শূণ্যতার পূর্ণতা তুমি পর্ব ১৯

শূণ্যতার পূর্ণতা তুমি পর্ব ১৯
রোকসানা আক্তার

আমি প্রবেশের যেমন ভাবলাম সূবর্ণার ব্যাপারে,সূবর্ণার মাঝে তার কিছুই দেখলাম না।ভাবলাম হয়তো উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলবে,
“ভাবী দেখেছো?নিহাল ভাইয়া কত ভালো হয়ে গিয়েছেন!আমি বললাম না ভাবী মানুষ সবসময় একরকম থাকে না!”
কিন্তু সূবর্ণা এরকম কিছুই বললো না।চুপচাপ বসে রইলো বাইরের দিকে তাকিয়ে।আমি আসাতেও যে নড়বেচড়বে তাও করলো না।আমি ডাকলাম,

“সূবর্ণা?”
এবার তাকালো।শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো সূবর্ণা।
“বলো ভাবী।”
“আমান ঘুমিয়ে গেছে?”
“হু।”
“একটু জাগাও তো।খাওয়াতে হবে।সকাল থেকে কিছুই খায়নি।”
সূবর্ণা জাগাতে থাকলো।নিহাল এমন সময় বাইরে থেকে ডাক দিলো।আমি গেলাম।বললাম,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“কিরে ভদ্রসদ্র মানুষ!”
“চলে যাচ্ছি তাহলে ভালো থাকিস!”
“চলে যাচ্ছিস মানে?মাত্রই তো এলি।”
“এখন আর সময় হয় না রে।আগের মতন কি সেই সময় আর আছে?”
“খুব ব্যস্ত মানুষ হয়ে গেছিস না?”

নিহাল হাসে।
আমি আবার বলি,
“তা গার্লফ্রেন্ড ট্রেন্ডফ্রেন্ড আছে নাকি?”
নিহাল চাপা হাসে এবার!আমি বলি,
“এই আছে তাহলে?”

“দূর ছাই!আমাদের মতন ছেলেদের সাথে কোন মেয়ে আর সম্পর্ক করবে।কাউকেই তো আমাদের মতন ছেলেদের পছন্দ না।মেয়েরা ভুলবশত পছন্দ করে ফেললেও কিছু ফ্যামিলি ওমনি নাক ছিটকায়!”
নিহাল যে এই কথাটা আমার শ্বশুর বাড়িকে উদ্দেশ্য করে বললো তা বুঝলাম।তবে,কথা হলো নিহাল কি আদৌ সূবর্ণাকে সত্যিকারের ভালোবেসেছে!ভাবনার কথা ভাবনাতেই রাখলাম।
তারপর বললাম,

“তা রাতের খাবার খেয়ে যাস!”
“নাহহ রে….!আরেকদিন!ভালো থাকিস!”
“তুই বড্ড চেইঞ্জ হয়ে গেছিস নিহাল!অবাক হলাম!”
“চেইঞ্জটা যদি তোর বিয়ের আগে হতাম তখন নিশ্চয়ই ভালোবাসতিস,না?”
“আমার ছেলে আছে রে ভাই।এখনো তুই আমাকে ভালোবাসিস?”

“এখন আর কাউকে বাসি না।বাসবোও না মনে হয়!ভালোনাসলে তা সফল হয়না।সবাই ঠকায়!”
এ বলে নিহাল রুমের দিকে তাকায়।রুমের ভেতর সূবর্ণা আছে!নিহালের অনুভূতিতে কি তা জানি না।তবে,কথার হাবভাবে মনে হলো সূবর্ণাকে সত্যিই ভালোবেসেছিল!ভাবনার মাঝে নিহাল বলে,
“থাক তাহলে!”

চলে যায় নিহাল।তারপর সূবর্ণার এই বাসায় আরো তিন-চারদিন কাঁটে।রাতে শুয়েছিলাম আমি, সূবর্ণা এবং আমান।আমার চোখে প্রায় ঘুম।ফোনের শব্দে চোখ খুলে যায়।ভাবলাম আমার ফোনে কল এসেছে বৈ কি!কিন্তু ফোন হাতে নিয়ে দেখি আমার ফোন না।সূবর্ণা ফোনে।সূবর্ণাও দেখলাম ঘুমিয়ে গেছে!আমি সূবর্ণাকে হাত দিয়ে জাগাতে থাকলাম।দুই তিনবার ডাকার পর সূবর্ণা চোখ মেলে।বললাম,

“দ্যাখ তো এত রাতে কে কল করেছে তোর ফোনে।”
সূবর্ণা ঘুমু ঘুমু চোখে বালিশের পাশ থেকে হাতরিয়ে ফোনটা হাতে নেয়।ফোনটা সামনে এনে বলে,
“বিদেশের নাম্বার ভাবী।”
“রিসিভ কর!”
সূবর্ণা রিসিভ করলো কল।রিসিভ হতে ওপাশ থেকে অনবরত কেউ কথা বলে যাচ্ছে,

“আমার বাসায় থাকতে যদি তোমার এতই সমস্যা তাহলে বিয়েতো করার কোনো মানে হয়নি আমাকে!ড্যাংড্যাং করে বিয় করেছো লোকজনকে দেখাতে !ম্যানারলেস কোথাকার!আমার জীবনটা অতিষ্ঠ করে দিয়েছো তুমি!এবং তোমার পরিবার!আমার মায়ের সামনে থেকে তোমার মা-ভাই কীভাবে তোমাকে নিয়ে আসতে পারে!সাহস কত তোমার মা-ভাইয়ের!”
বুঝতে আর বাকি রইলো না আমার সূবর্ণার জামাই বলতেছে এসব!সূবর্ণা রুদ্ধশ্বাসে বলে,

“কথা শেষ হয়েছে আপনার!এবার আমি বলি…!”
“তোর কোনো কথাই শুনবো না আমি!কোনো কথাই ই না!”
“আমার দোষ কোথায়?কি দোষ করেছি আমি!দোষটা তো বলবেন যে আমার সাথে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করে যাচ্ছেন বিয়ের পর থেকে!”

“যাচ্ছেতাই ব্যবহার?!আমার মাকে তুই সম্মান করতে জানিস?আমার মায়ের ই তো মন জুগিয়ে চলতে পারিস নাই,আবার আমার দেখে ভালো ব্যবহার চাচ্ছিস!সাহস তো কম না তোর!”
“আমি কারো সাথেই খারাপ ব্যবহার করিনি!কারো সাথেই না!”
“ইউ জাস্ট সেটাপ!নস্টালজিক গার্ল!”

সূবর্ণা কেঁদে উঠে এবার!আমার আর সহ্য হলো না!চোখমুখ শক্ত করে সূবর্ণার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিতে নিলাম ওই ছেলেকে কিছু বলার জন্যে।কিন্তু সূবর্ণা বাঁধ সাধলো।কিছু বলতে দিলো না।কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,
“ভাবী প্লিজ কিছু বলো না!আমি কথা বলে দেখি!”

বলে সূবর্ণা উঠে বেলকনিতে চলে গেলো!বেশ অবাক হলাম সূবর্ণাকে দেখে!কতটা ধৈর্য্য আছে এই এতটুকুন মেয়ের!সংসার রাখতে কতটাই না প্রচেষ্টা! চোখে পানি চলে এলো আমার!বেলকনিতে যাওয়ার মিনিট তিনেক পরই সূবর্ণা চেঁচিয়ে উঠলো!আমি বেলকনিতে গেলাম দৌড়ে।সূবর্ণা ফ্লোরের উপর হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতেছে!কারণ জিজ্ঞেস করতেছি কিছুই বলতেছে না!

“এই সূবর্ণা? সূবর্ণা? ”
জড়িয়ে ধরলো খুব শক্ত করে এবার আমাকে!বললো,
“ভাবী?উনি আর আমার সাথে সংসার করতে চাচ্ছেন না!”
বলে সূবর্ণা কুপিয়ে কেঁদে উঠে আরো।সূবর্ণার কান্নার আওয়াজ পেয়ে মা-বাবা পাশের রুম থেকে দৌড়ে আসেন।আমানেরও সদ্য কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে যায়।বসে চোখমুখ ঢলতে ঢলতে কেঁদে উঠে আমান!বাবা উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠেন,

“সুপ্রভা?কি হয়েছে?সূবর্ণা কান্না করতেছে কেনো?!কি হয়েছে!”
আমি বাবাকে কোনো জবাব দিতে পারলাম না।চুপচাপ, নিথরভাবে বসে রইলাম সূবর্ণার মাথা কোলে নিয়ে!
পরদিন চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিই।শাশুড়ী মাকে সব জানাই।তাই শাশুড়ী মা দেরী না করে সূবর্ণাকপ নিয়ে চলে যেতে বলেন।যাওয়ার সময় মা কিছু পিঠা-পায়েশ বানিয়ে দেন!সূবর্ণা রেডি হচ্ছে।তাই আমি সবকিছু নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম।এমন সময় নিহাল ভেতরে ঢুকে।আমাকে দেখে মুখে ফুটে উঠে।গাট্টাগোট্টা দেখে বলে,

“বেড়ানো শেষ!”
আমি হাসলাম বিপরীতে।নিহাল বুঝলো চলে যাবো যে।নিহাল এগিয়ে এসে আমানকে কোলে তুলে নিল।তারপর বললো,
“এখনই যেতে হলো?একটা মেয়ে পছন্দ করেছে বাবা আমার জন্যে।সবাই তাকে আগামী পরসু দেখতে যাবে।আর তুই চলে যাচ্ছিস!?”
আমি শান্ত স্বরে বললাম,

“ভাগ্যে ছিলো না হয়তো তোর হবু বউকে দেখার।সমস্যা নেই আবার এলে যদি দেখা হয়!”
নিহাল কিছু আর বললো না।চুপ করে রইলো। তখন সূবর্ণা বেরিয়ে আসে।মেয়েটার চোখমুখ ফোলা খুব!যে-কেউ মেয়েটার মুখ দেখে বুঝবে মেয়েটার ভীষণ রকম মন খারাপ।নিহালের মনেও হয়তো তাই সাড়া দিল।সে সূবর্ণার দিকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকলো!সূবর্ণা কাছে এসে,

“চলো ভাবী।”
মাথা নুইয়ে বললো সূবর্ণা।আমি নিহালের দিকে তাকিয়ে,
“যাই নিহাল!ভালো থাকিস।”
বলে আমানকে কোলে তুলে নিলাম আমার।তারপর মা-বাবাকে বললাম,

“যাই মা…বাবা!”
মা বলেন,
“আচ্ছা সাবধানে যাস!আর সূবর্ণার খবর জানাস!”
বলে মা তারপর কি কি যেন বিড়বিড় করে বলেন!হয়তো সূবর্ণার শ্বশুর বাড়ির লোকদের নিয়েই বলতেছেন।আমরা আর তা শুনলাম না।বেরিয়ে এলাম ততক্ষণে।

পনেরো দিনেক পর সূবর্ণা হাতে টাটকা একটা কাগজ হাতে পায়।ডিভোর্স পেপার ওটা।সূবর্ণার স্বামী পাঠিয়েছে!সূবর্ণা প্রথম কয়েক মুহূর্তে স্তব্ধ চোখে কাগজটির দিকে তাকিয়ে থাকে!তারপর টেবিলের উপর থাকা কলমটা নিয়ে খসখস করে সাইন করে দেয়!করে এসে আমার পাশে এসে বসে।আমি সূবর্ণার হাত চাপটে ধরি।সূবর্ণা চুপচাপ তারপর।আমরা সবাই ই চুপচাপ।এমন একটা পরিস্থিতি এখন..কথা বলারই ভাষা নেই কারো।

তবে শাশুড়ী মা কিছু না বলতে পারলেও দুই চোখ বেয়ে উনার নোনা জল গড়িয়ে পড়তেছে।এভাবে অনেকগুলো দিন পার হয় আমাদের।বাসায় ঠিকমতন রান্নাও হয়না।কারো খাবার টাইম-মেন্যু নেই!এমনো দিন যাচ্ছে খাইও না আমরা!সূবর্ণা তো মোটেও না!তবে কথা বলে খুব!তাও আমানের সাথে।আমাদের সাথে তেমন না!একদিন আমি বিছানা গোছগাছ করতেছি।সূবর্ণা এমন সময় আমার রুমে আসে।খাটের কোণায় এসে বসে।হুট করে বলে,

“ভাবী?আমিতো এখন ডিভোর্সী, না?সমাজ আমাকে আর মূল্য দেবে না!কেউ বিয়েও করতে চাইবে না আর!আচ্ছা,ভাবী?আমি যদি বাইরে না যেয়ে এভাবে চারদেয়ালে কাটিয়ে দিই…ব্যাপারটা মন্দ হবে না,না?তবে আফসোস লাগতেছে….আত্মহত্যা মহাপাপ.. বিধাতা এই বিধান টা না করলেও পারতেন!”
ভেতরটা কেঁপে উঠলো!তাকিয়ে রইলাম সূবর্ণার মুখের দিকে!শুধু!সূবর্ণা আবার বলে উঠলো,

“ভাবী নিহাল ভাইয়া তো বিয়ে করে ফেলেছে না?উনার বউ নিশ্চয়ই খুব সুন্দর,না?”
তারপরও কোনো জবাব দিতে পারলাম না।অতিরিক্ত মন খারাপ হলে মানুষ অনেককিছুই বলে যা সূবর্ণা বলতেছে আমি জানি।আর সূবর্ণার এখন এরকম কথা বলাটা স্বাভাবিক!,মানুষ ডিপ্রেশনে থাকলে পাগলও হয়ে যায়!আমি সূবর্ণাকে জড়িয়ে ধরলাম।কাঁধে সান্ত্বনার হাত বুলালাম!,

তার দুইদিন পর,
আমি আমানকে শোইয়ে দিয়ে ড্রেসিং এর সামনে বসলাম।প্রতি রাতে শোওয়ার সময় বেণী করে ঘুমাই।আকাশ ফ্রেশ হয়ে বাথরুম থেকে বের হলো সবে!আমার কল বেঁজে উঠে তখন!

শূণ্যতার পূর্ণতা তুমি পর্ব ১৮

“তোমার কল এসেছে।রিসিভ করো।”
আমি আকাশের কথায় খেয়াল করি তখন।ফোনটা হাতে নিই।স্ক্রিনে তাকিয়ে নিহালের নাম্বার!

শূণ্যতার পূর্ণতা তুমি শেষ পর্ব