অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ১৫

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ১৫
ইফা আমহৃদ

“আপনি এটা বলতে পারলেন রৌধিক। জোর করেছে বলেই আমাদের বিয়ে হয়েছে। আপনি কী শুধু এই কারণেই আমার প্রতি এতো কেয়ার করেন। তাহলে আপনার কেয়ার আমার চাই না। এগুলো যে, কাঁটা গাঁয়ে নুনের ছিটে দিচ্ছে।”
দরজা দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে কথাগুলো আওড়ালাম। রৌধিক এখনো ঘরে আসেনি। তার বন্ধুদের সাথে কথা বলছে। এগুলো রৌধিকের বিদেশি বন্ধু। বিয়ের সময় আসতে পারে নি, তাই হুট করে সারপ্রাইজ দিতে না জানিয়ে চলে এসেছে। এক ছুটে বাবার কাছে চলে যেতে ইচ্ছে করছে, বাবাকে সবটা খুলে বলতে ইচ্ছে করতে। তার সান্তনা নিতে ইচ্ছে করছে। আমি তো সেই কবেই বাবাকে জানিয়ে দিতাম, শুধুমাত্র তার শরীরের কথা চিন্তা করে নিশ্চুপ। তবে আর নয়, এই দোটানায় আমি বড্ড ভেঙ্গে পড়েছি। এবার বাবা হিসেবে সবটা তাকে জানাতে হবে।

ওড়না টা খুলে ঝেড়ে নিলাম। বেডের পাশে রাখা বালিশ টেনে এক কোণে গুটি মেরে শুয়ে পড়লাম। এপাশ ওপাশ করলাম কিয়ৎক্ষণ। চোখের পাতা এক করা দায়। ফুরিয়ে গেল আরো অপেক্ষায় ঘেরা কাতর মুহুর্ত। উদাসীন পা ফেলার মৃদু শব্দ শ্রবণ হলো। পরমুহূর্তেই নেত্র যুগল খিঁচে গ্ৰথণ করে নিলাম। আমি এই মানবটির মুখোমুখি হতে চাই না। পিটপিট চোখে দেখলে লাগলাম রৌধিকের কান্ড। রৌধিক ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বাম হাতের সিলভার রঙের ঘড়িটা খুলে রাখল। শার্টের কলার থেকে টাই ঢিলে করতে করতে কাবার্ড থেকে টাওয়াল বের করল। কাঁধে ঝুলিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আমি পুরো চোখ খুললাম। কী হতো, যদি রৌধিক আমার পাশে বসে মাথায় হাত রেখে দেখত? কি হতো? যদি বাধ্যবাধকতার ফোঁকট থেকে বেরিয়ে আমাকে প্রাপ্ত সম্মান টুকু দিতো। আমি আশাহত, অপারক, উদাসীন। টুস করে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো অশ্রুধারা। অতিবাহিত হলো মিনিট পনেরো। ছিটকিনি খোলার শব্দ শ্রবণ হলো। রৌধিকের বের হওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে। পানির ছোপ ছোপ শব্দ করে বেরিয়ে এলো রৌধিক। আমার দিকে গভীর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। অস্বস্তি বেড়ে গেল। চোখের পাতা টিপটিপ করছে। আলো নিভিয়ে দিল। আমার পাশে বসলো। ভাঁজ করে রাখা ব্লাঙ্কেট টা মেলে গলা পর্যন্ত টেনে দিল। পাশ গিয়ে শুয়ে পড়ল। আমি আগ্নেয়গিরির লাভার ন্যায় ফুটতে ফুটতে ব্লাঙ্কেট টা ফেলে দিলাম নিচে। ধর ফরিয়ে উঠে বসলো রৌধিক। পুনরায় ব্লাঙ্কেট টা টেনে দেওয়া উদ্যেগ হতেই চ্যাঁচিয়ে উঠলাম আমি,

“সমস্যা কী আপনার? আমার ব্লাঙ্কেট চাই না। কেন বারবার একই কাজ করছেন। দয়া দেখাতে হবে না আমায়!”
আমি পূর্বের ন্যায় চোখ গ্রথণ করে আছি। এই কথাগুলো তার সামনাসামনি বলার ক্ষমতা নেই আমার। পুরো ব্লাঙ্কেটটা নিজের শরীরে প্যাঁচিয়ে নিল। ফোনের বাটন চেপে স্ক্রিনের আলো জ্বেলে নিল। ড্রয়ার হাতরে রিমোটের সন্ধান করল। এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিল। ধীরে ধীরে শীতলতার পরিমাণ বাড়তে লাগল। হিম হয়ে এলো শরীর।

অবস তিক্ত অভিজ্ঞতা হলো আমার। একদম ছোট হয়ে গেলাম। হাতরে এদিক ওদিক ব্লাঙ্কেট খুঁজতে লাগলাম। সেঁটে গেলাম রৌধিকের দিকটায়। রৌধিকের কাছ থেকে ব্লাঙ্কেট টেনে গায়ে জড়ালাম। এখন ঠান্ডায় যথারীতি কাঁপছি। রৌধিক টান দিয়ে ব্লাঙ্কেট সরিয়ে নিল। বেশ কিছুটা সড়ে গেল। আমিও পরক্ষণে টান দিলাম। সরে এলো আমার কাছে। রৌধিক আবার টান দিল। পুরুষালী শক্তির কাছে আমি হেরে গেলাম। পুরোটা রৌধিকের কাছে চলে গেল। উঠে বসলাম আমি। সর্বশক্তি দিয়ে টান দিলাম। পুরোটা আমার কাছে। রৌধিক টান দিতেই ছেড়ে দিলাম আমি। ব্লাঙ্কেট নিয়ে রৌধিক সোজা নিচে পড়ে গেল। খিলখিলিয়ে হেঁসে উঠলাম আমি। রৌধিকও হাঁসল। ব্লাঙ্কেট তুলে আমাকে পেঁচিয়ে দিয়ে তিনি গিয়ে সোফায় শুয়ে পড়লেন। এসির পাওয়ার কমিয়ে দিলো। আমি সেদিকে না তাকিয়ে চোখ গ্ৰথণ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম।

রৌধিক বক্সার দের মতো আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ দুটো হিংস্রতায় ভরা। আমার দিকে তাকিয়ে এক হাতের আঙুলের সাথে অন্য হাতের আঙুলে আঘাত করলেন।‌ আমি বিরবির করে বললাম, “বক্সার রৌধিক!”
ইশারায় হাত দিয়ে এগিয়ে আসতে বললেন। টেনে টেনে মুখে বললেন,

“তুমি আমাকে ফেলে দিয়েছ ,তাই না! তার উপরে আমাকে না তুলে দাঁত কেলিয়ে হেঁসেছ। এবার আমি তোমার দাঁতগুলো ভেঙে ফেলবো। যাতে পানি চিবিয়ে খাওয়ার মতোও দাঁত না থাকে। তারপরে দেখবো এতো হাঁসি থাকে কই‌।”
চুপসে গেলাম আমি। এই ছেলেটা কী সত্যিই আমাকে মে’রে দাঁত ভেঙে ফেলবে। তাহলে আমাকে দেখতে কেমন লাগছে। সবাই বলবে, দাঁত ছাড়া জোনাকি! আমার ভাবনার মাঝেই রৌধিক এগিয়ে এলো। আমাকে কাঁধে তুলে দিলো এক আছাড়। সাথে সাথে চেপে উঠলাম আমি। কোমড়েও ব্যাথা পেলাম বেশ। নড়েচড়ে উঠলাম। পুরো‌ ঘর অন্ধকার।

বাইরে ল্যাম্প পোস্টের নিভু নিভু আলো জ্বলছে। আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে সবকিছু। সবকিছু বুঝে উঠতে বেশ সময় লাগল। এতোক্ষণ আমি স্বপ্ন দেখছিলাম। স্বপ্নের মাঝে এই ছেলেটা আমাকে আছাড় দিয়েছে! ছেলেটি তো বড্ড বিচ্ছু। স্বপ্নেও আমাকে জ্বালাচ্ছে। প্রতি’শোধ নিচ্ছে। দৃষ্টি গেল সামনের দিকে। সোফায় রৌধিক নেই। পাহাড় সমান উঁচু করা জামা কাপড়। মনে হচ্ছে কাবার্ডের সব কাপড় চোপড় নামিয়ে রেখেছে। আমি ধীরে ধীরে উঠে বসলাম। বেডের কিনারায় ভর করে এক পায়ে দাঁড়ালাম। এক পায়ের সাহায্যে খুড়িয়ে খুড়িয়ে বেলকেনিতে গেলাম। রৌধিক নেই সেখানেও। রুমে ফিরে এলাম। ভুতুম পেঁচার মতো মুখ করে বেডের উপর বসে রইলাম। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। ওয়াশরুমের দরজাও বন্ধ তাহলে গেল কোথায়। সোফার উপর রাখা কাপড় চোপড় ঠেলে আচম্বিতে নড়ে চড়ে উঠলো কেউ। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলাম।এক পায়ে সাহায্য সোফার পায়ে গিয়ে দাঁড়ালাম। রৌধিক মাঝ নিদ্রায়। শীতের কারণে এমন করেছেন তিনি। জামা কাপড় গুলো মেঝেতে ফেলে দিয়ে ডাকল,

“এই যে শুনছেন?”
“কী।” রৌধিকের ঘুমু ঘুমু কন্ঠস্বর।
“চলুন বেডে গিয়ে ঘুমাবেন। আপনার আবার সোফায় শুলে কোমর ব্যাথা করে। চলুন।”
রৌধিক মুচকি হাসলেন। দৃষ্টিগোচর হলো না সেই হাসি। অন্ধকারের মাঝে বুঝা গেল না।
“তোমার সমস্যা হবে না?”
“হলেও কিছু করার নেই। চলুন।”

রৌধিক বেডে শুয়ে পড়লেন। আমিও গিয়ে শুলাম। রৌধিক হাই তুলে বলল,
“কালকে বাড়িতে বসে বসে এই জামা কাপড় গুলো কেচে দিও।”
“আমার কালকেও পরীক্ষা আছে!” নত কন্ঠে বললাম আমি।
“পড়াশোনা করেছ না-কি পরীক্ষার খাতায় আমার মাথা মন্ডু লিখে দিয়ে আসবে। আর সেটা দেখেই টিচার তোমায় মার্কস দিবে।

আমি প্রিন্সিপাল স্যারের সাথে কথা বলেছি, এই পরীক্ষাটা না দিলেও হবে। তবে এই পরীক্ষার ভিত্তিতে ফাইনাল পরীক্ষায় একটা এক্সট্রা মার্কস প্লাস করা হয়। সেটা তুমি পাচ্ছ না, তাই ভালো ভাবে পড়াশোনা করতে হবে। যাতে এটাই প্লাস মার্কস ছাড়াই তোমার রেজাল্ট ভালো হয়।”
ফোঁস করে দম ছাড়লাম আমি। মিনমিনে গলায় বললাম,
“জোর করে তো আপনাকে স্যারের সাথে কথা বলতে বলি নি। তাহলে কেন বলেছেন?”

রৌধিক ভ্রু কুঁচকালো। আমার দিকে তাকিয়ে সরু গলায় বললেন,” এই জন্য বুঝি মেডামের রাগ হয়েছে?
তুমি জানো না, অন্যের কথা শুনতে নেই আর শুনলেও অর্ধেক শুনতে নেই। পুরোটা শুনতে।”
“কি এমন বলেছেন যে, পুরোটা শুনতে হতো।”
“তুমিই বলো, তোমার সাথে বিয়েটা তো বাবার সম্মানের জন্যই করেছি। তাহলে? এটা জোর নয়?
আমি ওদের সবটা বলেছি, দেশে ফেরার পথ থেকে বিয়ে পর্যন্ত সবটা।”
“আর এখনকার কথাটা..
রৌধিক হতাশ হলেন। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “তোমাকে বোঝানোই বেকার।‌ তোমার আর আমার জীবনটা সবে অনুবদ্ধ। আয়াস তো পেতেই হয়। কিন্তু আমাদের পরিশিষ্ট টা হবে একদম পরিপাটি, গোছানো, সাজানো।”

আমি ঘুম থেকে উঠার আগেই রৌধিক অফিসে গেছে। এখন রোদ্দুর ঝিকিমিকি বিকেল। আমি জানালার পাশে বসে আছি। প্রবেশ ঘটলো আদ্রিতা, রৌধিকের মায়ের। হাতে তাদের লুডু। তারা এখন লুডু খেলবে। তাদের আবদার পূরণ করতে খেলতে রাজি হয়ে গেলাম। দুই গেম খেললাম। দুটোতেই রৌধিকের মা জিতলেন। একটায় আমি সেকেন্ড তো আরেকটায় আদ্রিতা। খেলা শেষ করে আমার মাথায় তেল দিয়ে দিলেন। সকালে এবং দুপুরে মৌমিতাই আমাকে খাইয়ে দিয়েছেন। এক সময় তিনি বলেন উঠলেন,

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ১৪

“জোনাকি, তোমার বাবাকে এবার সত্যিটা জানানো দরকার।”
আমি বললাম,” মা,আমি তো জানাতেই চাইছি। কিন্তু সাহসে কুলায় না। কি করব আমি? প্রচন্ড ভয় হয় বাবা যদি সহ্য করতে না পারে, তখন?
“ঠিক আছে, আমি তাকে বুঝিয়ে বলবো।”

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ১৬