শালুক ফুলের লাজ নাই শেষ পর্ব 

শালুক ফুলের লাজ নাই শেষ পর্ব 
রাজিয়া রহমান

গ্রামে ১ সপ্তাহ হয়ে গেছে ধ্রুবদের। অথচ শহরে ফিরে যাবার মতো তাড়া নেই যেনো এরকম মনে হচ্ছে ধ্রুবর।নিজের চাকরি,শালুকের পড়ালেখা সবকিছু মাথা থেকে বের হয়ে গেছে। ধ্রুবর দিন কাটে বাড়ির পিছনের শ্যাওলা ধরা পুকুর ঘাটে বসে।

পুকুরের পানির দিকে তাকিয়ে আনমনে কি ভেবে যায় ধ্রুব,কে জানে তা!
ভীষণ জ্বালাপোড়া অনুভব হয় ধ্রুবর, জীবনের সব হিসেব যেনো মিলতে মিলতে ও মিললো না।
জটিল লাগে এই জীবন। কখনো কি ধ্রুব ভেবেছিলো এভাবে মা’কে হারিয়ে ফেলবে?
ভাগ্যে যদি হারিয়ে ফেলাই ছিলো তবে কেনো মায়ের সাথে শেষ বার দেখা হলো!
দেখা না হলেও তো কষ্ট একটু কম হতো তাহলে। পেয়ে হারানোর সে কি যন্ত্রণা!
এতোদিন কেনো বুঝতে পারে নি ধ্রুব?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ধ্রুবর পাশে এসে জহির বসলো। একটা মাটির ঢেলা কুড়িয়ে নিয়ে পানিতে ছুঁড়ে মারলো জহির।তারপর আপন মনে বলতে লাগলো, “বাবা যখন মারা যায়,আমি তো তখন ছোট ছিলাম।এজন্য সবসময় মনে হয় বাবার আদর কিছুই পাই নি যেনো। বাবা যদি আজও বেঁচে থাকতেন তাহলে হয়তো আমি বুঝতাম না তোর ব্যথাটা।কিন্তু কিছু করার নেই ধ্রুব,প্রকৃতির এই নিয়মকে আমাদের মেনে নিতেই হবে।কিছুতেই এই নিয়ম কে অস্বীকার করা যায় না।

এখন জীবন থেকে কেউ হারিয়ে গেছে ভেবে যদি জীবনকে এখানেই থামিয়ে রাখি আমরা, তবে আমরা নিজেরাও হারিয়ে যাবো অল্প সময়ের মধ্যে।

এখন যেই সময় তুই পার করছিস তোর কাছে এই দুনিয়া ছেড়ে চলে যাওয়াটা মনে হতে পারে সবচেয়ে সুন্দর সমাধান। কিন্তু একটা সমস্যা তখনও রয়েই যায় ধ্রুব।তোকে ঘিরে আবার যারা বেঁচে আছে তাদের ও এই অনুভূতি হতে পারে।
বাবা মারা যাবার পর আমার সবসময় ইচ্ছে করতো আত্মহ/ত্যা করতে।কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে যেতো মা আছে,বোন আছে,ভাই আছে।”

ধ্রুব বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে জহিরের দিকে তাকিয়ে বললো, “তোর কাছে আমি কৃতজ্ঞ থাকবো জহির ভাই।”
জহির মুচকি হাসলো।ধ্রুব বাড়িতে গিয়ে বড় চাচীকে বললো, “ক্ষিধে পেয়েছে চাচী।”
আদিবা বেগমের চোখের কোণে জল জমতে লাগলো। ছুটে গেলেন রান্নাঘরে। ১ সপ্তাহ ধরে ধ্রুব কেমন আগের মতো চুপচাপ, উদাসীন হয়ে যাচ্ছিলো লক্ষ্য করছিলো সবাই।সবার মনে ভয় ছিলো আবারও বুঝি ধ্রুব সবার সাথে অভিমান করে দূরে চলে যাবে।কিন্তু আজ যেনো মনে হচ্ছে চাঁদের মুখ থেকে মেঘ সরে গেছে।

খেতে বসে ধ্রুব উঠে গেলো। শালুক রুমেই বসে ছিলো। একটা বই সামনে নিয়ে তাকিয়ে আছে বইয়ের দিকে।কিন্তু মন নেই বইতে।কি ভাবছে যেনো শালুক।
ধ্রুবর মন খারাপ দেখে শালুকের নিজের ও ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। নিজেও ঘাবড়ে গেছে শালুক ধ্রুবকে এরকম ভেঙে পড়তে দেখে।ধ্রুবর মন খারাপ দেখে ভয়ে শালুক ও ধ্রুবকে খুব একটা ঘাটালো না।

রুমের দরজা বন্ধ করে ধ্রুব শালুককে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লো। তারপর আস্তে করে বললো, “আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি শালুক। আমরা আর শহরে যাবো না।গ্রামেই থাকবো,বাড়িতেই থাকবো।তুমি কি রাজি হবে আমার এই সিদ্ধান্তে?”
শালুক কেঁদে ফেললো। ধ্রুবর গলা জড়িয়ে ধরে বললো, “আমি ভীষণ খুশি হবো তাহলে। বাড়িতে সবাইকে ছেড়ে একা একা থাকতে আমার খুব খারাপ লাগে। ”

ধ্রুব বললো, “চলো খেতে যাই।আমার ক্ষিধে পেয়েছে। ”
শালুককে সাথে নিয়ে ধ্রুব খাবার খেলো।তারপর বাবার রুমে গেলো। সেলিম সাহেব ব্যবসায়ের হিসাব করছেন।ধ্রুব গিয়ে বাবার পাশে বসে বললো, “বাবা,আমি ব্যবসায় করতে চাই।”
অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকালেন সেলিম সাহেব। তারপর বললেন,”তোর চাকরি?”

ধ্রুব হেসে বললো, “চাকরি আমার দ্বারা হবে না বাবা।ব্যবসায় মনে হয় রক্তের সাথে মিশে গেছে আমাদের। আপনারা সবাই ব্যবসায় করছেন আমি ও আপনাদের পথ অনুসরণ করতে চাই।আরেকটা কথা, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি বাড়ি থেকে আর যাবো না।এখানেই থাকবো।”

সেলিম সাহেব এবার হতবাক হয়ে গেলেন। ধ্রুব এগিয়ে গিয়ে বাবার পাশ ঘেঁষে বসলো। বাবার কাঁধে মাথা রেখে বললো, “মা’কে তো হারিয়ে ফেলেছি বাবা।আমার ভীষণ ভয় হচ্ছে এভাবে হঠাৎ করে যদি কোনোদিন তোমাকে হারিয়ে ফেলি!তাহলে যে বাবা আমার আফসোসের সীমা থাকবে না।এজন্য আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি বাড়িতেই থাকবো।প্রাণ ভরে তোমাকে বাবা বলে ডাকবো।তোমার ছায়া হয়ে থাকবো,যাতে তোমার যেকোনো প্রয়োজনে হাজির হয়ে যেতে পারি। আবারও যাতে আমার বুকে হাহাকার না জন্মে যে বাবা কে ও মন ভরে ডাকতে পারি নি।

আমাদের যৌথ পরিবারের যে রেওয়াজ সেটা শহরে থেকে আমি ভাঙবো না।”
সেলিম সাহেব ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।বুকের ভেতর একটা প্রশান্তির অনুভূতি হচ্ছে তার। এই তো সেই ছেলে যে কি-না তার মুখোমুখি হতো না দীর্ঘ সময় ধরে।

এই তো সেই ছেলে যে কি-না এক টেবিলে বসে তার সাথে খেতে বসতো না পর্যন্ত।
এই তো সেই ছেলে যে তার ডাকে সাড়া দেওয়ার প্রয়োজন ও মনে করতো না ।
অথচ আজ সেই ছেলেই কি-না তার কাছে থাকতে চাইছে, শুধুমাত্র মন ভরে তাকে ডাকার জন্য।
আহা,পিতা হওয়া বুঝি সার্থক হলো তার এতোদিনে!

এরপর ম/রে গেলেও আর কোনো আফসোস থাকবে না।
এর অনেক দিন পর একটা ঘটনা ঘটে গেলো। জহির একটা মেয়ে নিয়ে বাসায় হাজির।ধ্রুব তখন নিজের রেস্টুরেন্টে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। বাড়িতে সেদিন প্রায় উৎসব উৎসব আমেজ।আফিফার বাবু হবে,৭ মাস উপলক্ষে বেবি শাওয়ার অনুষ্ঠান হচ্ছে আজ বিকেলে।

আকাশীরং একটা সুতি শাড়ি পরনের মেয়েটা গুটিগুটি পায়ে গিয়ে সবাইকে সালাম করতে লাগলো। লিলি বেগম ছুটে এলেন বাহিরে।এসেই বউকে জড়িয়ে ধরলেন বুকে।
মাথার ঘোমটা খানিকটা সরিয়ে বললেন,”আল্লাহ আমার ঘরে আরেকটা চাঁদ দিছে বুঝি।”

শালুক কলেজে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। ছিপছিপে গড়নের,শ্যামলা মিষ্টি চেহারার শাড়ি পরা একটা মেয়েকে দেখে শালুক বুঝতে পারলো না ঘটনা কি ঘটেছে।
আদিবা বেগম মিষ্টি নিয়ে শালুককে খাইয়ে দিতে দিতে বললো, “আমাদের জহিরের বউ রে শালুক,তোর ভাবী।যা ভাবীর সাথে পরিচিত হয়ে নে।”

শালুকের মাথার উপর দিয়ে গেলো সবটা।জহির ভাই এভাবে বিয়ে করেছে,কিন্তু কেনো?
নাশতার টেবিলে বসে ফরিদা বেগম ডাল আর শুঁটকি ভর্তা দিয়ে শালুককে ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দিতে দিতে বললেন,”ওর নাম রুমা বুঝলি।মেয়ের মা নেই,সৎ মা ঘরে। খুবই মিষ্টি একটা মেয়ে।জহিরের ক্লাসমেট ছিলো।ভালো বন্ধুত্ব ছিলো জহিরের সাথে। শুনবি,আমাদের এই লাজুক জহির একটু আধটু মনে হয় পছন্দ ও করতো ওরে।সৎ মা মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে মুক্ত হতে চেয়েছিলো।এক মাঝবয়েসী লোকের সাথে বিয়ে ঠিকঠাক, লোকটার আগের স্ত্রী মা/রা গেছেন,সেই ঘরে তিনটা ছেলে মেয়ে আছে। বড় ছেলে নাকি এবার ক্লাস ১০ এ পড়ে।

পরশু রাতে জহির বড় আপাকে কল দিয়ে বললো, “মা,আমি যদি একটা মা-হারা মেয়েকে বিয়ে করে বাড়িতে নিয়ে আসি তুমি কি তাকে মেনে নিবে?”
তোর ফুফু তো শুনে আকাশ থেকে পড়লো যেনো।যে ছেলে কারো দিকে তাকিয়ে কথা বলতে ও লজ্জা পায় সে নিজ মুখে নিজের বিয়ের কথা বলছে!

ছুটে এসে আমাদের বললো তোর ফুফু।আমরা তিন জা মিলে বললাম,”এর চাইতে ভালো আর কিছু হতেই পারে না। একটা মা হারা মেয়ে আর কিছু না পেলেও অন্তত তোর ফুফুর মতো একজন মা তো পাবে।তোর ফুফুর সে কি আনন্দ যখন আমরা তিন জা সম্মতি দিলাম।ব্যস আর কি লাগে,আজ সকালে ছেলে আর বউ হাজির।”

হাসনা বেগম তাড়াতাড়ি নাশতা নিয়ে ছুটছেন নতুন বউয়ের জন্য। ফরিদা কে টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে শালুককে ভাত খাওয়াতে দেখে কপট রাগ দেখিয়ে বললেন,”নিজের ছেলের বউয়ের আর কতো যত্ন নিবি?বাড়িতে এখন নতুন আরেকটা বউ এসেছে, তার দিকে ও তো খেয়াল দিতে হবে।তার নাশতা পানির আয়োজন করবে কে?”
শালুক ভেংচি দিয়ে বললো, “যাচ্ছি আমি,আমার খাওয়া শেষ। ”

ধ্রুব বাহিরে দাঁড়িয়ে হর্ণ দিচ্ছে বাইকে।শালুক ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ছুটে বের হয়ে গেলো।
জীবন ভীষণ সুন্দর মনে হচ্ছে শালুকের। নিজের পড়ালেখার পাশাপাশি দিবাকেও পড়া দেখিয়ে দেয় শালুক। ছুটির দিনে ধ্রুব শালুককে নিয়ে বের হয়ে যায় ঘুরতে।সন্ধ্যা বেলায় সবাই মিলে জমজমাট আড্ডা দেয়।
রুমা চমৎকার সংসারী মেয়ে,শালুক নিজেও রুমার থেকে টুকটাক কাজ করা শিখে।

এর মধ্যে শাপলার বিয়ে ঠিক হয় পলকের সাথে। আফিফার ছেলের ততদিনে প্রায় ৬ মাস বয়স হয়ে গেছে। সময় পেলেই সজিব আফিফাকে নিয়ে বেড়াতে চলে আসে।সজিবের আজকাল ভীষণ ভালো লাগে এই পরিবার কে।নিজের মা বাবা না থাকায় এই বাড়িতে আসলে সবাই কে মনে হয় নিজের মা বাবা যেনো। এরা সবাই ভীষণ আপন করে কথা বলে সজিবের সাথে।

সবকিছু ঠিকঠাক মতো যখন চলছিলো ঠিক তখনই আদনান জানালো শাপলার বিয়েতে যোগ দিতে দুই মাসের ছুটি নিয়ে সে দেশে আসছে।আদনানের দেশে আসার খবরটা আনন্দের হলেও সবার জন্য ভীতিকর ও বটে।একবার তো ঝামেলা করলো আফিফার বিয়ের সময়। এখন আবার শাপলার বিয়ের সময় কি করে বসে!
বিয়ের দিন সকালে আদনান এসে পৌছালো। সবার হাসিমুখের আড়ালে লুকিয়ে থাকা উদ্বেগ আদনানের কাছে গোপন রইলো না।হাসলো আদনান সবার এই ভয় দেখে।

বিয়েটা হয়ে গেলো মহা ধুমধামে। সবাই চাপা আতংক নিয়ে দিন কাটাচ্ছে। শালুক দরকার ছাড়া নিজের রুম থেকে বের হচ্ছে না। ধ্রুব যদিও এসব নিয়ে ভাবছে না।সে বারবার শালুককে ভরসা দিয়ে যাচ্ছে কিছু হবে না।
আদনানের ছুটি আর ১ মাস আছে। এমন সময় আদনানের দাদা সিদ্ধান্ত নিলেন,এভাবে আর চলে না।

আদনান দেশে এসেছে অথচ সবাই তার সাথে এমন করে ব্যবহার করছে যেনো এই মাত্র সে খুন করে এসেছে। এই সবকিছুর একটাই সমাধান আদনান কে ও বিয়ে করিয়ে দেওয়া।
ধ্রুব,জহির দুজনেই আদনানের ছোট। দু’জনে বিয়ে করেছে অথচ বড় ভাই হয়ে আদনান এখনো বিয়ে করে নি দাদা হয়ে নাতির এই অবস্থা তার সহ্য হলো না।

নিজের তিন ছেলে, ছেলের বউ,মেয়েকে ডেকে নুরুল ইসলাম সাহেব সন্ধ্যায় নিজের মতামত জানালেন।সবাই তার মতামত শুনে খুশি হলো। অন্তত যেই আতঙ্কে থাকছে সবাই তা থেকে তো মুক্তি পাবে সবাই।শালুককে ও এভাবে পালিয়ে বেড়াতে হবে না।
সবসময় সবার দুশ্চিন্তা করতে হবে না।

রাতে খাবার টেবিলে নুরুল ইসলাম সাহেব আদনানকে বললেন,”আদনান,তোর দাদী তো ভাই তোর বউ দেখার জন্য উতালা হয়ে আছে।এখন তুই যদি বলিস তবে আমরা তোর জন্য মেয়ে দেখি।বিয়েটা করে না হয় আবার বিদেশে যাবি।”
আদনান চুপ করে থেকে বললো,

“বেশ তো।আমার আপত্তি নেই।আমি জানি আপনারা সবাই আমাকে নিয়ে ভয়ে আছেন।আমি যতোই বলি না কেনো আমার পক্ষ থেকে শালুক,ধ্রুব কারো কোনো ক্ষতি হবে না তা কেউ বিশ্বাস করবে না।আমি অনেকটা মিথ্যাবাদী রাখালের মতো হয়ে গেছি।সবার মুখে যে দুশ্চিন্তার ছাপ দেখতে পাই তাতে আমার নিজেকে নিজের শেষ করে দিতে ইচ্ছে করে মাঝেমাঝে।
তবে আমার একটা অনুরোধ রইলো দাদা।

আমার জন্য যদি মেয়ে দেখেন তবে কোনো ডিভোর্সি অথবা বিধবা মেয়ে দেখবেন।আমি নিজে কোনো চরিত্রবান পুরুষ ছিলাম না।সৌদি গিয়ে আমি নিজেকে নিজে পরিবর্তন করে নিতে চেয়েছি।জানি না কতোটুকু পেরেছি।দুই বার ওমরাহ হজ্জ করেছি,আল্লাহর কাছে নিজের সমস্ত অপরাধের জন্য ক্ষমা চেয়েছি।আজও আমি অনুতপ্ত। আমার আল্লাহ যদি আমাকে ক্ষমা করেন তবেই আমি ক্ষমা পাবো।

আমার এসব অতীতের কথা শুনে কোনো অবিবাহিতা মেয়ে রাজি হবে না।”
পরের সপ্তাহে মেয়ে দেখা ফাইনাল হলো। আদনানকে আলাদাভাবে পাত্রীর সাথে কথা বলতে দেওয়া হলো।
২৪-২৫ বছর বয়সী একটা মেয়ে বসে আছে আদনানের সামনে। আদনান গলা খাঁকারি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “আপনার নাম কী?”

মেয়েটা কাঁপা গলায় বললো, “সায়মা আক্তার।”
আদনান জিজ্ঞেস করলো, “আপনার কি আমাকে কিছু বলার আছে? এই বিয়েতে আপনার কোনো আপত্তি বা জোর করে আপনাকে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে এরকম কিছু হলে আমাকে জানাতে পারেন।”
সায়মা মুচকি হেসে বললো, “না এরকম কোনো ব্যাপার নেই।”

আদনান এক গ্লাস পানি খেয়ে বললো, “আমার কিছু কথা বলার আছে দয়া করে শুনবেন,তারপর আপনার যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার নিবেন।”
সায়মা উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালো আদনানের দিকে।ফর্সা,কিছুটা স্বাস্থ্যবান লোকটার দিকে এই প্রথম সরাসরি তাকালো সায়মা।

আদনান নিচের দিকে তাকিয়ে বললো, “কয়েক বছর আমি আমেরিকায় ছিলাম।তখন আমার কাজিনের সাথে আমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো। ওর সাথে আমি ফিজিক্যাল রিলেশনে ও চলে যাই।
যাই হোক,আমি তখন ভীষণ স্বার্থপর স্বভাবের মানুষ ছিলাম।নিজের স্বার্থের জন্য নিজের কয়েকজন আপন মানুষের ক্ষতি ও করেছি।পরবর্তীতে বুঝতে পারি আমি আসলে ভীষণ অন্যায় করেছি।

এক প্রকার সবার অপছন্দের মানুষ হয়ে গেলাম বাড়িতে।তাই বিদেশে চলে যাই। যাবার আগে যাদের ক্ষতি করেছি তাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিই।সৌদি গিয়ে নিজের মধ্যে অনুশোচনা জন্মায়।সবকিছুর জন্য,আমার অতীতের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই।আমি চাই না আমার সাথে বিয়ে হবার পর আপনি এসব জানতে পেরে কষ্ট পান।তাই আগেই জানিয়ে দিলাম।এবার আপনার যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার নিবেন।”

সায়মা অপলক তাকিয়ে থেকে বললো,”আমার প্রথম বার যার সাথে বিয়ে হয় তার প্রথম স্ত্রী অন্য কারো সাথে পালিয়ে যায় ৩ টা ছেলেমেয়ে রেখে।আমার বিয়ের ২ বছর পর সেই স্ত্রী আবারও ফিরে আসায় সন্তানের দিকে তাকিয়ে তিনি আমাকে ডিভোর্স দিয়ে তাকে গ্রহণ করেন।

আমাদের নিম্নবিত্ত পরিবার, ভাই বোন ৫ জন।আমার পরে আমার আরো ২ জন বোন আছে।বাবা মায়ের ঘাড়ের বোঝা হয়ে বসে আছি বলতে পারেন।আমার ডিভোর্স হয়েছে দেড় বছর হলো।

আপনার অতীতের কথা শুনে আমার ভীষণ খারাপ লেগেছে সত্যি তবে এ ও সত্যি আমি ডিভোর্সি, আমার পারিবারিক অবস্থা খারাপ জেনেও আপনি আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছেন বলে আমার আসলেই ভালো লাগছে।আপনাদের পারিবারিক অবস্থার কথা আমাদের গ্রামের সবাই জানে,আপনি চাইলেই কোনো ষোড়শী মেয়েকে বিয়ে করতে পারতেন,আপনাদের আর্থিক অবস্থার দিকে তাকিয়ে অনেক মেয়েই আপনার এই অতীতের কথা মনে রাখতো না।

সেখানে আপনি তবুও নিজের অনুশোচনার জন্য আমার মতো কাউকে বিয়ে করতে চেয়েছেন। আমার কোনো অমত নেই।আমার শুধু একটা অনুরোধ রইলো, অতীতে আপনার যেই থাকুক,তখন আমি ছিলাম না।কিন্তু ভবিষ্যতে যখন আমি থাকবো তখন যেনো আর কেউ না আসে আপনার জীবনে।আপনি যদি আমার অতীত মেনে নিতে পারেন তবে আমার ও আপনার অতীত নিয়ে আর কখনো কোনো প্রশ্ন থাকবে না।”

ছোট্ট পরিসরে আয়োজন করে পরের দিন আদনানের বিয়ে হয়ে গেলো। বহুদিন পর আজ আবারও বাড়ির সবাইকে নিশ্চিন্ত মনে হলো।
আজ আর শালুককে ভয়ে রুমে বসে থাকতে হচ্ছে না। ইদানীং শালুকরা তিন জা মিলে হুটহাট এটা সেটা রান্না করে ফেলে।যেকোনো কাজে তিন মাথা একসাথে দেখা যায়।

আদনান সৌদি যাবার পরের মাসে সবাই সুখবর পেলো নতুন অতিথি আগমনের।
খবর শুনে নয়না,আফিফা,শাপলা সবাই বাবার বাড়ি এলো।ভিডিও কলে আদনান সবার হাসি ভরা মুখ দেখছে আর চোখের পানি মুছছে।সায়মার লাজুক মুখখানার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আদনানের কেমন ঘোর লেগে গেলো।
ইচ্ছে করলো এক ছুটে গিয়ে বউটাকে জড়িয়ে ধরে এরকম মিষ্টি একটা সংবাদ জানানোর জন্য।

রাতে শুতে গিয়ে শালুক মুখ ভার করে রাখলো। ধ্রুব কিছুক্ষণ এটা ওটা বলে হাসানোর চেষ্টা করে ও যখন ব্যর্থ হলো তখন ঝাপটে ধরে বললো, “কি হয়েছে শালুক,বলো না আমাকে।”
মুখ বাঁকিয়ে শালুক বললো, “আদনান ভাই বিয়ে করেছে সেদিন,অথচ এখনই খুশির খবর দিয়ে দিলো।আফিফা আপা আর আমাদের বিয়ে একই দিনে হয়েছে তাদের ও খুশির খবর সবাই জানতে পারলো। অথচ আমি এখনো কাউকে কোনো খুশির খবর শুনাতে পারলাম না।আমার কি লজ্জা লাগছে না? ওরা সবাই ফার্স্ট, সেকেন্ড হয়ে গেছে। ”

ধ্রুব হাহা করে হেসে বললো,”আমি কি এমনি এমনি বলি যে শালুক ফুলের লাজ নাই?আসলেই লাজ নাই।নিজে বাচ্চা হয়ে এখনই কিনা বাচ্চা চায়। ”
শালুক মুখ বাঁকিয়ে বললো, “কিছুদিন পর আমি ১৮ বছরের হবো।”
ধ্রুব শার্ট খুলতে খুলতে বললো, “তারপর না হয় বাচ্চা নিয়ে ভেবো,এখন ও ছোট তুমি ভীষণ। ”

শালুক কটমট করে তাকিয়ে বললো, “তাই না,তবে রে!
খবরদার রাতে কোনো ভাবে যদি আমাকে টাচ করার চেষ্টা করেছেন তবে দেখবেন।১৮ বছর যখন হবো তখনই বাকি সব ও হবে।”

শালুক রাগ করে রুম থেকে বের হয়ে যেতে নিলো,ধ্রুব পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে রুমের বাতি বন্ধ করে দিলো।
তারপর বদ্ধ ঘরের ভেতর থেকে শালুকের হাসির রিনিঝিনি ভেসে আসতে লাগলো। হয়তো স্বর্গ সুখ রচিত হচ্ছে তাদের বদ্ধ ঘরে।

(সমাপ্ত)

শালুক ফুলের লাজ নাই পর্ব ৩৫