শালুক ফুলের লাজ নাই পর্ব ১১

শালুক ফুলের লাজ নাই পর্ব ১১
রাজিয়া রহমান

আদনানের সময়টা ভালো যাচ্ছে না। আদনান নিজেও বুঝতে পারছে না সে এতো অস্থির হয়ে আছে কেনো।কেনো এমন কু ডাক ডাকছে তার মন।
না পারছে আশাকে কিছু বলতে আর না পারছে ধ্রুবকে কিছু বলতে।
ধ্রুবকে আদনান চেনে,ধ্রুব এরকম ছেলে না।কিন্তু আশা!
আশার কাছে তো এসব ছেলেখেলা।

আদনান জানে আশার কাছে রিলেশনশিপটা ভীষণ ইজি।তবুও আদনান মিষ্টি কথা দিয়ে আশাকে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে এতো দিন।আজ এই ছেলের সাথে কাল ওই ছেলের সাথে ডেটে যাওয়া সব হাসিমুখে সহ্য করেছে।শুধু একবার বিয়েটা হোক,সব হাতে আসুক।তারপর দুই লাত্থি মেরে সে এই মেয়েকে বিদায় করবে।এরকম ক্যারেক্টারলেস মেয়েকে বউ হিসেবে মানায় না।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

অপশন হাতে রেখেই আদনান প্ল্যান করেছে।শালুক হচ্ছে তার সেকেন্ড অপশন। এজন্যই তো আমেরিকায় থাকাকালীন শালুকের সাথে মিষ্টি কথা বলে ওকে পটিয়ে রাখার টেকনিক এপ্লাই করে রেখেছে।
গোসল করে এসে আশা ধ্রুবর খোঁজে নিচতলায় স্টাডি রুমে গেলো। ধ্রুব মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক একটা বই পড়ছে।
আশা ধ্রুবর সামনের চেয়ারে বসে বললো, “এটা কিসের বই ধ্রুব?”
ধ্রুব বইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, “মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখা।”

আশা আগ্রহী হয়ে বললো, “আমাকে গল্প বলো ধ্রুব,তোমাদের ফ্রিডম ফাইটারদের স্টোরি শুনতে চাই আমি। ”
ধ্রুব বললো, “ভাইয়ার কাছে যাও,ভাইয়া বলবে।সকাল থেকে আমার সাথে কথা বলছো ভাইয়ার মন খারাপ হবে।”
আশা হেসে বললো, “ধ্রুব,আদনান স্টোরি বলতে পারে না। ওর সব স্টোরি এক পর্যায়ে সেক্সুয়াল স্টোরিতে কনভার্ট হয়ে যায়। সবসময় তো আর এসব শুনতে ভালো লাগে না। ”
ধ্রুবর কান লাল হয়ে গেলো আশার কথা শুনে। এই বিষয়ে আর কথা বাড়ালো না ধ্রুব।কথা বলতে গেলে আশা হয়তো ফ্রি মাইন্ডে আরো অনেক কিছু শেয়ার করে ফেলবে।
আশার দোষ দেয় না ধ্রুব,তার ন্যাশনালিটি,তার দেশের কালচার যেমন সে তেমনই হবে।তবে অবাক লাগে তার আদনানের ব্যবহার।

আদনান কেমন যেনো রূপ বদলে ফেলার চেষ্টা করছে বলে ধ্রুবর মনে হয়। বাড়ির পিছনের পুকুরে আগে সবাই মিলে লাফঝাঁপ দিয়ে গোসল করতো। বিশাল পুকুরের এ মাথা থেকে ও মাথা সাঁতরে যাওয়ার প্রতিযোগিতা করতো।
সকালে ভিজে বাড়িতে আসার পর ধ্রুব আদনানকে বলেছিলো পুকুরে গোসল করতে যাবার কথা।
শুনে আদনান হেসে বললো, “পাগল না-কি তুই?পুকুরের পানিতে যেই পরিমাণ জার্মস আছে,মাই গড!”

ধ্রুব মুচকি হেসে চলে গেলো গোসল করতে পুকুরে।কাক ময়ুরের পুচ্ছ লাগালে কি ময়ুর হতে পারে!
ধ্রুব নিচের দিকে তাকিয়ে গল্প বলতে লাগলো। আশাকে খুঁজতে খুঁজতে আদনান ও ধ্রুবর স্টাডি রুমে এসে হাজির হলো। আশার দিকে তাকিয়ে আদনান অবাক হলো। চিকন ফিতার একটা টপস আর স্কার্ট পরে আশা বসে আছে ধ্রুবর সামনে। দেহের অবয়ব স্পষ্ট হয়ে আছে ওর।

আদনান হাসিমুখে এসে আশার পাশে বসলো। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে গল্প শুনে তারপর বললো, “দূর,এসব কি বলছিস?এসব কি এখন বলার সময় না-কি? শোন,আমি গল্প বলি।আমেরিকায় যাওয়ার পরের গল্প শোন।”
ধ্রুব হেসে বললো, “গল্প শোনার আগ্রহ নেই ভাই আমার।তুমি বরং তোমার প্রাণপাখিটাকে নিয়ে গিয়ে গল্প করো আমি একটু পড়ি।”

আদনান খুশি হলো ভীষণ। আশার হাত ধরে বললো, “চলো আশা।তোমার সাথে আজ সারাদিনে গল্প করা হয় নি।”
আশা বিরক্ত হয়ে বললো, “তোমার আর গল্প! তোমার গল্প শুরু হবে রুমের দরজা বন্ধ করে। রোমান্সে চলে যাবে,ঝাঁপিয়ে পড়বে তুমি আমার উপর। ”
ধ্রুব কানে হাত দিয়ে বইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। আদনান ভীষণ বিব্রত হলো।এই মেয়ের মুখে কোনো লাগাম নেই।
আশাকে রুমে এনে আদনান বললো, “পাগল হয়েছ তুমি আশা?কি বলছো এসব ধ্রুবর সামনে? আমার মান সম্মান আর রাখলে না।”

আশা বিরক্ত হয়ে বললো, “তুমি যা করো আমি তাই বলেছি আদনান। বাড়তি কিছু বলি নি।”
আদনান দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললো,”এমন ভাব করছো যেনো শুধু আমারই এসবে ইন্টারেস্ট, তোমার নেই?”
আশা হাসলো। তারপর বললো, “এটা ঠিক আমার ও এই ব্যাপারে আগ্রহ,তবে কি জানো আদনান, বাংলাদেশে আসার পর তোমাদের কালচার সম্পর্কে একটু আধটু জানার পর আমি নিজেকে সামলে নিয়েছি। এটা তো তোমার দেশ,তোমার দেশের কালচার তুমি ভালো জানো আমার চাইতে।তোমার উচিত ছিলো আমাকে বুঝানোর। তুমি তা কি করেছো?
সুযোগ পেলেই তুমি আমাকে বদ্ধ ঘরে নিয়ে আসতে চাইছো,আমি ও তাই তোমার থেকে দূরে সরে থাকতে চাইছি।
তুমি মানুষটা কেমন যেনো আদনান। তোমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে অনেক ডিফরেন্স।”

আদনানের মাথায় যেনো আগুন জ্বলে উঠলো। আশার হাত চেপে ধরে বললো, “কি ডিফরেন্স?”
আশা নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, “আজ যখন আমি বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম, ধ্রুব একবারের জন্যও আমার দিকে তাকায় নি।ওর সাথে হেটে এসেছি বাড়ি পর্যন্ত, ধ্রুবকে একবার ও দেখি নি আমার বডির দিকে তাকাতে।অথচ বাড়ি আসতেই তোমার নজর গিয়েছিল আমার বডিতে।
এই যে একটু আগে,আমি ধ্রুবর স্টাডি রুমে গিয়েছি।এটাও একটা এক্সপেরিমেন্ট ছিলো আমার। আমি এই টপস পরে যাওয়ায় ধ্রুব বইয়ের দিকে তাকিয়ে ছিলো পুরোটা সময়। আমি ওকে বলেছিলাম আমাকে স্টোরি বলতে, ও তখনও তাকায় নি আমার দিকে।

তুমি কিন্তু ওর স্টাডি রুমে ঢুকেই আমার সারা শরীর স্ক্যান করে ফেলেছ।এজন্যই ধ্রুবকে আমার ভীষণ ভালো লাগছে। ও একজন পারফেক্ট মানুষ। তোমার মতো করে কাউকে ইমপ্রেস করার মিথ্যা চেষ্টা ধ্রুব করে না।বরং ওর এই শুদ্ধতায় মানুষকে ওর প্রতি ইমপ্রেস করে। ”
আদনান কি বলবে ভেবে পেলো না। আশার কাছ থেকে আদনান এসব এক্সপেক্ট করে নি।আশা কি তবে ধ্রুবতে একেবারে মজে গেছে!

আদনানকে হতভম্ব অবস্থায় রেখে আশা বের হয়ে গেলো আফিফার রুমের দিকে।
দুপুরে খাবার টেবিলে ধ্রুব বসার পর ধ্রুবর বাবা সেলিম সাহেব এসে বসেছেন ধ্রুবর মুখোমুখি চেয়ারে।
ধ্রুব সবেমাত্র মুখে ভাতের লোকমা তুলেছে সেই সময় সেলিম সাহেব বললেন, “ধ্রুব,খাবার পর তুমি গিয়ে তোমার মা’কে দেখে আসবে।”

ধ্রুব ভাতের লোকমা রেখে দিয়ে বললো, “আমি কারো হুকুম মেনে চলার মানুষ নই।”
সেলিম সাহেবের ভীষণ রাগ উঠে আছে গতরাত থেকে দীপালির অসুস্থতার খবর জানার পর থেকে। ধ্রুবর এই বাঁকা কথা তার সহ্য হলো না। চিৎকার করে বললেন,”অবশ্যই মেনে চলবে তুমি আমার হুকুম।আমার ছেলে তুমি,আমার বাড়িতে থাকতে হলে,আমার বাড়িতে খেতে হলে তোমাকে আমার কথা মানতেই হবে। ”

ধ্রুব হেসে ফেললো শব্দ করে। তারপর বললো, “কি বললেন যেনো আপনি? আমি কে?আপনার ছেলে?
মিথ্যা কথা এটা।আমি কারো ছেলে নই।সেদিন মনে ছিলো না আমি আপনার ছেলে যেদিন আমি আপনার পা জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম বাবা আমি আপনাকে ছাড়া থাকতে পারবো না।মা ও চলে গেছে আপনি ও চলে যাবেন আমাকে রেখে?
কই,সেদিন তো আপনার মনে পড়ে নি আমার কথা।
আপনার নতুন বউ যেদিন ধাক্কা দিয়ে আমাকে ফ্লোরে ফেলে দিয়ে আমার কপাল ফাটিয়ে দিলো,সেদিন ও তো আপনার মনে ছিলো না আমি আপনার ছেলে।

ভীষণ জ্বরে কাঁদতে কাঁদতে যেদিন আপনাকে পাশে পেতে চেয়েছি সেদিন তো আপনি আসেন নি আমার কাছে। মতির মা’কে পাঠালেন আমার কাছে থাকতে।
ছোট ছিলাম কিন্তু অবুঝ ছিলাম না আমি।সব মনে আছে আমার। আরো শুনতে চান কিছু?
আর কি বললেন আপনি? আপনার বাড়িতে থাকতে হলে,খেতে হলে আপনার কথা শুনতে হবে?তবে বেশ,আমি আপনার বাড়ি ছেড়েই চলে যাচ্ছি। থাকবো না আপনার বাড়িতে।”
মুহুর্তেই যেনো একটা ভূমিকম্পের মতো সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেলো। ধ্রুব দোতলায় গিয়ে একটা ব্যাগে নিজের শার্ট-প্যান্ট কিছু নিয়ে বের হয়ে এলো।

হাসনা বেগম গিয়ে পথ আটকে দাঁড়ালেন।তিনি কিছু বলার আগেই ধ্রুব বললো, “তোমার পায়ে পরি চাচী,আমাকে তুমি থাকতে অনুরোধ করো না।তোমার অনুরোধ আমি ফেলতে পারবো না চাচী।তবে নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে থাকতে হবে আমাকে।আমার নিজের কাছে নিজেকে তুমি ছোট করো না।”
এই কথার পর হাসনা বেগমের আর কিছু বলার থাকে না।ধ্রুব হনহনিয়ে চলে গেলো।

হাসনা বেগম সেলিম সাহেবের সামনে গিয়ে বললো, “খুশি হয়েছেন তো মেজো ভাইজান?আপদ বিদায় হয়েছে এবার শান্তি হলো তো আপনার? কিভাবে পারলেন ছেলেকে খোঁটা দিতে?ক্লাস এইটে উঠার পর থেকে ধ্রুব নিজে টিউশনি করে নিজের পড়ার খরচ নিজে চালায়।অনার্সে উঠে তো ঢাকা শহরেই চলে গেলো। আপনার একটা কানাকড়ি ও তার পিছনে খরচ করতে হয় নি।তবুও কিভাবে পারলেন ছেলেকে খোঁটা দিতে?
কার জন্য খোঁটা দিলেন?যে নিজের স্বামী সন্তান রেখে চলে গেলো এই বাড়ি থেকে,তার জন্য?
কিসের দায় ধ্রুবর তাকে দেখতে যাবার?ধ্রুব যেদিন মা মা করে পুরো বাগানে গড়াগড়ি খেয়ে কেঁদেছে সেদিন কি সে এসেছিলো ধ্রুবকে দেখতে?

স্কুল থেকে চুরি করে ধ্রুব দীপালির বাড়ির সামনে গিয়ে হাজির হলো,কই তখনও তো সে এলো না একবার ছেলেকে দেখতে।দীপালির পিসেমশায় ঘাড় ধাক্কা দিয়ে আমার ধ্রুবকে বের করে দিলো।
বাড়িতে জানার পর আপনি ধ্রুবকে বাগানের আমগাছের সাথে বেঁধে মেরেছেন কেনো গেলো সেই বাড়িতে তার জন্য।
তখন তো কেউ এই ছেলেটার কথা ভাবেন নি।আজ কেনো তার উপর অধিকার দেখাতে আসছেন?”

পাথরের মূর্তির মতো সবাই থম মেরে বসে রইলো। সেলিম সাহেব জবাব দিলেন না।কি জবাব দিবেন তিনি?
রাগের মাথায় ছেলেকে এই কথা বলেছেন,মন থেকে তো বলেন নি।কাকে বুঝাবেন এখন এই কথা তিনি!
কারোর আর খাওয়া হলো না আদনান ছাড়া। আদনান মনে মনে ভীষণ খুশি হলো ধ্রুবর চলে যাওয়ায়।
শালুক স্কুল থেকে ফিরে দেখে পুরো বাড়ি কেমন থম মেরে আছে।কি হয়েছে কিছুই বুঝতে পারলো না। শাপলা ও কলেজে গেছে।কাকে জিজ্ঞেস করবে শালুক?
মায়ের কাছে গেলো একবার,গিয়ে দেখে মায়ের মুখ ভার।এটা হচ্ছে সতর্কতা সংকেত।মায়ের মুখ ভার দেখলে কেউ মা’কে ঘাটায় না।

দাদীর ঘরে গিয়ে শালুক জিজ্ঞেস করলো দাদীকে সবাই এমন চুপ হয়ে আছে কেনো।
সিতারা বেগম কেঁদে উঠলেন।কেঁদে বললেন,”আমার ভাইয়ের যে পোড়া কপাল রে বইন,আমার ভাই রাগ কইরা কই যেনো গেছে গা।”
শালুকের বুক কেঁপে উঠলো। ধ্রুব ভাই নেই?রাগ করে চলে গেছে ধ্রুব ভাই?কিন্তু কোথায় গেছে?
শহরে তো যাবে না শালুক শিওর। হল বন্ধ গিয়ে থাকবে কোথায়?
তবে কোথায় গেলো?

চিন্তায়,উৎকন্ঠায় শালুক ও খেলো না। বাকিটা সময় শালুক অপেক্ষা করে রইলো ধ্রুব ভাই বাড়িতে আসার।দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো,বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। কিন্তু ধ্রুব এলো না।
ঝাঁক বেঁধে পাখিরা নীড়ে ফিরতে লাগলো,চারদিকে কোলাহল থেমে যেতে লাগলো। বাগানে বসে একটা হুতুমপেঁচা ডাকতে লাগলো বড় করুণ সুরে।শালুকের বুক কাঁপতে লাগলো।
ধ্রুব কোথায়?ভালো আছে তো?

এতো কষ্ট কেনো তাকে দিলো সৃষ্টিকর্তা? কি হতো যদি আরেকটু কম কষ্ট দিতো!
রাত বাড়তে লাগলো, সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগলো শালুকের বুকের চিনচিনে ব্যথা,উৎকন্ঠা।
তবুও ধ্রুব ফিরে এলো না।

আদনানের সময়টা ভালো যাচ্ছে না। আদনান নিজেও বুঝতে পারছে না সে এতো অস্থির হয়ে আছে কেনো।কেনো এমন কু ডাক ডাকছে তার মন।
না পারছে আশাকে কিছু বলতে আর না পারছে ধ্রুবকে কিছু বলতে।
ধ্রুবকে আদনান চেনে,ধ্রুব এরকম ছেলে না।কিন্তু আশা!
আশার কাছে তো এসব ছেলেখেলা।

আদনান জানে আশার কাছে রিলেশনশিপটা ভীষণ ইজি।তবুও আদনান মিষ্টি কথা দিয়ে আশাকে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে এতো দিন।আজ এই ছেলের সাথে কাল ওই ছেলের সাথে ডেটে যাওয়া সব হাসিমুখে সহ্য করেছে।শুধু একবার বিয়েটা হোক,সব হাতে আসুক।তারপর দুই লাত্থি মেরে সে এই মেয়েকে বিদায় করবে।এরকম ক্যারেক্টারলেস মেয়েকে বউ হিসেবে মানায় না।

অপশন হাতে রেখেই আদনান প্ল্যান করেছে।শালুক হচ্ছে তার সেকেন্ড অপশন। এজন্যই তো আমেরিকায় থাকাকালীন শালুকের সাথে মিষ্টি কথা বলে ওকে পটিয়ে রাখার টেকনিক এপ্লাই করে রেখেছে।
গোসল করে এসে আশা ধ্রুবর খোঁজে নিচতলায় স্টাডি রুমে গেলো। ধ্রুব মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক একটা বই পড়ছে।
আশা ধ্রুবর সামনের চেয়ারে বসে বললো, “এটা কিসের বই ধ্রুব?”
ধ্রুব বইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, “মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখা।”

আশা আগ্রহী হয়ে বললো, “আমাকে গল্প বলো ধ্রুব,তোমাদের ফ্রিডম ফাইটারদের স্টোরি শুনতে চাই আমি। ”
ধ্রুব বললো, “ভাইয়ার কাছে যাও,ভাইয়া বলবে।সকাল থেকে আমার সাথে কথা বলছো ভাইয়ার মন খারাপ হবে।”
আশা হেসে বললো, “ধ্রুব,আদনান স্টোরি বলতে পারে না। ওর সব স্টোরি এক পর্যায়ে সেক্সুয়াল স্টোরিতে কনভার্ট হয়ে যায়। সবসময় তো আর এসব শুনতে ভালো লাগে না। ”
ধ্রুবর কান লাল হয়ে গেলো আশার কথা শুনে। এই বিষয়ে আর কথা বাড়ালো না ধ্রুব।কথা বলতে গেলে আশা হয়তো ফ্রি মাইন্ডে আরো অনেক কিছু শেয়ার করে ফেলবে।
আশার দোষ দেয় না ধ্রুব,তার ন্যাশনালিটি,তার দেশের কালচার যেমন সে তেমনই হবে।তবে অবাক লাগে তার আদনানের ব্যবহার।

আদনান কেমন যেনো রূপ বদলে ফেলার চেষ্টা করছে বলে ধ্রুবর মনে হয়। বাড়ির পিছনের পুকুরে আগে সবাই মিলে লাফঝাঁপ দিয়ে গোসল করতো। বিশাল পুকুরের এ মাথা থেকে ও মাথা সাঁতরে যাওয়ার প্রতিযোগিতা করতো।
সকালে ভিজে বাড়িতে আসার পর ধ্রুব আদনানকে বলেছিলো পুকুরে গোসল করতে যাবার কথা।
শুনে আদনান হেসে বললো, “পাগল না-কি তুই?পুকুরের পানিতে যেই পরিমাণ জার্মস আছে,মাই গড!”

ধ্রুব মুচকি হেসে চলে গেলো গোসল করতে পুকুরে।কাক ময়ুরের পুচ্ছ লাগালে কি ময়ুর হতে পারে!
ধ্রুব নিচের দিকে তাকিয়ে গল্প বলতে লাগলো। আশাকে খুঁজতে খুঁজতে আদনান ও ধ্রুবর স্টাডি রুমে এসে হাজির হলো। আশার দিকে তাকিয়ে আদনান অবাক হলো। চিকন ফিতার একটা টপস আর স্কার্ট পরে আশা বসে আছে ধ্রুবর সামনে। দেহের অবয়ব স্পষ্ট হয়ে আছে ওর।

আদনান হাসিমুখে এসে আশার পাশে বসলো। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে গল্প শুনে তারপর বললো, “দূর,এসব কি বলছিস?এসব কি এখন বলার সময় না-কি? শোন,আমি গল্প বলি।আমেরিকায় যাওয়ার পরের গল্প শোন।”
ধ্রুব হেসে বললো, “গল্প শোনার আগ্রহ নেই ভাই আমার।তুমি বরং তোমার প্রাণপাখিটাকে নিয়ে গিয়ে গল্প করো আমি একটু পড়ি।”

আদনান খুশি হলো ভীষণ। আশার হাত ধরে বললো, “চলো আশা।তোমার সাথে আজ সারাদিনে গল্প করা হয় নি।”
আশা বিরক্ত হয়ে বললো, “তোমার আর গল্প! তোমার গল্প শুরু হবে রুমের দরজা বন্ধ করে। রোমান্সে চলে যাবে,ঝাঁপিয়ে পড়বে তুমি আমার উপর। ”
ধ্রুব কানে হাত দিয়ে বইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। আদনান ভীষণ বিব্রত হলো।এই মেয়ের মুখে কোনো লাগাম নেই।
আশাকে রুমে এনে আদনান বললো, “পাগল হয়েছ তুমি আশা?কি বলছো এসব ধ্রুবর সামনে? আমার মান সম্মান আর রাখলে না।”

আশা বিরক্ত হয়ে বললো, “তুমি যা করো আমি তাই বলেছি আদনান। বাড়তি কিছু বলি নি।”
আদনান দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললো,”এমন ভাব করছো যেনো শুধু আমারই এসবে ইন্টারেস্ট, তোমার নেই?”
আশা হাসলো। তারপর বললো, “এটা ঠিক আমার ও এই ব্যাপারে আগ্রহ,তবে কি জানো আদনান, বাংলাদেশে আসার পর তোমাদের কালচার সম্পর্কে একটু আধটু জানার পর আমি নিজেকে সামলে নিয়েছি। এটা তো তোমার দেশ,তোমার দেশের কালচার তুমি ভালো জানো আমার চাইতে।তোমার উচিত ছিলো আমাকে বুঝানোর। তুমি তা কি করেছো?
সুযোগ পেলেই তুমি আমাকে বদ্ধ ঘরে নিয়ে আসতে চাইছো,আমি ও তাই তোমার থেকে দূরে সরে থাকতে চাইছি।
তুমি মানুষটা কেমন যেনো আদনান। তোমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে অনেক ডিফরেন্স।”

আদনানের মাথায় যেনো আগুন জ্বলে উঠলো। আশার হাত চেপে ধরে বললো, “কি ডিফরেন্স?”
আশা নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, “আজ যখন আমি বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম, ধ্রুব একবারের জন্যও আমার দিকে তাকায় নি।ওর সাথে হেটে এসেছি বাড়ি পর্যন্ত, ধ্রুবকে একবার ও দেখি নি আমার বডির দিকে তাকাতে।অথচ বাড়ি আসতেই তোমার নজর গিয়েছিল আমার বডিতে।
এই যে একটু আগে,আমি ধ্রুবর স্টাডি রুমে গিয়েছি।এটাও একটা এক্সপেরিমেন্ট ছিলো আমার। আমি এই টপস পরে যাওয়ায় ধ্রুব বইয়ের দিকে তাকিয়ে ছিলো পুরোটা সময়। আমি ওকে বলেছিলাম আমাকে স্টোরি বলতে, ও তখনও তাকায় নি আমার দিকে।

তুমি কিন্তু ওর স্টাডি রুমে ঢুকেই আমার সারা শরীর স্ক্যান করে ফেলেছ।এজন্যই ধ্রুবকে আমার ভীষণ ভালো লাগছে। ও একজন পারফেক্ট মানুষ। তোমার মতো করে কাউকে ইমপ্রেস করার মিথ্যা চেষ্টা ধ্রুব করে না।বরং ওর এই শুদ্ধতায় মানুষকে ওর প্রতি ইমপ্রেস করে। ”
আদনান কি বলবে ভেবে পেলো না। আশার কাছ থেকে আদনান এসব এক্সপেক্ট করে নি।আশা কি তবে ধ্রুবতে একেবারে মজে গেছে!

আদনানকে হতভম্ব অবস্থায় রেখে আশা বের হয়ে গেলো আফিফার রুমের দিকে।
দুপুরে খাবার টেবিলে ধ্রুব বসার পর ধ্রুবর বাবা সেলিম সাহেব এসে বসেছেন ধ্রুবর মুখোমুখি চেয়ারে।
ধ্রুব সবেমাত্র মুখে ভাতের লোকমা তুলেছে সেই সময় সেলিম সাহেব বললেন, “ধ্রুব,খাবার পর তুমি গিয়ে তোমার মা’কে দেখে আসবে।”

ধ্রুব ভাতের লোকমা রেখে দিয়ে বললো, “আমি কারো হুকুম মেনে চলার মানুষ নই।”
সেলিম সাহেবের ভীষণ রাগ উঠে আছে গতরাত থেকে দীপালির অসুস্থতার খবর জানার পর থেকে। ধ্রুবর এই বাঁকা কথা তার সহ্য হলো না। চিৎকার করে বললেন,”অবশ্যই মেনে চলবে তুমি আমার হুকুম।আমার ছেলে তুমি,আমার বাড়িতে থাকতে হলে,আমার বাড়িতে খেতে হলে তোমাকে আমার কথা মানতেই হবে। ”

ধ্রুব হেসে ফেললো শব্দ করে। তারপর বললো, “কি বললেন যেনো আপনি? আমি কে?আপনার ছেলে?
মিথ্যা কথা এটা।আমি কারো ছেলে নই।সেদিন মনে ছিলো না আমি আপনার ছেলে যেদিন আমি আপনার পা জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম বাবা আমি আপনাকে ছাড়া থাকতে পারবো না।মা ও চলে গেছে আপনি ও চলে যাবেন আমাকে রেখে?
কই,সেদিন তো আপনার মনে পড়ে নি আমার কথা।
আপনার নতুন বউ যেদিন ধাক্কা দিয়ে আমাকে ফ্লোরে ফেলে দিয়ে আমার কপাল ফাটিয়ে দিলো,সেদিন ও তো আপনার মনে ছিলো না আমি আপনার ছেলে।

ভীষণ জ্বরে কাঁদতে কাঁদতে যেদিন আপনাকে পাশে পেতে চেয়েছি সেদিন তো আপনি আসেন নি আমার কাছে। মতির মা’কে পাঠালেন আমার কাছে থাকতে।
ছোট ছিলাম কিন্তু অবুঝ ছিলাম না আমি।সব মনে আছে আমার। আরো শুনতে চান কিছু?
আর কি বললেন আপনি? আপনার বাড়িতে থাকতে হলে,খেতে হলে আপনার কথা শুনতে হবে?তবে বেশ,আমি আপনার বাড়ি ছেড়েই চলে যাচ্ছি। থাকবো না আপনার বাড়িতে।”
মুহুর্তেই যেনো একটা ভূমিকম্পের মতো সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেলো। ধ্রুব দোতলায় গিয়ে একটা ব্যাগে নিজের শার্ট-প্যান্ট কিছু নিয়ে বের হয়ে এলো।

হাসনা বেগম গিয়ে পথ আটকে দাঁড়ালেন।তিনি কিছু বলার আগেই ধ্রুব বললো, “তোমার পায়ে পরি চাচী,আমাকে তুমি থাকতে অনুরোধ করো না।তোমার অনুরোধ আমি ফেলতে পারবো না চাচী।তবে নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে থাকতে হবে আমাকে।আমার নিজের কাছে নিজেকে তুমি ছোট করো না।”
এই কথার পর হাসনা বেগমের আর কিছু বলার থাকে না।ধ্রুব হনহনিয়ে চলে গেলো।

হাসনা বেগম সেলিম সাহেবের সামনে গিয়ে বললো, “খুশি হয়েছেন তো মেজো ভাইজান?আপদ বিদায় হয়েছে এবার শান্তি হলো তো আপনার? কিভাবে পারলেন ছেলেকে খোঁটা দিতে?ক্লাস এইটে উঠার পর থেকে ধ্রুব নিজে টিউশনি করে নিজের পড়ার খরচ নিজে চালায়।অনার্সে উঠে তো ঢাকা শহরেই চলে গেলো। আপনার একটা কানাকড়ি ও তার পিছনে খরচ করতে হয় নি।তবুও কিভাবে পারলেন ছেলেকে খোঁটা দিতে?
কার জন্য খোঁটা দিলেন?যে নিজের স্বামী সন্তান রেখে চলে গেলো এই বাড়ি থেকে,তার জন্য?
কিসের দায় ধ্রুবর তাকে দেখতে যাবার?ধ্রুব যেদিন মা মা করে পুরো বাগানে গড়াগড়ি খেয়ে কেঁদেছে সেদিন কি সে এসেছিলো ধ্রুবকে দেখতে?

স্কুল থেকে চুরি করে ধ্রুব দীপালির বাড়ির সামনে গিয়ে হাজির হলো,কই তখনও তো সে এলো না একবার ছেলেকে দেখতে।দীপালির পিসেমশায় ঘাড় ধাক্কা দিয়ে আমার ধ্রুবকে বের করে দিলো।
বাড়িতে জানার পর আপনি ধ্রুবকে বাগানের আমগাছের সাথে বেঁধে মেরেছেন কেনো গেলো সেই বাড়িতে তার জন্য।
তখন তো কেউ এই ছেলেটার কথা ভাবেন নি।আজ কেনো তার উপর অধিকার দেখাতে আসছেন?”

পাথরের মূর্তির মতো সবাই থম মেরে বসে রইলো। সেলিম সাহেব জবাব দিলেন না।কি জবাব দিবেন তিনি?
রাগের মাথায় ছেলেকে এই কথা বলেছেন,মন থেকে তো বলেন নি।কাকে বুঝাবেন এখন এই কথা তিনি!
কারোর আর খাওয়া হলো না আদনান ছাড়া। আদনান মনে মনে ভীষণ খুশি হলো ধ্রুবর চলে যাওয়ায়।
শালুক স্কুল থেকে ফিরে দেখে পুরো বাড়ি কেমন থম মেরে আছে।কি হয়েছে কিছুই বুঝতে পারলো না। শাপলা ও কলেজে গেছে।কাকে জিজ্ঞেস করবে শালুক?
মায়ের কাছে গেলো একবার,গিয়ে দেখে মায়ের মুখ ভার।এটা হচ্ছে সতর্কতা সংকেত।মায়ের মুখ ভার দেখলে কেউ মা’কে ঘাটায় না।

দাদীর ঘরে গিয়ে শালুক জিজ্ঞেস করলো দাদীকে সবাই এমন চুপ হয়ে আছে কেনো।
সিতারা বেগম কেঁদে উঠলেন।কেঁদে বললেন,”আমার ভাইয়ের যে পোড়া কপাল রে বইন,আমার ভাই রাগ কইরা কই যেনো গেছে গা।”
শালুকের বুক কেঁপে উঠলো। ধ্রুব ভাই নেই?রাগ করে চলে গেছে ধ্রুব ভাই?কিন্তু কোথায় গেছে?
শহরে তো যাবে না শালুক শিওর। হল বন্ধ গিয়ে থাকবে কোথায়?
তবে কোথায় গেলো?

চিন্তায়,উৎকন্ঠায় শালুক ও খেলো না। বাকিটা সময় শালুক অপেক্ষা করে রইলো ধ্রুব ভাই বাড়িতে আসার।দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো,বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। কিন্তু ধ্রুব এলো না।
ঝাঁক বেঁধে পাখিরা নীড়ে ফিরতে লাগলো,চারদিকে কোলাহল থেমে যেতে লাগলো। বাগানে বসে একটা হুতুমপেঁচা ডাকতে লাগলো বড় করুণ সুরে।শালুকের বুক কাঁপতে লাগলো।
ধ্রুব কোথায়?ভালো আছে তো?

শালুক ফুলের লাজ নাই পর্ব ১০

এতো কষ্ট কেনো তাকে দিলো সৃষ্টিকর্তা? কি হতো যদি আরেকটু কম কষ্ট দিতো!
রাত বাড়তে লাগলো, সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগলো শালুকের বুকের চিনচিনে ব্যথা,উৎকন্ঠা।
তবুও ধ্রুব ফিরে এলো না।

শালুক ফুলের লাজ নাই পর্ব ১২