শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ২৭

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ২৭
নূরজাহান আক্তার আলো

‘বন্ধু হাইট্টা যখন যায় পিছন ফিইরা ফিইরা চায়
দেখলে তারে মনের ভিতর মনের ভিতর দো’তারা বাজায়।
বন্ধুর মাথায় বাবড়ি চুল দেখতে লাগে বিউটিফুল।
রংয়ে ঢঙ্গে রহিম সাইজ্জা আমারে নাচায়।’
উপর থেকে চেঁচিয়ে গান গাইছে শীতল। আর নিচে দাঁড়িয়ে গান শুনে হতবাক শুদ্ধ। তার বোধগম্য হলো না আসলেই গান নাকি আস্ত খোঁচা?
গানই যদি হয় খাপে খাপ মিলল কিভাবে? ‘দেখলে তারে মনের ভিতর দো’তারা বাজায়।’ এই লাইনের মানে কি? তাকে দেখে ওর মন দোতারা বাজে? তা ধীর গতিতে বাজে নাকি বুলেটের গতিতে? ভয়ংকর ব্যাপার তো। হুম, পরখ করা দরকার। পরখের আগে অবশ্য চ্যালাকাঠ দরকার।

বেশি শক্তপোক্ত না হলেও চলবে। ওই এক বারি দিলে ভূত পালিয়ে যায় এমন হলেই হয়। তাছাড়া এইবার বাড়ি এসে বুঝল আশপাশে চ্যালাকাঠ দেখে নি। আগে ছাদে, বাগানে চ্যালাকাঠ পড়ে থাকত। চ্যালাকাঠগুলোর হাত-পা গজিয়েছে বোধহয়। হঠাৎ উড়ে উড়ে কোন গর্তে লুকিয়েছে তাও
জানা দরকার। এত দরকারে দরকারী কাজগুলো সেরে ফেলবে যদিও।
ততক্ষণে শীতলের গান থেমে গেছে। থামার কারণ পরের লিরিক্স ভুলে গেছে সম্ভবত। শুদ্ধ নিশ্চিত তাকে বের হতে দেখেই শীতল গান গেয়েছে।
আর গান থেমেছে মানে সে উঁকি মেরে হলেও দেখবে দাঁড়িয়ে আছে কী না। একথা ভাবামাত্রই জানালার পর্দার আড়াল থেকে ইঁদুরের মতো মুখ বের করে উঁকি মারল শীতল। তাকে জানালা বরাবর তাকিয়ে থাকতে দেখে চট করে মাথা সরিয়ে নিলো। সেকেন্ডের ব্যবধানে আবারও উঁকি মারল। তখন শুদ্ধ চেঁচিয়ে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-‘ নেমে আয়। মারব না।’
-‘(….)’
-‘কথা কানে ঢুকল না? আয় বলছি, ভাজা বাদাম কিনে দিবো।’
-‘(…..)’
-‘আমাকে যেতে হলে খবর আছে তোর।’
-‘(……)’
-‘এক থেকে দশ গুনব। এর মধ্যে না এলে আজ সারারাত কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখব।’
একথা শুনে শীতল পর্দার আড়ালে থেকে জবাব দিলো,
-‘আমি কিছু করি নি শুদ্ধ ভাই।’
-‘আমি কখন বললাম তুই কিছু করেছিস? আয়, আয়, দ্রুত আয়, বের হতে হবে আমাকে।’
-‘আমি এত বোকা না। বাদামের লোভ দেখিয়ে চ্যালাকাঠ দিয়ে মারার ধান্দা। কি ভেবেছেন বুঝি না কিছু?’
-‘ভালোই তো চালাক হয়েছিস। চালাক হওয়া খু্বই ভালো। তবে কতটা চালাক হয়েছিস পরীক্ষা নেবো সময় করে। এখন আয়। নয়তো চলে যাব কিন্তু?’

-‘কোথায় যাবেন?’
-‘পাত্রী দেখতে।’
-‘আমি যাব না?’
-‘না, আগে আমি দেখে আসি পছন্দ হলে সবাই গিয়ে দেখে আসিস।’
-‘মেয়ে কি করে? দেখতে কেমন? গায়ের রং সাদা নাকি কালো? আমার মতো লম্ব চুল নাকি বব কাটিং? কাজল পরলে সুন্দর দেখায় তো?’
-‘সুন্দরী বউ লাগবে না আমার। আমি চাই বুদ্ধিমতী বউ। সুন্দরীরা বোকা আর মাথামোটা টাইপের হয় সেটার জলজ্যান্ত প্রমাণ তুই।’
একথা শুনে শীতলের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। মন ভার হলো। সে মুখ গোমরা করে জবাব দিলো,
-‘ চোখের সামনে থেকে বিদায় হোন, নামব না আমি।’
-‘ওকে। আচ্ছা শোন, একটা কাজ করে দিতে পারবি? করলে কচকচে পাঁচশ টাকার নোট দেবো।’
-‘কি কাজ শুদ্ধ ভাই?’
-‘একটা মোটা চ্যালাকাঠ আমার রুমে রেখে আসবি। আজকাল বাড়িতে জংলী বিড়ালের উপদ্রব বেড়েছে। মুখের ভাষাও জ’ঘ’ন্য। শায়েস্তা করা লাগবে। এসে যদি দেখি কাজ কমপ্লিট করেছে তাহলে সাথে সাথে টাকা পেয়ে যাবি।’

-‘সত্যি তো?’
-‘হুম।’
-‘আচ্ছা।’
-‘ থাক তাহলে রাতে দেখা হচ্ছে। টাকা নেওয়ার জন্য রেডি থাকিস।’
একথা বলে শুদ্ধ সময় দেখে দ্রুতপায়ে বেরিয়ে গেল চৌধুরী বাড়ির গেট পেরিয়ে। শুদ্ধ চালাকিও ধরে ফেলেছে সে। তবে চালাকি খাটল না দেখে খিলখিল করে হেসে উঠল। শুদ্ধকে জব্দ করতে পেরে খুশির অন্ত নেই।
দুটো ডানা থাকলে আকাশে এখনই দুচক্কর মেরে আসার মতো খুশি তার অন্তরে। সন্ধ্যায় বাড়ির সদস্যের সামনে ওই দুঃসাহসিক কাজটা করতে পেরে মন যেন পুরো পৃথিবীর সামনে বলতে চাচ্ছে, ‘ পৃথিবী এত সুন্দর ক্যা? সুখ এত শান্তির ক্যা?’
একথা বলে সে ধারালো নখের দিকে তাকিয়ে নখের উপর চুমু খেলো।

তারপর কায়দা করে ভ্রুঁ জোড়া নাচিয়ে দুষ্টু হেসে বলল,’আসবি আর লাগতে? আজ পিঠে দিয়েছি এবার মুখে দেবো। সুন্দরী মেয়েদের সাথে উড়াউড়ি করার স্বাদ জন্মের মতো ঘুচিয়ে দেবো।’
মুখ ভেংচি দিয়ে কথাটা বলে স্মরণ হলো শুদ্ধ পাত্রী দেখার কথা বলল। আসলেই কি তাই? গেলে যাক। তার মতো বিশুদ্ধ পুরুষকে কোন মেয়ে সঙ্গী হিসেবে নিয়ে কপাল পুড়াতে চায় সেও দেখবে। অবশ্য সেই মেয়ের জন্য অগ্রিম আকাশসম সমবেদনা। একথা বলে মিটিমিটি হাসতেহাসতে রুমে চলে গেল সে। খুব শান্তি লাগছে। রাগ মিটেছে। এতক্ষণ রাগে মাথা টাথা হ্যাং হয়ে যাচ্ছিল যেন। ইচ্ছে করছিল দাঁতের তলে দিয়ে পিষতে।
এত রাগ হতো না, যদি না পেয়ারাগাছের লাল পিঁপড়ে কামড়ে অবস্থা খারাপ করে দিতো। পিঁপড়ের জ্বালায় লাফ মেরে নামতে পারত। গাছে উঠতে নামতে ভালোই পারে সে। তিনবোনের মধ্যে সেই একমাত্র গাছে উঠতে পারে। শুধু নিচে কাঁটা বিছানো থাকায় নামতে পারে নি। কাহিনী এখানে শেষ হলে তাও হতো। মনকে বুঝ দিতে পারত। হারামি পিঁপড়ের কামড়ে কান্নাকাটি করে মানুষ হাসাতে চায় নি। এখন তো বড় হয়েছে। পিঁপড়ের কামড়ে কাঁদলে লোকে কি বলবে? তাই সেকথা গোপনই থাক।

কিন্তু পেঁয়ারার ফুলের উপর বসা হারামজাদা মৌমাছিটাও ভুনভুন করে উড়ে এসে ঠিক ঘাড়ের উপর দিয়েছে হুল ফুঁটিয়ে। একহাতে ডাল ধরে আরেক হাত দিয়ে মৌমাছি সরাতে গিয়ে দেখে তিনটে মৌমাছি। তিনটে কামড়ে ধরে আছে। তারপর কোনোমতে তিনটেকে পিষে মেরে কাঁদছিল সে। খুব জ্বলছিল। মৌমাছির কামড়ে জ্বালা যত বাড়ছিল তার সব রাগ জমা হচ্ছিল শুদ্ধর উপর। তার কারণে এসব হয়েছে। তারপর আর কি সুযোগমতো সেও নখ দিয়ে তাকেও জ্বালিয়ে দিলো, দেখ কেমন লাগে!
অতঃপর এখন শান্তি আর শান্তি। আজ মন ভালো থাকা পড়তে বসল।
কিছুক্ষণ বই নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখে তার মনে হলো কাল থেকে রমজান মাস। পবিত্র মাস। এ মাসে পড়ে কি হবে? ইদের পর মেলা সময় আছে।
তখন পড়লেই হয়। এখন মন ভালো উপন্যাসের বইটা শেষ করা যাক।
যেই ভাবা, সেই কাজ, সে উঠে গিয়ে অর্ধেক পড়া উপন্যাসের বই নিয়ে শুয়ে পড়ল। উপুর হয়ে শুয়ে বুকের নিচে বালিশ নিয়ে মনযোগ সহকারে
পড়তে লাগল। পড়তে পড়তে তার একটা লাইন বেশ পছন্দ হলো,

-‘কাউকে জীবন্ত লাশ বানাতে চাও? তবে তার সবাঙ্গে তীব্র ভালোবাসার জীবাণু ছড়িয়ে দাও। রন্ধে রন্ধে তুমি নামক রোগ ছড়িয়ে দাও। তোমার নাম তার মনকুঠুরিতে খোদাই করতে বাধ্য করো। যদি করো, দেখবে সে মরবে না তবে ভালোও থাকবে না। প্রাপ্তি হিসেবে দেখবে পুরো মানুষটাই তোমার দখলে। তোমার আয়ত্তে।’
___ বাণীতে আলো
কথাখানা ভারি পছন্দ হলো শীতলের। চিৎ হয়ে শুয়ে বইটা বুকের উপর রেখে গভীর চিন্তায় মগ্ন হলো। ভাবল অনেক কিছু। তার শত্রু ওই একটা।তাকে এই মন্ত্রে কাবু করলে কেমন হয়?

সুনশান এরিয়া। চারদিকে অন্ধকার জঙ্গল। সেই জঙ্গল পেরিয়ে শুদ্ধ পাঁচ মিনিটের পথ পায়ে হেঁটে এসে থেমেছে নির্জন এক স্থানে। তারপর আশেপাশে তাকিয়ে প্রবেশ করল জঙ্গলের আরো গভীরে। সারি সারি গাছ। অন্ধকার পথ। কাঁটা ঝোপে ভরা মেঠো পথ পেরেয়ি এসেছে আধা ভাঙ্গা পুরনো এক খুপড়ির কাছে। খুপরিটা দেখে মনে হচ্ছে কয়েক বছর আগে কোনো বাড়ি বানাতে গিয়েও বানানো হয় নি। অবহেলায় ইট খসে গেছে। সবুজ লতা পাতায় ভরা গেছে খুপরির দূর্বল প্রচীর। আশপাশের বড় বড় গাছের পাতা ঝরে শুকিয়ে মাটিতে পড়ে আছে। কদম ফেলার সাথে সাথে মড়মড় শব্দ হচ্ছে। সে খুপরির এক কোণে শুকনো পাতার
স্তুপ সরিয়ে হাঁটু গেঁড়ে বসে মাটি স্পর্শ করতে খট করে শব্দ হলো। মুহূর্তে সেখানে গোলাকৃতি লোহার প্লেট দেখা গেল। আশ্চর্যজনকভাবে প্লেটের মাঝখানে হালকা নীল আলো জ্বলে উঠল। ঘুরছে প্লেটটা।

প্যার্টান লক চাচ্ছে। শুদ্ধ অদ্ভুত কায়দায় প্যাটার্ন আঁকলে ইংলিশে S অক্ষরটি ভেসে লক খুলে গেল। দেখা মিলল একটি গেটের৷ গেটে পা রাখতেই সাপের মতো পেঁচানো সিঁড়ি। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে লোহার প্লেটের মাধ্যমে গেট বন্ধ পুনরায় বন্ধ করে সিঁড়ি বেয়ে নামল সে এলো। তারপর নির্দিষ্ট এক স্থানে দাঁড়াতেই শরীর স্ক্যাণ হলো। স্ক্যান করার কারণ শরীরে যদি কোনোভাবে ক্ষতিকর কিছু লেগে থাকে তাহলে সেটা রিমুভ হয়ে যাবে। নতুবা এলার্ট দেবে। এখানে প্রবেশের আগে এমন অনেক সর্তকতা মানতে হয় তাকে। মানার মতো সিস্টেম অন রেখেছে। তাছাড়া পারসোনাল ল্যাবে অনেক কিছু আছে সেগুলো একদিকে যেমন উপকারী তেমনি ক্ষেত্রবিশেষ হয়ে দাঁড়ায় প্রাণনাশী। শুদ্ধর শরীর স্ক্যান হয়ে গেলে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। পিপ পিপ শব্দে বোতাম চেপে পাসওয়ার্ড ইন করল। মুহূর্তেই গেট খুলে যেতেই চোখ পড়ল এক মানবীর দিকে। মানবী এ্যপ্রোণ পরিহিত
অবস্থায় সোফায় গা এলিয়ে বসে আছে। চোখজোড়া বন্ধ। অথচ ঠোঁটে অমায়িক হাসি। হঠাৎ সেই হাসি মুছে গেল। দ্বিতীয় কারো উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ খুলে তাকাল। শুদ্ধকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উঠে দাঁড়াতেই শুদ্ধ ভেতরে প্রবেশ করে বলল,

-‘ঐশ্বর্য কোথায়?’
-‘কেবলই ফ্রেশ হতে গেল। চলে আসবে এক্ষুণি।’
-‘হঠাৎ জরুরি তলব?’
-‘কাজ হয়ে গেছে।’
-‘কোনটা?’
-‘পুরনোটা।’
-‘নতুন কোনো সিমটম দেখা দিয়েছে?’
-‘হুম।’
-‘কি?’
-‘ছেলেটার পুরুষালি হরমোনগুলো ব্লক হয়ে নারীর দেহের হরমোন তৈরি হচ্ছে৷ এবং পুরুষালি অবয় কেটে ধীরে ধীরে নারী দেহের গঠন প্রকাশ পাচ্ছে।’

-‘তারমানে আমার ধারণায় সঠিক মেডিসিন বদলে দিয়েছে কেউ।’
-‘হুম। তবে অবাক করার মতো ব্যাপার ঘটেছ সব…! ‘
-‘যেমন?’
-‘ছেলেটার কন্ঠস্বর মেয়েদের মতো শোনাচ্ছে। শরীরে অস্বাভাবিক ভাবে পশম এবং তার পুরুষালি স্তনবৃত্ত প্রাপ্ত বয়স্ত নারীর মতো দেখাচ্ছে। যা আমাদের ধারণার বাইরে ছিল। কথা হচ্ছে এই মেডিসিন কোথা থেকে এলো? কারা বানাল? তাদের মূল উদ্দেশ্য কি? এটার রেজাল্ট ভয়াবহ। কেউ যদি প্রতিশোধমূলক কাজ করতেও এটা বাজারজাত করে তাহলে পুরুষসমাজ হুমকির মুখে।’
একথা শুনে শুদ্ধ ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তাকিয়ে পাশের রুমে চলে গেল। পরনের পোশাক ছেড়ে ল্যাবের পোশাক পরে গেল নির্দিষ্ট একটি কক্ষে।

কাঁচের তৈরী বিশালাকা কক্ষে শুয়ে আছে জীবন্ত পুরুষ। শ্বাস চললেও চলাফেরা নেই। কথা বলে মাঝে মাঝে। চোখে মেলে তাকায় না৷ খাবার নিজে হাতে তুলে খায় না। তাকে শুধু বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে বিশেষ এক উপায়ে। তবে তার মরার দিন ঘনিয়ে এসেছে। বর্তমানে তার যা অবস্থা ভদ্রসমাজে চলাফেরা করতে পারবে না সে। কারণ সাধারণ মানুষ তার কাছে খাদ্যে পরিণত হতে পারে। আবার সাপের ন্যায় খোলস ছাড়তেও পারে। শুদ্ধ মুখে মাক্স পরে এগিয়ে গেল তার কাছে। কে বলবে বড়লোক বাপের ছেলে এটা? যাই হোক, কর্মফল বলে একটা কথা আছে। এসব ভাবতে ভাবতে শুদ্ধ নিজে পরখ করল। মাত্র চার সপ্তাহে এসব সিমটেম দেখা দিয়েছে। আর কিছুদিন নাহয় অপেক্ষা করা যাক। দেখা প্রয়োজন,

তাদের আর কী কী দেখতে হয়। তারপর নাহয় পরবর্তী ধাপ অনুযায়ী এগোনো যাবে। এরপর সে আর কিছুক্ষণ সেখানে থেকে ঐশ্বর্যের সাথে দেখা করল। কথা হলো গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে। সেসব করতে করতেই রাত বাজল একটা। ঐশ্বর্যকে সব বুঝিয়ে দিয়ে বের হয়ে ফিরতে ফিরতে বাজল রাত দেড় টা। সায়নের পার্টি অফিস তখনো খোলা। পার্টি অফিস পেরিয়ে চৌধুরী বাসায় যেতে হবে। শুদ্ধ কি মনে করে অফিসের ভেতরে প্রবেশ করল। তাকে দেখামাত্রই আজমসহ সকলেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে গেল।
শাহরিয়ার ভাইয়ের ছোটো ভাই মানে তাদেরও ভাই। মুখে মুখে শুদ্ধকে ভাই ভাই ডেকে ব্যস্ত রাখতে চাইলেও খুব একটা লাভ হলো না। শুদ্ধ চট করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর আজমকে বলে বসল,

-‘ভাইয়া কোথায়? উহুম, বাড়তি কথা নয় কাজের কথা বলো।’
-‘ভাই একটু কাজে গেছে। চইলা আসবে নে।’
-‘কোথায় গেছে?’
-‘কনককে মারা দিতে। হালায় বহুত জ্বালাইতাছে। শাহরিয়ার ভাইয়ের ঠা/প না খাইয়ে মা’দা’চো’,দ শুধরাইবো না। আপনে বসেন ভাই। ঠান্ডা খান।’
-‘কনক মানে সিদ্দিকের চ্যালা?’
-‘হ ভাই।’
-‘কি করেছে সে?’
-‘কনকের বইনরে কেরা জানি রেপ করছে এহন কনক দোষ দিতাছে শাহরিয়ার ভাইয়ের। পুলিশ কেসও করছে। পুলিশ আইছিল কিছুক্ষণ আগে।’

-‘তারমানে ভাইয়া থানায় এখন, তাই তো?’
-‘হ। না মানে হইছে কি ভাই….!’
-‘চলো।’
-‘ভাই কিতাছি যে, চৌধুরী বাড়িতে জানাইতে মানা করছিল শাহরিয়ার ভাইয়ে। জানাইলে আমারে আগে কোপাইবে কইছে। সকালডা হইলেই ভাইয়ে জামিন পাইয়া যাইব। আপনে থানায় যাইয়েন না ভাই। শাহরিয়ার ভাইয়ে গোস্সা করবো।’
শুদ্ধ শুনল। তারপর এক পকেটে হাত গুঁজে আজমের কাঁধে হাত রেখে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
-‘তোমার শাহরিয়ার ভাই নির্বাচনে দাঁড়াবে, তা জনো?’
-‘জে ভাই, জানি।’

-‘এসব কেস ভাইয়ার নামের আগে পিছে থাকলে তার নির্বাচন করার সাধ ঘুচে যাবে। রাজনীতি করো অথচ সিদ্দিকের চাল ধরতে পারো নি?সিদ্দিকের এখন একটাই লক্ষ্য ভাইয়াকে নির্বাচন করতে না দেওয়া। এ এজন্যই কনকের বোনের কেসটা ভাইয়ার ঘাড়ে চাপাতে চাচ্ছে হয়তো।
যাতে কেস জারি হয় তার নামে। নির্বাচনের আগেই ভাইয়াও মুখ থুবকে পড়ে। যদি ভাইকে ভালোবাসো এবং তার স্বপ্ন পূরণ করতে চাও তাহলে চলো যাই গা রাতের দাগ রাতেই মুছি। দাগ পড়বে না দাগকে অবহেলা করতে নেই। কোন দাগ কার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় বলা মুশকিল।’
তার কথাগুলো আজম হতবাক হয়ে শুনল। আসলেই তো! এভাবে তো ভেবে দেখে নি। এজন্য শিক্ষিত মানুষের সঙ্গে চলা উচিত। কারণ এরা জানেও বেশি। জ্ঞান রাখেও বেশি। দুজন কথা না বাড়িয়ে চলল থানার দিকে। যেতে যেতে শুদ্ধ ফোনে কারো সাথে কথা বলল। কথাশুনে মনে হলো কোনো বড় মাপের মানুষ। এটাও বুঝল, শুদ্ধর রাজনীতিবিদের সাথে যোগাযোগ আছে। সঙ্গে এটাও বুঝল সায়নের জামিন হলো বলে।
থানায় অলরেডি জানানো হয়ে গেছে। ঘটনা বুঝে আজম হঠাৎ আমতা আমতা করে বলল,

-‘ভাই একখান কথা কইতাম অনুমতি পাইলে।’
-‘হুম।’
-‘রাগ কইরেন না। ভুল কইলে মাফ কইরে দিয়েন। মুনের কথা চাইপ্পা রাখতে পারি না দিইখা কইতাছি।’
-‘(…)’
-‘ভাই? আপনে ওসব কাজ ছাইড়া আমগো লগে মাঠে আইসা পড়েন। কি দরকার শুধু শুধু অবুজ ইঁন্দুরের হোগায় ইনজেকশন মারা? আমগো চাইরপাশে বড় বড় মেলা ইঁন্দুর আছে। তাও মুখোশ পরা ইঁন্দুর। আমি আর শাহরিয়ার ভাই মাঠে নামছি হেগোরে সাফ করনের লিগা। আপনে আমাগো সঙ্গ দিলে আরো ভালো হইতো। কারণ আপনের তো আবার ইঁন্দুরে হোগায় ইনজেকশন মারার অভিজ্ঞতা আছে। পারবেন ভালোই।
আমরা রোজ আপনেরে ইঁন্দুর আইনা দিমু আপনে খালি ইনজেকশন মারবেন।’

-‘ আমি খালি ইনজেকশন মারি একথা কে বলেছে?’
-‘শীতল আপায়।’
-‘এসব ভাষা ব্যবহার করেছে?’
-‘না, না, ছিঃ! ছিঃ! আপা পড়ালেহা জানা মাইয়া। এসব ভাষা কয় নাই।
আপা ভালো ভাষা কইছে।’
-‘শুনি কত ভালো ভাষা ব্যবহার করেছে?’

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ২৬

-‘আসলে হইছে কি, আমিই ভাইরে আপনের কথা জিগাইছিলাম। তখন আমি নতুন। কাউরেই চিনতাম না। শীতল আপায় ভাইয়ের সাথেই ছিল। আপারে গাড়ি কইরা কলেজে নামাইয়া দিতে যাইতেছিলাম। আপনের কথা কওনের পর আপায় কইছিল, আপনে সাইটেশ। আমি বুঝি নাই, এডি আসলে কি। কাম কি। পরে আপা আমারে বুঝাইতে কইল, আপনে বিজ্ঞানী। পরীক্ষা নিরিক্ষা করনের লিগা নাকি ইঁন্দুরের বামে ইনজেকশন মারেন। আপা শিক্ষিত মাইয়া তাই কইছিল, বাম। বাম কি তাও বুঝি নাই তহন। পরে আপা চইলা গেলে শাহরিয়ার ভাই কইছিল বাম মানে হইল পাছা। ভদ্রলোকেরা পাছাকে সন্মান দেখনোর লিগা বাম কয়। আমার আবার এত ভালো ভাষা মুখে আহে না। তাই আমি কইছি হোগা, ভালো করছি না ভাই?’

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ২৮