শেষটা সুন্দর সিজন ২ পর্ব ২৯

শেষটা সুন্দর সিজন ২ পর্ব ২৯
জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

‘একটা কার্ড নিয়েও তোদের দুজনের ঝগড়া করতে হয়?’
‘মামনি, তুমি তোমার ছেলেকে বলো এখান থেকে যেতে। আমি যা বলব তাই হবে। এটাই আমার বিয়ের কার্ড, দ্যাট’স ফাইনাল।’

‘বিয়েটা তোর একার না, আমারও। সো, আমি যেটা পছন্দ করব সেটাই ফাইনাল হবে।’
ওদের এমন তর্ক বিতর্ক দেখে দোকানদারও বেজায় ক্ষিপ্ত। সেই এক ঘন্টা যাবত এরা এভাবে ঝগড়াই করছে। দুই মা দাঁড়িয়ে দেখছে আর ভাবছে, এই দুই টম এন্ড জেরি কী করে সংসার করবে? এদের তো কোনো কিছুতেই বনিবনা হয় না।
দোকানদার এবার কিছুটা উঁচু সুরে বলে উঠেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘আমি একটা বুদ্ধি দেই আপনাদের, দুই পক্ষ দুই ডিজাইনের কার্ড নেন। যার যার পছন্দ মতো। মেয়ে পক্ষ মেয়ের পছন্দের কার্ড নিবেন। আর ছেলে পক্ষ ছেলের পছন্দের। তাহলেই তো সব মিটমাট হয়ে যাচ্ছে।’
সারাজ নাকের পাটা ফুলিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বলল,

‘হ্যাঁ, এটাই হবে। এই পুতুল, তুই তোর পছন্দ মতো কার্ড নে। আমার বাড়িতে আমার পছন্দের কার্ড যাবে। আর যদি এখন একটাও তিড়িং বিড়িং করেছিস তবে কার্ড ছাড়াই বিয়ে হবে। আর এমনিতেও এখন অনলাইনেই ই-মেইল পাঠিয়ে ইনভাইট করা যায়। তোর কথা রাখতেই এসব। এখন আর কথা না বাড়িয়ে, চুপচাপ কার্ড পছন্দ করে বের হ এখান থেকে।’
পুতুল মুখ কালো করে মেহুলের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। মিনমিনিয়ে বলল,

‘আমার পছন্দের নিলে কী হয়?’
‘আহা, এমন করছিস কেন? দুইজনে দুইটা পছন্দ কর দুই বাড়ির জন্য, তাহলেই তো হচ্ছে।’
পুতুল তার হাতের বেগুনী কার্ডটা দোকানদারকে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘এটা মেয়ের বাড়ির কার্ড। বাকি সব ইনফরমেশন মায়ের কাছ থেকে নিয়ে নিন।’

বলে সে দোকানের বাইরে গিয়ে দাঁড়াল। মনে মনে মারাত্মক বীতঃস্পৃহ সে। সারাজের কাছে তার পছন্দ অপছন্দের কোনো দাম নেই? একটা কার্ড’ই তো নিজের পছন্দের নিতে চেয়েছিল, এটা আর এমন কী ব্যাপার। অথচ, লোকটা তার এই ক্ষুদ্র ইচ্ছাতেও সম্মতি জানায়নি। ভবিষ্যতে হয়তো এভাবে বড়ো কোনো ইচ্ছাও গ্রাহ্য করবে না।

‘আম্মু, তোমরা কি এখন বাসায় যাবে?’
রিতা একবার মোবাইলে সময় দেখে বলল,
‘কেবল তো সাত’টা বাজে। আর এখনও তো সব শপিং বাকিই রয়ে গিয়েছে। ভাবছি আজকে মেহেদীর শপিংটা সেরে ফেলব। আর তো বেশিদিন নেই। কাল বাদে পরশু’ই তো মেহেদী, তারপর হলুদ, তারপর দিন বিয়ে আর তার একদিন পর রিসিপশন। এই মেহুল, আমরা তো বাগদান বা এনগেজমেন্টের কোনো আয়োজন’ই করলাম না।’
মেহুল চমকে বলল,

‘হ্যাঁ, তাই তো। ঘরের ছেলে মেয়ের বিয়ে বলে কি এনগেজমেন্টের আয়োজন হবে না?’
‘কেন হবে না? অবশ্যই হবে। কালই হবে।’
সারাজ ঠোঁট জোড়ো করে জোরে নিশ্বাস ফেলে বলল,
‘কতকিছু করতে হয়, বলোতো? আমার তো এখনই ক্লান্ত লাগছে।’
‘তাহলে আর বিয়ে করার কী দরকার।’

নির্লিপ্ত সুরে বলল পুতুল। সারাজ শুনেই বুঝল, ইচ্ছে করে ত্যাড়া ত্যাড়া কথা বলছে। তাই তাকে পাত্তা না দিয়ে বলল,
‘আম্মু, আব্বু বলেছেন মিটিং শেষে নয়টার পর ফিরবেন। তাই এর আগে যা যা শপিং শেষ করো। আমি আছি।’
‘এই সারাজ, একটু তোর বাবাকেও কল দিয়ে দেখতো উনি কোথায় আছেন।’
‘কথা হয়েছে, মা। বাবা এলাকায় বেরিয়েছেন। উনারও ফিরতে লেইট হবে।’

‘যাক, আমরা তাহলে আজ স্বাধীন।’
সারাজ কপাল গুঁটিয়ে বলল,
‘উঁহু, একদমই না। তাড়াতাড়ি শপিং করবে। বেশি ঘুরে আমার মাথা খাবে না কিন্তু।’
‘এই, তুমি বাড়ি যাও তো। তোমাকে আমাদের আসতে হবে না।’
পুতুলের কথা শুনে ফিচেল হাসে সারাজ। তারপর ভ্রু উঁচিয়ে বলে,

‘কেন রে, আমি গেলে কি তোর শপিং এ ব্যাঘাত ঘটবে?’
পুতুল তার দিকে কিছুটা তেড়ে এসে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
‘খবরদার যদি শপিং গিয়ে আমার পছন্দে বাম হাত ঢুকিয়েছো। সাবধান করে দিচ্ছি কিন্তু।’
সারাজ হেসে বলল,

‘কেবল বাম হাত কেন, এই পুরো আস্ত আমিটাই ঢুকে যাব।’
পুতুল চোখ রাঙিয়ে বলল,
‘সারাজ ভাই।’
সারাজ হেসে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। এই মেয়ের এসব ঠুনকো রাগকে পাত্তা দেওয়ার সময় তার নেই।
মেহুল এসে পুতুলের হাত ধরে বলল,

‘এখন তো একটু থাম। আর দুদিন বাদে তোদের বিয়ে, অথচ এখনও তোরা একজন অন্যজনকে এক চুলও ছাড় দিচ্ছিস না। এরকম করলে কী করে হবে বলতো?’
‘আমাকে কেন বলছো? তোমাদের ঐ আদরের ছেলেকে বলতে পারো না কিছু?’
রিতা হেসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

‘আচ্ছা ঠিক আছে, ওকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে গুরুতর একটা শাস্তির ব্যবস্থা করব।’
পুতুল ততক্ষণাৎ হেসে বলে,
‘তা তো অবশ্যই। আর সেই শাস্তিটা আমিই দিব।’
‘আচ্ছা, দিস। এবার চল।’

‘মা, এই গাঢ় সবুজ রঙের জামদানীটা কী সুন্দর না?’
মেহুল শাড়িটা দেখে বলে,
‘হ্যাঁ, সুন্দর তো। তোর পছন্দ হয়েছে?’
‘ভীষণ।

‘কিন্তু, আমার পছন্দ হয়নি। এমন ক্যাটক্যাটে একটা সবুজ রং চোখে লাগে একদম। ঐ হালকা আকাশী রঙের শাড়িটা দেখতে পারিস।’
পুতুল তখন ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে উঠে,
‘মেহেদী প্রোগ্রামে সবাই এমন সবুজ রঙেরই শাড়ি পরে। ঐসব আকাশী ফাকাশী পরে না।’
‘এই কথা কোন বইয়ে লেখা আছে শুনি? সবুজ রং না পড়লে কি মেহেদী হবে না? অবশ্যই হবে। আরর ঐ আকাশী কালারটা তোর সাথে মানাবে। একবার গায়ে লাগিয়ে দেখ।’

সারাজের সাথে তাল মিলিয়ে তখন মেহুলও বলে উঠল,
‘সারাজ যখন এত করে বলছেই, তখন একবার গায়ের সাথে লাগিয়ে দেখ না।’
অনিচ্ছা শর্তেও শাড়িটা হাতে নিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল পুতুল। তারপর শাড়ির ভাঁজ খুলে মেলে ধরল গায়ে। নিজেকে আয়নায় ভালো ভাবে পরখ করে দেখল। না, খারাপ লাগছে না। তাও, তার মন বলছে ঐ সবুজ রংটা তাকে বেশি মানাত।

‘ভালোই লেগেছে, মা। চাইলে নিতে পারো।’
পুতুলের সম্মতি পেয়ে সারাজ খুশি হয়। দোকানদারকে বলে এটা প্যাক করে দিতে। তারপর সবার দিকে চেয়ে বলে,
‘তোমরা অন্য দোকানে যাও। আমি পেমেন্ট করে ব্যাগ নিয়ে আসছি।’

পুতুল, মেহুল আর রিতা বেরিয়ে যায় এবার এনগেজমেন্টের জন্য আংটি দেখার উদ্দেশ্যে।
পুতুল এবার আগে বাগেই মায়ের কানের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
‘আংটি আমার পছন্দের কিনবে। খবরদার এবার যদি আর সারাজ ভাইকে সাপোর্ট করেছো।’
মেহুল জবাবে কেবল দুই দিকে মাথা নাড়ায়।

একটার পর একটা আংটি দেখিয়েই যাচ্ছে, তবে কোনোটাই পুতুল বা সারাজের পছন্দ হচ্ছে না। এত বড়ো বড়ো আংটি পুতুল কখনোই পরবে না। সে তো চাচ্ছে, সিম্পলের মধ্যে কিছু। হঠাৎ একটা আংটিতে চোখ পড়ে পুতুলের। বলে উঠে,
‘ঐটা দেখান তো।’
তার সাথে আরেকজন ও একই কথা বলে। পুতুল চেয়ে দেখে সারাজ ও দোকানদারকে ঐ আংটিটাই দেখাতে বলছে। মনে মনে স্বস্তি পায় সে। যাক, অন্তত আংটি’টা তো নিজের পছন্দের নিতে পারবে।

মোটামুটি এনগেজমেন্ট আর মেহেদী প্রোগ্রামের জন্য সব কেনাকাটা শেষ তাদের। সারাজের মাথা ব্যথা উঠেছে। এই মহিলা গুষ্ঠির সাথে শপিং এ আসা, আর যেচে পড়ে পাগল হওয়া একই কথা। এই কয়েক ঘন্টাতেই মাথা খারাপ করে দিয়েছে তার। এই সামান্য কয়টা জিনিস কিনতে না হলেও পুরো শপিং মল সাতবার চক্কর লাগিয়েছে তারা। সেই চক্করে চক্করে এখনও মাথা চক্কর খাচ্ছে তার।

সবগুলো শপিং ব্যাগ গাড়ির পেছনে রেখে সারাজ বলে উঠল,
‘চলো, আগে একটু কোথাও গিয়ে চা খেয়ে আসি। আমার খুব মাথা ধরেছে।’
সবাই সম্মতি দিল। পুতুল তো রীতিমত নেচে নেচে বলল,
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। চলো।’

বাসায় ফিরতে সকলের দশটার উপরে বেজে যায়। পুতুল আর মেহুলকে নামিয়ে দিয়ে সারাজও মা’কে নিয়ে তার বাসায় ফিরে গিয়েছে। তবে, বাসায় ফিরেই চমকে যায় পুতুল আর মেহুল। বসার ঘর পুরো ভরে গিয়েছে জিনিসপত্রে। পুতুল তার হাতের ব্যাগ গুলো রাখতে রাখতে বলল,
‘এগুলো কে করল, মা?’
মেহুল কোমরে হাত দিয়ে বলল,

‘নির্ঘাত তোর বাবার কাছ। উনাকে বলেছিলাম, আমাকে না জানিয়ে কিছু কিনবেন না। অথচ দেখ, আমাকে না বলে পুরো শপিং মলটাই তুলে নিয়ে এসেছেন। এই লোকটাকে নিয়ে যে আমি কী করি। তুই এক কাজ কর, এখন যা কেনা হয়েছে এগুলো তোর রুমে নিয়ে রাখ। আর এখানের জিনিসগুলো আমি গুছিয়ে নিচ্ছি।’
মায়ের কথা মতো পুতুল ব্যাগগুলো হাতে নিয়ে ক্লান্ত ভঙিতে নিজের রুমে ছুটল। আজ বেশি হেঁটে ফেলেছে হয়তো, পাগুলো কেমন যেন ঝিমঝিম করছে।

ব্যাগগুলো বিছানায় রাখতে নিলে অসাবধানতায় শাড়ির ব্যাগটা নিচে পড়ে যায়। সেটা তুলতে গিয়ে আরেকদফা চমকাল পুতুল। ভুল শাড়ি চলে এসেছে না-কি? এটা তো সেই সবুজ জামদানীটা। কিন্তু সে তো পরে আকাশীটাই দিতে বলেছিল। তবে এটা এখানে এল কী করে? তখনই একটা ছোট্ট কাগজে নজর পড়ল তার। শাড়ির প্যাকেটেই রাখা। খুলে দেখল সেখানে লেখা,

শেষটা সুন্দর সিজন ২ পর্ব ২৮

‘আমি ব্যতিত তোর পছন্দের সবকিছু মাত্রাধিক জঘন্য। তাও শাড়িটা কিনে দিলাম, যেন গাল ফুলিয়ে না থাকিস। খবরদার, এই শাড়ি পরে আমার সামনে আসবি না। বলা যায় না, বমি টমিও হয়ে যেতে পারে আমার।’
লেখা পড়ে পুতুল আনন্দ পাবে না-কি কষ্ট, সেটা নিয়েই সে এখন বিরাট কনফিউজড।

শেষটা সুন্দর সিজন ২ পর্ব ৩০