শেষটা সুন্দর শেষ পর্ব (সারপ্রাইজ পর্ব) 

শেষটা সুন্দর শেষ পর্ব (সারপ্রাইজ পর্ব) 
জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

হুট করেই গরমের ঠান্ডা লেগেছে সারাজের। বাচ্চা ছেলেটার বেহাল দশা। তাকে নিয়ে চিন্তায় অস্থির তার প্রিয়জনেরা। দু’দিন অপেক্ষা করেও ঠান্ডার কোনো অবসান না দেখে হসপিটালে ছুটল সবাই। রিতা, সাদরাজের সাথে মেহুল আর রাবীরও আছে। মেহুল আর রিতা সারাজকে নিয়ে ডাক্তারের কেবিনে প্রবেশ করে। ছোট্ট সারাজের চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। কেমন যেন নেতিয়ে পড়েছে বাচ্চাটা। এই নিয়ে দুই মায়ের চিন্তার শেষ নেই।

ডাক্তার ভালোভাবে সারাজকে দেখে বললেন, গরমের ঠান্ডা। গায়ের ঘাম শুকিয়ে এই ঠান্ডার উৎপত্তি। ছেলেটাকে কিছুদিন রেস্টে রাখতে হবে। আর তার সাথে নিয়ম মাফিক ঔষধগুলো খাওয়াতে হবে।
ডাক্তার দেখিয়ে তারা কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে। সাদরাজ আর রাবীর তখন বাইরেই ছিল, তাদের অপেক্ষায়। রিতা আর মেহুল তাদের কাছে গিয়ে সারাজের ব্যাপারেই কথা বলছিল। সারাজ এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছে। এই জায়গাটা নতুন তার কাছে। এই পরিবেশটা বেশ অন্যরকম ঠেকল তার।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সবার মাঝেই সে দাঁড়িয়ে ছিল। হুট করেই কী ভেবে গুটি গুটি পায়ে সামনে এগিয়ে যায়। কথার মাঝে ব্যাপারটা কেউ খেয়াল করে না। অনেকটা এগিয়ে বাচ্চা ছেলেটা থমকে দাঁড়ায়। পর্দা সরিয়ে ছোট্ট মুখটা এগিয়ে উঁকি দেয়। কী দেখে যেন সে সেদিকেই চেয়ে থাকে। মেহুল আচমকা তার পাশে সারাজকে না দেখে অস্থির হয়ে উঠে। পরে ভালো মতো সামনে তাকাতেই দেখে, বাচ্চাটা কার কেবিনে যেন উঁকি দিচ্ছে। ওকে পেছন দিয়ে দেখে মেহুল হেসে ফেলে। রিতার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে,

‘দেখ রিতা, তোর ছেলের কান্ড দেখ।’
সবাই মেহুলের ইশারা দেওয়া হাতের দিকে চাইল। তার সাথে তাল মিলিয়ে হাসল সবাই। বাচ্চাটা কেবিনের ভেতর কী এত দেখছে?
মেহুল তার দিকে এগিয়ে যায়। পেছনে দাঁড়িয়ে সেও সারাজের মতো ভেতরে উঁকি দেয়। বিশেষ কিছু দেখতে পারে না সে। সারাজের পাশে আস্তে করে বসে, প্রশ্ন করে,
‘ঐদিকে কী দেখছো, সোনা?’

ছেলেটা হকচকিয়ে ফিরে। পরে নিজেকে স্বাভাবিক করে, দুঃখি দুঃখি গলায় বলে,
‘মা, দেখো ঐ বাবুটা কত কাঁদছে। ওকে কেউ আদর করছে না কেন? ওর মা বাবা কোথায়, মা?’
মেহুল এতক্ষণে ব্যাপারটা খেয়াল করে। হ্যাঁ, কেবিনের একটা খালি বেডে তোয়ালে মোড়ানো একটা বাচ্চা গলা ছেড়ে কেঁদে যাচ্ছে। অথচ আশেপাশে তার কেউ নেই। কারোর কানেই কি বাচ্চাটার কান্না যাচ্ছে না? বাচ্চাটার মা বাবা কোথায়?

মেহুল কেবিনটা ভালো ভাবে খেয়াল করে দেখল। কিন্তু, কোথায় কেউ নেই। অদ্ভুত তো! মেহুল কেবিনের ভেতরে এগিয়ে যায়। তার পেছন পেছন সারাজও যায়। তাদের ভেতরে ঢুকতে দেখে বাকি সবাই ও কেবিনের দিকে আসে।
মেহুল বেডের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। দুগ্ধশিশুটা কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখ ভয়ংকর লাল করে ফেলেছে। তাও তার কান্না থামছে না। মেহুলের তাকে দেখে বড্ড মায়া হয়। সে সযত্নে কোলে তুলে দেয় বাচ্চাটাকে। তখন পেছন থেকে সারাজ তার ওড়নায় টান দেয়। মেহুল ঘুরে চাইতেই সে ফোকলা দাঁতে হেসে বলে,

‘নিচে নামাও, আমিও একটু দেখি।’
মেহুল মুচকি হেসে হাঁটু ভেঙে সারাজের সামনে বসে। সারাজ আপ্লুত চোখে বাচ্চাটাকে দেখে। এত ছোট শিশু সে আগে দেখেনি। এ যেন এক ছোট্ট পুতুল। সারাজ তার ছোট ছোট হাত এগিয়ে বাচ্চাটার চোখ মুখ মুছিয়ে দেয়। আদুরে গলায় বলে,

‘থাক পুতুল, আর কেঁদো না।’
মেহুল চমকে তাকায়। হেসে বলে,
‘ও পুতুল?’
সারাজ মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,
‘হ্যাঁ তো। দেখো, পুরো পুতুলের মতো ছোট্ট একটা শরীর। কেমন তুলতুলে নরম ওর হাত পা। আমার বাসায়ও ওর মতো একটা পুতুল আছে।’
ওর কথা শুনে মেহুল সহ বাকি সবাই হেসে ফেলে।

মেহুল হাসতে হাসতে আবার বাচ্চাটার দিকে তাকায়। সে এতক্ষণে খেয়াল করে বাচ্চাটা আর কাঁদছে না। ভেজা চোখে পিটপিট করে চেয়ে আছে। ঐ মিষ্টি, মায়াভরা ছোট্ট মুখটা দেখে মেহুলের হৃদয় যেন বড্ড ব্যথিত হয়। সে দু হাত তুলে বাচ্চাটাকে নিজের গালের সাথে মিশিয়ে নেয়। বাচ্চাটাও কেমন যেন আদর পেয়ে মেহুলের কোলে একদম মিশে গিয়েছে। রাবীর নিষ্পলক চেয়ে মেহুলকে দেখে। একটা ছোট্ট বাচ্চা পেলেই মেয়েটার হৃদয় যেন হুহু করে উঠে। পুরনো ঘা থেকে রক্ত ঝরে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

সেই সময়ই একজন নার্স ত্রস্ত পায়ে কেবিনে প্রবেশ করে। উত্তেজিত গলায় প্রশ্ন ছুড়ে,
‘আপনারা কি বাচ্চাটার পরিবারের কেউ?’
সবাই চমকে তাকায়। মেহুল কপালে গাঢ় ভাঁজ ফেলে বলে,
‘না। কিন্তু, বাচ্চাটার বাড়ির লোক কোথায়? ওর মা বাবা কোথায়?’
নার্সটি বিকৃত মুখে বিতৃষ্ণার সুরে বলল,

‘আর বলবেন না, জন্ম দিয়েই মা উধাও। এমন একটা দুধের শিশুকে রেখে কেউ কি পালিয়ে যায়, বলুন। আজকাল মানুষের দয়া মায়া বলতে কিছু নেই। কালই শিশুটার জন্ম। জন্মের দু ঘন্টা পর কেবিনে এসে দেখি, বাচ্চা আছে অথচ মা উধাও। হুলোস্থুল লাগে হসপিটালে। মা’কে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। আর না পাওয়া গিয়েছে বাচ্চাটার পরিবারের কাউকে। তাই এই ফুটফুটে বাচ্চাটা এভাবে অনাহারে অবহেলায় এখানে পড়ে আছে। পুলিশকে জানানো হয়েছে, এখন উনারা এসেই একটা সিদ্ধান্ত নিবেন। না জানি, বাচ্চাটার ভবিষ্যত কেমন হবে! বড়ো মায়া হচ্ছে বাচ্চাটাকে দেখে।’

মেহুলের বুকটা কেমন যেন করে উঠল। এমন একটা বাচ্চাকে কেউ ফেলে রেখে কী করে চলে যেতে পারে? এত নিষ্ঠুর মানুষ কী করে হতে পারে? সে বাচ্চাটাকে আরো বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়। রাবীরের দিকে চেয়ে বিনা দ্বিধায় বলে উঠে,
‘আমি এই বাচ্চাটাকে দত্তক নিতে চাই, রাবীর।’
রাবীর বিহ্বল, নির্বাক। এতদিন মেয়েটা নিজে থেকেই দত্তক নিতে চাইছিল না। রাবীর অনেকবার বললেও, সে রাজি হয়নি। তার কাছে তো সারাজ ছিল। কিন্তু, আজ হঠাৎ করেই মেয়েটার অভিব্যক্তি এভাবে বদলে গেল?
মেহুল পুনরায় অধৈর্য গলায় বলল,

‘কী হলো, আপনি কিছু বলছেন না কেন?’
রাবীর এগিয়ে গিয়ে বাচ্চাটার মুখ পানে চাইল। বাচ্চাটার চোখ বুজা। মেহুলের দিকে চেয়ে বলল,
‘আপনি কি নিশ্চিত, মেহুল?’
মেহুল ঢোক গিলে পরপর মাথা ঝাঁকাল। রাবীর তপ্ত শ্বাস ছাড়ল। নার্সের দিকে চেয়ে বলল,
‘বাচ্চাটাকে আমরা এডপ্ট নিব। আপনি ডক্টরের সাথে কথা বলুন।’
নার্স খুশি হয়ে মাথা হেলিয়ে বেরিয়ে গেল।

রিতা এসে মেহুলের কাঁধে হাত রাখে। মেহুল ভেজা স্বরে বলল,
‘আমি কি ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি, রিতা?’
রিতা ঠোঁট ছড়িয়ে হাসে। তাকে আশ্বস্ত দিয়ে বলল,
‘হ্যাঁ, অবশ্যই।’

দুই দিনের মধ্যেই সমস্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে বাচ্চাকে নিয়ে বাড়িতে আসে মেহুল আর রাবীর। আজ থেকে তারাই এই বাচ্চার আইনানুগ বাবা মা।
তারা বাড়িতে প্রবেশ করতেই, রাবীরের মা এগিয়ে এলেন। বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে বললেন,
‘সেই তো বাচ্চা দত্তক নিলে। তাহলে এই ছয় বছর এত অপেক্ষা করার কী দরকার ছিল?’
তার প্রশ্নের কোনো জবাব দেয়নি কেউ। তবে ভদ্রমহিলা দারুণ সুন্দর ভাবে বাচ্চাটাকে মেনে নিল। কোলে নিয়ে অনেক আদর করল। ভালোবাসায় ভরিয়ে দিল ছোট্ট শরীরটাকে। তারপর হেসে প্রশ্ন করলেন,

‘তা, বাবুর নাম কী রাখবে?’
‘পুতুল, ওর নাম পুতুল। আমার পুতুল।’
পেছন থেকে ছুটে এল সারাজ। খুশিতে হাত তালি দিতে দিতে বলল,
‘মা, ও আমার পুতুল।’

তার কর্মকান্ড দেখে সবাই হেসে ফেলল। রিতা এসে মেহুলের পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
‘মনে হচ্ছে, আমার ছেলের বউ চলে এসেছে।’
মেহুল চমকে তাকায় তার দিকে। পরে আবার সারাজ আর ছোট্ট পুতুলকে দেখে। হঠাৎই কী ভেবে যেন চকচক করে উঠে তার চোখ। সত্যিই কি, বাচ্চাটা তার সারাজের পুতুল?

শেষটা সুন্দর শেষ পর্ব

(কালকের সমাপ্তিতে অনেকের অনেক অভিযোগ ছিল। তাই আজকের এই সারপ্রাইজ পর্ব। আশা করছি এখন আর কোনো অভিযোগ নেই। আর একটা ব্যাপার, মেহুলের গানের বিষয়েও অনেকে বলেছেন। গল্পের কোনো এক পর্বতে বলা হয়েছিল, মেহুল শাশুড়ির খুশির জন্য গান ছেড়ে দিয়েছে। তাই এই বিষয়টা আমি আর উল্লেখ করিনি। এখন আরেকটা খুশির খবর দেই, আমার পরবর্তী গল্প আসবে সারাজ আর তার পুতুলকে নিয়ে। এখন বলুন, কে কে পড়তে চান তাদের? কমেন্টে জানাবেন অবশ্যই। আর হ্যাঁ, আজকের এই সারপ্রাইজটা কেমন লেগেছে🫣)

সমাপ্ত