শিমুল ফুল পর্ব ১৬

শিমুল ফুল পর্ব ১৬
জাকিয়া সুলতানা ঝুমুর

রোকসানা শিলাদের উঠোনে শিমুলের বাইকটা দেখেই যা বুঝার বুঝে গেছে।পুষ্পকে বললো,
“কখন এসেছিস?”
পুষ্পর বুকটা কাঁপে,
“পাঁচ মিনিট হবে আম্মা।”

রোকসানা তীক্ষ্ণ চোখে পুষ্পর দিকে তাকিয়ে থাকে।পুষ্প মায়ের চোখে রাগের ঝলক দেখে শুকনো ঢোক গিলে।
“কেন এসেছিস?”
পুষ্প মিথ্যে কথা গুছিয়ে বললো,
“কয়দিন কলেজে যাচ্ছি না তো তাই পড়া নিতে এসেছিলাম।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রোকসানা ভেতরটা রাগে ফেটে যায়।ইচ্ছে করছে পুষ্পর চামড়া তুলে রোদে শুকিয়ে নিতে।কি সুন্দর সাজিয়ে গুছিয়ে মিথ্যা বলছে।রোকসানা কি এতো বোকা?দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“বলে আসলিনা?”
“তুমি ঘুমিয়ে ছিলে আম্মা।”

শিলার আম্মা এসে পাশে দাঁড়িয়েছে।রোকসানা পরের বাড়িতে নিজেদের কথা বাড়াতে চাইলো না।পুষ্পর দিকে ইশারা করে বললো,
“বাড়িতে চল।”

পুষ্প শিলার মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে তার মায়ের পিছু পিছু বাহির হয়।শিমুল পাশের রুম থেকে মা মেয়ের সব কথা শুনে।পুষ্পর ভয় জড়ানো কন্ঠ শুনে বলে,”আর কয়টা দিন তোকে আর ভয় পেতে হবে না পুষ্প।আব্বাকে খুব শীঘ্রই পাঠাচ্ছি।”

রোকসানা বাড়িতে গিয়ে পুষ্পকে ধরে।
“তুই আমাকে জন্ম দিয়েছিস নাকি আমি তোকে জন্ম দিয়েছি?”
পুষ্প মায়ের চোখের বর্ণ দেখে ভয় পায়।তার মা যে আসল ব্যাপারটা ধরে ফেলেছে এটা বেশ বুঝতে পারছে।চুপ করে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকে।পুষ্পর চুপ থাকা যেনো উনার আগুনে ঘি ঢালে।

“নিজেকে খুব চালাক ভাবিস?তুই গাছের পাতায় পাতায় চললে আমি ওই পাতার শিরায় শিরায় চলি।”
পুষ্প একদম নিশ্চুপ।তার আম্মা এতো চালাক!কিভাবে বুঝে গেলো?
“লজ্জা করেনা তোর?”
পুষ্প মাথা নিচের দিকেই করে রাখে।

“তুই না তোর আব্বাকে কথা দিয়েছিলি?তাহলে আবার শিমুলের সাথে দেখা করতে গেছিস কেন?”
পুষ্প বললো,
“আমি শিলার কাছে গিয়েছিলাম আম্মা।”
রোকসানা জোড় দিয়ে বললো,

“ওখানে শিমুল ছিলো।”
পুষ্প প্রেমে পড়ে খুব ভালো মিথ্যা বলা শিখে গেছে।না ঘাবরে বললো,
“না কেউ ছিলো না।”
রোকসানা চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
“আমি অন্ধ না চোখ আছে।
পুষ্প আবার বলে,

“সত্যি আম্মা আমি শিলার কাছেই গিয়েছিলাম।”
“এতো মিথ্যা বলতে পারিস?এই তোর লজ্জা নেই?”
পুষ্প কি বলবে।মাথা এদিক ওদিক ঘুরিয়ে তাকায়।রোকসান পুষ্পর এই নির্লিপ্ততা দেখে বলে,

“চেয়ারম্যানের ছেলের কাছে যাস তাই না?কিভাবে ভাবলি শিমুলের মতো ছেলে তোকে বিয়ে করবে?শরীর দেখে পাগল হইছে বুঝেছিস?শরীর পাওয়ার জন্য এসব ভাওতাবাজি।অভিনয় করে মন গলায় তারপর চাহিদা মিটে গেলে ছুড়ে ফেলতে একবার ভাববে না।তোকে চিনবেও না।তখন কি করবি তুই?”
শিমুলের নামে এই নোংরা কথাগুলো পুষ্পর সহ্য হলোনা।সামনে দাঁড়ানো মহিলাটাকে শত্রু মনে হলো।ত্যাড়া গলায় বললো,

“শিমুল এমন না।”
“শিমুল কেমন?”
পুষ্প কথা বলেনা।রোকসানা বলে,
“এতো বড় হয়ে গেছিস যে পুরুষের সানিধ্য লাগবে তাই না?নিজেই পুরুষ খুঁজে নিয়েছিস?”
নিজের মায়ের মুখে এমন কথা শুনে পুষ্পর খুব লজ্জা লাগে।কিছু বলার ভাষা খুঁজে পায় না।
“দাঁড়া তোর বিয়ের ব্যবস্থা করছি।”

পুষ্প হঠাৎ করেই ফুসে উঠে বললো,
“শিমুলকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবনা।”
রোকসানা পুষ্পর চুলে ধরে বলে,
“বিয়ে করে ভালোও বলবি।”
পুষ্প সমানতালে তর্ক করে,
“করবো না বিয়ে।কি করবা?”
“যা করা দরকার।”

“আমাকে জোর করে বিয়ে দিতে চাইলে আমি বি*ষ খেয়ে ম*রে যাবো তাও শিমুলকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবনা।”
রোকসানার রাগ আকাশ ছুঁয়ে যায়।নিজের মেয়ের এই অধঃপতন সহ্য হয় না।ইচ্ছা করে মেরে মাটিচাপা দিয়ে দিতে।পুষ্পর চুলের মুঠি ধরে সজোড়ে দেয়ালের সাথে আঘাত করে।পুষ্প চিৎকার করে উঠে।রোকসানা থামে না পরপর তিনটা আঘাত করে পুষ্পকে ছাড়ে।

পুষ্প দেয়াল ঘেষে ফ্লোরে বসে পড়ে,হাত দিয়ে কপাল চেপে ধরে।কপালে কেটে র*ক্ত বের হচ্ছে।পুষ্প শব্দ করে কেঁদে দেয়।রোকসানা তখন বিছানায় পড়ে কাঁদছে।সব অভিযোগ পুষ্পর প্রতি।উনার আহাজারিতে ঘর নিরব হয়ে যায়,পুষ্প ব্যাথায় কাঁদতে ভুলে যায়।কপাল বেয়ে রক্ত পড়ে অথচ পুষ্প মায়ের আহাজারি দেখছে।তার হঠাৎ করেই মনে হলো,এই দুনিয়া বড়ই কঠিন।ম*রে গেলেই বুঝি শান্তি।

শিমুল রাতে ঘুমাতে পারে না।সারা শরীর কেমন জ্বালাপুড়া করছে।পুষ্পকে মনে পড়ে বুকটা অসহনীয় ভাবে জ্বলে।বারবার শুধু মনে হয় পুষ্প ভালো আছে তো?পুষ্প যে তাকে কতো বেশী ভালোবাসে তা শিমুলের বোঝা হয়ে গেছে।আজকে পুষ্প নিজ থেকে শিমুলকে ছুঁয়ে দিয়েছে।

যখন বারবার শিমুলকে আঁকড়ে ধরছিলো তখন শিমুলের ইচ্ছা করছিলো ঠিক বুকে ঢুকিয়ে নিয়ে আসতে।মেয়েটা তার জন্য এতো কষ্ট সহ্য করছে এর বদলে যদি আল্লাহর নামে কবুল করতে না পারে তাহলে হবে?হবে না।পুষ্পকে ভালোবাসায় পূর্ণ করতে হবে।চোখের পানির দাম দিতে হবে।তা না হলে যে শিমুল প্রেমিক হিসেবে ব্যর্থ।

শিমুল সকালে নাস্তার টেবিলে নাস্তা করতে যায়।উদ্যেশ্য পুষ্পর ব্যাপারে কথা বলা।শিমুলকে দেখে মজিব হাওলাদার বলে,
“দাদা একটা মেয়ে দেখেছি তোর জন্য।”
দাদার মুখে এমন কথা শুনে শিমুল চমকে যায়।মাথা ঘুরিয়ে তার আব্বার দিকে তাকায়।শওকত হাওলাদার নির্লিপ্ত ভাবে নাস্তা করছে।তারমানে পুষ্পর কথা তার দাদাকে বলেনি।সে তার আব্বাকে বললো,

“আব্বা আপনাকে কিছু বলেছিলাম।”
শওকত হাওলাদার শিমুলের দিকে তাকিয়ে বললো,
“তোমার মুখে এসব কথা যেন আর না শুনি।”
শিমুলে মুখের খাবার গিলতে ভুলে যায়।চোখের আকৃতি ইতোমধ্যে বড়ো আকার ধারন করেছে।তার আব্বার দিকে তাকিয়ে বললো,

“কিন্তু আব্বা…”
শওকত হাওলাদার চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে শিমুলের কথার মাঝেই বলেন,
“যা বলেছো সব ভুলে যাও।”
শিমুল অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে থাকে।তার আব্বার কথা সে বিশ্বাস করেছিলো।কিন্তু উনার মুখেই এখন উল্টা কথা।মজিব হাওলাদার বলেন,

“শিমুল কিসের কথা বলে শওকত?
শওকত হাওলাদার বলেন,
” আপনার নাতীর মনে রঙ লাগছে আব্বা।যেই সেই রঙ না হোটেলের মালিক মিজানের মেয়েরে বিয়ের রঙ।”
মজিব ভ্রু কুচকে শিমুলের দিকে তাকায়।আর শিমুল বিস্ময় নিয়ে তার আব্বার এমন কথাগুলো হজম করে।
মিজান চাচারা গরীব না মধ্যবিত্ত ফ্যামিলি।এমন অবঙ্গা করে কথা বলতে হবে কেন?

শওকত টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।সাথে সাথে শিমুলও উঠে দাঁড়ায়।তার কন্ঠে না চাইতেও তেজ চলে আসে।
“আপনি বলেছিলেন আমার ইচ্ছার গুরুত্ব দিবেন।”
“আ-জায়গায়,কু-জায়গায় পছন্দ করলে কি গুরুত্ব দিতে হবে?আমাদের বংশের একটা নাম আছেনা?নাম অনুযায়ী জায়গায় যাইতে হয়।”

পাশ থেকে শিমুলের বুবু পেশকারা বেগম বললেন,
“আর জায়গা পাইলি না?ছিহ ছিহ।”
মজিব হাওলাদার বলেন,
“ঢাকা যা ঘুরাফিরা করে আয় এসব মন থেকে উড়ে যাবে।”

সবার কথাগুলো শিমুলের বি*ষের মতো লাগে।এমনিতেই পুষ্প খারাপ অবস্থায় আছে এখন সবার কথাগুলো মাথায় লাগছে।গলার স্বর নমনীয় করার চেষ্টা করে সে তারা আব্বাকে বলে,
“আমি পুষ্পকেই বিয়ে করবো।আপনি প্রস্তাব নিয়ে যান।”
শওকত হাওলাদার শান্ত গলায় বলেন,

“এসব আশা ছেড়ে দাও।এই মেয়েকে নিয়ে আর একটা কথাও বলবেনা।”
শিমুল কিছু বলার আগেই তিনি চলে যায়।মজিব হাওলাদার বলেন,

“তোর জন্য চাঁদের মতো মাইয়া পাইছি।বিয়েটা করে নে।সুন্দরী বউ ঘরে থাকলে আর কারো কথা মনে পড়বেনা।”
শিমুল বুঝতে পারে ঘরের মানুষ কেউ তার পছন্দে খুশী না।দাদার কথা শুনে তেতে উঠে বলে,
“তোমার এতো পছন্দ হলে তুমিই বিয়ে করে নাও।”

শিমুল তার রুমে চলে যায়।নিজেকে অসহায় লাগছে।সমাজ,বংশ,অহংকার এসবের তুপে তার ভালোবাসা হারাতে পারে না।যেকোনো ভাবে হোক পুষ্পকে তার করে নিবেই।এসময় পেশকারা আসে।শিমুলকে বলে,
“ভাই সত্যি কইরা ক তো।মিজানের বাড়িত গিয়া কিছু খাইছিলি?”
শিমুল অবাক হয়ে বললো,

“কি খেতে যাবো?”
“আমার মনে হয় তোরে খাবারের সাথে কিছু খাওয়াইয়া তাবিজ করছে।তা না হলে হাওলাদার বাড়ির পোলা ওই বাড়িতে যাইবো কেন?”

বুবুর চিন্তা ভাবনা দেখে শিমুল অবাক হয়।রুম থেকে ঠেলে তার বুবুকে বের করে বলে,
“তোমার মন মানসিকতা এতো নোংরা কেন?বিয়ে করবো বলেছি করবোই।এতো কথা মজা লাগেনা।যাও।”
এলাকার ডাক্তারকে ডেকে আনা হয় শিমুলের সেলাই ড্রেসিং করানোর জন্য।ওনি এসে কাজের ফাঁকে ফাঁকে অনেক কথা বললেন।একপর্যায়ে বললেন,

“কালকে মিজান কাকার মেয়ের মাথাও কেটে গিয়েছিলো।আমার কাছেই নিয়ে আসছে সেলাই করার জন্য।বাবা কি শক্ত মেয়ে সেলাই করলাম একটু উহু পর্যন্ত করলো না।চুপ করে বসে ছিলো।”
শিমুল চমকে উঠে বলে,
“কিভাবে কেটেছে?”

“মিজান কাকা নিয়ে এসেছিলো উনিই বললো,বাথরুমে পা পিছলে পড়ে গিয়ে কেটেছে।”
শিমুলের বুকটা দুমড়েমুচড়ে হাহাকার করে উঠে।বুকে রক্তক্ষরণ হয়,নাকের ডগা অদৃশ্যভাবে কেঁপে উঠে।নিজেকে খুব অসহায় লাগে,শিমুলের জন্য এতো মার খাচ্ছে অথচ শিমুল কিছুই করতে পারছেনা।কিভাবে কেটেছে এটা বুঝতে একটুও কষ্ট হয় না।উনারা কি আদো বাবা মা এভাবে কেউ মারে?তাদের উপর শিমুলের খুব রাগ হয়।রাগ হয় নিজের উপরেও।
শিমুল তার মা রাবেয়াকে ডাকে।তিনি আসলে উনার কোলে মাথা রেখে শুয়ে বলে,

“মা তুমিও কি আমার পছন্দের বিপক্ষে?”
ছেলের ব্যাথাতুর মুখটা দেখে রাবেয়ার ভালো লাগেনা।
“তোর পছন্দই আমার পছন্দ।আমার ক্ষমতা থাকলে আজকেই তোকে বিয়ে করিয়ে দিতাম।”
মায়ের কথা শুনে শিমুলের ভালো লাগে।একটা মানুষ তো আছে যে কিনা শিমুলের পছন্দের পক্ষে।

“আব্বাকে একটু বুঝাও না মা।ওরা না হয় একটু কম বড়লোক।তাতে কি!আমি তো বউ আনবো শশুড় বাড়ির বড়লোকি দিয়ে কি করবো?”
রাবেয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে।এই বাড়ির লোকের যে চাই ক্ষমতা আর পয়সা।কিন্তু তারপরেও ছেলেকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো,
“আচ্ছা বলবো।”

সারাদিন শিমুল তার আব্বার অপেক্ষা করে।চেয়ারম্যান হয়েছে বিধায় এমপি সাহেবের সাথে দেখা করতে গিয়েছে।গভীর রাতে বাড়ি আসে।খাওয়া দাওয়ার পরে শিমুল উনার রুমে যায়।রাবেয়া বিছানা ঠিক করছেন শওকত হাওলাদার টিভি ছেড়ে খবর দেখছে।শিমুল পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
“আব্বা।”

শওকত হাওলাদার টিভির দিকে তাকিয়েই বলে,
“তুমি কি আবার আগের কথাগুলোই বলতে এসেছো শিমুল?”
শিমুল বলে,
“আমি জলদি বিয়ে করতে চাই।”
শওকত বলেন,

“মেয়ে ঠিক করে ফেলেছি।”
“আমি পুষ্পকে বিয়ে করব।”
শওকত হাওলাদার ঠান্ডা চোখে তাকায়।
“পুষ্পকে বিয়ে করলে হোটেলে ফ্রী ভাত খেতে পারবে এর বেশী কিছু না।আর যে মেয়ে ঠিক করেছি তাকে বিয়ে করলে তোমার ক্ষমতা বাড়বে।”

শিমুল রেগে যায়।তাকে কিনা ক্ষমতার লোভ দেখায়?
“আমার পুষ্প হলেই চলবে ক্ষমতা লাগবে না।”
শওকত ছেলের নির্লজ্জতা দেখে অবাক হয়।এমপির সাথে সম্পর্ক করার এতো বড়ো সুযোগ হাত ছাড়া করা বোকামি।কিন্তু ছেলের কথা শুনে তারও চোয়াল শক্ত হয়ে আসে,
“আমি যেখানে বলবো সেখানেই বিয়ে হবে।রাত হয়েছে ঘুমাতে যাও।”

শিমুল যায় না।ঘাড় ত্যাড়া করে দাঁড়িয়ে থাকে।রাবেয়া এগিয়ে আসে।স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে নিচু স্বরে বললো,
“শিমুলের যখন এতো পছন্দ,তাহলে একটু ভেবে দেখেন না।সংসার তো ওই করবে।”
রাবেয়ার কথা শুনে শওকত হাওলাদারের মেজাজ তরতরিয়ে বাড়ে।রাবেয়ার দিকে তাকিয়ে ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দেয় যেন শিমুলের রাগ রাবেয়ার উপর ঝাড়ে।রাবেয়া গালে হাত দিয়ে ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকে।
শওকত হাওলাদার শাসিয়ে বলে,

“ছেলেকে একদম লাই দিবিনা।যদি লাই দিয়েছিস তাহলে তিনকথা শুনবি।মনে থাকে যেন।”
শিমুল চিরবিরিয়ে বলে,
“আব্বা আপনি আমার মা কে মারলেন কেনো?খবরদার মার গায়ে হাত তুলবেন না।”
শওকত বলেন,
“কি করবি হাত তুললে?তোর রুমে যা।আর ছোটলোকের ভুত মাথা থেকে নামা।”

রাবেয়া ছেলের রাগী চেহারার দিকে তাকিয়ে ঠেলে শিমুলকে বের করে দেয়।শিমুল রুমে এসে বসে।রাগে তার হাত কাঁপছে।কাঁপা কাঁপা হাতেই সিগারেট ধরায়।সারারাত ঘুমাতে পারে না।তার পুষ্প ভালো নেই,প্রতিনিয়ত কষ্টে ধুকে ধুকে শেষ হয়ে যাচ্ছে।এই কষ্ট পাওয়ার মূলে আছে শিমুল,অথচ শিমুল কিছুই করতে পারছেনা।

একবার ভাবে পুষ্পর সাথে দেখা করতে যাবে কিন্তু পুষ্পর বাবা মা দেখলে যদি আবার মারে!ইচ্ছেটা বহু কষ্টে ধামাচাপা দিয়ে চুপচাপ বিছানায় বসে থাকে।

পুষ্পর আব্বা পুষ্পকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলো।একটা সেলাই লেগেছে।মিজান শেখের বুঝতে দেরী লাগেনি এটা যে রোকসানার আঘাতের কারনেই কেটেছে।পুষ্পর নিরবতা,আর রোকসানা আঁচলে বারবার চোখ মুছে যাচ্ছে।মিজান শেখ আর কিছু বলে না।পুষ্প যে শিমুলকে ভুলতে পারেনি এটা তিনি বুঝে।কিন্তু কিছু বলেনা,লেবু বেশী চিপলে তিতা হয়ে যায়।
পুষ্পর সাথে রোকসানা কথা বন্ধ করে দিয়েছে।

কিন্তু নিজে নিজেই খুচিয়ে খুচিয়ে এটা সেটা বলছে,এই কথাগুলো শুনতে পুষ্পর খুব খারাপ লাগে।সারাদিন পুষ্পকে খেতেও বলে না।পুষ্পর কান্না পায় সারাদিন কিছুই খায়নি।রাতে ঘুমানোর সময় হঠাৎ করেই তার ইচ্ছা করছে মরে যেতে।শিমুলকে না পাওয়ার দুঃখ,বাবা মায়ের হাহাকার মিশ্রিত নিঃশ্বাসের শব্দ তাকে পোড়ায়।এখন মনে হয় সে মরে গেলেই সব শান্ত হয়ে যাবে।সিলিংফ্যানের দিকে একমনে তাকিয়ে ভাবে কিভাবে ওরনা ঝুলালে ভালো হবে।খাটে চেয়ার রেখে ফ্যান নাগাল পাওয়া যাবে কিনা।

চেয়ারম্যান বাড়িতে ছোট বেলা থেকেই ফুলি কাজ করে।ছোট থেকে এখন বড় হয়েছে পনেরো বছরের মেয়ে।সকাল সকাল গোসল করে ঠোঁটে লাল লিপিস্টিক দিয়ে হাসি হাসি মুখে ড্রয়িংরুমের ফার্নিচার মুছে যাচ্ছে।শিমুল রুম থেকে বেরিয়ে ফুলিকে দেখে বিরক্তিতে চোখ বাকায়।

“ফুলি সর।আর সকাল সকাল সং সেজেছিস কেন?”
ফুলি শিমুলকে দেখে খুশীতে ঝুমঝুম করে বলে,
“আরে ভাইজান আপনে এই পুরান টাওজার পইরা হাটেন কেন?বউ আইতাছে নতুন কাপড় পরেন গিয়া যান।”
বউ মানে?আব্বা কি পুষ্পকে মেনে নিয়েছে?শিমুল বললো,
“কার বউ?”

ফুলি যেন অবাক হয়।মাথায় হাত দিয়া বলে,
“আল্লাহগো যার বিয়া তার খবর নাই,পাড়া পরশীর ঘুম নাই।আপনার বউ।এমপি সাহেবের ভাগনীর লগে বিয়া ঠিক হইতাছে যানেন না নাকি?আজকে উনারা আসবো।বউ ও নাকি আইবো।বিয়ার আগেই জামাইর বাইত আইতাছে বেডীর শরম নাই।”

ফুলি আরো অনেক কিছুই বলে কিন্তু শিমুলের কানে যায় না।দ্রুত পায়ে রান্নাঘরে মায়ের কাছে যায়।হরেক রকমের রান্নার ঘ্রানে ঘর মৌ মৌ করছে।রাবেয়া ছেলেকে দেখেই বুঝে ফেলে।
শিমুলের হাত ধরে টেনে দূরে গিয়ে দাঁড়ায়।
শিমুল বলে,

“এসব কি শুনি মা?আমি কিন্তু আগুন লাগিয়ে দিবো।”
রাবেয়ার চোখে পানি টলটল করে।ছেলেকে এমনভাবে দেখতে খারাপ লাগে।কিন্তু তিনি যে অসহায়।শিমুলের দিকে তাকিয়ে বলে,

“আব্বা আজকে চুপ করে থাক।তুই উল্টাপাল্টা কিছু করলে তোর আব্বা আমাকে তালাক দিয়ে দিবে।”
শিমুল স্তব্ধ হয়ে যায়।তার আব্বা যানে তার মা তার দূর্বল জায়গা তাই রাবেয়াকে হাতিয়ার বানিয়েছে।মায়ের অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে গেলে রাবেয়া বলে,

“তুই না আমার আব্বা।”
শিমুল আর কিছু বলেনা দ্রুত পা ফেলে বিকট শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দেয়।পল্টিবাজ বাপ সবজায়গায় গুটি জিতে নিতে যায়।স্বার্থপর লোক।

খুব ভোরে চেচামেচির শব্দে পুষ্পর ঘুম ভেঙ্গে যায়।বিছানা ছেড়ে হুড়মুড় করে উঠে দাঁড়ায়।বাহিরে গিয়ে বুঝতে পারে পাশের বাড়িতে আগুন লেগেছে।মিজান শেখ আর রোকসানা সেখানেই।পুষ্প কি ভেবে আবার ঘরে আসে।রোকসানার বালিশের কাছেই মোবাইলটা পড়ে রয়েছে।পুষ্প দ্রুত হাতে শিমুলের নাম্বারে ডায়াল করে।শিমুল কেঁটে দেয়।সেকেন্ড পড়েই মোবাইলটা তার স্বরে চেঁচিয়ে উঠে।পুষ্প রিসিভ করে,

“হ্যালো।”
পুষ্পর গলা শুনতে পেয়ে শিমুল চোখ বন্ধ করে ফেলে।পুষ্প বাচ্চাদের মতো করে কাঁদে।
“এই তুমি কথা বলোনা কেন?”
পুষ্প এই প্রথম শিমুলকে তুমি করে বলছে শিমুলের খুশী হওয়ার কথা ছিলো অথচ কান্না পাচ্ছে।দীপ্তিময় চোখজোড়া লাল লাল হয়ে পানি জমে।লঘু গলায় বলে,
“ভাল আছিস জান?”

শিমুলের আদুরে কথায় কষ্টরা বুক চেপে ধরে।পুষ্প ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে,
“একটুও ভালো নেই।”
শিমুলের ঠোট কাঁপে।এই মেয়েটাকে সে একটুও শান্তি দিতে পারছেনা।আবার আজকে কিনা অন্য মেয়ে তারই বাড়িতে বউ হওয়ার জন্য চলে আসছে!শিমুলের বুকটা ব্যথা করে।নিঃশ্বাস আটকে বলে
“খুব ভালোবাসি আমার ফুলকে।”

পুষ্প ঢুকরে কেঁদে উঠে।এই দুনিয়ার বেড়াজাল তার আর সহ্য হয় না।
“ভালোবাসায় এতো কষ্ট কেন শিমুল?আমি সইতে পারছিনা।ম*রে যাবো!”
খুব গোপনে শিমুলের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।পুষ্পর কান্না বুকে ছুড়ির মতো বসে যাচ্ছে।পুষ্পর কথা শুনে বলে,
“আমাকে সাথে নিয়েই ম*রিস পুষ্প।খবরদার একা ম*রতে যাবি না।”
পুষ্প বলে,

“আমাকে বিয়ে করবা তো?”
শিমুল বলে,
“করবো তো।শিমুলের ফুল ছাড়া শিমুল গাছের দাম নেই যে।”
“আম্মা এতো মারে আমি সহ্য করতে পারছিনা।আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাও না।”
শিমুল চোখ বন্ধ করে তার ফুলের নিষ্পাপ কথাগুলো শুনে।

“খুব শীঘ্রই কাছে নিয়ে আসবো।”
পুষ্প বলে,
“অশান্তি লাগে।”
“আমারো।”
“তোমার বাড়িতে জানিয়েছো?”

শিমুল দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে।পুষ্পকে কেই মেনে নেয়নি অথচ আজকে অন্য মেয়ে তার বাড়িতে আসবে এটা যদি পুষ্প শুনতে পায়?ছোট মেয়েটা এই এত এত বিরহ নিতে পারবেনা।
“জানিয়েছি।”
পুষ্প খুব আদুরে গলায় বলে,

“শোন,আমি কিন্তু তোমাকে ছাড়া মরে যাবো।মনে রেখো।”
শিমুলের চোখ দিয়ে পানি পড়ে।বেশী কথা বলতে পারে না।ছোট করে বলে,
“রাখবো।”
“রাখি আম্মা চলে আসবে।”

শিমুল ফুল পর্ব ১৫

শিমুল হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে।
“আচ্ছা।”
ফোন কাটার পরে শিমুলের ইচ্ছা করছে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে কিন্তু পারে না।তার পুষ্প তার কাছে আসতে চাইছে কিন্তু পুষ্পর বদলে আসছে আরেকজন।

শিমুল ফুল পর্ব ১৭