শালুক ফুলের লাজ নাই পর্ব ১৫

শালুক ফুলের লাজ নাই পর্ব ১৫
রাজিয়া রহমান

আজ আফিফার বিয়ে। বিয়ে বাড়ির সকল আনন্দ চাপা পড়ে আছে সবার মন খারাপের আড়ালে।
সবাই কেমন রোবটের ন্যায় চলছে।
হাসি মুখে বেদনার চাপ।বুকে লুকায়িত গোপন ব্যথা।
আকাশে মেঘের আনাগোনা, যেনো আকাশের ও মন খারাপ। আদনান সকাল থেকে নিজের রুমে বসে আছে দরজা আটকে।
কি করেছে সে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না।

সে তো শালুককে হারাতে চায় নি।বরং আজীবনের জন্য শালুককেই চেয়েছে। কিন্তু কি হয়ে গেলো এটা!
শাপলা কাঁদছে ভীষণ। ছোট বোনটাকে এতো তাড়াতাড়ি হারিয়ে ফেলবে সে কখনো ভাবে নি। আশা কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না আদনান কেনো এমন করছে।তার সব কিছু বিরক্ত লাগছে।
আজ যদি শালুকের বদলে শাপলা যেতো ওই ঘরে তাহলে কি হতো?
ধ্রুবর তখন কি করার থাকতো?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সে কি শাপলাকে বিয়ে করতো?তাহলে তার ভালোবাসার কি হতো? যাকে ছোটবেলা থেকে ভালোবেসে এসেছে তাকে কিভাবে ভুলে যেতো?উত্তর পায় না আশা।
খুব সাদামাটাভাবে আফিফার বিয়ে হলো। বিয়েতে কোনো সানাই বাজে নি,কেউ কান্না করে নি।আফিফা বিয়েতে একটুও কাঁদে নি।পুরোটা সময় রোবটের মতো ছিলো অনুষ্ঠানে।
আদনান বের হলো আফিফার বিদায়ের সময়। আফিফা সবার থেকে বিদায় নিলো কিন্তু আদনানের সামনে ও গেলো না। ফিরে ও তাকালো না আদনানের দিকে।

আফিফা চলে যাবার পর সবাই আদনানকে নিয়ে বসলো। হাসনা বেগম নিরবে কেঁদে চলেছেন।ছেলেটার তো এমনিতেই কপাল পোড়া এখন সেই সাথে জুটেছে নিজের মেয়ের কপাল।
শালুক যে বড় অবুঝ, সে কিভাবে সংসার করবে?
ধ্রুব কোথায় আছে এখন?কয়েকবার কল দিয়েছেন কিন্তু ফোন বন্ধ ছিলো ধ্রুবর।
আদনান উসখুস করছে কেমন। নিজের জালে নিজেই ফেঁসে গেছে। সবার সামনে খারাপ হয়েছে।সবার কাছে খারাপ হলেও আদনানের এতো কষ্ট হতো না যতোটা কষ্ট হচ্ছে শালুককে হারানোর জন্য।

বুকের ভেতর কেমন হাহাকার করছে শালুকের জন্য তা কাকে বুঝাবে আদনান?
আদিবা বেগম সবচেয়ে ক্ষিপ্ত হলেন ছেলের উপর। আদনানের শার্টের কলার চেপে ধরে বললেন, “কেনো এমন করলি তুই?
আমার ছোট মেয়েটাকে কেনো এভাবে তাড়ালি তুই?যার চঞ্চলতায়,হাসিতে মুখরিত হতো আমাদের পুরো বাড়ি সেই মেয়েটা আজ কই?

আজীবন যেই ছেলেটা কষ্ট পেয়ে এসেছে, সেই ছেলেটা একেবারে আজ বাড়ি ছেড়েছে।কেনো তুই এমন করলি?
আদনান মাথা নিচু করে বসে রইলো। কি জবাব দিবে সে?কিভাবে বলবে কেনো এমন করেছে সে?
নুরুল ইসলাম সাহেব গম্ভীরমুখে বললেন, ” তোর সমস্যা কি আদনান ক্লিয়ার করে বল?”
আদনান কিছু বলতে পারলো না। বুকের ভেতর দুরুদুরু করে কাঁপছে তার।জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে তার বুকটা।
আদিবা বেগম স্থির থাকতে পারলেন না।সপাটে দুই থাপ্পড় বসালেন ছেলের গালে।তারপর হিংস্র বাঘিনীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়লেন আদনানের উপর।

অপ্রকৃতস্থর মতো চিৎকার করে বলতে লাগলেন,”আজ আমার মেয়ের বিয়েটা তোর কারণে এরকম নিরানন্দভাবে হয়েছে। আমার বাড়ির হাসির উৎস হারিয়ে গেছে। ঘরছাড়া ছেলেটা ঘরে ফিরে এসেছিলো, তোর জন্য একেবারে হারিয়ে গেলো। খু/ন করে ফেলবো তোকে আমি।তোর মতো ছেলের আমার দরকার নেই।
সব শেষ করে দিলি তুই।সব শেষ হয়ে গেলো তোর জন্য। ”
ফরিদা টেনে আদিবা বেগমকে সরিয়ে আনলেন আদনানের উপর থেকে।
সবার সব কথা আদনান মাথা নিচু করে শুনে গেলো। তবুও স্বস্তি পেলো আশা সামনে না থাকায়।আশা,শাপলা,দিবা আফিফার সাথে গিয়েছে আফিফার শ্বশুর বাড়িতে।

ধ্রুব শালুককে নিয়ে ঢাকায় চলে গেলো। শালুকের এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না তার বিয়ে হয়েছে ধ্রুব ভাইয়ের সাথে। ধ্রুব ভাইয়ের হাত ধরে সে বাড়ি ছেড়ে এসেছে।
কেনো এরকম হলো তার সাথে? সে তো ধ্রুব ভাইয়ের জন্য খাবার নিয়ে গিয়েছিলো,তবে কেনো ওরা এভাবে খারাপ কথা রটালো?

ধ্রুব ভাই কেমন মানুষ তা অন্তত সবাই জানে বাড়ির।তবে কেনো কেউ প্রতিবাদ করলো না?ধ্রুব ভাইয়ের জীবনটা কেনো এভাবে নষ্ট করে দিলো তারা?ধ্রুব ভাইয়ের কেশবতীর কি হবে তাহলে? শালুকের কান্না এলো ভীষণ।
আহারে ধ্রুব ভাই! আজীবন শুধু সব হারিয়ে এলো।এবার শেষ পর্যন্ত বুঝি ধ্রুবর কেশবতীকে ও হারাতে হলো তার জন্য।
ধ্রুব শালুকের হাত শক্ত করে মুঠোয় পুরে বললো, “শালুক!”
শালুক চমকে উঠলো। তারপর জবাব দিলো ধ্রুবর ডাকের।
ধ্রুব জিজ্ঞেস করলো, “ভয় লাগছে তোর?”

শালুক কেঁদে উঠলো। তার কেমন বুক ধড়ফড় করছে।ধ্রুব শালুকের চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো, “আমাকে তুই চিনিস না শালুক?মনে কর আমি তোর বন্ধু।আমাকে স্বামী ভেবে ভয় পেতে হবে না।বন্ধুর মতো থাকবি।আজ থেকে তোর সব দায়িত্ব আমার। আমি ছাড়া এই পৃথিবীতে তোর সবাই থাকলেও,তুই ছাড়া আমার আর কেউ নাই শালুক।আমাকে ভয় পেয়ে তুই দূরে চলে যাস না কখনো।আজ থেকে আমার বেঁচে থাকার একমাত্র কারণ তুই শালুক। ”
শালুক কেঁদে উঠে বললো,”তোমার সেই কেশবতীর কি হবে? কেনো আমাকে বিয়ে করলে?কি হতো এমন বিয়ে না করলে?তোমার ভালোবাসা তো অপূর্ণ রয়ে গেলো।”

ধ্রুব হাসলো। তারপর বললো, “আমার ভালোবাসা হারায় নি শালুক।আমার ভালোবাসা তো আমার কাছেই আছে।”
শালুক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কিভাবে?”
ধ্রুব হাসলো। কিছু বললো না।
ঢাকায় এসে ধ্রুব শালুককে নিয়ে তার একটা ক্লাসমেটকে কল দিলো। ১৫ মিনিট পর একটা মেয়ে এলো শালুকদের কাছে।এসে শালুককে জড়িয়ে ধরে বললো, “তুমি শালুক না?কতো শুনেছি তোমার গল্প আমি।”
শালুক বুঝতে পারলো না কিছু।ধ্রুব শালুকের হাত ধরে বললো,”শালুক,তুমি রিমার সাথে যাও ওর বাসায়।আমি একটা বাসা ঠিক করেই তোমাকে নিয়ে যাবো।”

শালুকের ভীষণ ভয় করলো। এই অচেনা শহরে, অচেনা একটা মেয়ের সাথে থাকার জন্য ধ্রুব শালুককে রেখে যাচ্ছে! এই মেয়ে কে?একে তো শালুক চেনে না।ধ্রুব ভাই যদি আর না আসে?
শালুক ধ্রুবর হাত চেপে ধরে রাখলো। কেঁদে উঠলো শালুক ধ্রুবকে ধরে। তারপর বললো, “আমি কোথাও যাবো না ধ্রুব ভাই। আমি আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না।আমার ভীষণ ভয় করে। ”
শালুকের হাউমাউ করে কান্না দেখে ধ্রুবর ভীষণ মন খারাপ হলো। কি করবে সে এখন?
শালুককে সে কোথায় রাখবে?সে নিজেই তো থাকতো হলে।এখন তো তার নিজের ও থাকার জায়গা নেই। ধ্রুব ভেবেছে রাতটা কোনো মসজিদের সামনে শুয়েই কাটিয়ে দিবে।

শালুকের কান্না থামে না দেখে ধ্রুব বুকে চেপে ধরলো। তারপর কোমলস্বরে বললো, “ভয় পাচ্ছিস?আমি আছি না শালুক?আমি থাকতে আমার বউয়ের কিচ্ছু হবে না।নিশ্চিন্তে থাক তুই।”
রিমা শালুককে নিয়ে গেলো তাদের বাসায়।চার বান্ধবী মিলে একটা ফ্ল্যাটে থাকে তারা।নিপা,সুমি,লিমা,ফ্ল্যাটের সবাই একই ভার্সিটিতে পড়ে। শালুক ভয়ে ভয়ে বসে রইলো এক পাশে বিছানার।
রিমা ডাইনিং রুমে বিছানা করে নিলো নিজের জন্য। নিজের বিছানায় শালুককে ঘুমাতে দিলো নিজের রুমমেট নিপার সাথে।

রাত ১২ টা বাজে।ধ্রুব দাঁড়িয়ে আছে রিমাদের ফ্ল্যাটের উল্টোপাশে রাস্তার উপর।
ধ্রুব শালুককে রিমার সাথে পাঠিয়ে ও নিশ্চিন্তে থাকতে পারলো না।মন আনচান করছে তার কেমন শালুকের জন্য।
শালুক নিজেও ঘুমাতে পারছে না।ভয় লাগছে তার কেমন। এখানে কাউকে সে চিনে না সে।কিভাবে থাকবে সে এখানে তাহলে?
ভয়ে এসে বারান্দায় দাঁড়ালো সে।এসে দেখে ধ্রুব রাস্তার পাশে আছে।
শালুকের হঠাৎ করেই কান্না পেলো। জীবন কেমন করে বদলে গেলো একটা ঘটনায়।
দায়িত্ব কি একেই বলে!
যেই দায়িত্বের জন্য ধ্রুব এই রাতে এসে এখানে দাঁড়িয়ে আছে।

রাতে আশার মা রাদিবা কল দিলো আদনানের মা’কে। তারা আগামী বুধবার দেশে আসছে।আশার বিয়ে দিয়ে দ্রুতই মেয়ে এবং জামাইকে নিয়ে আমেরিকায় চলে যেতে চায় তারা।আশার বাবা মেয়েকে ছাড়া থাকতে পারছে না।
আদিবা বেগম শুনলেন।অন্যসময় হলে যেমন উৎফুল্ল হতেন আজ আর সেটা হলেন না।বুকের ভেতর ভারী হয়ে আছে তার।
ছেলেকে উচ্চশিক্ষিত হয়তো বানাতে পেরেছেন কিন্তু মানুষ বানাতে পারেন নি তিনি।তার ছেলেটা মানুষ হয় নি।আজ এতো দিন পরে তিনি উপলব্ধি করলেন একটা স্বার্থপর, নিচ মনের ছেলের মা তিনি।
কাকে নিয়ে মিথ্যে অহংকার করতেন এতোদিন!

সকালে উঠে নয়নার হাত ধরে বললেন, “আমার আফিফা যখন জহিরকে ভালোবাসে বলে জানালো,ভেতরে ভেতরে চুরমার হয়ে গেলো মেয়েটা সেদিন আমি উপলব্ধি করেছিলাম আমি তোর সাথে অন্যায় করেছি।
আর আজ কি মনে হচ্ছে জানিস,আজ মনে হচ্ছে তোর সবচেয়ে বড় উপকার করেছি আমি।অন্তত এরকম নোংরা মানসিকতার একটা ছেলে তোর জীবন সঙ্গী হয় নি।
নয়না মামীকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। কেউ বুঝতে পারছে না এখনো কেনো আদনান এরকম করলো। কি লাভ হলো তার এতে করে!

একটা হাসিখুশি পরিবারের শান্তি একটা ঘটনার জন্য বিলীন হয়ে গেলো। একটা ছন্নছাড়া ছেলে আবারও সব কিছু হারিয়ে ফেললো। একটা ফুলের মতো মেয়ের জীবনে অনিশ্চয়তা নেমে এলো।
কোথায় আছে তারা,কেমন আছে,কেউ জানে না।
ধ্রুবর রাত কাটলো রাস্তার পাশে বসে বসে। আর শালুকের রাত কাটলো অন্ধকার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ধ্রুবকে পাহারা দিয়ে।
সকাল হতেই ধ্রুব চলে গেলো। প্রথমে একটা ছোট বাসা নিতে হবে আর তারপর একটা ছোট চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে।এতো দিন টিউশনি করে নিজের একার খরচ খুব ভালো করে চলতো,উপরন্তু আরো থাকতো ব্যাংকে।
কিন্তু এখন শালুক আছে।

যতোবারই ধ্রুব ভাবে তার বোকা ফুল আজ থেকে তার হয়ে গেছে আজীবনের জন্য,চাইলেই সে ফুলটাকে দেখতে পারবে,আলতো করে ছুঁয়ে দিতে পারবে।
একটা ছোট বাসায় দুজন ছোট একটা সংসার সাজাবে।ঘরের বাহিরে থাকা ছেলেটা কারো টানে সময়মত ঘরে ফিরে যাবে,ভাবলেই ধ্রুবর ভীষণ আনন্দ লাগে।
কখনো কি ভেবেছে এরকম সিনেম্যাটিকভাবে সে তার ভালোবাসার মানুষকে পেয়ে যাবে?
ভাবে নি কখনো। ভেবেছে কতো কাঠখড় পোড়াতে হবে কে জানে।

আল্লাহ হয়তো জুটি বেঁধে রেখেছিলো তার ভালোবাসার মানুষের সাথে,তাই এভাবে পেয়ে গেছে।
সারাদিন রোদে ঘুরে ঘুরে ধ্রুব বাসা খুঁজতে লাগলো। আর রিমার বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে শালুকের দুই চোখ খুঁজতে লাগলো ধ্রুবকে।
সবার কথা মনে পড়ছে শালুকের।মা,বাবা,বড় চাচা,বড় চাচী,মেজো চাচী,নিজের ভাই বোন,চাচাতো ভাই বোন সবাইকে মনে পড়ছে।আর বুঝি কোনো দিন স্কুল যাবার সময় দাদার থেকে টাকা নেওয়া হবে না।
দাদীর পানের বাটি থেকে জর্দা দেওয়া পান খেয়ে অসুস্থ হয়ে যাবে না।
বড় চাচী,মেজো চাচী কেউ চুলে তেল দেওয়ার জন্য সারা বাড়ি পিছু পিছু ছুটবে না।শাপলার ব্যাগ থেকে টাকা চু/রি করা হবে না।

শান্তর জন্য স্কুল থেকে ফেরার সময় চকলেট নিয়ে আসা হবে না।
মায়ের হাতের মাইর খেতে হবে না।বাবা,চাচাদের গলা ধরে আদুরে ভঙ্গিতে কোনো আবদার করা হবে না।
বুকের ভেতর কেমন জ্বলেপুড়ে যেতে লাগলো শালুকের।
কিভাবে থাকবে শালুক?কেমন করে বাঁচবে?
ধ্রুবর সাথে তো চলে এসেছে রাগ করে, বাড়িতে থাকলে আদনানকে দেখলে রাগ উঠবে বলে চলে এসেছে। ফেলে এসেছে নিজের সবকিছু, সব আপন মানুষ।

এই অচেনা শহরে,অচেনা মানুষের সাথে ভীতু শালুক কিভাবে থাকবে?
ধ্রুব কল দিলো দুপুর দেড়টার দিকে। রিমা এনে ফোন দিয়ে যেতেই ধ্রুব জিজ্ঞেস করলো, “খেতে যাস নি কেনো তুই?এক্ষুনি গিয়ে খেয়ে আয়।ভয় পাচ্ছিস কেনো?

শালুক ফুলের লাজ নাই পর্ব ১৪

তোর মনে আছে,ছোট বেলায় কিছু হলেই তুই আমার কাছে ছুটে আসতি।আজ ও তো আমি আছি তোর পাশে।আমি তোর জীবন সঙ্গী শালুক।আমাকে ভরসা কর।জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমি আছি তোর সাথে। ”

শালুক ফুলের লাজ নাই পর্ব ১৬