অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ৩৫

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ৩৫
ইফা আমহৃদ

“এই সেই লোকটা, যার কাছে আমার মেয়েকে রেখেছিলাম। আমাকে মেয়েকে নিয়ে পালিয়েছিল। আমি কত খুঁজেছি, কিন্তু পাইনি।”
মিতা যথারীতি ক্ষিপ্ত হলেন। এগিয়ে গেলেন বাবার দিকে। রৌধিক থামিয়ে দিলেন। স্টার্ফদের ডেকে পানি আনতে বললেন। আমি নিশ্চুপ। একপাশে দাঁড়িয়ে তাদের কাণ্ড দেখছি। ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতেই এগিয়ে এলাম। চড়া গলায় বললাম,
“হচ্ছেটা কি এখানে? কী হচ্ছে। [রৌধিককে উদ্দেশ্য করে] আপনি আমাদের এখানে কেন এনেছেন। বাবার অপারেশন করতে আপনার থেকে টাকা নিয়েছিলাম বলে। ঠিক আছে, শর্ত মোতাবেক আমি চলে যাবো। হ্যাপি।”

“জাস্ট শাট আপ, জোনাকি। এতটা অবুঝ নয় যে, ধরে ধরে বুঝাব। কান খুলে শুনে রাখো,
তুমি এই বাড়ির ছোট মেয়ে। যার সাথে আমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। ইয়ানাত ও ইভুর ছোট বোন।
তোমার মনে না থাকা, স্বাভাবিক। তবে এই বাড়ির ছোট মেয়ে ছিল। তা নিশ্চয়ই অজানা নয়।”
আমি শব্দহীন স্বরে মাথা নাড়ালাম। রৌধিক মিতা আন্টিকে বলতে বললেন। মিতা আন্টি এতক্ষণে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস স্থাপন করলেন, আমিই তার হারিয়ে যাওয়া মেয়ে। অশ্রুসিক্ত নয়ন। দৃষ্টি টলমলে। শ্বাস-প্রশ্বাস টেনে বলেন,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“তখন আমার মেয়ের সবে তিন বছরে পা রেখেছে। ঘরমুখো পরিবেশ। ট্রেনে গ্ৰামের উদ্দেশ্য পাড়ি জমাই। এর আগে কখনো ভিড়ভাট্টায় গ্ৰামে যাওয়া হয়নি।মধ্যবিত্ত পরিবার ছিল আমাদের। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন হতে যাত্রা শুরু হয়। আমার কোলে ছিল ইফা আর হাত ধরা ছিল ইয়ানাত। ওর বাবার কাছে ছিল ইভু আর জামা কাপড়ের ব্যাগপত্র। আমি ওর বাবার আগেই ট্রেনে উঠি। ট্রেন ছেড়ে দেয়, কিন্তু ইভু আর ওর বাবাকে দেখতে পাই না। আমি বিচলিত হই। সামনের কেবিনে তিনি আর তার স্ত্রী ছিলেন। তাদের কাছে ইয়ানাত আর ইফাকে রেখে দরজার কাছে আসি। ইয়ানাত বয়সে বড় হওয়ার কারণে আমার আঁচল ধরে সাথেই আসে। ভিড়ভাট্টা ঠেলে দরজার কাছে আসতেই ধাক্কাটা জোয়াল হলো। মুখ থুবড়ে পড়ে যাই চলন্ত ট্রেন থেকে। ইয়ানাত তা দেখে সেও লাফ দেয়। মাথা ফেটে যায় ইয়ানাতের। আমি জ্ঞান হারিয়েছি। ধরাধরি করে হসপিটালের নিয়ে যায়। ইয়ানাতের চিন্তায় ইফার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। পরে যখন মনে পড়ে তখন অনেক খুঁজেছি, পাইনি। বিজ্ঞাপন দিয়েছি। নিউজ করেছি। বোনকে হারিয়ে ইয়ানাত ইভু ভেঙে পড়েছিল আর রৌধিক তো পাগল হয়ে গেছিল। নয় বছরের রৌধিককে শান্ত করাই যাচ্ছিল না। মেন্টাল এসাইলামেও পাঠান হয়েছিল। হিতে বিপরীত হয়। সে স্টেশনে গিয়ে বসে থাকত। উগ্র মেজাজী। ব্যবহারের পরিবর্তন হতে থাকল। তাই বাধ্য হয়ে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়।”

আমি বরাবরের ন্যায় নিশ্চুপ। একদম প্রাণহীন। রৌধিক এত পাগলামি করেছেন? আমার ভাবনার মাঝেই বাবা বলেন,
“সারারাত মা মা বলে কাঁদছিল ইফা। এক পর্যায়ে ঘুমিয়ে যায়। গ্ৰামে ফিরে আপনাদের খোঁজার চেষ্টায় বাকি রাখিনি। আমরাও বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম। শহরে ওসেও খুঁজেছি, পায়নি। আমার স্ত্রী এক পর্যায়ে বলেন ওকে আমাদের কাছে রেখে দিতে। নিসন্তান পিতা মাতার সন্তান হিসেবে। ওর নাম জানতাম না আমি। আমাদের আঁধার ঘরের নিভু নিভু আলো হিসেবে ওর নাম রাখি জোনাকি। তারপর ও আমাদের পরিচয়েই বড় হয়। কখনো বুঝতে দেইনি, আমরা ওর আসল পিতা মাতা নই।”

তিনি থামতেই রৌধিক বলতে শুরু করল, “বিদেশে গিয়ে সবকিছু মানে ইফাকে মিস্ করতাম। ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম প্রচুর। কিন্তু পারিনি। একসময়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। ইফাকে ভুলতে শেফা নামের একটি মেয়ের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলি। কিন্তু বিয়ের সময় সে পালিয়ে যায়। বাবা ধরে বেঁধে জোনাকির সাথে বিয়ে দেয়। জোনাকির সাথে থাকতে অহেতুক ভালো লাগে আমার। ওর অশ্রু দেখলে কষ্ট পাই আমি। সেদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে দেখি আশেপাশে জোনাকি নেই। আমি বাড়ি থেকে বের হই দ্রুত। কিছুদূর যেতেই জোনাকির দেখা পাই। একটা জুয়েলারি দোকানে। জোনাকি বের হতেই আমি সেই দোকানে গিয়ে জানতে পারি, লকেট বিক্রি করতে এসেছিল। লকেটটা দেখেই আমার সন্দেহের সুত্রপাত। কারণ সেইম লকেট ছিল ইফার। ধীরে ধীরে খোঁজ খবর নিতে থাকি। আশেপাশে মানুষের কাছ থেকেও জানতে পারি। তারপর ব্লাড টেস্ট, ডিএনএ টেস্টে আমি সিউর হয়ে যাই।”

মিতা অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিলেন আমায়। ইমতিয়াজ আমহৃদ আবেগে আপ্লুত হলেন। তার ছোট মেয়েকে ফিরে পেয়েছেন বলে কথা। তবে ব্যাপারটা আপাতত কেউ জানে না। বিয়ের পরে সবাইকে জানাবে। ভাবতেই অবাক লাগে আমি এই বাড়ির মেয়ে। এত ভালোবাসা সব আমার। আনন্দে তো কেঁদেই দিয়েছি শেষে।

জানালার পাশে বসে আছি। রৌধিক শাওয়ার নিতে গেছে। ঘণ্টাখানেক পূর্বে বাড়িতে ফিরেছি। মা অনেকবার বলেছিলেন, থাকার কথা। বহুদিন, বহুবছর পর নিজের মেয়েকে কাছে পেয়েছে। রৌধিক কিছুতেই রাজি হয়নি। তার এক কথা, বউ বাচ্চা ছাড়া থাকতে পারবে না। প্রয়োজনে বিয়ের পর আমাকে রেখে যাবে। আমারও মন ভার হলো, মা বাবার সাথে একটু থাকতে পারলাম না। আর্দ্র স্পর্শে ভাবনার ছেদ ঘটল। রৌধিক ছাড়া কেউ নয়। সেটা বোধগম্য হতে সময় লাগল না। এটা তার নিত্যদিনের অভ্যাস। ছোট আলফার সাথে কথা বলা।
মাথা তুলে বেশ কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর বললেন, “রেগে আছো?”
প্রতুক্তি নেই। পুনরায় বললেন, ” বেশি রেগে আছো? ওহ্ আচ্ছা। বাবা মা পেয়ে আমাকে ভুলে গেছ?”
“আপনাকে কেন ভুলব, হ্যাঁ? একটু মায়ের কোলে মাথা রেখে কথা বলতে পারলাম না। বাবার সাথে মন খুলে হাসতে পারলাম না। ভাই বোনকে এক নজর দেখতে পারলাম না।”

বিনিময়ে দৃঢ় করে মাথা গুঁজে দিলেন পেটে। ভিজে গেল খানিকটা জামা। কোমর জড়িয়ে ধরে বললেন,
“কিন্তু তুমি আমার কাছে না থাকলে তোমাকে দেখতে পারব না, হাসতে পারব না, ঘুমাতে পারবে না, খেতে পারব না। সবগুলোই যে একত্রে।”
মানুষটা আজব। ঠিক হারিয়ে যাওয়া সকলের থেকে খুঁজে বের করেছে। এত ভালোবাসা কি আদৌও আমার প্রাপ্য।‌

লালে নীলে সেজে উঠেছে আহম্মেদ বাড়ি। বাইরে কাজে ব্যস্ত পুরুষ জাতি। মেয়েরা সাজতে ব্যস্ত। আদ্রিতার সাজ প্রায় শেষের দিকে। পাক্কা দুই ঘণ্টা লেগেছে হলুদ সাজে। গ্ৰাম থেকে অনেকে এসেছে। গমগম করছে চারিপাশ। তাই হলুদের অনুষ্ঠান দুপুরে করা হয়েছে। দুই পক্ষের হলুদ একসাথে। এতে লোকজনের আনাগোনা একটু বেশিই। রৌধিক বোনের বিয়ে উপলক্ষে পাঁচ দিনের ছুটি নিয়েছেন। সবে জয়েন করেছে নাহলে আরও কয়েকটা দিন নিতেন। বর্তমানে কোমর বেঁধে কাজ করছেন বাইরে। বিরিয়ানি রান্না করছে। সেখানে তদারকি করছেন।
আদ্রুপু শাড়ির কুচি ঠিক করতে করতে বলেন,
“জোনাকি, তুই সেজে নে। অনুষ্ঠান শুরু হলে বলে।”

“না, আদ্রুপু। তুমি সাজো। এই অবস্থা না সাজাই ভালো। মেকআপ ধুতে ধুতে অনেক কষ্ট হবে।”
ইতোমধ্যে সেজে গুজে বেরিয়ে গেছে সকলে। হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হলে বলে, শুধু আদ্রুপুকে নেওয়ার অপেক্ষায়। নুপুরের মৃদু শব্দে উপস্থিত হলেন ইয়ানাত আপু। আদ্রুপুকে পরখ করে নিয়ে যেতে লাগলেন। আদ্রুপু পা বাড়িয়ে পেছনে ফিরলেন একচোট। পার্লারে বিউটিশিয়ানকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “তাড়াতাড়ি হালকা মেকআপে ওকে সাজিয়ে দিন। অপেক্ষা করছি, তাড়াতাড়ি আসিস।”
“ওর সাজার কি দরকার!” বিরক্ত হয়ে ইয়ানাত।

” তোমার কাছে আমি যতটা প্রিয় আমার কাছে জোনাকি ততটা প্রিয়। আর আমার প্রিয় মানুষ সাজবে না। তা হতেই পারে না।”
ইয়ানাত আপু দমে গেল। আঠা লাগানোর ন্যায় চুপ। আদ্রুপুকে নিয়ে গেলেন। আমি ইয়ানাত আপুর কাণ্ডে একটু হাসলাম। তিনি জানতেই পারলেন না, তার বোনকেই এইসব বলছে। পাত্তা দিলাম না। সাজতে বসলাম। মিনিট বিশেকের মাথায় আমার সাজ কম্পিলিট। একদম হালকা। হালকা মেকআপ, কাজল, লিপস্টিক। এতেই ঢের সুন্দর লাগছে। চোখ ফেরান দায়। রৌধিকের ভাষ্যমতে, প্রেগন্যান্ট হবার পর থেকেই ক্রমশ মাত্রাতিরিক্ত সুন্দরীতে রুপান্তরিত হচ্ছি। আমি ব্যালকেনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। রৌধিক রান্নার দিকটায় তদারকি করছেন। হাতে চিকন বাঁশ। কোমড়ে গামছা বাঁধা।

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ৩৪

গায়ে সেন্টো গেঞ্জি। পড়ণে লুঙ্গি। সাথে যুক্ত হল, রোদের প্রখর উত্তাপ্ত। আজ প্রথম তাকে এই পোশাকে দেখলাম। পুরো ক্রাশড্। রৌধিকের নেত্রযুগল আমার দিকে নিবদ্ধ হতেই থমকে গেলাম। দ্রুত বাঁশ ফেলে ছুটে এলেন। বুঝতে অসুবিধে হল না, তিনি এখানেই আসছেন। রুমে পার্লারের বিউটিশিয়ান ছাড়া কেউ নেই। আমি দ্রুত পা বাড়ালাম। রৌধিক পৌঁছানোর পূর্বেই প্রস্থান করতে হবে আমায়। কিন্তু তা আর হল না। দ্বার পর্যন্ত অগ্ৰসর হতেই হন্তদন্ত হয়ে এলেন রৌধিক। দুই পাশে হাত রেখে আটকে দাঁড়ালেন। হাতের ইশারায় চলে যেতে বললেন। তার ছুটলেন বৈদ্যুতিক গতিতে। রৌধিক শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দিলেন। স্থির পা জোড়া গতিশীল করে এগিয়ে আসতে লাগলেন। তার পায়ের সাথে মিল রেখে আমিও পিছিয়ে যাচ্ছি ক্রমশ।

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ৩৬