অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ১৩

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ১৩
ইফা আমহৃদ

আকাশ টা মেঘলা। ঝড় হাওয়া বইছে। বৃষ্টি হওয়ায় সম্ভবনা নেই বললেই চলে। আমি বসে আছি ডাইনিং টেবিলে। রৌধিক বসে আছে আমার পাশে। আদ্রিক আঙ্কেল এখনো নিচে নামেনি। তার সাথে নাকি কোন স্পেশাল গেস্ট আছে। কালকে একটা বড় ডিল ফাইনাল করা হবে। তাই সেই গেস্টের থেকে কিছু আইডিয়া ধার নিবে। আজকে খাওয়া একটু বেশিই ভালো। আদ্রিতা বসে আছে আমার সামনাসামনি। একট হাত গালে দিয়ে, মুখে চামচ পুড়ে চিবিচ্ছে‌। বাড়িতে গেস্ট আছে, তাই তাকে ছাড়া খাওয়া যাবে না। রৌধিক ফোনে কারো সাথে মেসেঞ্জারে কথা বলছে। ফোন টা না রেখেই দৃষ্টি সরিয়ে মৌমিতা আন্টির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন,

” মা, বাবাকে আসবে না। কতোক্ষণ অপেক্ষা করব। কাল বাদে পরশু ওর পরিক্ষা। ওকে পড়তে বসতে হবে।”
আন্টি কিচেনে ছিল। খাবারের বাটি নিয়ে টেবিলের উপর রাখল। কিচেনের দিকে যেতে যেতে বলল,
“আমি জানি না কিছু। বাবা আসুক তারপরে খাওয়া শুরু করবে।”
রৌধিক বিরাগী হলেন। চেয়ার টেনে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“চলো, জোনাকি। গিয়ে পড়তে বসতে হবে। তারা খেয়ে গেলে আমি খাবার রুমে পৌঁছে দিবো।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রৌধিক উল্টো ঘুরে হাঁটা দেওয়ার আগেই পায়ের শব্দ শোনা গেল। রৌধিক সেদিকে চাইলো। ফোনটা টেবিলের পাশে রেখে পুনরায় টেবিলে বসে পড়লেন। টেবিল সামনাসামনি হওয়ার কারণে আমি আদ্রিতার দিকে চেয়ে আছি। আদ্রিতা এক ধ্যানে উপরের দিকে তাকিয়ে আছে। অসাবধানতাবশত হাত থুতনি থেকে নিচে পড়ে গেল। বাড়ি খেয়ে টেবিলের সাথে শব্দ হলো মৃদু। হাত দিয়ে থুতনি ঘসতে লাগলো। রৌধিক ভ্রু নাচিয়ে বলল,

“তোরই হবু বর। এতো গিলার কিছু নেই।”
আদ্রিতা মৃদু শব্দে বলল, “ভাইয়া।”
“কী ভাইয়া হ্যাঁ?”
আদ্রিতা লজ্জা পেল। আমি উপরের দিকে চাইলাম। নিজের দৃষ্টিকে দৃষ্টিভ্রম হিসেবে ভাবতে আরো একবার চোখ পরিষ্কার করে তাকালাম। না আমার দৃষ্টি ভ্রম হয়। সেই ডাক্তার ছেলেটা। এসে বসলেন চেয়ারে। আন্টি খাবার দিতে লাগলেন। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,

“জোনাকি, আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? হুয়াই?”
সবাই আমাদের দিকে জিজ্ঞাসুলভ দৃষ্টি দিল। আমি না বুঝার কন্ঠে বললাম,
“আপনি? আপনি এখানে কী করছেন ডাক্তার সাহেব?”

তিনি মৃদু হেসে বললেন, ” আমি ডাক্তার ঠিকই, কিন্তু এখন ডাক্তার নই। তাই ডাক্তার সাহেব না বলাই ভালো।”
আমিও সায় দিলাম। অতঃপর সবাইকে সবটা খুলে বলতে চাইলাম, কিন্তু তার আগেই রৌধিক সবাইকে সবটা জানিয়ে দিল। আন্টি বিরিয়ানি আমার প্লেটে দিলেন। রৌধিক প্লেটটা টেনে নিলেন। সেই প্লেটে খেয়ে শুরু করলেন। আমি রুদ্ধ চোখে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছি। আন্টিকে আমার জন্য ভাত আর সবজি তরকারি দিতে বললেন। আন্টি অসন্তুষ্ট হয়ে বলে, আজকে সবার জন্য বিরিয়ানি, ডিমের কোরমা আর রোস্ট রান্না করেছেন। এখন আমাকে কিভাবে ভাত দিবে।
রৌধিক অসন্তুষ্ট হলেন। টেবিলের দিকে তাকিয়ে বলে, জানো তো কালকে থেকে ওর পরীক্ষা শুরু। এই সময় তেলের জিনিস খেলে অসুস্থ হয়ে যেতে পারে।

আমি অসহায় হয়ে মুখ কুঁচকে রইলাম। সামনে বিরিয়ানি আর এই ছেলেটা বলছে, ভাত আর সবজি। রীতিমত অবিচার করছে আমার প্রতি। আন্টি তার স্থানে অনড়। কিছুতে আজ আর রান্না ঘরে যাবে না। তাছাড়া রান্না ঘরে বাড়ির বাইরের কেউ প্রবেশ করতে পারে না।
উঠে চলে গেলেন রৌধিক। কিচেনে গিয়ে নিজেই এক বাটি স্যুপ করে নিয়ে এলেন। আমার সামনে এসে রাখলেন। কপালে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু জল কণা মুছে খেতে বললেন। মুখ ফুলিয়ে এক চামচ মুখে দিলাম আমি। এতো পানসে কেন?

আমি কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম,” প্লীজ,এটা খাবো না। হাঁফ প্লেট বিরিয়ানি।”
“নো, নো মানে নো। একটা দানাও না। এটাই খাও।”
সবাই মিটিমিটি হাসছে আমাদের দেখে। রৌধিক সবার দিকে চেয়ে সন্দিহান গলায় বললেন, “ওয়াট?”
আদ্রিতা প্রিন্ট করে বলল, “বাবা, তোমার ছেলে বউ পাগ’লা হয়ে গেছে। দেখতে পারছ তুমি? তুমি দুজনকে আলাদা থাকার পার্মিশন দিলে, কিন্তু ভাই বউ ছাড়া থাকতে পারবে না। তাই বউ নিয়ে নিজের ঘরের চলে গেছে। বউয়ের জন্য রান্না করছে। বাহ্। টেইক জিনিয়াস।”

লজ্জা কুঁকড়ে উঠলাম আমি। একটা মুহূর্তে জন্য হলেও মনে হলো, কোনো অদৃশ্য গাছের শিকড় মাটির ফাঁক করে বেরিয়ে আসুক। আমাকে নিয়ে আবার অদৃশ্য হয়ে যাবে। মিলিয়ে যাই আমি। ভেতরের গুমোট লজ্জা ভাবটা চিরতরে নিষিদ্ধ করে দেই। নাকের ডগা লাল হয়ে উঠলো আমার। মুখের মাঝে লাল আভা ছড়িয়ে পড়লো। কি হতো রৌধিক নিজেকে একটু সংযত করত। আমাকে অন্তত এই পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না। ওড়না টা হাত দিয়ে খাঁমচে ধরলাম। মাথা নত করে রইলাম। যাতে কেউ আমার নজরে না পড়ে। রৌধিকও কম নয়, হাই তুলে বলল,

“তাই বুঝি। বলি, তাহলে ইভু কেন এলো। বাবার সাথে দেখা করতে। কিন্তু তুই তো এতো দেরী করে খাস না। তুই কেন বসে আছিস, মেঘলা আকাশের পূর্ণিমা দেখতে?”
সাথে সাথে চুপ হয়ে গেল আদ্রিতা। এক ছুটে পালিয়ে গেল নিজের ঘরে। এবার সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমিও মাথা নত করে ধীর পায়ে ঘরে চলে এলাম। মুহুর্তেই হেঁসে উঠলো সবাই। লজ্জা যেন প্রচন্ড ভাবে ঝুঁকে ধরলো আমায়। পেছন থেকে অনবরত হাঁসির শব্দ শুনতে পেলাম।

নিদ্রায় চোখের পাতা ঢুলুঢুলু। নিজে থেকেই চোখের পাতা বুজে যাচ্ছে। সময় বারোটা এগারো। আমি চোখে হাত দিয়ে বই পড়ছি। রৌধিক আঙ্কেলের ঘরে আলোচনায় বসেছে। শরীরটাও ক্লান্ত লাগছে। বইটা বেডের উপর রেখে উবুত হয়ে শুয়ে পড়লাম। এতে ঘুম আরো ঝোঁকে বসল। আমি উপায়হীন হয়ে বইয়ের উপর মাথা রাখলাম। চোখ বুজে গেল।
হুট করেই মাথায় চপল মারল কেউ। চোখ না মেলেই আরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে পড়লাম আমি‌। হাত ধরে টেনে তুলল কেউ। ঘুমের মাঝেই বলছে,

” জোনাকি, ওঠ তাড়াতাড়ি!”
আমি আরো নড়েচড়ে শুয়ে পড়লাম। মানুষটি একদম টেনে বসিয়ে দিল আমায়। আমি ঘুমের মাঝেই আওড়ালাম,
“প্লীজ, আমাকে ঘুমাতে দিন।”
উল্টো পানির ছিটা দিল মুখে। আমি লাফিয়ে উঠলাম। এক লাফ দিয়ে একদম বেলকনিতে ছুটে গেলাম। রৌধিক ছিটকে দূরে সরে গেল। বলল,

“কুল, কুল জোনাকি। এতো হাইপার হচ্ছো কেন?”
আমার ধ্যান ভাঙতে ভাঙতে বেশ সময় নিল। রৌধিক ততক্ষণে আমার পিছুপিছু বেলকেনিতে চলে গেল। আমাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল। আশ্বাসের স্বরে বলল,”

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ১২

“ভয় পেও না, আমি খাবার নিয়ে এসেছি। বিরিয়ানি! চলো, খেয়ে নিবে।”
“খাবো না, পড়বোও না। ঘুমাবো। প্রচুর ঘুম পেয়েছে।”
রৌধিক আমার কথা শুনলো না। হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। এক লোকমা মুখের ভেতরে পুড়ে দিয়ে বলল,
“পড়তে হবে না। কালকে হালকা পড়েই পরীক্ষা দিতে যাবে। তাহলেই হবে।”

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ১৪