি যায়নি। উপরের শার্টটা খুলে দিতে বললেন। খুলতে সাহায্য করার পরক্ষণেই এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিল। উষ্ণতা যেন কমছেই না। অথচ হিমলতায় আমার অবস্থা শোচনীয়। বাধ্য হয়ে টাওয়াল ভিজিয়ে নিয়ে এলাম। তার সর্বাঙ্গ আর্দ্র টাওয়াল দ্বারা ভিজিয়ে দিতে লাগলাম। তার স্থির দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ।
গলার কাছে মুছে এক পলক অবলোকন করলাম তার মুখ। এখনো একই ভঙ্গি। অস্বস্তি বোধ হল। আমি আমার কাজে মনোনিবেশ করলাম। হাত ধরে ফেললেন। ফিচেল হেসে বললেন,

“আমার জন্য তোমাকে অনেক কষ্ট করতে হচ্ছে জোনাকি। আ’ ম রিয়েলি স্যরি।”
আমি হাত ছাড়িয়ে নিলাম। পুনরায় মুছতে শুরু করি। তার দিকে তাকানোর ফুরসৎ নেই। তবুও নিজের অস্বস্তির ইতি টেনে বলি,
“আপনি আর আমি একই। এক আত্মা এক প্রাণ। আপনাকে সাহায্য করা মানে নিজের সাহায্য করা। নিজের জন্য কেউ কখনো বিরক্ত বোধ করে।”
রৌধিকের অপলক দৃষ্টি। তার দৃষ্টি ক্রমশ প্রখর হচ্ছে। আমি অস্বস্তিতে কাদা হয়ে যাচ্ছি। নিজের কাজের মাঝে আমার বেবীটার যত্ন নিতে ভুলে গেছি। খাওয়া-দাওয়া করা হয় না সময়মত। আমার ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে রৌধিক বললেন,
“তা না-হয় বুঝলাম। এবার কি এত ভাবছ?
জোনাকি, আমি কখনো আমার কাজ অন্যকে দিয়ে করাইনি। তুমিও প্রথম। কেমন একটা লাগছে। ঘরেও থাকতে ভালো লাগছে না। নড়াচড়া করতে পারছি না।”
বলেই দীর্ঘ শ্বাস-প্রশ্বাস নিলেন। হুট করেই অন্তঃকরণের বাঁধ ভাঙল। দ্বিধাহীন চিত্তে বলে ফেলি, “আমি একটা খবর দিলে, আপনার ঘর‌ ছেড়ে কোথাও যাবে ইচ্ছে করবে না।”
“কী, খবর?”

“এখন বলব না। কিছুদিন পর বলব, আগে আপনি সুস্থ হন।‌ এই সংবাদটা পেলে আপনি চুপ থাকতে পারবেন।”
ততক্ষণে তার দেহখানা মুছা শেষ। আমি টাওয়াল নিয়ে ওয়াশরুমের নিমিত্তে পা বাড়ালাম। দু’পা ফেলে তৃতীয় পা ফেলতেই হাত ধরে ফেললেন রৌধিক। কোমর জড়িয়ে ধরলেন। কিছুতেই ছাড়বেন না। আমি পড়লাম ফেঁসাদে। কীভাবে সূচনা ঘটাব। মিনিটের ব্যবধানে রাজ্যের লজ্জারা বেষ্টিত করল আমায়। লজ্জামিশ্রিত মুখটা নত হল। গালে রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়ল। ওষ্ঠদ্বয় একে অপরের থেকে বিন্দু পরিমাণ কিঞ্চিৎ করতে ব্যর্থ আমি। অথচ সর্বদা কারণে অকারণে ওষ্ঠদ্বয় একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে। নিঃশ্বাস টানলাম। অধর কামড়ে ধীরে ধীরে বললাম,
“আমি। আমি। আমি..
“তুমি কী জোনাকি?”
“আমি। না না আমি নই, আপনি। আপনি..
“আমি কি জোনাকি..

কথনগুলো গলায় দলা পাকিয়ে রইল। আমি নিরুপায়। বচনহীন।‌ বেশ কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হওয়ার পরেও যখন একটি শব্দও মুখ দেখে নির্গত করতে পারলাম না। তখন বোধগম্য হল, তাকে বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। অন্য উপায় অবলম্বন করতে হবে। আমি আঙুল তুলে কাবার্ডের তিন নং ড্রয়ারে ইশারা করলাম। মিনমিনিয়ে বললাম, “ওখানে আপনার কাতরতার উত্তর রয়েছে।”
রৌধিক সন্দিহান চোখে চেয়ে থেকে উঠে দাঁড়ালেন। নিজের কৌতুহল দমিয়ে রাখতে ব্যর্থ হলেন। ড্রয়ারের দিকে অগ্ৰসর হলেন। স্বযত্নে খুললেন। অতিশয় সাবধানতা অবলম্বন করে। আমি ক্রমাগত ঘামচি। রৌধিক পশ্চাৎ ফিরলেন। এমন ব্যবহারে আমার অস্বস্তি তরতর করে বাড়ছে। কাবার্ড খুলতেই বাচ্চাদের ছবি নজরে এলো। ঘাড় কাত করে ছবিটা দেখলেন তিনি। দৃষ্টি সরি আমার দিকে আকর্ষণ করে ইশারায় বললেন, “কী?”
পরক্ষণে ড্রয়ারে হাতরে দু’টো জুতা পেলেন। বাচ্চার জুতো। সদ্য জন্ম নেওয়া বাচ্চাদের পড়ার উপযোগী জিরো সাইজের কাপড়ের জুতো। রৌধিক একবার জুতো আরেকবার বাচ্চার ছবিটার দিকে তাকাচ্ছেন। অবশেষে ধৈর্য্যহারা হয়ে গেলেন। আমাকে মাথা চুলকে বলেন,

“তোমার কী খেয়ে দেয়ে কাজ নেই জোনাকি। এইসব দিয়ে কাবার্ড ভরে রেখেছ? এজন্যই বলেছিলে, আমি বাইরে যেতে চাইব না। সিরিয়াসলি! আমাকে আবার তুমি ছেলে বুলাচ্ছ। আমি ফেলে দিচ্ছি এগুলো।
“না” বলে চ্যাঁচিয়ে উঠলাম আমি। রৌধিক এক’পা ফেলে উপর পা তুলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হয়ত ভাবছে, সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে আমার রিয়েকশন এমন কেন?
আমি দীর্ঘশ্বাস নিলাম। এই লোকটাকে কীভাবে বুঝালে তিনি বুঝবেন? সব দিব্যি বুঝেন, এটা বুঝেন না। টেনে টেনে বললাম, ” কিছু না। আপনাকে কিছু বুঝতে হবে না। ওগুলো আমার দিন। আপনি আসুন শুয়ে পড়ুন। রাত বাড়ছে। ঘুমের অভাবে অসুস্থ হয়ে পড়বেন!”

“আমি সত্যি কিছু বুঝতে পারছি না জোনাকি। এগুলো যখন তখন কেনা যায়। সামান্য এই জিনিসগুলো নিয়ে এত বিরক্ত কেন তুমি?”
প্রত্যুত্তর দিলাম না। কোনো কথা নেই তার সাথে। কোনো কথা নেই। আমি তাকে ঠিকই বলব, তবে মুখে নয়। তার যেমন বুঝার ক্ষমতা নেই, আমার তেমনি বলার মত তেজ অবশিষ্ট নেই। ফাঁকা মস্তিষ্কে কিয়ৎক্ষণ গভীর ভাবনায় লিপ্ত হলাম। অতঃপর উঠে ব্রাশদানী থেকে তিনটা ব্রাশ নিলাম। রৌধিকের অগোচরেই। তার ব্রাশটা এগিয়ে দিলাম। তিনি ধরে এপিঠ ওপিঠ করে বললেন,
“এটা আমার ব্রাশ। এখন আর ব্যবহার করব না। অনেকদিন হয়ে..
“চুপ একদম চুপ। বুঝতে তো পারেন না। আমি বুঝাচ্ছি তাও বকবক করে যাচ্ছেন। একদম চুপ।”
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিক্ষেপ করে বললাম আমি। রৌধিক বাক্যের সমাপ্তি না টেনেই চুপ করে রইলেন। লহমায় নিজের ওষ্ঠদ্বয় কিঞ্চিৎ ব্যবধান মিটিয়ে নিলেন তর্জনীর সহায়তায়। শান্ত বাচ্চার ন্যায়।
পরক্ষতেই আমার ব্রাশ দিলাম। তিনি হাতে নিয়ে বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। অন্য আঙুল দিয়ে শব্দহীন স্বরে বললেন, ” তুমি!”
“হ্যাঁ।”

তৃতীয় ব্রাশটা একদম ছোট। আদ্রিতা এনেছিল আজকে। ব্রাশটা দেখে বাবুর কথা মনে পড়েছিল। তবে বাবুর কোনো নাম রাখা হয়নি। সেটা আপাতত মহাশয়ের কাজ।
তিনি জানতে পারলে বলবেন,
“আমি বাবা হতে চলেছি, অথচ আমিই জানি না। তোমরা নাম ঠিক ফেলেছ?”

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ৩২

আমি ভাবনা থেকে বেরিয়ে রৌধিকের হাতে তৃতীয় ব্রাশটা এগিয়ে দিলাম। তিনি ব্রাশটা নিয়ে আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। কিছু বলতে না দিয়ে আমি তার হাতটা নিজের পেটের উপর রাখলাম। রৌধিক বাকহীন। তার অনুভূতিটা দেখার জন্য চাতক পাখির ন্যায় হাপিত্যেশ করে রইলাম। হাত সরিয়ে ফেললাম। রৌধিক তার হাত সরালেন না। ভুলে গেলেন। বিনিময়ে দৃঢ় করে চেপে ধরলেন। কেঁপে উঠলাম আমি। তিনি পাথর। হাঁটু মুড়ে বসলেন। দুই হাত রাখলেন। পিছিয়ে যেতে ব্যর্থ হলাম। তার নেত্রযুগল চিকচিক করছে জলে। টেনে টেনে বললেন,
“জো জোনাকি, সত্যি? আমি বাবা..

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ৩৪