চড়ুইপাখির অভিমান পর্ব ২৫

চড়ুইপাখির অভিমান পর্ব ২৫
লেখনীতে- নন্দিনী নীলা

‘তারমানে আমার ধারনাই সত্যি আপনার কিছু হয়েছে যেটা আমার, আমাদের সবার থেকে লুকিয়ে বেড়াচ্ছেন?’
‘ আমি কিছু লুকানোর মত ছেলে না যা হবে স্পষ্ট। যা হয়েছে সেটা কিছুক্ষণ আগে হয়েছে তাই কাউকে বলার সুযোগ হয়ে ওঠেনি।’
‘ মানে?’
‘ আমার সাথে আসো।’

স্পর্শ আমাকে টেনে রুম থেকে নিয়ে আসলো। তারপর গেস্ট রুমের পাশে আরেকটা গেস্ট রুম কর্নারে। ছোট করে আমি জানতাম এই রুমে দরজা এজন্য এখানে কেউ থাকে না। সেই রুমটার স্পর্শ আমাকে নিয়ে আসলাম। রুমটাই এসে আমি আরেকটা ধাক্কা খেলাম। একটা মেয়ে বসে আছে বিছানায় তার চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছে। আমি গোল গোল চোখে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছি। এই মেয়েটাকে? আর এখানেই বা কী করছে? আর স্পর্শ আমাকে এখানে নিয়ে আসলো কেন?
আমি মেয়েটাকে দেখা বাদ দিয়ে স্পর্শ দিকে তাকালাম।
‘কে এই মেয়ে? আপনি আমাকে এখানে নিয়ে আসছেন কেন? এই মেয়েটাকে তো আমি চিনি না। আপনার কি হয় এই মেয়ে?’
স্পর্শ আমাকে ফিসফিসিয়ে বললো, ‘সব একটু পরে বলছি! তুমি আগে ওনার কাছে যাও আর একটু শান্ত করে আসো। উনার সাথে কথা বলো।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘ আমি চিনিনা, জানিনা, তার সাথে কথা বলতে যাব কেন? আমি কথা বলতে পারবোনা। আপনি আমাকে এখানে কেন এসেছেন?এই মেয়ের সাথে আপনার কি সম্পর্ক সত্যি করে বলুন। আজকে আমাদের বাসর রাত। আর আপনি আমাকে একটা অচেনা, অজানা মেয়ের কাছে এনে বলছেন তার সাথে আলাপ করতে তার কান্না থামাতে।’
আমি চেয়েও ফিসফিস করে কথা বলতে পারলাম না আমার গলার স্বর উঁচু হয়ে গেল। কোন মেয়ে বা তা মানতে পারবে যে তার বাসর রাতে তার স্বামী আরেকটা মেয়ের কাছে এনে তার কান্না থামাতে বলছে। তার সাথে আলাপ করতে বলছে। এটা কি কোন মেয়ে পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব? অন্য মেয়ের কাছে এটা স্বাভাবিক হলেও আমার কাছে এটা স্বাভাবিক না‌। মেয়েটাকে দেখার পর থেকে আমার বুকটা অজানা ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছে। এ আমার সতীন হতে আসছে না তো। আমি রাগী চোখে মেয়েটাকে দেখলাম আরেকবার। মেয়ের কান্না অফ করে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে। আমি স্পর্শের দিকে তাকিয়ে আবার চিৎকার করে কিছু বলতে যাব তার আগেই স্পর্শ আমাকে টেনে রুমের বাইরে নিয়ে আসলো।

‘আপনি আমাকে এভাবে টেনে বাইরে নিয়ে আসলেন কেন?’
‘এত চিৎকার করছো কেন? বললাম তো বলবো সবকিছু! তার আগে আমার সাথে একটু কথা বলো।’
‘ আমি পারবো না‌ সীফাকে বলেন। নিজের সতীনের সাথে আমি আলাপ করতে পারবোনা। ‘
‘ হোয়াট সতীন মানে কি? তুমি আর আমি ছাড়া বাসায় কেউ জানে না ওর কথা।’
আমি বড় বড় চোখ করে স্পর্শের দিকে তাকালাম।
‘মানে এই মেয়েকে লুকিয়ে বাসায় নিয়ে রেখেছেন?’
‘হ্যাঁ সবাইকে কাল জানাবো!’

‘ কিহ? আপনি লুকিয়ে চুড়িয়ে একটা মেয়েকে বাসায় এনে রেখেছে? সেটা আমাকে গর্বের সাথে বলছেন! এই মেয়ের জন্য আপনি আমাদের বাড়ি যেতে এতো লেট করেছেন তাই না।’
‘ হুম। সিনক্রেট অফ করে যা বলছি তাই করো। না হলে কিন্তু এই মেয়েটাকে সত্যি তোমার সাথে সতীন বানিয়ে দেব।’
আমি কাঁদো কাঁদো মুখ করে স্পর্শের দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘ আপনি এটা বলতে পারলেন। আজকে প্রথম দিন আপনার আসল রুপ দেখিয়ে দিলেন। তাই নাই!এই আপনার ভালোবাসা।’
মুখ গোমরা করে আমি রুমের ভেতরে ঢুকলাম। স্পর্শ আর ভেতরে এলো না। আমি একাই মেয়েটার কাছে গেলাম। মেয়েটা কান্নাকাটি অফ করে দরজার দিকে তাকিয়ে ছিল। আমাকে দেখে জড়োসড়ো হয়ে বসলো।
আমি গিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘ আপনি আমার স্পর্শকে আমার থেকে কেড়ে নিতে এসেছেন তাই না। আজ আমাদের বাসর আর আপনার জন্য স্পর্শ আমাকে ধমক দিছে। আপনি কে হ্যা স্পর্শের সাথে পরিচয় হলো কি করে?’

মেয়ে ভয়ে আতকে দাঁড়িয়ে পরলো। এই মেয়ে তো আমার থেকেও বড় কিন্তু আমার ভয় পাওয়া দেখে মেয়েটা কেঁপে উঠেছে।
মেয়েটা বলল , ‘ আমি ওনাকে চিনি না। ওনার নাম কি আমি তাও জানিনা। আজ উনি আমার জান বাঁচিয়েছে। আর আমাকে আশ্রয় দিয়েছে।’
‘কি আপনি স্পর্শ কে চেনেন না? আজকে স্পর্শ আপনাকে বাচিয়েঁছে কিভাবে বলুন আমাকে সব। মিথ্যে বলে একদম চালাকি করবেন না কিন্তু। আমি কিন্তু আপনাকে একদম উচিৎ শিক্ষা দিয়ে দেবো মিথ্যা কথা বললে। ‘
‘ আমি কোন মিথ্যা বলছি না।
আমার নাম শুভ্রতা। আজ আমার বিয়ে ছিল আমি বিয়ের একদিন আগেই পালিয়ে গিয়েছিলাম বয়ফ্রেন্ডের সাথে। আমার বয়ফ্রেন্ডের নাম রোহিত।

রোহিত বাজে ছেলে। ওর ইচ্ছে ছিল আমাকে বাসা থেকে বের করে নিয়ে আমার সতিত্ত হরণ করা। ও রিলেশন চলাকালীন‌ই চেয়েছিল কিন্তু আমি ওর কোন কিছুতেই সাঁই দেয়নি। সব সময় নিজেকে রক্ষা করে চলেছি। কিন্তু পাগলের মত ভালবাসতাম ওকে। এ জন্য ওর হাত ধরে পালিয়ে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। বাড়ির সবার অমতে। কিন্তু আমাকে বিয়ে না করে। ও আমার সর্বনাশ করতে চেয়েছিল। সেটা আমি বুঝতে পারি ও যেদিন আমাকে ওর বন্ধুর বাড়ি নিয়ে যায়। ওর বন্ধু বাড়ি নিয়ে বিয়ের কোনো ব্যবস্থাই করে না। যখন তখনই আমি সব বুঝতে পেরে চায়। আর আড়াল থেকে ওদের তিন বন্ধুর কথোপকথন শুনতে পাই।ওদের খারাপ উদ্দেশ্য আমি বুঝতে পারি তখন আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। যাকে এত ভালবাসলাম।

এত বিশ্বাস করলাম।‌যার হাত ধরে নিজের বাবা-মার হাত ছেড়ে চলে এলাম। সেই কি না আমার ক্ষতি করার পরিকল্পনা করছে।‌ আমি খুব ভেঙে পরি রুমে এসে দরজা আটকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ি। তখনই পালানোর চেষ্টা করি কিন্তু ভেতর থেকে দরজা লক করা ছিল। এজন্য আমি পালাতে পারিনা। আমি সারারাত রুমে পালানোর জন্য রাস্তা খুঁজি। আর ওরা দরজা ভেঙে আমার রুমে ঢোকার চেষ্টা করে। আমি রুমে বসে শুধু আল্লাহকে ডাকি। সকালের দিকে ওরা দরজা ভেঙে রুমে আসে ততক্ষণই বেলকনি দিয়ে শাড়ি দিয়ে দোতলা থেকে নেমে যায়। জীবন মরণ বাজি রেখে আমি রিক্স নেই এখানে থাকলে ওদের হাতে আমাকে মরতে হবে ওর থেকে শেষ চেষ্টা করি।

ওরা আমাকে পালাতে দেখে ফেলায় তারপর আমার পেছনে তারা করা শুরু করে। আমি সারা রাস্তা লুকিয়ে-চুরিয়ে ওদের থেকে গা ডাকা দিয়ে বাঁচি। এগারোটার দিকে আমি আমার হাজবেন্ডের গাড়িতে এক্সিডেন্ট করতে গিয়ে বাঁচি। তিনি সময় মতো ব্রেক না করলে তার গাড়িতে চাপা পড়ে মারা যেতাম। তখন আমার পেছনে ছিল আমার বয়ফ্রেন্ড আর ওর তিনজন বন্ধ। আমি ওদের দেখে ভয়ে রোড পার হতে যায় তখনই অঘটন ঘটে আর তারপর তিনি আমাকে বাঁচান ওদের হাত থেকে আর তারপর আমাকে সকালের নাস্তা করিয়ে আমার বাড়ি নিয়ে যায়। কিন্তু সেখানে গিয়ে বিপদ কমার বদলে আরো বাড়ে। আব্বু আম্মুকে নাকি বরপক্ষের অনেক অপমান করে চলে গেছে। আমি সেখানে যাওয়ার পর আমাকে অনেক বকাবকি করে তারা। তারপর আমার সাথে আপনার হাজবেন্ড কে দেখে মনে করেন এই আমার বয়ফ্রেন্ড।

আমাদের অনেক নাম হয়ে গেছে এই বিয়ে ভাঙার। আমাকে আর বিয়ে দেওয়া যাবে না। আমার ছোট বোন আছে তাদের কেউ আর পার করা যাবে না। তাদের মুখে কালি পড়ে যাবে। তাই তারা সিদ্ধান্ত নেয়।আমার পছন্দ করা ছেলের সাথেই আমাকে বিয়ে দিয়ে আমাকে বাসা থেকে বের করে দেবে। আমার সাথে আর সম্পর্ক রাখবে না। আমার বয়ফ্রেন্ড মনে করেন তারা আপনার হাজবেন্ড কে। আমাকে বিয়ে দিয়ে বাড়ি থেকে তাড়াবে ।আমার মুখ দেখবেনা। আমার সাথে সম্পর্ক রাখবে না। উনি আমাকে হেল্প করতে গিয়ে বিপদে পড়ে যান। সবাই ধরে বেঁধে আমাদের দুজনকে বিয়ের পিঁড়িতে বসার চেষ্টা করায়। কিন্তু কেউ আমার কথা শুনে না। অবস্থা বেগতিক দেখে উনি আমাকে নিয়ে পালিয়ে আসে। আর আসার পরে সারা রাস্তায় বলে।আজ নাকি উনার ও বিয়ে । অনেক লেট হয়ে গেছে। উনি খুব চিন্তায় থাকে। আমারও খুব খারাপ লাগে। আমাকে হেল্প করতে গিয়ে ওনার একটা বিপদ হয়ে গেল। আমার খুব খারাপ লাগে উনার জন্য। উনী আমাকে বাসায় এনে লুকিয়ে তারপর চলে যান। তারপর এখন আপনারা দুজন এলেন।’

চড়ুইপাখির অভিমান পর্ব ২৪

আমি শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে আছি। মেয়েটাকে অনেক ভুল বুঝেছিলাম। আমার ধারনা ভুল আমি মেয়েটার সাথে কথা বলে তারপর স্পর্শের কাছে চলে এলাম। সব ঠিক আছে কিনা জিজ্ঞেস করলো স্পর্শ আমি মাথা নাড়লাম।
স্পর্শ বলল, ‘ যাওয়ার সময় তো ধানিলংকা রূপ ধারণ করে গেলে আসার সময় তো ঠান্ডা কি করে?’
‘আপনি আমাকে আগে বললেই হতো। আমি কি এতটাই খারাপ যে কাউকে সাহায্য করবো না। এভাবে একটা মেয়ের সামনে কেউ নিয়ে যায়। কত আজে বাজে কথা হয় না ভাবছিলাম। 2 মিনিট আমি ভয় হার্ট অ্যাটাক করে ফেলতাম।’

চড়ুইপাখির অভিমান পর্ব ২৬