শেষটা সুন্দর শেষ পর্ব 

শেষটা সুন্দর শেষ পর্ব 
জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

গ্রীষ্মের এক উত্তপ্ত সকাল। চারদিক খা খা করছে রোদে। বাইরে তাকানোই যেন মুশকিল। আর যারা বাইরে প্রতিদিনকার কাজে ব্যস্ত, তাদের তো মনে হচ্ছে তাপদাহ বুঝি তাদের খরখরে পিঠের উপর ঠাটিয়ে চাপড় বসিয়ে যাচ্ছে। এই আর যেন সহ্য করা যাচ্ছে না।

ঘেমে গেয়ে এসে পাঞ্জাবীটা খুলে রাখল রাবীর। উফ, মাথা ধরেছে তার। রীতিমত চোখে অন্ধকার নেমেছে যেন। সে গলা উচিয়ে মেহুলকে ডাকল,
‘মেহুল, এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দিতে পারবেন?’
নিচ থেকে আওয়াজ এল,
‘আসছি।’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রাবীর চুপচাপ বিছানায় শরীর মেলল। মেহুল গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এসে বলল,
‘আপনার শরবত।’
রাবীর উঠে বসে। শরবতের গ্লাসটা হাতে নিয়ে অমায়িক হেসে বলল,
‘এটা কখনো ভুলবেন না, তাই না?’
মেহুল মৃদুমন্দ হেসে বলে,
‘না।’

‘বসুন।’
ইশারায় রাবীরের পাশে বসতে বলল। মেহুল বসে না। বলে,
‘এখন বসা যাবে না। রান্নার কাজ বাকি। একটু পরেই রিতারা চলে আসবে।’
মেহুল ব্যস্ততা দেখিয়ে চলে যেতে নিলেই রাবীর তার ওড়না টেনে ধরে। ভ্রু কুঁচকে ফিরে মেহুল। অধৈর্য গলায় বলে,
‘আর কী চাই?’

রাবীর তার নিচের ঠোঁট কামড়ে হাসতেই, মেহুল বুঝে। এক ঝটকায় ওড়ানাটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,
‘আমার অনেক কাজ। একদম জ্বালাতে আসবেন না।’
বলেই তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যায় সে। তার যাওয়ার পানে চেয়ে পুনরায় হেসে, বিছানায় গা এলিয়ে দেয় রাবীর।

দুপুরে রোদের ঝাঁঝ আরো বাড়ে। রান্নাঘরে মেহুল যেন আর টিকতে বাড়ছে না। তাও সে সটান দাঁড়িয়ে সব রেঁধে যাচ্ছে। কাউকে হাত লাগাতে দিচ্ছে না। এই একটা দিন, সে সবকিছু উপেক্ষা করে রান্নায় মনোযোগ দেয়। যদিও যার জন্য এত আয়োজন, সে আদৌ এত সব খেতে পারে না। এখন অল্প স্বল্প খাওয়া শিখলেও, ঐ ডাল ভাত চটকিয়েই খাওয়াতে হয় তাকে। নাহলে গলা দিয়ে নামে না যে। তাও, প্রতিবছর মেহুল বেশ আয়োজন করে সবকিছু করে। নিজের হাতে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর বিষয়টা সে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে। বাড়ি সুদ্ধ সবার জন্য একা রাঁধে। আর এই সবকিছুতেই মেহুল ভীষণ তৃপ্তি পায়।

ওড়ানা দিয়ে হাত মুছতে মুছতে মেহুল রুমে প্রবেশ করে। রাবীর তখন আধশোয়া বসে লেপটপে কিছু করছিল। মেহুল এসে তাগদা দিয়ে বলল,
‘একবার সাদরাজ ভাইয়াকে কল দিয়ে দেখুন না, উনারা কোথায় আছেন।’
রাবীর লেপটপের উপরেই দৃষ্টি বরাদ্দ রেখে বলে,
‘মাত্র কথা হয়েছে। বলেছে, রওনা দিয়েছে।’
মেহুল বড়ো বড়ো চোখে চেয়ে বলে,

‘সেকি! আমার তো এখনও কিছুই করা হয়নি। আর এক ঘন্টার মধ্যে কীভাবে সব করব?’
রাবীর লেপটপ চাপিয়ে তার দিকে ঘুরে তাকায়। বলে,
‘কী করতে হবে? আমাকে বলুন, আমি করে দিচ্ছি।’
মেহুল জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে মনে মনে হিসাব কষল, কোন কোন কাজ বাকি তার। পরে রাবীরের দিকে চেয়ে বলল,
‘আপাতত আপনি ড্রয়িং রুমটার ডেকোরেশনের ব্যবস্থা করুন। আমি বাকি কাজ করে নিতে পারব।’

লাল রঙের জামদানি’টা গায়ে জড়াতেই, নিজেকে যেন নতুন বউ রূপে আবিষ্কার করল মেহুল। মনে পড়ল বিয়ের কথা। একটা লাল টুকটকে বউ সেজেছিল। কী নিদারুণ লজ্জা আর ভয় ছিল চোখে মুখে। তবে জেদ আর বিষন্নতাও ছিল বরাবর। কিন্ত, সময়ের পরিবর্তনে রাবীরের একচ্ছত্র ভালোবাসায় সমস্ত জেদ, রাগ, ক্ষোভ মিলিয়ে যায়। তৈরি হয়, নতুন সম্পর্ক। তারপর জীবন চলতে চলতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। অন্তরালে হাতিয়ে দেখে, একি ভিতরে তো শূন্যতা ছেয়ে আছে। আজও সেই শূন্যতা পূরণ হয়নি। মেহুল ভ্রু কুঁচকে ফেলল। নিজেকে নিজে ধমকে বলল,

‘কে বলেছে পূরণ হয়নি?’ এই যে তার ছোট্ট সারাজ, সব শূন্যতা পূর্ণ করে দিয়েছে। আর কোনো কিছুর আক্ষেপ নেই তার।
শাড়ির আঁচল’টা পেছনে ঠেলতেই পিঠে কারোর উষ্ণ স্পর্শ পায়। আয়নার দিকে ফিরে তাকায়। রাবীর খুব যত্ন করে একটা পিন দিয়ে আঁচলটা আটকে দেয়।
চোখ সরিয়ে আয়নায় তাকিয়ে বুক ফুলিয়ে নিঃশ্বাস নেয় সে। কানের কাছে মুখ নিয়ে হিসহিসিয়ে বলে,
‘এখনও কেন আপনাকে দেখলে আপনার হৃদস্পন্দন থমকে যায়, মেহুল? এই একটা মানুষের উপর আমি আর কতবার প্রেমে পড়ব বলুন তো?’

লজ্জায় গালে লাল আভা ফুটে মেহুলের। ছয় বছরের বৈবাহিক জীবন তাদের। অথচ, মেহুলের লজ্জা পাওয়া দেখলে মনে হয়, সে যেন সদ্য বিবাহিতা একটা ছোট্ট কিশোরী। যার প্রতিটা শিরায় শিরায় প্রেমের পীড়া টগবগ করছে।
লজ্জায় রাঙা মেহুলকে দেখে ঠোঁট ছড়িয়ে হাসে রাবীর। পুনরায় একই স্বরে বলে,

‘এখনও এত লজ্জা! লজ্জা ভাঙার আর কোনো উপায় তো বাকি রাখিনি। তাও এত লজ্জা কোথ থেকে আসে?’
বেশ আফসোসের সুরে বলে রাবীর। মেহুলের তো তাতে আরো লজ্জা বেড়ে যায়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে লোকটার লজ্জা শরম সব লোপ পাচ্ছে। হুটহাট কেমন সব বেশরম কথা বলে বসেন। মেহুল কিছু বোঝাতে আসলেই, উল্টো সেই কথার মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়। তাই মেহুল ও এখন ধৈর্য্য হারিয়ে পিছ ছেড়ে দিয়েছে।
মেহুলের ধ্যান ভাঙে রাবীরের অধর স্পর্শে। তার ঘাড়ে গভীর ভাবে ঠোঁট ছুঁয়ে রাবীর সরে আসে। চোখে মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলে বলে,

‘ঐ যে গাড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছে। ওরা চলে এসেছে বোধ হয়।’
রাবীর রুম থেকে বেরিয়ে যায়। মেহুল কোনো রকমে চুল বেঁধে তার পেছনে হাঁটা ধরে।
গাড়ির দরজাটা খুলেই একটা পাঁচ বছরের ছেলে ছুটে এসে মেহুলের কোমড় জড়িয়ে ধরে। খিলখলিয়ে বলে উঠে,
‘কেমন আছো, মা?’

তার উচ্ছ্বসিত বাচ্চা গলার স্বরে মনটা আনন্দে ভরে যায় মেহুলের। বাচ্চাটাকে আষ্টে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। বলে,
‘আমি ভালো আছি, সোনা। তুমি কেমন আছো?’
ছেলেটা মাথা তুলে তাকায়। দু হাত দু দিকে মেলে দিয়ে বলে,
‘আমি এতগুলো ভালো আছি।’
মেহুল তার গাল টেনে দেয়। হেসে বলে,
‘তাই!’
ছেলেটা মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,
‘দাদু কোথায়?’

‘উপরে, তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন।’
ছেলেটা এক দৌড়ে ভেতরে চলে যায়। সে যাওয়ার পর রিতা এসে তার পাশে দাঁড়ায়। হেসে বলে,
‘কাল থেকে পাগল হয়ে যাচ্ছিল, আম্মু, কবে মা’র কাছে যাব, কবে মা’র কাছে যাব, এই বলে বলে। আর এখন এসেই দেখ, কেমন চোটপাট শুরু করেছে।’
মেহুল হেসে বলে,
‘থাক। ও এমন করে বলেই তো, আমরা আনন্দে থাকতে পারছি।’

দুপুরের খাওয়া শেষ করে, মেহুল বসল সারাজকে খাওয়াতে। নিজ হাতে ভাত মেখে খুব ছোট একটা লোকমা তুলে সে সারাজের মুখের সামনে ধরে। সারাজ ততক্ষণাৎ মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে অভিমানের সুরে বলে,
‘আমি আগে কেক কাটব, মা।’
রিতা পাশে বসেই দই খেতে খেতে বলল,

‘ঐ হয়েছে। কেকের কথা শোনার পর থেকেই খাওয়া দাওয়া সব উঠে গিয়েছে তার।’
মেহুল এক হাতে সারাজকে আগলে নেয়। আদুরে গলায় বলে,
‘কেক কাটব তো আমরা। সবাই মিলে কেক কাটব। তবে এখন না, সন্ধ্যায়।’
ছেলেটা তার দিক চেয়ে মন খারাপ করে বলল,
‘কেন? এখন কাটলে কি হবে?’

‘দুপুর বেলায় তো কেউ কেক কাটেনা, বাবা। সন্ধ্যার পর সবাই বার্থডে পালন করে। তোমার জন্য কিন্তু আমরা অনেকগুলো গিফ্টও এনেছি। তোমার কি গিফ্টগুলো চাই?’
ছেলেটার চোখ মুখ খুশিতে চকচক করে উঠে। মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, চাই।’
মেহুল হেসে বলে,
‘তাহলে আগে তোমাকে এই ভাত গুলো শেষ করতে হবে। তারপর তুমি তোমার সমস্ত গিফ্ট পেয়ে যাবে।’
ছেলেটা মাথা হেলিয়ে বলল,
‘আচ্ছা।’

সন্ধ্যায় কেক কাটা শেষ করে, সারাজ তার গিফ্টগুলোতে মনোযোগ দিল। অনেক গিফ্ট পেয়েছে সে। তার আম্মু আব্বু তাকে অনেক রকমের খেলনা কিনে দিয়েছে। আর তার মা বাবা তাকে একটা ছোট্ট সাইকেল গিফ্ট করেছে। এই গিফ্ট পেয়ে তো বেচারা খুশিতে আত্মহারা। তাছাড়া তার দাদুও তাকে বেশ সুন্দর সুন্দর কিছু কাপড় কিনে দিয়েছেন।

সাদরাজ বড়ো কেকের পিস’টা রেখে দেয়। পেছন থেকে রিতা দেখে বলে,
‘কী ব্যাপার, খাবেন না?’
সাদরাজ চেয়ে বলল,
‘না, ইচ্ছে করছে না।’

রিতা মুচকি হেসে এগিয়ে আসে। কেক’টা তুলে নিজের ঠোঁটের অংশে ঘষে দেয়। সাদরাজ তার কাজ দেখে ভ্রু কুঁচকায়। ব্যাপার’টা ঠাহর করার চেষ্টা চালাচ্ছে। কেক’টা ঠোঁটে মুখে লাগিয়ে লাজুক হাসে সে। পিটপিট করে এদিক ওদিক চেয়ে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘এবার খাবেন?’
সাদরাজ বড়ো বড়ো চোখে তাকায়। মেয়েটা লজ্জা শরমের মাথা খেয়েছে নাকি? ছেলেটা যে বড়ো হচ্ছে, অথচ এই মেয়ে বাচ্চা বাচ্চাই রয়ে গিয়েছে। সাদরাজ দু’দিক মাথা নাড়িয়ে নিজেকে ধাতস্ত করে। রিতার দিকে দু’কদম এগিয়ে তার ঠোঁটের পাশটা আঙ্গুল দিয়ে ঘষে লঘু সুরে বলে,

‘আমার ছেলে বাচ্চাটা বড়ো হলেও, বউ বাচ্চাটা আর বড়ো হলো না।’
রিতা তখন অতশত না ভেবে চট করে তার মুখ এগিয়ে কেকের অংশটা সাদরাজের গাল ঘষে লাগিয়ে দিল। সাদরাজ পিছিয়ে যায়। গালে হাত দিয়ে হতাশ গলায় বলল,
‘অসভ্য মেয়ে।’

সারাজ এবার কিছুদিন মেহুলদের সাথে থাকবে। তারপর আবার যাবে তার আব্বু আম্মুর বাড়িতে। এভাবেই সে থাকে। কিছুদিন মা বাবার কাছে, কিছুদিন আম্মু আব্বুর কাছে। আর এই নিয়ে তার কোনো অসুবিধা নেই। আবার রিতা বা সাদরাজেরও কোনো অভিযোগ নেই। মেহুল এই নিয়েই ভালো আছে, সুখে আছে। জীবন নিয়ে আর কোনো আক্ষেপ বা আফসোস নেই তার। তাদের ছোট্ট সারাজ তাদের জীবনে পূর্ণতা এনে দিয়েছে। আর এখন জীবন এটাতেই খুশি। সব পাওয়া না পাওয়ার মাঝেও গল্পের শেষটা ভীষণ সুন্দর। অন্তত মেহুল এখন তাই ভাবে।

শেষটা সুন্দর পর্ব ৬৭

(আসসালামু আলাইকুম। আমি জানি, “এখন অনেকেই বলবেন, কেন মেহুলকে মা বানালাম না। আমি তো চাইলেই পারতাম মেহুলকে মা বানাতে।” কিন্তু, আমি ইচ্ছে করেই এমন কিছু করিনি। এমন কিছু করলে, গল্পটা বাস্তবতার ছোঁয়া পেত না। বাস্তবতা ভীষণ কঠোর। জীবনে সবারই কিছু না কিছুর কমতি রয়েছে, কিছু আফসোস, কিছু না পাওয়ার কষ্ট রয়েছে। তাই বলে জীবন তো আর থেমে নেই। জীবন চলছে, চলবে। আর সব না পাওয়া গুলো মেনে নিয়েই আমাদের সুখী হতে হবে, এটাই নিয়ম। মেহুলের জীবন ও সেই নিয়মে আবদ্ধ। সে তার তাকদিরকে মেনে নিয়েছে। যেখানে কারোর কোনো ক্ষমতা চলে না। আর যারা তাকদির বিশ্বাস করে, তাদের সবার জীবনের শেষটাই ভীষণ সুন্দর হয়; ঠিক মেহুলের মতো।

শেষটা সুন্দর শেষ পর্ব (সারপ্রাইজ পর্ব)