শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ২৬

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ২৬
নূরজাহান আক্তার আলো

আজ প্রায়’ই দু’দিন হলো আহনাফের সঙ্গে কোনোভাবে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। ফোন বন্ধ। মাঝে মাঝে কল ঢুকলেও কল রিসিভ করছে না সে। আর না নিজের অবস্থানের কথা জানাচ্ছে। একমাত্র ছেলের খোঁজ নিতে না পেরে আহনাফের বাবা-মা অস্থির হয়ে উঠেছে। পরিচিত যাদের জানে/চিনে তাদের থেকেও খোঁজ পান নি তারা। অগত্যা ভেবেই নিয়েছে
শখের সাথে বোধহয় কিছু হয়েছে।নয়তো বলা নেই, কওয়া নেই, এভাবে
যোগাযোগ বন্ধ করার কারণ কি? এসব ভেবেই উনারা রওনা দিয়েছেন
চৌধুরী বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে। সরাসরি কথা বলা দরকার।

ছোট ছোট সমস্যাগুলোই একটা সময় বিরাট আকার ধারণ করে। মোটকথা, মাত্রই কদিন হলো ওদের এনগেজমেন্ট হয়েছে, এরমধ্যে কি এমন হলো যে সে যোগাযোগ করা বন্ধ করে দিলো। কই আহনাফ তো এতদিন এমন কিছু করে নি। হ্যাঁ বহুবার রাগ করেছে কিন্তু এভাবে একেবারেই লাপাত্তা হয়ে যায় নি। অর্থাৎ বুঝতে হবে ঘটনা অন্যকিছু। তবে অন্যকিছুটা কি গিয়েই নাহয় জানা যাবে।
এদিকে এতকিছু ঘটে যাচ্ছে অথচ শখ কিছুই জানে না। জানবে কিভাবে
রুমে ফোন রেখে ভাই-বোনদের সঙ্গে বাগানে এসেছে সে।শশুড়-শাশুড়ি ননদ একের পর এক কল করেই যাচ্ছে ক্ষুণাক্ষরেও টের পায় নি। ফোন সাইলেন্ট থাকায় আশেপাশের কারোর কানে পৌঁছায় নি ফোনের টোন।
দুপুরে খেয়ে বই পড়তে পড়তেই ঘুমিয়েছিল একটু। বিকেলে ফ্রেশ হয়ে একটা বই হাতে নিতেই সাম্য, সৃজন টেনে বাগানে এনেছে। শীতল নাকি ডাকছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এসে দেখে শীতল গাছে উঠে বসে আছে৷ স্বর্ণও ঘাসের উপর বসে আছে। দেখে মনে হচ্ছে তাকেও জোর করে ঘুম থেকে টেনে তোলা হয়েছে। শখ স্বর্ণের দিকে একবার তাকিয়ে উপরে তাকাল। শীতল মগ ডালে বসে পা দুলাতে দুলাতে পেঁয়ারা খাচ্ছিল। ওড়না কোমরে পেঁচিয়ে রাখা। শখ তাকে দেখে নিজেও ঘাসের উপর বসল। শীতল তখন চারটা পেঁয়ারা ছুঁড়ে দিলো ভাইবোনের দিকে। সাম্য, সৃজন, শখ, স্বর্ণও কামড় বসাল ডাসা ডাসা পেয়ারায়। লাল পেয়ারা। খেতে খুবই মজা। পেয়ারায় কামড় বসিয়ে কিছু একটা ভেবে শীতল শখকে ডাকল,
-‘আপু?’
-‘হুম।’
-‘তোমার হবু শশুড়ের এন্টিনায় সমস্যা আছে নাকি?’
ছোটো বোনের মুখে হবু শশুড়ের নামে একথা শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল শখ। পেয়ারা চিবানো থামিয়ে চোখ তুলে তাকাল দাঁত বের হাসা শীতলের দিকে। বোনকে তাকাতে দেখে শীতল সাহস পেল। সে বুকভরে দীর্ঘশ্বাস টেনে বলল,

-‘আমার মনে হয় সমস্যা আছে।’
-‘ ছিঃ! ছিঃ! এসব কি বলছিস শীতল! এসব বলতে নেই।’
-‘তুমিই বলো সমস্যা না থাকলে ভাইয়ার একটা ছোটো ভাই ডাউনলোড করল না কেন? করলে তোমার সাথে আমিও ওই বাড়িতে আস্তানা গেড়ে বসতে পারতাম।’
শখ বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। এই পাঁজিটা কিসব বলে? বোনের মুখ দেখে শীতলের পেট ফেটে হাসি পেল। কিন্তু হাসল না। বরং শখকে আর একটু ভড়কে দিতে বলল,
-‘তোমার শশুড়কে ফোন দিয়ে বলো তো আরেকটা ছেলে ডাউনলোড দিতে। কাজকর্ম যা করার এখন থেকেই শুরু করতে বলো। কানা, বোঁচা যেমনই হোক ছেলে হলেই হবে। দাও, দাও, এক্ষুণি ফোন দাও। এমনিতে অনেক দেরি হয়েছে তাছাড়া শুভ কাজে দেরি করতে নেই।’
একথা বলে শীতল থামতেই সাম্য গেটের দিকে উঁকিঝুঁকি মেরে একটা সাদা গাড়ি বাড়ির মধ্যে আসছে দেখে বলল,

-‘শীতল আপু গাছ থেকে নামো। শুদ্ধ ভাই কিন্তু বাসাতেই আছে। তোমার জন্য আমাদেরকেও না পানিশমেন্ট পেতে হয়।’
-‘এ্যাই! এ্যাই বে’য়া’দ’ব আমি তোর শুদ্ধ ভাইকে ভয় পাই? জানিস, তোর পিয়ারের শুদ্ধ ভাই আমাকে ভয় পায়, এই আমাকে, এই শীতলকে ভয় পায় ওই শোয়াইব শুদ্ধ ভাই।’
-‘যাহ্! ঢপ মারার আর জায়গা পাও না?’
-‘আমি ঢপ মারছি? আমি? প্রমাণ দিবো দেখবি?’
-‘হুম দেখব।’
-‘ঠিক আছে। আগামী লাল শুক্রবারেই প্রমাণ দেবো তখনই মিলিয়ে নিস
আমার কথা। এই শীতল মিথ্যা বলে না রে পাগলা, বলে না।’
-‘ঠিক আছে।’
শখকে পঁচিয়ে শীতল এবার স্বর্ণকে বলল,
-‘আপু, তিন রাস্তার মোড়ে বড় একটা কসমেটিকের দোকান আছে না?
ওই দোকানের মালিকের ছেলেটার নাম রিহান। সে তোমাকে খুব পছন্দ করে। কিন্তু ভয়ে বলতে পারে না। সে আমাকে দু’ডজন চুড়ি ঘুষ দিয়েছে তোমাকে কথাটা জানানোর জন্য।’

-‘ওহ।’
-‘সে আরো বলেছে আমি তাকে দুলাভাই ডাকলে আরো অনেক কিছু দিবে।’
-‘ডেকেছিস?’
-‘না।’
-‘কেন?’
-‘তুমি পারমিশন দিলে ডাকব।’
-‘দুলাভাই হিসেবে তাকে পছন্দ হয়েছে?’
-‘না।’
-‘কেন?’
-‘ব্যাটার দাঁত হলুদ। দেখলে মনে হয় বারো মাস জন্ডিসে ভুগে। আহনাফ ভাইয়ের মতো স্মার্ট না। কিন্তু আমার মতো কিউট মেয়ের দুলাভাই হতে হবে স্মার্ট, হ্যান্ডসাম, চকলেট বয় টাইপ। নয়তো সমাজে মুখ দেখানোর উপায় থাকবে না।’
-‘তাহলে কি ক্যান্সেল?’
-‘হুম।’
-‘তাহলে চুরিগুলো ফেরত দিয়ে বলে দিস আগে দাঁতের চিকিৎসা করতে তারপর তোকে শালি বানানোর চিন্তা করতে।’
-‘ওকে।’

এভাবে কথায় কথায় গল্পে গল্পে ভাই-বোনরা মিলে দুষ্টুমি করতে লাগল।
তখন সেখানে নিঃশব্দে শুদ্ধ উপস্থিত হলো। তাকে দেখামাত্র সবাই চুপ।
শীতল পাতার আড়ালে নিজেকে লুকানোর চেষ্টায়। শুদ্ধ সব ক’টার মুখ দেখে জানাল আহনাফের বাবা মা এসেছে। ভদ্রভাবে সবাই গিয়ে যেন দেখা করে, কথা বলে। অহেতুক হি হি করলে একেক টাকে মেরে গাছে ঝুলিয়ে রাখবে। ভাইয়ের কথা শুনে স্বর্ণ, শখ, সাম্য, সৃজন ভদ্র বাচ্চার মতো ধীরে সুস্থে হেঁটে বাড়ির দিকে গেল। এবার শুদ্ধ মুখ তুলে তাকাল পাতার আড়ালে থাকা শীতলের দিকে। বুঝতে বাকি নেই সে ধরা পড়ে গেছে। তাই শীতল বোকা বোকা হাসল। হেসে হেসে বলল,
-‘কতদিন পর আপনাকে দেখলাম শুদ্ধ ভাই। এত শুকিয়ে গেছেন কেন?’
-‘মেয়েদের সাথে উড়াউড়ি করা চারটেখানি কথা না, তাই না?’
-‘হে, হে, কথাটা চেনা চেনা লাগছে। কোথায় যেন শুনেছিলাম। তা কেমন চলছে আপনার উড়াউড়ি?’
-‘ভালোই।’
-‘দোয়া করি যেন ভালোই যায়।’
-‘হুম।’

একথা বলতে বলতে শুদ্ধ বাগানের এক কোণে কেটে রাখা বরই গাছের বড় বড় দুটো ডাল টেনে এনে রাখল পেয়ারা গাছের গোড়ায়। শুকনো ডাল কাঁটায় ভরে আছে৷ তাকে গাছের গোড়ায় ডাল রাখতে দেখে এবার শীতল আর্তনাদ করে উঠল,
-‘এ কি করলেন শুদ্ধ ভাই?’
-‘কি করলাম?’
-‘গাছের নিচে কাঁটা রাখলেন কেন? নামব কিভাবে আমি?’
-‘তুই কি করে নামবি আমি কি জানি?’
-‘কাঁটা সরান।’
-‘পারব না। আর নেমে কি করবি? মগডালে বসে বসে কার এন্টিনায় কি সমস্যা হিসাব কর। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। নিরিবিলি স্থান। একটুপরেই
তেনারাও সঙ্গ দিতে আসবে। ভাব, ভাব, মন দিয়ে ভাব, আমি আসছি।’
একেতে গাছের নিচে বরইয়ের কাঁটা দিয়ে রাখল তার উপরে ভূতের ভয় দেখাচ্ছে। ভীষণ রাগ হলো শীতলের। সে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,

-‘আমি কি আপনার এন্টিনার কথা বলেছি নাকি? বলেছি শখ আপুর শশুড়ের…!’
-‘আমারটার কথা বলিস নি বলেই এখনো শ্বাস নিতে পারছিস। বললে আজই জানাযা সম্পূর্ন করতাম।’
-‘কাঁটা সরান শুদ্ধ ভাই। সত্যি বলছি আপনাকে বলি নি। আর আমি যা বলি শুনে নেন কিভাবে? এমন খরগোশমার্কা কান হলে তো সমস্যা।’
-‘আমার কান খরগোশমার্কা?’
-‘হুম। না, না, আমি তা বলি নি।’
শুদ্ধ ঠান্ডা দৃষ্টিতে শীতলের দিকে তাকিয়ে আরো দুটো বরইয়ের ডাল এনে গাছের আশেপাশে বিছিয়ে রাখল। যাতে লাফ দিয়েও নামতে না পারে। এরপর কোনোদিকে না তাকিয়ে চলে গেল বাড়ির দিকে। আর বেচারা শীতল চেঁচিয়ে বলতেই থাকল,
-‘যাবেন না শুদ্ধ ভাই। নাক ছুঁয়ে বলছি আর কোনোদিন গাছে উঠব না।
দয়া করে কাঁটা সরিয়ে যান। শুদ্ধ ভাই! ও ভাই! ভাই রে! এ কে কোথায় আছিস নামা আমাকে। বাঁচা রে!’

সায়ন একঘন্টা আগে বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে শুয়েছিল। ঘুমানোর ইচ্ছে না থাকলেও এপাশ-ওপাশ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। এটুকু সময়ে একটা স্বপ্নও দেখেছে স্বর্ণকে নিয়ে। তাদের বিয়ের স্বপ্ন। স্বর্ণ কী সুন্দর করে সেজেছে। নীল শাড়ি পড়েছে। শীতল আর শখ স্বর্ণকে রেখে গেছে তার রুমে। ফুলে ফুলে ভরা পুরো রুম। সে খুশিতে ডগমগ হয়ে মুখ ভর্তি হাসি নিয়ে রুমে এসেছে। কিন্তু রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখে স্বর্ণ বিছানায় নেই। তার জানামতে, নতুন বউরা বিছানার মাঝখানে লজ্জায়
নত হয়ে বসে থাকে। মুখের সামনে থাকে একহাত ঘোপটা। কিন্তু তার বউ কই? বউ নাই দেখে তার বুকে বিজলি পরার উপক্রম। চোখের ভাসে ঝিকিমিকি বাতির আলো। সে পাগলা ভেড়ার মতো এদিক ওদিক পানে তাকিয়ে খুঁজতে থাকে প্রাণপ্রিয় বউকে। খুঁজতে খুঁজতে দেখে স্বর্ণ চুপ করে সিলিংয়ের উপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে। তাকে ফ্যানের উপর বসে থাকতে দেখে সে শুধায়,

-‘একি রে তুই ওখানে কেন? নেমে আয় বউ! আজ না আমাদের সোহাগ রাত।’
-‘সোহাগ রাত না ছাই।’
-‘ওমা এ কি কথা? বিয়ে হয়ে গেছে আমাদের। আর নেই ভাবনা। আর নেই চিন্তা। দ্রুত নেমে আয় জান। দু’জন মিলে করে ফেলি বেবি আনার প্ল্যান।’
-‘ না সায়ন ভাই, আমি আপনার সাথে বাসর করব না।’
-‘কেন সোনা? কি অপরাধ আমার। কি করেছি আমি, বল? ‘
-‘আপনি কেন ক্যাটকেটে হলুদ শর্ট পরে বিয়ে করতে গেলেন না? কেন বলুন?’
-‘আমার তো হলুদ কালার শর্ট নেই সোনা। তোর হলুদ শাড়ি কেটে নাহয় একটা বানিয়ে দিস।’
একথা বলতে না বলতে স্বর্ণ লাফ দিয়েছে তার উপর। সে স্বর্ণকে ক্যাচ করে জাপটে ধরে পাগলের মতো চুমু দিতে শুরু করেছে৷ চুমুতে চুমুতে ভিজিয়ে ফেলেছে স্বর্ণের চোখ, গাল, ঠোঁট, থুতনী, গলা ও মৃসন গ্রীবা। এতদিনের অপেক্ষা তর যে আর সয় না। কম্পিত হাতে খুলেও ফেলেছে বউয়ের পরনের শাড়ি। মুখ ডুবিয়েছে গলায়। মন, মস্তিষ্ক, হাত ও উন্মাদ
দেহখানা যেন এখন পাগলা ঘোড়ার ন্যায় অবাধ্য। তখন তীব্র ঝাঁকুনিতে ঘুম ভেঙ্গে যায় তার। দু’চোখ খুলে দেখে শুদ্ধ ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে আছে।

তার বাসরঘরে শুদ্ধ কোথা থেকে এলো? বউ কই তার? সে কিছু বলার আগে বিরক্তি নিয়ে শুদ্ধ বলল,
-‘রুমের দরজা খোলা রেখে কোলবালিশকে পাগলের মতো চুমু খাচ্ছিলে কেন? মাথা টাথা কি একেবারেই গেছে?’
সায়ন ঘাড় ঘুরিয়ে আশেপাশে তাকাল। ফুলে ভরা রুমে ফুল কই? আর বউ? বউ কই তার? সে এবার মাথা চুলতে আমতা আমতা করে বলল,
-‘ আমার বউ কোথায়? এখানেই তো ছিল।’
-‘ডাস্টবিনে ফেলে এসেছি। যাও, ধূলো ঝেড়ে তুলে নিয়ে এসো। আসার সময় বাবা কিজন্য ডাকছে শুনে এসো।’
-‘বাবা ডাকছে?’
-‘হুম।’
-‘ তুই যা, শাওয়ার নিয়ে আসছি।’
-‘কিছুক্ষণ আগেই না শাওয়ার নিয়ে লাঞ্চ করলে?’
-‘আরে ভাই স্বপ্নে কিছু দোষ ছিল।’
শুদ্ধ সায়নের কথার মানে বুঝে মুখ কুঁচকে বিরক্তি নিয়ে চলে গেল।আর সায়ন গায়ের উপর থেকে চাদর সরিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে বিরবির করল,’ দিনে দুপুরে কী হতচ্ছাড়া স্বপ্ন দেখলাম রে বাবা, ছ্যাহ্!’
এরপর নিজেকে বকতে বকতে ওয়াশরুমে চলে গেল। শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে এবার একা একাই হেসে ফেলল। স্বর্ণ জানলে তাকে ঝাঁটা পিটা করবে।

এদিকে ড্রয়িংরুমে সবাই উপস্থিত হয়েছে আহনাফের বাবা মায়ের জন্য। কুশল বিনিময় সেরেছেন। উনারা এখন ইনিয়ে বিনিয়ে শখের সাথে কথা বলছেন। বোঝার চেষ্টা চালাচ্ছেন শখের সাথে কোনো সমস্যা হয়েছে কি না। কিন্তু শখ জানিয়েছে তাদের মাঝে কোনো সমস্যায় হয় নি। কিছুক্ষণ আগেও আহনাফের সাথে কথা হয়েছে। এ কথা শুনে আহনাফের বাবা
বললেন শখের ফোন থেকে একটা কল দিতো। শখ দিলো। একবার কল দিতেই আহনাফ কল ধরে বলল,
-‘হ্যা সোনা বলো। এতক্ষণে মনে পড়ল আমার কথা?’
বড়দের সামনে এমন সম্ভোধনে লজ্জায় কুঁকড়ে গেল শখ। বড়রাও মুখ এদিক ওদিক করলেন। তখন আহনাফের বাবা ফোনটা নিয়ে বললেন,

-‘সমস্যা কি তোমার? আমাদের কারো কল ধরছো না কেন?’
-‘ কেন ধরছি না ভালো করেই জানো। যাই হোক, তোমরা এখানে কেন হঠাৎ?’
-‘যাদের বাড়ির মেয়েকে নিয়ে এত সমস্যা তাদের জানাতে হবে না পুরো ঘটনা?
-‘না, বাসায় যাও।’
-‘একথা আগে ভাবা উচিত ছিল।’
-‘কথা বাড়িও না বাবা। বাসায় যাও।’

উনাদের বাবা-ছেলের কথা শুনে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে আছেন শারাফাত চৌধুরী। সাওয়ান চৌধুরীর কপালেও চিন্তার ভাঁজ। শুদ্ধ দুই হাত পেছনে মুড়ে রাজকীয় ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে। বোঝার চেষ্ট করছে মূল ঘটনা।
কথার শুরুটা মোটেও পছন্দ হয় নি তার। এরা বাবা ও ছেলে উল্টাপাল্টা কিছু বললে আজ ধোলাই দিতে খামতি রাখবে না সে। পেটপুরে ধোলাই খাইয়ে এরপর বাসায় পাঠাবে। তার আবার অহেতুক পায়তারা সহ্য হয় না।
তখন ভেজা চুল মুছতে মুছতে দ্রুতপায়ে সায়ন নেমে এলো। তার গলায় ঝুলানো হালকা আকাশি রঙ্গা তোয়ালে। পরনে মেরুন টি-শার্ট ও কালো টাউজার। সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতেই চোখাচোখি হলো স্বর্ণের সাথে। তাকে অসময়ে গোসল করতে দেখে ভ্রুঁ কুঁচতে তাকিয়ে আছে সে। সায়ন গা ঘেঁষে দাঁড়াল একদম স্বর্ণের পাশাপাশি। বাকিরা আহনাফদের কথা শোনার মগ্ন। তখন স্বর্ণ কন্ঠস্বর খাদে এনে বলল,

-‘অসময়ে গোসল কেন?’
-‘কোনো কথা বলবি না বে’য়া’দ’ব। বিয়ে করতে বলি করিস না তাহলে স্বপ্নে আসিস কেন? দূরে যা, যাহ্ বলছি।’
স্বর্ণ তার কথার আগামাথা কিছুই বুঝলো না। ওদিকে আহনাফের বাবা পারছেনা ছেলেকে দু’থাপ্পড় দিতে। তখন শারাফাত চৌধুরী গলা খাঁকারি দিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। তারপর নিজে কথা বলার জন্য হাত বাড়িয়ে ফোন চাইলেন। আহনাফের বাবা ফোন এগিয়ে দিলে শারাফাত চৌধুরী স্বভাবসুলষ গুরু গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
-‘কি হয়েছে আহনাফ? কোনো সমস্যা?’
হঠাৎ উনাকে দেখে আহনাফ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলে।সে দ্রুত নিজেকে সামলে সালাম দিলো। শারাফাত চৌধুরী বাড়তি কথায় না গিয়ে আসল প্রসঙ্গে কথা তুললেন। সরাসরি জানতে চাইলেন এসবের মানে কি। শখ
কিছু করেছে? কিংবা অন্যকিছু? আহনাফ মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ চুপ থাকল। তারপর নিঃশব্দে শ্বাস টেনে বুকে সাহস নিয়ে স্পষ্টস্বরে জানাল,

-‘আঙ্কেল, বিয়ের ডেটটা এগিয়ে আনা যায় না?’
-‘কেন?’
-‘ দেড় বছর আমার কাছে অনেক বেশি মনে হচ্ছে।’
-‘কিন্তু শখের পড়া..! ”
জবাবে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন শারাফাত চৌধুরী। অনুধাবন করার চেষ্টা করলেন ছেলেটার ব্যাকুলতা। কাতরতা। এ বয়স। এ সময়। এই উপলদ্ধির সাথে পরিচিত তিনি। আজ বয়স বেড়েছে। চুলে দু’একটা
পাক ধরেছে মানে এই না অনুভূতিরাও লোপ পেয়েছে। মনে মনে কিছু একটা ভেবে উনি ফোন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সরাসরি শখকে শুধালেন,

-‘মা, তোমার কি মতামত? বিয়ের ডেট কি এগিয়ে আনব?’
শখ আমতা আমতা করে ওড়নার একটা কোণা শক্ত করে চেপে ধরেছে।
সত্যি বলতে, সে জানে আহনাফ কেন এমন করছে। আসলে সে শখকে ছাড়া থাকতে পারছে না। তার একটা দিন একটা বছর মনে হচ্ছে। দেড় বছর তার কাছে নাকি দেড় যুগের সমান। এই দূরত্ব না ঘুচালে সে পাগল হয়ে যাবে। তার একটাই অভিযোগ চৌধুরী বাড়ির বড় কন্যা দিনকে দিন তাকে পাগল বানিয়ে দিচ্ছে। ফোনের অপরপাশে থেকে চুপ করে শুনছে আহনাফ। সে একমনে আল্লাহকে ডেকে যাচ্ছে যাতে শখ মুখ ফুটে তার সম্মতি জানায়। শারাফাত চৌধুরীও দেখছে আহনাফের অস্থিরতা আর শখের নির্লিপ্ততা। তখন সায়ন মুখ খুলল। আহনাফের উদ্দেশ্যে বলল,
-‘ ডেট এগোবে ঠিক আছে। কিন্তু শখের পড়াশোনার কথা আগে ভাবতে হবে। এতদিন এত কষ্ট করে তীরে এসে তরী ডুবানো যাবে না। গার্ডিয়ান হিসেবে তোমাকেও তো বুঝতে হবে আহনাফ। ডাক্তারী পেশাকে অন্যের সাথে গুলিয়ে ফেললে চলবে না।’

একথা শুনে আহনাফের মুখটা মলিন হয়ে গেল। এবার সাওয়ান চৌধুরী বললেন,
-‘আবার কবে দেশে ফিরবে বাবা?’
-‘তিন মাস পর।’
-‘তুমি কি তিনমাস পর বিয়ের অনুষ্ঠান সারতে চাচ্ছো?’
-‘জ্বি আঙ্কেল।’
-‘শখকেও নিয়ে যাবে?’
-‘জ্বি। আমি এই তিনমাসে সব ব্যবস্থা করে ফেলব।’
-‘তা নাহয় বুঝলাম। কিন্তু এভাবে তো পড়াশোনায় ব্যাড ইফেক্ট পড়বে।’
-‘আমি আছি। সব সামলে নেবো, ইনশাআল্লাহ্!’
এ পর্যায়ে আহনাফের বাবা প্রচন্ড বিরক্ত হলেন। ধমকে উঠে ছেলেকে বললেন,
-‘এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি করছো আহনাফ। হুট করে দেশ ছেড়ে, আপন মানুষ ছেড়ে, পড়াশোনায় ইফেক্ট পড়বে এটা তো ভুল বলেন নি উনারা। বারণ শুনছো না কেন? সমস্যা কি তোমার?’
উনার ধমকে থমকে গেল ড্রয়িংরুম। শখও নীরবে কাঁদতে লাগল। তবুও আহনাফ দমলো না। সে মলিন মুখে জবাব দিলো,

-‘ওকে ছাড়া আমার উপরেও খুব বাজে ইফেক্ট পড়ছে বাবা। এই আমিটা দিন দিন বড্ড বেশি এলোমেলো হয়ে যাচ্ছি। বউ আমার, বিয়েও করব আমি, তাহলে আগে করলে কি সমস্যা? ওকে আজ হলেও আমার কাছে আসতে হবে ;কাল হলেও। তাহলে আগে পিছের হিসাব করে কি লাভ? নিজেদের কথা সাইডে রেখে আমার কথাটাও ভাবো তোমরা, প্লিজ।’
থমকে গেল সবাই। কথা হারিয়ে গেল। একটা ছেলে কতটা ভালোবাসলে এভাবে সবার সামনে প্রিয় মানুষটাকে কাতর সুরে চাইতে পারে। আপন করার আকুলতা দেখাতে পারে। আহনাফের কথায় শখের বুক পাজর ভেঙ্গে এলো। বলা বাহুল্য, এই ক’দিনে মানুষটার প্রতি তারও মায়া পড়ে গেছে। একটু একটু করে ভালোবাসতে শিখেছে। সেও চায় মানুষটাকে।
শখকে কাঁদতে দেখে সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। তখন শুদ্ধ এগিয়ে এসে বসল বোনের পাশে। হাত বাড়িয়ে ফোনটা হাতে নিলো। আহনাফ শুদ্ধকে দেখে সালাম দিলো। শুদ্ধ জবাব নিয়ে বাড়তি কথায় না গিয়ে সরাসরি শখের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ল,

-‘ আহনাফ স্পষ্টভাবে তোকে চাইছে। এবার বল তুই কি চাস?’
-‘(…..)’
-‘মুখ খোল। জবাব দে। রাজি থাকলে জানা, না থাকলেও। প্রয়োজনে আহনাফকে ক্যান্সেল করে দেবো। পৃথিবীতে ভালো ছেলের অভাব নেই।’
একথা শুনে শখ যেন আঁতকে উঠল। ভেজা চোখ তুলে তাকাল ভাইয়ের দিকে। আহনাফকে ভালোবেসে ফেলেছে। পরিস্থিতি যা এখন মুখে কিছু বলতে হবে। কিন্তু কিভাবে বলবে সেও রাজি। তিনমাস পর বিয়ে হলেও তার সমস্যা নেই। বোনের চুপ থাকতে দেখে শুদ্ধ বলল,
-‘তাহলে বাদ?’
-‘আ..ম আমার কোনো সমস্যা নেই ভাইয়া।’
-‘তাহলে তিনমাস পরেই? ‘
-‘হুম।’
তখন সাওয়ান চৌধুরী কথা ধরলেন,
-‘কিন্তু তোর পড়াশোনা?’
একথার জবাব শখের দেওয়া হলো না। কারণ আহনাফের চোখে চোখ রেখে শুদ্ধ পুনরায় তাকে জিজ্ঞাসা করে বসল,

-‘শখের পড়াশোনা নিয়ে তোমার আপত্তি আছে?’
-‘না ভাইয়া।’
-‘ভেবে বলছো?’
-‘জ্বি ভাইয়া।’
-‘ ভালোবাসলে ভালোবাসার মানুষের চাওয়া-পাওয়াকেও ভালোবাসতে হয়। খেয়াল রাখতে হয়। তার ভালো-মন্দ সকল সমস্যার সমাধানদাতা হতে হয়। আশা করি, তুমিও তাই হবে।’
এইটুকু বলে সে মেজো চাচ্চুর দিকে তাকাল। উনার বলা কথার জবাবে বলল,
-‘বিয়ের পরেও মেয়েদের পড়াশোনা হয়। শুধু প্রয়োজন হয় নিজের চেষ্টা আর আপনজনদের সার্পোট। নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে এ দুটোই যথেষ্ট। তাছাড়া, বিয়ের পর আহনাফ যদি শখের পড়াশোনায় সামান্যতর বাঁধার কারণ হয় আমি কথা দিচ্ছি বোন রাখব না ওর কাছে। কারণ, ওকে মনে রাখতে হবে সে চৌধুরীদের সম্পত্তি নয় স্বয়ং চৌধুরীদের কলিজা নিয়ে যাচ্ছে। যাকে তাকে এই অমূল্য রত্ন আমরা দেবো না। যাকে দেবে তাকে অবশ্যই যোগ্য হতে হবে। কতটুকু যোগ্য কথায় নয় কাজে করে দেখাতে হবে।’

শুদ্ধর প্রতিটা শব্দের ভার বুঝতে বাকি রইল না কারো। এটা যেন ঠান্ডা মাথায় শীতল কন্ঠে হুমকি। এরপর আহনাফের কথা অনুযায়ী তিনমাস পর বিয়ের ডেট ঠিক করা হলো। গুমোট পরিবেশ কাটাতে সকলে অন্য প্রসঙ্গে কথা তুলল। আহনাফও হাফ ছেড়ে খুশি মনে কল কাটল। এরপর
আর কিছুক্ষণ থেকে আহনাফের বাবা-মা বিদায় নিলেন। শখ চলে গেল নিজের রুমে। একে একে ড্রয়িংরুম ফাঁকা হতেই সায়নও রুমের দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। রুমে না সে যাবে স্বর্ণের রুমে। কারণ পাজিটা তাকে বিয়ে করতে চাই না অথচ স্বপ্নে এসে কিসব করে যায়। কেন করে এসব? এর জবাব তাকে দিতেই হবে। না দিলে চড়িয়ে দাঁত ফেলে দেবে বেয়াদবটার। কিন্তু সে যাওয়ার আগেই শুদ্ধ পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে বলল,
-‘বাগানে যাও। কেউ তোমাকে ডাকছে।’

একথা বলে শুদ্ধ রুমে চলে গেল। সায়ন ভেবেছে স্বর্ণ বোধহয়। তাই সেও পা বাড়াল বাগানের দিকে। কিন্তু গিয়ে কাউকে দেখল না। খুঁজল এদিক ওদিক। হঠাৎ কারো কান্নার শব্দে আর একটু এগিয়ে যেতেই কান্নার শব্দ তীব্র হলো। ভালো করে খেয়াল করে দেখল স্বর্ণ নয় শীতল গাছের উপর বসে ভ্য ভ্য কাঁদছে। গাছের নিচে কাঁটা বিছিয়ে রাখা। তাকে দেখামাত্রই সায়ন বিচলিত হয়ে বলল,
-‘এ কি কান্ড ওখানে কেন তুই? আর এভাবে কাঁটা বিছিয়ে রাখা কেন?’
-‘ ওই কুত্তা বিছিয়েছে। ‘
-‘কুত্তা? কুত্তা এভাবে কাঁটা বিছিয়েছে? বলিস কি? এ দেখি ডিজিটাল কুত্তা। একে তো জাদুঘরে রেখে আসা উচিত। সেই সাথে নামকরণ করা উচিত, ‘কাঁটা বিছানো কুত্তা।’
অন্যসময় হলে সায়নের কথা শুনে শীতল খিলখিল করে হাসত। কিন্তু এখন মোটেও হাসতে ইচ্ছে করছে না তার৷ তাই নাক টেনে ফোঁপাতে ফোঁপাতে জবাব দিলো,

-‘এই কুত্তা সেই কুত্তা নয়। এটা মানুষ কুত্তা।’
-‘মানুষ আবার কুত্তা হয় কিভাবে? কি বলছিস পাগলের মতো। কাঁটা সরাই। নেমে আয় দেখি।’
একথা বলে সায়ন একে একে কাঁটাগুলো সরালে শীতল গাছ থেকে নেমে এলো। কোমরে গুঁজে রাখা ওড়নাটা ঠিকঠাক করে ধপাধপ পা ফেলে ছুটলো বাড়ির ভেতর। দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে চলে গেল শুদ্ধর রুমে। ভিজিয়ে রাখা দরজা খুলে দেখল শুদ্ধ খালি গায়ে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। সে রাগে ফসফস করে কোনোমতে নিজেকে সামলে তার রুমে চলে গেল। ওয়াশরুমে গিয়ে মাথাতে পানিও দিলো। তারপর ভেজা চুল
মুছে ধপ করে শুয়ে পড়ল বিছানার উপর। খানিকক্ষণ পরে মাগরিবের আজান দিলো।

সন্ধ্যার নাস্তা করার জন্য সিরাত সবাইকে ডাকছে। সেও গেল। সায়ন বাদে একে একে সবাই হাজির হয়েছে। শুদ্ধ কোথাও যাবে বোধহয় রেডি হয়ে নিচে নেমেছে। শীতল তাকে দেখামাত্র থমথমে মুখে সোফা ছেড়ে মেঝেতে বিছানো কার্পেটের উপর বসল। তারপর এক হাত বাড়িয়ে ট্রে থেকে হালিমের বাটি হাতে তুলে নিলো। শুদ্ধও এসে বসেছে পাশের সোফায়। শীতল গরম হালিম মুখে দিতেই ছ্যাকা খেয়ে উফ করে ঠোঁট চেপে ধরল। শুদ্ধ ভ্রুঁ কুঁচকে কিছু বলার আগেই শীতল উঠে হনহন করে রান্নাঘরে চলে গেল। এই অসভ্য মানুষটার সাথে কথা বলবে না সে। ততক্ষণে সবাই বসেছে ড্রয়িংরুমের সোফায়। সিরাত, সিমিন বাহারি সব নাস্তা চা এনে রাখছে সবার সামনে। তুলে নিয়েছে যে যার পছন্দের সব নাস্তা। হঠাৎ কারেন্ট চলে গেল। এবং তখনই শুদ্ধর মুখ থেকে ব্যথাতুর শব্দ বেরিয়ে এলো। সবার কানে পৌছে গেলে সেই শব্দ। সবাই বিচলিত। কি হয়েছে উতলা হয়ে জানতে চাইতে না চাইতে জেনারেটরও অন হয়ে গেল। ঝকঝকে আলোয় ভরে উঠল ড্রয়িংরুম। শুদ্ধ তখনো মুখ কুঁচকে চোখ বন্ধ করে সটান হয়ে বসে আছে। তার একটা হাত পিঠের পেছনে। সিঁতারা ছেলের হাত খেয়াল করে বললেন,

-‘আব্বা কি হলো তোর? এমন করছিস কেন?’
-‘না, কিছু না।’
সিঁতারা শুনলো না। জোর করে শুদ্ধর টিশার্ট উঁচিয়ে দেখে আঁতকে উঠে বললেন,
-‘একি কান্ড! এটা কি করে হলো?’
উনার কথা শুনে সবার দৃষ্টি শুদ্ধর পিঠের দিকে। কারো ধারালো চার আঙ্গুলের দাগ বসে গেছে। বিন্দু বিন্দু রক্ত বের হচ্ছে। কেউ যেন খামচি দিয়ে মাংস উঠানোর পায়তারা জুড়েছিল। শুদ্ধর অবস্থা দেখে সিরাত দৌড়ে গিয়ে এন্টিসেপটিক এনে লাগিয়ে দিলেন। সিমিন হায় হায় করে উঠলেন। ভর সন্ধ্যায় খারাপ জ্বিনের কারবার ভেবে সূরা পড়ে শুদ্ধর মাথায় ফুঁ দিলেন। সিরাত ঝাঁড়ু হাতে পুরো ড্রয়িংরুম খুঁজলেন বিড়াল টিড়াল আছে নাকি দেখতে। কিন্তু কিছুই পেল না। হঠাৎ করে এমন কান্ড ঘটায় সকলেই হতবাক। চোখের পলকে কি থেকে কি ঘটে গেল কিছুই বুঝলেন না কেউই। তবে শুদ্ধ আশেপাশে তাকিয়ে একজনকে না পেয়ে দীর্ঘশ্বাস চাপল। কাজ সেরে তখনই পালিয়েছে সে। পরপর শুদ্ধর ফোনে কল আসায় সে উঠে দাঁড়াল। কিন্তু সিঁতারা উঠতে দিলেন না কিছু খেয়ে ওষুধ খাইয়ে তবেই ছেলেকে ছাড়লেন। যে ক্ষত হয়েছে প্রচুর ব্যথা হবে।

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ২৫

শুদ্ধ কথা বাড়িয়ে ওষুধ খেয়ে বেরিয়ে গেল। কয়েকধাপ এগিয়ে পেছনে ফিরে তাকাল শীতলের বেলকনি বরাবর। কেউ নেই। তবে সে নিশ্চিত শীতল ওখানেই লুকিয়ে আছে। দেরি হয়ে যাচ্ছে ভেবে পুনরায় যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই শীতলের কন্ঠের গান কর্ণকুহুরে পৌঁছাল। সে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। শীতল তখনো চেঁচিয়ে গেয়ে যাচ্ছে,
বন্ধু হাইট্টা যখন যায় পিছন ফিইরা ফিইরা চায়
দেখলে তারে মনের ভিতর মনের ভিতর দো’তারা বাজায়।
বন্ধুর মাথায় বাবড়ি চুল দেখতে লাগে বিউটিফুল।
রংয়ে ঢঙ্গে রহিম সাইজ্জা আমারে নাচায়।

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ২৭