শেষটা সুন্দর সিজন ২ পর্ব ৩৩

শেষটা সুন্দর সিজন ২ পর্ব ৩৩
জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

একটি রৌদ্রদগ্ধ নিরুপম সকাল। চারদিক ঝলমল করছে সেই দিবাকরের আলোতে। একছটা আলোক রশ্মি মুখের উপর আপতিত হতেই ঘুম ছুটে যায় পুতুলের। পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। মন্থর গতিতে উঠে বসে। তারপর আনমনে মেহেদী রাঙা হাতগুলো ধরে চোখের সম্মুখে। মুচকি হাসি ফোটে অধর কোণে।

হাতের পিঠে সারাজের লেখা, “সারাজের ছোট্ট পুতুল” বাক্যখানা জ্বলজ্বল করছে। পুরো হাতে রংচটা মেহেদী। বাহ, চমৎকার রং হয়েছে। হাত দুখানা বক্ষঃস্থলে চেপে ধরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল পুতুল। অবশেষে এই হাত সারাজের মেহেদীর রঙে মজেছে। অবশেষে, দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে সারাজ ভাই তার হতে যাচ্ছে। নিজেকে যেন আজ পৃথিবীর সবথেকে সুখী মানুষ বলে মনে হচ্ছে তার।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ফ্রেশ হয়ে এসে দরজার বাইরে উঁকি দিল পুতুল। নিচ থেকে হৈ চৈ শোনা যাচ্ছে। মেহুলের গলাও স্পষ্ট। কাকে যেন খুব জোরে বকছে সে। পুতুল পা টিপে টিপে সিঁড়ির মাথায় দাঁড়ায়। একবার নিচে চোখ বুলায়। মেহুলকে দেখতে পায়, তার সম্মুখেই নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাদের বাড়ির এক ভৃত্য। নির্ঘাত কিছু একটা করেছে ঐ ভদ্রমহিলা। নয়তো মা এত রাগতেন না। সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামল পুতুল। মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘কী হয়েছে, মা?’
মেহুল ক্ষুব্ধ গলায় বলল,
‘আর বলিস না, খালাকে বললাম আমি উপরে যাচ্ছি তুমি পায়েসটা একটু দেখো। ওমা, উনি নাচতে নাচতে বাইরে চলে গেলেন। এইদিকে আমার এক পাতিল পায়েস পু ড়ে ছাই। এতগুলো দুধ বাদাম দিয়ে পায়েসটা বানিয়ে ছিলাম। সবটা পু ড়ে ছাই। বলতো, কেমন লাগে?’

ভৃত্য ভয়ে ভয়ে মাথা তুলে বলল,
‘আমাকে ক্ষমা করে দেন, খালা।’
পুতুল বলল,

‘থাক না, মা। উনি হয়তো বুঝেননি। থাক আর রাগ করো না। খালা, যান আপনি। চিন্তা করবেন না, বিয়ের সবকিছু মা একা হাতে সামলাচ্ছেন তো, তাই মাথাটা একটু গরম। আপনি মন খারাপ করবেন না। যান আপনি, অন্য কাজে যান।’
খালা ভীত চোখে তাকিয়ে সেই জায়গা থেকে বিদায় হলো। মেহুল গরম চোখে পুতুলের দিকে চেয়ে বলল,
‘আমার মাথা গরম হয়ে আছে?’

পুতুল হেসে বলে,
‘হ্যাঁ মা, তোমার মাথা বর্তমানে মারাত্মক গরম হয়ে আছে। খুব চাপ পড়ে গিয়েছে তাই না? আমার নানা-নানু, দাদা-দাদু কেউ’ই নেই। আজ নানু বা দাদু থাকলেও তোমার একটু হলেও চাপ কমতো।’
মেহুল মলিন হেসে পুতুলের মাথায় হাত রেখে বলল,
‘থাক, এসব নিয়ে আর ভাবিস না। মেয়ের বিয়েতে মা একটু ব্যস্ত থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তুই এসব না ভেবে নাস্তা করতে বস। তারপর আবার অনেক কাজ বাকি। এখন তাড়াতাড়ি গিয়ে ডাইনিং-এ বস, আমি নাস্তা আনছি।’

পুতুল নাস্তা খেতে খেতে বলল,
‘মা, সবাইকে কার্ড পাঠানো শেষ?’
‘হ্যাঁ, কালকেই সব হয়ে গিয়েছে। আমার আর তোর বাবার পরিবারের তো তেমন কেউ নেই। যারা আছে সব গ্রামে, সবাই নাকি কালকে আসবেন। আর শহরে যারা আছেন সব সাদরাজ ভাই আর তোর বাবার পরিচিত লোকেরা। উনারাও সবাই কালকেই আসবেন।’

পুতুল হঠাৎ মন খারাপ করে বলল,
‘তো, আজকে আমার হলুদে কেউ আসবে না?’
‘কে বলেছে আসবে না? এই যে আমরা এসেছি।’
গলার স্বর পেয়ে দরজার দিকে চেয়ে দেখে লীনা সহ তার ক্লাসের আরো অনেকেই। তাদের দেখেই খুশিতে ঝলমলিয়ে উঠল পুতুল। মেহুল হেসে বলল,

‘এবার খুশি তো?’
পুতুল মাথা নাড়িয়ে “হ্যাঁ” বোঝাল। কোনোরকমে খেয়ে উঠে গেল বন্ধুদের কাছে। এই ছেলে মেয়েগুলোর সাথে ক্লাসে সে সবথেকে বেশি মিশে। ওরা যে আজ আসবে পুতুল সেটা চিন্তাও করেনি। ভেবেছিল হয়তো কেবল বিয়েতেই আসবে। যদিও সে লীনাকে বারবার বলেছিল, কার্ডের সাথে ওদের সবাইকে বিশেষ ভাবে হলুদের দাওয়াতটাও দেওয়ার জন্য। অন্তত, ওরা সবাই থাকলে তো হলুদটা আর একঘেয়ে হবে না।

মেয়েরা সব পুতুলকে নিয়ে ছাদে গেল। পুতুলের গায়ে জড়ানো কাঁচা হলুদ রঙের শাড়ি। মুখে কোনো প্রসাধনীর ছিটে ফোঁটাও নেই। তাও এই রোদ ঝলমলে আলোতে স্নিগ্ধ লাগছে তাকে। ছাদে পুতুলের গোসলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। হলুদ মাখিয়ে গোসল করানো হবে তাকে। মেহুল হলুদের ডালা নিয়ে উপরে আসতেই সব যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ল হলুদ নিতে। মেহুল ডালা পেছন দিকে নিয়ে বলল,

‘দাঁড়াও দাঁড়াও, আগে আমরা একটু হলুদ ছোঁয়ায়। তারপর তোমরা যা খুশি করো।’
মেহুলের পেছন পেছন রাবীরও ছাদে এসে হাজির হয়। দুজনে গিয়ে খুব যত্ন করে মেহুলের গাল, কপাল আর হাতে হলুদ মাখাল। মেয়েকে হলুদ মাখিয়ে উঠে দাঁড়াল রাবীর। বাটি থেকে আরেকটু হলুদ নিয়ে এক সাইডে সরে পড়ল। মেহুল উঠে আসতেই মেহুলের সব বন্ধুরা হুমড়ি খেয়ে পড়ল যেন।

একজন অন্যজনকে হলুদ দিয়ে একেবারে হুলোস্থুল কান্ড বাঁধিয়ে দিয়েছে। পুতুলকে তো ইতিমধ্যেই হদুল দিয়ে ভূত বানানো শেষ। মেহুল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য তৃপ্তি ভরে দেখছে আর হাসছে। আচমকা সেই মুহূর্তে আঁচলে টান পেতেই ফিরে তাকায় সে। রাবীরের হাতের মুঠোয় তার শাড়ির আঁচল দেখে চোখ পাকায়। ইশারায় বলে, বাচ্চারা দেখবে। রাবীর সেসব তোয়াক্কা না করে মৃদু আওয়াজে বলে,

‘ওপাশে চলুন।’
মেহুল ভ্রু কুঁচকে একই সুরে বলে উঠে,
‘মাথা খারাপ হয়েছে আপনার? এতগুলো বাচ্চার সামনে কী শুরু করে দিয়েছেন?’
‘ওদের সামনে কিছু শুরু করতে চাইছি না বলেই তো, ওপাশে যেতে বলছি। চলুন।’
বলে রাবীর আগে পা বাড়াল। নিঃস্পৃহ ভঙিতে মেহুলকেও যেতে হলো সেদিকে।

‘কী হয়েছে আপনার?’
রাবীর মুচকি হেসে মেহুলের কাছে এসে দাঁড়ায়। মেহুল তখন সতর্ক দৃষ্টিতে আশপাশটা একটু পরখ করে দেখে নেয় কেউ আছে কি-না। অতঃপর রাবীরের দিকে চেয়ে বলে,

‘এই বয়সে এসেও শুধরালেন না আপনি? এতগুলোর বাচ্চার সামনে কী শুরু করেছেন, বলুনতো?’
জবাবে রাবীর কিছুই বলল না। একরাশ মৌনতা নিয়ে দুহাতের হলুদ সমস্তটা ঘষে লাগিয়ে দিল মেহুলের গালে। মেহুল হতভম্ব। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে রাবীরের দিকে। রাবীরের ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিৎ হাস্যরেখা। কপাল কুঁচকে ফেলে মেহুল। কিছুটা এগিয়ে এসে পা দুটো অল্প উঁচু করে রাবীরের গালে নিজের হলুদ ভর্তি গালটা ঘষে দেয়। রাবীর হেসে ফেলে। রগড় সুরে বলে উঠে,

‘আপনিও তো আগের মতোই দুষ্টু’ই রয়ে গেছেন, মেহুল।’
মেহুল কিঞ্চিৎ হেসে বলে,
‘তা অবশ্য ঠিক। বয়স বাড়লেও আমাদের ভালোবাসা তো আর কমে যায়নি। মনে হয়, এই তো সেদিন আপনার আমার বিয়ে, আমার অভিমান আর আপনার একচ্ছত্র ভালোবাসা।

তারপর আমার অপূর্ণতা পূর্ণ করে দেওয়ার জন্য ছোট্ট পুতুলের আগমন, সবকিছুই কত দ্রুত হয়ে গিয়েছে তাই না? এখনও চোখ নিমীলিত করলে সেসব দৃশ্য অক্ষিপটে ভেসে ওঠে। অথচ আমাদের সেই ছোট্ট পুতুল আজ কত বড়ো হয়ে গিয়েছে। তার আজ বিয়ে। আমাদের ছেড়ে অন্য ঘরে চলে যাবে। আমরা ওকে ছাড়া কীভাবে থাকব, বলুনতো?’

চোখ জোড়া ভিজে উঠে সঙ্গে সঙ্গে। রাবীর আলতো করে জড়িয়ে ধরে মেহুল। মাথায় অধর ছুঁইয়ে নরম গলায় বলে,
‘দূরে কোথাও যাচ্ছে না তো। এক মা ছেড়ে আরেক মায়ের কাছে যাচ্ছে। আর আমি জানি, সেখানে পুতুল ভালো থাকবে। আমার ছেলের উপর আমার ভরসা আছে, ও আমাদের পুতুলকে ভালো রাখবে মেহুল। চিন্তা করবেন না।’
মেহুল চোখ বোজে নিশ্বাস ফেলল। পুতুলকে ছাড়া আগামী দিনগুলো যে বড্ড পো ড়াবে তাকে।

সন্ধ্যা পড়তেই মন্ত্রী বাড়ি ঝলমলিয়ে উঠে হরেক রকম রঙিন আলোতে। পুরো গেইট থেকে বাগান অবধি চারদিকে নিদারুণ আলোকসজ্জা আর ফুলের সমারোহ। ইভেন্টের লোকেরা চমৎকার সাজিয়েছে, এই নিয়ে কারোর সন্দেহ নেই। এর মধ্যেই আস্তে ধীরে মানুষের আগমন শুরু হলো। মন্ত্রীর মেয়ের বিয়ে বলে কথা, বাড়ির আশেপাশের কোনো প্রতিবেশী দাওয়াত পাওয়া থেকে বাদ যায়নি।

পুতুলের হলুদের স্টেজ ছাদে করা হয়েছে। হলুদ রঙের ঝমকালো লেহেঙ্গায় অপ্সরী লাগছে তাকে। কানে গলায় স্থান পেয়েছে শুভ্র ফুল। ওষ্ঠ রাঙিয়েছে লাল রঞ্জকে। বরাবরের মতোই আজও পুতুলকে লীনাই সাজিয়েছে। মেয়েকে এত বলেও কেউ পার্লারে পাঠাতে পারেনি। তার একমাত্র বিউটিশিয়ান লীনা।

লীনা ব্যতিত আর কারোর কাছেই সাজবে না সে।
লীনা সহ বাকি সব বন্ধু বান্ধবরা হলুদ শাড়ি আর পাঞ্জাবীতে সেজেছে। সবাইকেই নিঁখুত সুন্দর লাগছে। পুতুলের সাজ শেষ হতেই মেহুল তার রুমে এল। তাদের সবাইকে তাড়া দিয়ে বলল,
‘এই, তোদের হয়েছে? জলদি পুতুলকে নিয়ে ছাদে আয়।’
পুতুল উঠে দাঁড়াল। লীনাকে বলল,
‘চল তাহলে।’

হলুদের মাঝপথেই শোনা গেল, নিচে নাকি বর এসেছে। এই নিয়ে হৈচৈ বেঁধেছে চারদিকে। সেই কথা পুতুলের কর্ণগোচর হতেই সে লজ্জা আর অস্বস্তিতে মজে যায়। ইশ, আজ তো সারাজের আসার কথা ছিল না। তবে কেন এল? তাকে হলুদ দিতে? নিদারুণ ব্রীড়ায় রক্তিম হয়ে উঠে পুতুলের নাক আর নরম গালযুগল।

পুতুলকে রেখেই নিচে ছুটল সবাই। একাই বসে আছে পুতুল। আশেপাশে যারা আছে তারা সবাই প্রতিবেশী। তাদের সে খুব একটা চেনে না। তাই উঠে দাঁড়িয়ে ছাদের একপাশে গিয়ে দাঁড়ায় সে। একটু আঁড়ালে দাঁড়িয়ে নিচে তাকায়। ঐ তো সারাজের গাড়িটা দেখা যাচ্ছে। আরো একবার সে লজ্জায় লাল হয়। ফিরে আসতে নিয়েও হঠাৎ থামল কী ভেবে।

তার ঠিক অল্প কিছু দূরত্বেই দুজন মহিলা দাঁড়ান। দুজনেই পুতুলের দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়েছেন। কিছু একটা নিয়ে কথা বলছেন তারা। সেই কথার সুর’ই অকস্মাৎ পুতুলের কানে আটকেছে। সেখানের একজন মহিলা অন্যজনকে বলছিলেন,
‘শুনেছি, এই মেয়ে নাকি মন্ত্রী সাহেবের আসল মেয়ে না। হসপিটাল থেকে পেয়েছিল নাকি। অথচ দেখ, আজ সেই মেয়েরই কী ধুমধাম করে বিয়ে দিচ্ছেন। না জানি কোন মায়ের সন্তান, কপাল করে জন্মেছে বটে। নয়তো এমন পালিত মেয়ে কি আর এত ভালোবাসা পায়?’

মুহুর্তেই মাথা ঘুরে উঠল পুতুলের। হঠাৎ চোখে অন্ধকার দেখছে যেন। হাত পা ঠকঠক করে কাঁপছে। অকস্মাৎ এসব হচ্ছে কেন তার সাথে? বক্ষঃস্থল এভাবে কাঁপছে কেন? মনে হচ্ছে নিশ্বাস ফেলতে পারছে না। এত কষ্ট কেন হচ্ছে? একটু আগেও তো সব ঠিক ছিল।

শেষটা সুন্দর সিজন ২ পর্ব ৩২

এখন এখন…. এসব কিছু মিথ্যে। সে তার মা বাবার’ই সন্তান। মেহুলের সন্তান। উনারা মিথ্যে বলছেন মিথ্যে। দিক বেদিক না দেখে ছুটে নিচে নামতে লাগল পুতুল। মনে মনে এক কথাই আওড়াতে লাগল, “আমিই আমার মা বাবার আসল সন্তান। আমাকে হসপিটাল থেকে পেয়ে আনেনি। আমিই উনাদের আসল সন্তান, আমিই।”

শেষটা সুন্দর সিজন ২ পর্ব ৩৪