অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ১৬

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ১৬
ইফা আমহৃদ

সটান হয়ে পুরো জায়গা দখল করে রয়েছে রৌধিক। তার বিশাল বলিষ্ঠ পুরুষালী দেহের কারণে বেডে বিন্দু পরিমাণ ফাঁকা নেই। গায়ে ঘামে ভেজা দুর্গন্ধ যুক্ত শার্টটা। জুতো বিহীন মোজা সমেত পা জোড়া বেডে জায়গা হচ্ছে না। অফিস থেকে এসেই শুয়ে পড়েছে। প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে শাওয়ার নিয়েই বসতো, আজ তার ব্যতিক্রম।

লুডু খেলতে খেলতে মা আর আদ্রিতার সাথে এতোটাই ব্যস্ত ছিলাম যে, কয়টা বাজে খেয়াল করি নি। তড়িগড়ি করে রুমে আসতেই দেখতে পেলাম, রৌধিক হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। তাকে এই অবস্থায় দেখে অস্বস্তি লাগছে আমার।
সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে গেলাম। পায়ের ঘামার্ত মোজা খুললাম। অমনি নাকে গিয়ে বাড়ি খেল। বি’শ্রী গন্ধে ভেতরটা গুলিয়ে উঠল। আমি সময় না নিয়ে মোজা খুলে ওয়াশরুমের দিকে ছুঁড়ে ফেললাম। বাবারে একটু হলেই আমার প্রাণ পাখি ফ্রুত করে উড়ে যেত। বার কয়েক শ্বাস নিয়ে রৌধিককে ডাক দিলাম।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“এই যে শুনছেন। উঠুন। তাড়াতাড়ি ফ্রেস হয়ে আসুন।”
রৌধিক নড়েচড়ে অন্যদিকে ফিরে গেল। তাজ্জব বনে গেলাম আমি। তার শরীর টা হয়তো বেশ ক্লান্ত। তাই নিচে গিয়ে এক গ্লাস শরবত নিয়ে এলাম। মা তো বারবার জিজ্ঞাসা করছিলেন, রৌধিক কোথায়? মনে হচ্ছিল আমি তাদের ছেলেকে জেলখানায় আঁটকে রেখেছি। রৌধিকের কথা বলতেই তিনি নিজের হাতে শরবত তৈরি করে দিলেন। এসে দেখি রৌধিক পূর্বের ন্যায় ঘুমিয়ে আছে। আমি গ্লাসটা রেখে রৌধিককে ডাক দেওয়ার চেষ্টা করলাম। রৌধিক ধক করে উঠে খ্যাঁক করে ধমকে আবার শুয়ে পড়লেন। একদম কাঁঠালের আঠা। যেন লাগলে আর ছাড়ে না।
আমি তার ঘুম নামক আঠা ছাড়ানোর জন্য কোমরে ওড়না পেঁচিয়ে পড়লাম। থমথমে মুখে বললাম,

“এই যে, বিদেশি ইঁদুর। উঠেন।”
রৌধিক ভ্রু সরু করলেন। চোখ মেললেন। চোখের মণি এদিক ওদিকে ঘুরালেন। হাই তুলে উঠে বসল। একরোখা জবাব দিলেন,” ওয়ার্ট?”
” রাখেন তো আপনার বিদেশি বুলি। চুপচাপ এটা খেয়ে আমায় উদ্ধার করুন।”
“থামো তুমি! কানের কাছে এতো মাছির মতো ভনভন করছ কেন? ভাঙা রেডিও এর থেকে ভালো চলে। দেখতে পারছ না, আমি ঘুমাচ্ছি?”
আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলাম। আহা জোনাকি, ইউ আর গ্ৰেড। নাহলে এই মানুষটাকে তুলে ফেললি। ক্ষমতা আছে বস। নিজেকে বাহবা দিচ্ছিলাম এমন সময় খেয়াল করলাম রৌধিক নেই। আমার হাতের শরবতের গ্লাস টাও ফাঁকা। এক বিন্দু পরিমাণও অবশিষ্ট নেই।‌ আচ্ছা উনি শরবত খেয়েছেন তো না-কি ফেলে দিয়েছেন?

আজ শুক্রবার। ছুটির দিন। সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেছে। রৌধিক এখনো ঘুমিয়ে আছে। রান্না বান্না শেষ। আদ্রিক আঙ্কেল মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে এসেছেন। আমরা মহিলারাও একসাথে নামাজ পড়ে নিয়েছি। ডাইনিং টেবিলে খেতে বসেছি একসাথে। আমি খাবার খাচ্ছি কম নড়াচড়া করছিল বেশি। রৌধিক নেই। সকালেও তিনি কিছু খায়নি। বেলা গড়িয়ে গেলে আর খাবে না। একদম রাতে খাবে। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। শ্বশুর মশাই হয়তো আমার অবস্থাটা বুঝতে পারলেন। আদ্রিতাকে গম্ভীর গলায় বললেন,

“আদ্রিতা যাও। রৌদুকে ডেকে নিয়ে এসো।”
আদ্রিতা বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নেড়ে চলে গেল। বরাবরই প্রচণ্ড ভীত সে। বাবাকে বেশি ভয় পায়। টেবিলের কাজ ততক্ষণ বন্ধ রইল। যতক্ষণ রৌধিক আর আদ্রিতা এসে পৌঁছালো না। রৌধিক বেরিয়ে এলো, পড়নে কালকের ঢিলেঢালা টি শার্ট। ট্রাউজারের বেশ কিছুটা অংশ ভেজা। মুখের পানি না মুছেই বেরিয়ে এসেছে। তার ফর্সা মুখে মুক্তোর মতো আকর্ষণ করছে। এসেই চেয়ার টেনে বসল। হাতা ফোল্ড করতে করতে ঘুমু ঘুম কন্ঠে বলল,

“কী দরকার ছিল আমাকে ডাকার? কাঁচা ঘুমটা ভেঙে দিলে। কিছুদিন ধরে কাজের চাপে ঘুমাতেই পারছি না”
মৌমিতা এক চামচ ভাত প্লেটে তুলে দিতেই বাঁধ সাধলেন রৌধিক। মৌমিতা আরো এক চামচ দিতে চাইলেন। রৌধিক নিল না। প্লেট সরিয়ে ফেলল। মৌমিতা থমথমে বললেন,
“তাহলে কী দরকার এতো কাজ করার। আগে শরীরের যত্ন।”
খাওয়ার সময় কোনো কথা বলো না। মুখ ছিঁচকালেন রৌধিক। প্লেটে খাবার নেড়ে বিরক্ত নিয়ে বলে,
“আর কোন খাবার ছিল না। এই রুই, কাতলা মাছ রান্না করেছ?”

রৌধিক তবুও মুখে খাবার তুলে। এতো দিনে তাকে যতটুকু চিনেছি, যে খাবার ফেলা একদম পছন্দ করে না। মৌমিতা হাতাশাহত হলো। আপ্যিতেশ করতে লাগলেন। ফোড়ন কেটে বললেন,
“আজকে দাড়োয়ান ভাই হাঁটুতে ব্যাথা পেয়েছে। ছুটি দিয়েছি তিনদিনের। এদিকে কাঁচা বাজার ফুরিয়ে এসেছে। ফ্রিজে যা ছিল, তাই রান্না করেছি।”

রৌধিক নিজের প্লেট থেকে সম্পূর্ণ খাবার গুলো আমার প্লেটে ঢেলে দিল। আমি তাজ্জব বনে গেলাম। এতো গুলো আমি খাবো কিভাবে। রুই হোক বা কাতলা। সব কিছু দিয়েই খাওয়ার অভ্যাস আছে আমার। হাত ধুয়ে নিল। উঠে দাঁড়ালো। রান্না ঘরে গিয়ে বাজারের থলে নিয়ে এলো।‌ রুমের দিকে পা বাড়াল। পেছনের দিকে চেয়ে স্বাভাবিক স্বরে বলল,
“আমি বাজারে যাচ্ছি। কী কী লাগবে লিস্ট কর, দশ মিনিটের মাথায় বের হবো। কিছু বাকি থাকলে, নেক্সট টাইম যাবো না।”

সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। রৌধিক সত্যি বাজারে যাবে? আধুনিক যুগের ছেলে হয়ে বাজারে। আচ্ছা দাম কষাকষি করে আনতে পারবে? নাকি বিক্রেতারা তাকে ঠকিয়ে দিবে? আদ্রিতা ঘনঘন পলক ফেলে আমতা আমতা করতে বলে,
” তুই সত্যিই বাজারে যাবি ভাই?”
“আমাকে‌ দেখে তোর কী মনে হচ্ছে? মজা করছি? অহেতুক কোন কথা বললে, আমি যাবো না।”
আদ্রিক আহম্মেদ থামতে বললেন আদ্রিতাকে। ক্রেডিট কার্ড বের করে এগিয়ে দিয়ে বললেন,
“নাও, যা লাগে এটা দিয়ে খরচ করো?”

“আমি এখন রোজগার করি। বাবার টাকা‌ নষ্ট করি না। জায়গা জমি বিক্রি করি না। নিজের টাকায় দেনমোহরের টাকাও পরিশোধ করব। যোগ্য হাসবেন্ড হয়ে দেখিয়ে দেব।
আর তোমাকেও যোগ্য বউ হতে হবে। আজকের রান্নাটা তুমি করবে। এবার রুমে এসো।”
বলেই হনহনিয়ে চলে গেলেন তিনি। বুঝতে অসুবিধে হলো না, এই কথাগুলো তিনি আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন। একই কথাগুলো আমি বিয়ের প্রথমদিন তাকে শুনিয়েছি।

তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করলাম। আন্টি আর আদ্রিতা লিস্ট তৈরি করে ধরিয়ে দিল। আমি লিস্ট নিয়ে পেটে হাত বুলাতে বুলাতে রুমে চলে এলাম। আজ আমার কম করেও বারো মাসের অন্তঃসত্ত্বা লাগছে। যা খাওয়া হয়েছে।
সেন্টার টেবিলের উপর লিস্ট টা রেখে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম আমি। বিরবির করে বললাম,
“এই যে আপনার লিস্ট।”
“আমার লিস্ট মানে কী? বাজারের লিস্ট।”
বেরিয়ে যাওয়ার উদ্যেগ হতেই হাত টেনে ধরলাম। রৌধিক ভ্রু কুঁচকে কিছু বলার জন্য ঈষৎ অধর নাড়াতেই ফট করে বললাম,

“আপনি তখন‌ আমাকে ব্যঙ্গ করেছেন, তাই তো?”
“এখানে ব্যঙ্গ করার কী আছে? আমি তো লাফা’ঙ্গা, উদ্ভর মানুষ। বাবার টাকায় খেতাম। বউকে বাবার টাকায় খাওয়াতাম। তাই এখন নিজের টাকায় খাওয়ানোর চেষ্টা করছি। এরপর হাজবেন্ডের অধিকারও দেখবো। এবার পথ ছাড়।”
আমাকে রেখেই হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি। এদিক দিয়ে বেশ ভালো লাগলো। রৌধিক বাবার কাজে হাত লাগিয়েছে। আমি অন্যমনস্ক হয়ে সাজতে বসলাম। আজ সাজব আমি। রৌধিকের অর্ধাঙ্গিনী রুপে সাজব।

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ১৫

রৌধিক বাড়ি ফিরেছে। এক থলে ভর্তি করে পুঁটি মাছ নিয়ে এসেছে। গলদা চিংড়ি, সলা চিংড়ি আর লিস্ট অনুযায়ী সব নিয়ে এসেছে। রৌধিকের কথা অনুযায়ী এক থলে পুঁটি মাছ কাটার দায়িত্ব পড়ল আমার উপর। আজ লাল রঙের শাড়ি পড়েছি। লিপস্টিক দিয়েছি, চোখে কাজল দিয়েছি। এতো সেজে এসেছি পুঁটি মাছ কাটতে। এই ছিল তোর মনে? জীবনেও তোর ভালো হবে না। একটা বাচ্চা মেয়েকে এভাবে শাস্তি দিল। আমিও দেখে নিবো। কোমরে আঁচল গুঁজে মাছ কাটতে বসলাম।

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ১৭