শালুক ফুলের লাজ নাই পর্ব ৫

শালুক ফুলের লাজ নাই পর্ব ৫
রাজিয়া রহমান

ধ্রুব ক্লান্ত,অবসন্ন দেহটাকে টেনে নিয়ে গেলো ছাদের ঘরে। যেই শঙ্কা ছিলো তার মনে, সেটাই সত্যি হলো।
ড্রয়ার থেকে একটা এলবাম বের করলো ধ্রুব।
এই এলবামে শুধু শালুকের ছবি,ছোট থেকে বড় পর্যন্ত। খুব যত্ন করে ধ্রুব সব জমিয়ে রেখেছে।

মাঝেমাঝে ধ্রুব নিজেই অবাক হয় শালুকের প্রতি তার এই বাড়াবাড়ি রকমের ভালোবাসা দেখে।
ধ্রুব নিজেকে সামলে রাখতে জানে,সেই সাথে সামলে রাখতে জানে নিজের মনের সব অনুভূতিকে।
চেয়ারে বসে শালুকের ছবি দেখতে দেখতে ধ্রুবর চোখ গেলো দেয়ালের দিকে। মার্কার পেন দিয়ে লিখা, “আমি ধ্রুব,সবকিছুতে সিরিয়াস থাকি।সিরিয়াস থাকতে থাকতে আমার টয়লেট ও সিরিয়াস হয়ে গেছে। এজন্য আমার সহজে টয়লেট পায় না।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ধ্রুব প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেলো এই লিখা পড়ে, পরমুহূর্তে ফিক করে হেসে ফেললো।
বিড়বিড় করে বললো, “আমার বোকা ফুলটা জানে না তার এসব চালাকি সব আমার নখদর্পনে। ”
শালুকের ছবির দিকে তাকিয়ে ধ্রুব বললো,”প্রিয় বোকা ফুল,তোমার পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত সব কিছু আমার ভীষণ চেনা,তেমনই ভীষণ চেনা তোমাকে।বাম হাতে এলোমেলো অক্ষরে এসব লিখলে কি আমি বুঝবো না বলো?তোমাকে এতো বেশি অনুভব করি যে মাঝেমাঝে আমি নিজের অস্তিত্ব ভুলে যাই।বোকা ফুল,তুমি নিজেও তোমার নিজেকে এতো বেশি চেনো না যতোটা আমি তোমাকে চিনি।”

শালুকের এই লেখা দেখে ধ্রুবর মন হঠাৎ করেই ভালো হয়ে গেলো। ছাদের ঘর থেকে বের হয়ে শালুকের রাজ্যের সামনে একমুহূর্ত দাঁড়ালো। শালুক লিখাটা একবার হাত দিয়ে ছুয়ে গুনগুন করে গাইতে লাগলো, “দূর হতে আমি তারে সাঁধিবো,গোপনে বিরহডোরে বাঁধিব।”

নিচ তলায় এসে ধ্রুব তার ভোল পালটে ফেললো, হাসিখুশি মুখটি আবার গম্ভীর হয়ে গেলো।
ধ্রুবর বাবা সেলিম সাহেব টিভিতে তখন নিউজ দেখছেন।ধ্রুব গিয়ে রিমোটটা নিয়ে চ্যানেল পালটে দিলো,স্পোর্টস চ্যানেলে দিয়ে খেলা দেখতে শুরু করলো।

সেলিম সাহেব কিছুক্ষণ ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন নির্নিমেষ। কতো বছর হলো ধ্রুব তাকে বাবা বলে ডাকে না?
১০ বছর হয়ে গেছে। সেলিম সাহেব চারদিকে তাকিয়ে দেখলেন আশেপাশে কেউ নেই।সবার সামনে তিনি ধ্রুবকে ডাকতেও লজ্জা পান।ছেলে যে জবাব দিবে না তা তিনি জানেন,তবুও তিনি ডাকেন সবার আড়ালে।ছেলে তার ডাকে সাড়া দেয় না,সবার আড়ালে ডাকলে রক্ষা একটাই তিনি কারো সামনে বিব্রত হন না।
সাহস করে তাই ডাকলেন,”ধ্রুব…ধ্রুব….”

ধ্রুব গান গাইতে লাগলো, “সময় গেলে সাধন হবে না….”
দুই লাইন গেয়ে ধ্রুব হেডফোন কানে দিয়ে গান শুনতে লাগলো।
সেলিম সাহেব মুগ্ধ হয়ে ছেলের গান শুনলেন।দীপালির মতো গানের গলা পেয়েছে ছেলে,দীপালি ও তো এরকম গান গাইতো।বলতে লজ্জা নেই,দীপালির গান শুনেই তো তিনি দীপালির প্রেমে পড়েছেন।
আজ দীপালি তার কাছে শুধুই অতীত । সে স্বপ্ন হয়ে এসে দুঃস্বপ্ন হয়ে তার জীবন থেকে বিদায় নিয়েছে।
কি এমন ক্ষতি হতো এই দুঃস্বপ্নটা যদি তার জীবনে আজীবন থেকে যেতো।

তবুও তো তিনি ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে বাঁচতেন।
সেলিম সাহেব উঠে যেতেই ধ্রুব কান থেকে হেডফোন খুলে ফেললো। বুক ছিড়ে যেই দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসতে চাইলো,তাকে ধ্রুব বাহিরে আসতে দিলো না।সযত্নে আবারও বুকের ভেতর মাটিচাপা দিয়ে দিলো।
দোতলায় দাঁড়িয়ে শালুক দেখলো ধ্রুবর বেদনার্ত চেহারা। এক মুহুর্তের জন্য শালুকের মনে হলো, তার চাইতে বেশি কষ্ট নিয়ে কি ধ্রুব ভাই বেঁচে নেই,তবে সে কেনো এরকম কষ্ট পাচ্ছে!

শালুক ভাবছে,তার যদি ম্যাজিক জানা থাকতো তবে ধ্রুব ভাইয়ের মনের সব কষ্ট ম্যাজিক করে দূর করে দিতো।ধ্রুব ভাইকে ছোট বেলার মতো প্রাণবন্ত করে দিতো।গোমড়া মুখখানা ঝামা পাথর দিয়ে ঘষে হাসিমুখ করে দিতো।
আফসোস, তার কোনো ম্যাজিক জানা নেই।শালুক শাপলার রুমের দিকে গেলো। শাপলা চুল বাঁধছে বসে বসে।দুই ঠোঁট থেকে হাসি ফুরাচ্ছে না তার।

শালুক বোনকে এতো খুশি দেখে বললো, “কি রে আপা,এতো খুশি যে তুই?”
শাপলা কপট রাগ দেখিয়ে বললো, “এমনিতেই ভালো লাগছে খুব।”
শালুক ফিসফিস করে বললো, “আপা একটা সিক্রেট বলি তোকে?তোর মন আরো ভালো হয়ে যাবে।”
শাপলা মুখ বাঁকিয়ে বললো, “কোনো ইন্টারেস্ট নেই শোনার।”

শালুক মুখ কালো করে বললো, “প্লিজ আপা শোন না,না বলতে পারলে আমার ভীষণ কষ্ট হবে।এই দেখ আমার পেট এখনই কেমন গুড়গুড় করছে।পেট ফেটে মরে যাব আমি নয়তো। মরে গেলে তোর বরের কি হবে বল?তোর বর অকালে শালিকা হারাবে।এই শোকে সে পাগল ও হয়ে যেতে পারে।

তারপর ধর,তোর বাচ্চারা।ওরা খালামনির আদর পাবে না,ভাবতে পারিস কেমন মর্মান্তিক ঘটনা হবে এটা।খালা,খালা মানে বুঝিস তুই আপা?মায়ের বোন খালা,মায়ের চাইতে ভালা।আমি ওদের সেই খালা।আমি বেঁচে না থাকলে ওরা বিরাট বড় ক্ষতির সম্মুখীন হবে। প্রতি ঈদে ওরা যেই সালামি পাবে,সেই সালামি তো ওরা খালাকে ভাগ দিতে পারবে না।ওদের চিপস,চকোলেট, জুস এসবে কেউ ভাগ বসাবে না।এই কষ্ট তোর বাচ্চারা ছোট থেকেই বুকে চাপা দিয়ে রাখবে। অবুঝ শিশুর বুকে কি যন্ত্রণার পাহাড়, কেউ বুঝে না সেটা!

আহারে,আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি নাদুস-নুদুস দুটো রসগোল্লা টাইপের বাচ্চা অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলছে,” না খালামনি,না।তুমি যেভাবেই হোক বেঁচে থাক।দরকার হলে আমাদের আম্মুর চুল টেনে ধরে জোর করে হলেও তোমার মনের কথা বলো।তবুও আমরা তোমাকে হারাতে পারবো না।আমাদের সব টাকা পয়সা জমা রাখার জন্য হলেও তোমাকে ভীষণ দরকার আমাদের। একা একা তো আমরা চিপস জুস খেতে পারবো না তোমাকে ছাড়া। আপা এই দেখ,আমার দুই চোখ ভিজে গেছে তোর মাসুম বাচ্চাদের আর্তনাদ শুনে।আর তুই পাষাণ মা হয়ে ও বাচ্চাদের মনের কথা বুঝলি না!”
শাপলা বিস্ফোরিত নয়নে বোনের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর বললো, “তুই আমার বাচ্চাকাচ্চা পর্যন্ত চলে গেলি?বল,তোর অকাল মৃত্যু নিয়ে যখন আমার বাচ্চাদের ও এতো কষ্ট, ওদের মা হিসেবে আমি না হয় কথাটা শুনে তোর মনটা হালকা করি।”

শালুক হেসে দিয়ে বললো, “তোকে এমন একটা নিউজ দিবো,শুধু তুই না যদি আমাদের বাসার নয়না আপার পুঁচকি মেয়েও শুনে যে এখনো কথা বলতে পারে না, সেও হতবাক হয়ে কথা বলে ফেলতে পারে।এরকম একটা কান্ড ঘটে গেছে। ”

শাপলা বিরক্ত হয়ে বললো, “তো গিয়ে নিধিকে বল না।বেচারা এক সুযোগে কথা বলা শিখে যাবে।”
শালুক ঠোঁট উলটে বললো, “আমি চাইলেই নিধিকে বলতে পারতাম,কিন্তু ভেবে দেখলাম ও এতো তাড়াতাড়ি কথা বলা শুরু করলে তো আবার সমস্যা। অকালপক্ব হয়ে যাবে। তাছাড়া প্রকৃতির নিয়ম এই শালুক লঙ্ঘন করে না।রুলস ইজ রুলস,সবার জন্য নিয়ম সমান।এই ভেবেই ওকে বলি নি।”

শাপলা বিরক্ত হয়ে বললো, “বইন,তুই যা বলার ৩০ সেকেন্ডে বল,বলে বিদায় হ আমার রুম থেকে।”
শালুক হতাশ হয়ে বললো, “প্যাঁচামুখোটা একটা মেয়ের প্রেমে পড়েছে। ”
শাপলার বুজের ভেতর ধ্বক করে কেঁপে উঠলো। উত্তেজনায় দম বন্ধ হয়ে এলো যেনো।জড়ানো স্বরে শালুককে জিজ্ঞেস করলো, “কার প্রেমে পড়েছে ধ্রুব ভাই?”

শালুক ভ্রু নাচিয়ে বললো,”৩০ সেকেন্ড শেষ। আর কিছু বলবো না। ”
শাপলা মিনতির স্বরে বললো, “বোন না,প্লিজ বল না।এখন তুই না বললে আমি মরে যাবো উত্তেজনায়। প্লিজ।আমি মরে গেলে আমার বাচ্চারা মা-হারা হবে,তুই কি তা হতে দিতি পারবি?”
শালুক হেসে বললো, “অবশ্যই পারবো।তুই মরে যা,ওদের জন্য এই শালুক একলাই ১০০।ওরা তখন আমার কাছে থাকবে।তোকে ওদের এমনিতে ও খুব একটা পছন্দ না। মা হিসেবে তুই এমনিতেও খুব একটা সুবিধার না।”
শাপলা ব্যাগ থেকে ১০০ টাকার একটা নোট শালুকের হাতের মুঠোয় ধরিয়ে দিয়ে বললো, “বল না লক্ষ্মী বোন আমার,আমার কুঁচুপুঁচু,টুনুমুনু তুই।”

শালুক হেসে ফেললো শাপলার কথার ধরন দেখে।তারপর বললো, “আর ৫০ টাকা দে আপা।”
শাপলা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আর ২০ টাকা দিয়ে বললো, “আর ৫০ টাকা আছে আমার কাছে।এরপর আমি একেবারে দেউলিয়া হয়ে যাবো।”
শালুক বললো, “আচ্ছা থাক তাহলে। ধ্রুব ভাইয়ের ব্যাগে আমি দেখেছি একটা শপিং ব্যাগে কতোগুলো হেয়ার ব্যান্ড, অনেক সুন্দর জানিস আপা।তারপর চুলের গাজরা।আবার লিখা ছিলো আমার কেশবতীর জন্য।আমি একটু আগে ধ্রুব ভাইকে জিজ্ঞেস করতেই উনি হেসে বললো, উনি একজনকে ভীষণ ভালোবাসেন,সেই তার কেশবতী।”
শাপলার আনন্দিত চেহারায় রাজ্যের বিষাদ নেমে এলো। শালুককে সেসব বুঝতে না দিয়ে বললো, “আচ্ছা যা এখান থেকে এবার।”

শালুক উঠতে যেতেই মতির মা এসে ব্যস্ত হয়ে বললো, “ও আল্লাহ,আপনেরা এইখানে বইসা রইছেন।নিচে তো জহির ভাইজান আইসা হাজির।বড় আম্মায় সবাইরে ডাকে।”
শাপলা, শালুক দুই বোনেই নিচতলার দিকে গেলো।
আশা তার সাদা টি-শার্টটা পরে নিচে নামতেই দেখলো সবাই মিটিমিটি হাসছে তাকে নিয়ে।নয়না তার মেয়েকে কবিতা আবৃতি করে শোনাচ্ছে,

“হার্দিকা, ফার্দিকা,দেখলে মনে হয় চামচিকা।
আশা,পাশা কাকের বাসা,মাথায় তার আবর্জনায় ঠাঁসা। ”
আশা চমকে উঠলো এসব শুনে।আদনান এগিয়ে গিয়ে টি-শার্ট এর পিছনে এসব লিখা দেখে হতভম্ব হয়ে গেলো।
তারস্বরে চেঁচিয়ে বললো, “রাবিশ,এসব কে লিখেছে আশার টিশার্টে? ”

কেউ কোনো জবাব দিলো না। ধ্রুব আপেলে কামড় দিতে দিতে এগিয়ে এসে আশার টিশার্টের কবিতাটা পড়লো। তার ভীষণ হাসি পেলো, হাসি সামলে রেখে গম্ভীরমুখে বললো,”ছাদের রুমের দেয়ালেও কে কি সব হাবিজাবি লিখে রেখেছে ভাইয়া।দুই জনের লিখাই তো সেইম মনে হচ্ছে। সবার হাতের লিখা পরীক্ষা করে দেখা দরকার। কালপ্রিট এখানেই আছে।”
শালুকের ভীষণ হাসি পেলো এই কথা শুনে। মনে মনে বললো, “এই শালুককে ধরা এতো সহজ না।শালুকের মাথায় বুদ্ধি কিলবিল করে বুঝলি।আমার বাম হাতের ছড়িয়ে ছিটিয়ে লিখা চেনার সাধ্য তোর মতো প্যাঁচামুখোর নেই।”

বাবা এবং সৎ মায়ের সাথে কথা না বললেও ভাই বোনদের সাথে ধ্রুবর ভীষণ ভালো বন্ডিং। ছোট ভাই দিব্যকে বললো, “ছুটে গিয়ে কাগজ কলম নিয়ে আয়।”
ভাইয়ের আদেশ শুনে দিব্য ছুটে গেলো। তারপর কাগজ কলম এনে একে একে সবার লিখা পরীক্ষা করা হলো।ধ্রুব গম্ভীরমুখে বললো, “না,কারো লিখার সাথেই ম্যাচ করছে না।”
আদনান চিন্তিত হয়ে বললো,”আফিফার কাছে যে বাচ্চারা পড়তে আসে ওদের মধ্যে কেউ হতে পারে। ”
ধ্রুব মাথা নেড়ে বললো, “হতে পারে। ”

শালুক ফুলের লাজ নাই পর্ব ৪

শালুক মনে মনে বললো, “বড় গাধা আর ছোট গাধা,দুই গাধা আজীবন তপস্যা করলেও শালুকের মতো ট্যালেন্ট হতে পারবি না।শালুককে ধরা তোদের কাজ নয়।”
ধ্রুব শালুকের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললো, “মনের বাগানে ফোটা একটা বোকা ফুল,হাসলে তাকে ভীষণ মিষ্টি লাগে।”

শালুক ফুলের লাজ নাই পর্ব ৬