শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ২৮

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ২৮
নূরজাহান আক্তার আলো

-‘আসলে হইছে কি! আমিই ভাইরে আপনের কথা জিগাইছিলাম। তখন আমি নতুন। কাউরেই চিনতাম না। শীতল আপায় ভাইয়ের সাথেই ছিল। আপারে গাড়ি কইরা কলেজে নামাইয়া দিতে যাইতেছিলাম। আপনের কথা কওনের পর আপায় কইছিল, আপনে সাইটেশ। আমি বুঝি নাই, এডি আসলে কি! কাম কি! পরে আপা আমারে বুঝাইতে কইল, আপনে বিজ্ঞানী। পরীক্ষা নিরিক্ষা করনের লিগা নাকি ইঁন্দুরের বামে ইনজেকশন মারেন। আপা শিক্ষিত মাইয়া তাই কইছিল, বাম। বাম কী তাও বুঝি নাই তহন। পরে আপা চইলা গেলে শাহরিয়ার ভাই কইছিল বাম মানে হইল পা’ছা। ভদ্রলোকেরা পাছাকে সন্মান দেখনোর লিগা বাম কয়। আমার আবার এত ভালো ভাষা মুখে আহে না। তাই আমি কইছি হোগা, ভালো করছি না ভাই?’

-‘(……)’
-‘আপনে আমাদের দলে চইলা আহেন ভাই। মিইল্লা ঝুইল্লা কাম করলে
আমরাই হইব এহানকার রাজা।’
-‘ক্ষমতার লোভ ভালো জিনিস নয় আজম। ক্ষমতার লোভ মানুষকে পশুতে পরিণত করে। বিবেকের দুয়ারে মরিচা ধরায়। তাছাড়া আমি আমার কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলাম আর তাই আছি।’
-‘ শুদু শুদু ইঁন্দুরগুলানের উপ্রে এত রাগ ক্যান আপনের? হেরা যতই ছুডু প্রাণী হোক হেগোরে কি লাগে না কন?’
-‘(……)
-‘ভাইয়ে কি রাগ হইলেন নাকি?’
-‘ ভুলভাল বকবক শোনার অভ্যাস আছে আমার। বলো তুমি। সমস্যা নেই।’
-‘হে, হে, বাঁচাইলেন ভাই।’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এরপর আজম নিজের মতো করে বকবক করতেই থাকল। শুদ্ধ শুনছে কী না বোঝা গেল না। কারণ সে ব্যাকটোরিয়ার নাম মনে করায় ব্যস্ত। এ সময়, এ অবস্থায়, হঠাৎ ব্যাকটোরিয়ার নাম মনে করার কারণ জানা না গেলেও কাউকে শিক্ষা দেওয়ার প্ল্যান এঁটেছে একথা শতভাগ নিশ্চিত।
কারণ আর যাই হোক, সে অকারণে কিছু করে না।
এদিকে প্রতিটা টিভি চ্যানেলের ব্রেকিং নিউজ চাঞ্চল্যকর একটি ঘটনা।
বার বার দেখা হচ্ছে নামিদামি একটি কালো গাড়ি। গাড়ির ডিকি খোলা। এবং ডিকির মধ্যে রাখা মানুষের কাটা হাত-পা। ছবি সুস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না যদিও কারণ আবছা করা যাতে কেউ ভয় না পায়। কার গাড়ি? কাটা হাত-পা কাদের? কোন অপরাধের দরুণ এমন ভয়াবহ মৃত্যুদন্ড বোধগম্য হলো না কারো। সাংবাদিকরা ছবি তুলছে। প্রচার করছে নিজ চ্যানেলে।

তখনই সাক্ষী হতে হলো আরেকটা একটি ঘটনার। জানা গেল এ গাড়িটি রাজনীতিবিদ আবু সিদ্দিকের বড় ছেলের। সে বাইরের দেশে থাকলেও দিন তিনের হলো দেশে এসেছে। পেশায় রাগবি (Rugby) প্লেয়ার।বাবার মতো রাজনীতির ধাঁরে কাঁছেও নেই। শান্ত ও ধীর স্বভাবের। নাম কায়েশ সিদ্দিকী। বয়স ছাব্বিশের কাছাকাছি। কিছুক্ষণ আগে কায়েমের গাড়ি দেখালেও এখন কায়েশকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া দেখাচ্ছে। আবু সিদ্দিক সেই মুহূর্তে একটি বারে গলায় লাল পানি ঢালছিলেন। উনার মন মেজাজ ছিল অত্যান্ত ফুরফুরে। দলীয় অন্য সদস্যরাও ছিলেন আমোদ ফুর্তিতে। ঠিক সেই মুহূর্তে কনকের মাধ্যেমে ছেলের বিপদের কথা পৌঁছে গেল সিদ্দিকের কানে। ছেলের গাড়িতে নাকি কাটা কাটা হাত-পা পাওয়া গেছে। হিসাবে মোট পাঁচজন ছেলের হাত-পা। সিদ্দিক মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। নেশার ঘোরে পাজোড়া হড়কে গেলেও দ্রুত ধরে ফেলল কনক। ফোন কলে পুনরায় খোঁজ নিয়ে জানলেন ঘটনা সত্য। এসবের মানে কি? ছেলে একাজ করতেই পারে না।

অসম্ভব। কেউ না জানলেও উনি খুব ভালোই করেই জানেন রক্তে ফোবিয়ার আছে তার। র’ক্ত ট’ক্ত দেখতে পারে না। এর আগে রক্ত দেখে বহুবার প্যানিক এ্যাটার্ক হয়েছে তার। হসপিটালে থেকে অনেকবার। চিকিৎসা চলমান। এমনকি ছেলের কারণে বাসায় মুরগি কবুতরও জবাই হয় না৷ অথচ কার এত বড় স্পর্ধা হলো যে ছেলেটাকে এ়ভাবে ফাঁসাল? কিসের রাগ তুলল? সে যেই হোক
তাকে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। বরং এর পেছনে কারা আছে সেটাও বের করতে হবে। এমন ভয়ংকর প্ল্যান যার মাথা থেকে বেরিয়ে সে সাধারণ কেউ নয় নিশ্চয়ই!
এসব ভেবে উনি সময় নষ্ট না করে উঠে দাঁড়ালেন। চট করে উনার স্মরণ হলো সায়নের কথা। সায়ন থাকলে এসব ঝামেলা চুটকি মেরেই সমাধান করে দিতো। কিন্তু এখন সে নেই। নতুন করে পাখা গজিয়েছে তার, এখন ক’দিন উড়ুক। সময় করে টুপ করে পাখা ঝেটে দিলেই হবে। সদ্য উড়তে শেখা পাখি উচ্চতায় গেলে নিজেকে অন্যকিছু মনে করে। সায়নের একই অবস্থা। দল ছেড়ে সে ভেবেছিল একাই দল গোছাতে পারবে৷ অবশ্য সে পারলেও করতে তাকে করতে দেওয়া হবে না। কারণ সোনার ডিম পারা হাঁসকে তার ক্ষমতা বুঝতে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ না। এতে মালিকের বিপদ কী না!

কায়েশের ঘটনা যখন টিভি চ্যানেলের ব্রেকিং নিউজ আজম, শুদ্ধ আর সায়ন একসাথে থানা থেকে বের হচ্ছিল। তখন আজমকে তাদের দলের একজন কল করে ঘটনা জানাতেই সেও সায়নের কানে কথাখানা পৌঁছে দিলো। সায়ন শুনে হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরার উপক্রম। শুদ্ধ কিছু না বললেও আজম বলল,
-‘ হাসেন ক্যা ভাই? আমারেও কন আমিও একটু হাসি।’
-‘এমনি এমনি হাসছি না রে পাগলা। ঠা’প খেয়ে বাপ ডাকার সময় এসে গেছে বেচারা সিদ্দিকের। ওর নাজেহাল অবস্থা দেখে হাসছি।’
-‘কিন্তু একাম করলো কেডায়?’
-‘আছে একজন।’
-‘কেডা ভাই?’
-‘আমার ছায়াসঙ্গী।’

এরপরের প্রশ্ন করার সাহস হলো না আজমের। তবে ধারণা করে ঠোঁট টিপে হাসল। সায়ন আজমকে চলে যেতে বলে দুই ভাই এগোলো বাড়ির পথ ধরে। দুজনের কাছে দুটো বাইক। মাঝারি গতিতে পাশাপাশি বাইক চালাচ্ছে দুভাই। কারো মুখে কথা নেই। অথচ কিছুক্ষণ আগের ঘটনায় দুজনই অবগত। তারা এও জানে, কায়েশকে পরিকল্পনা ছাড়াই ফাঁসিয়ে দিয়ে পাশার পুরো চাল উল্টে দিয়েছে সুবর্ণ চৌধুরী স্বর্ণ। এই স্বর্ণ মাঝে মাঝে এমন সব কাজ কারবার করে সায়ন না হেসে পারে না৷ এটাও যে রাগের বহিঃপ্রকাশ খুব করে জানে সে। আর তার একটা কাজেই খেলার মোড় চূড়ান্ত সীমানায় নিয়ে যাবে এটা হয়তো সিদ্দিক আন্দাজও করতে পারবে না। যদিও চালটা একটু পেঁচানো। এই যেমন সিদ্দিক ওর দলেরই এক ছেলেকে দিয়ে কনকের বোনকে রেপ করাল। তাও এত নিঁখুতভাবে
বোঝার উপায় নেই এটা তার পূর্ব পরিকল্পনা। রেপ করার স্থানে আবার রেখে এসেছিল সায়নের নাম খোদাই করা ব্রেসলেট। শুদ্ধ দিয়েছিল ওই
ব্রেসলেটটা। সেটা পেয়ে কনকের ধারণা পূর্ব শত্রুতার জোরে একাজ সে করেছে। এরমধ্যে সিদ্দিকও যাতা বুঝিয়েছে। বিচারের দাবিতে কেসের কথা আগে স্মরণ করিয়েছিল। যাতে সায়নকে কেসে ফাঁসিয়ে নির্বাচন আঁটকাতে পারে। বোকা কনক বিশ্বাস করে সায়নের নামে কেস ঠুকেছে। যাতে কেস থাকায় নোমিনেশন আঁটকে যায়। তাদের প্ল্যান এই অবধিই ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু ঠান্ডা মাথার স্বর্ণ ব্যাপারটা সহজেই হজম পারে নি।

সায়নের গায়ে রেপ কেসের দাগ তার মনে ভয়ংকর জেদ সৃষ্টি করেছে।
ফলস্বরুপ আজমকে দিয়ে ছেলেগুলোর কাটা হাত পা নিয়ে সিদ্দিকের ছেলের গাড়ির ডিকিতে রাখিয়েছে। এদিকে সিদ্দিক যখন সায়ন এরেস্ট হয়েছে বলে আমোদে ফুর্তিতে ব্যস্ত তখন স্বর্ণই সিদ্দিকের ছেলেকে কট খাইয়ে দিয়েছে। এসব করার পর তাকে আগে জানিয়েছে। সব জেনে সে চুপ করে থানায় বসেছিল। বসেছিল বললে ভুল হবে যদিও, গরম গরম হালিম খাচ্ছিল পুলিশদের সাথে। বেশ ভালোই স্বাদের ছিল। এই অমৃত স্বাদের টানে হলেও সে আবার থানায় যাবে। যেতেই হবে!

অতঃপর তারা পাকিং লটে বাইক পার্ক করে এমনভাবে বাড়িতে প্রবেশ করল যেন কেউ টের না পায়। কিন্তু ড্রয়িংরুমে পা রাখতেই দেখে শীতল আর শারাফাত চৌধুরী বসে বসে লুডু খেলছে। টুকটাক খাবার দাবারও
দেখা যাচ্ছে। তাদের দেখে শীতল আড়চোখে বড় আব্বুর দিকে তাকাল।
এতক্ষণ ছলেবলে বড় আব্বুর কাছে শুদ্ধ নামের অনেককিছুই বলেছে।
বারণও করে দিয়েছে যাতে এসব না শুধায় তাহলে শুদ্ধ তাকে আবারও মারবে। একথা শুনে উনি জানিয়েছেন বলবে না। এতেই খুশিতে ডগমগ শীতল। এত রাতে ছেলেদের ফিরতে দেখে উনি ঘড়ির দিকে তাকালেন।
তারপর গমগম সুরে বললেন,
-‘ক’টা বাজে এখন? ভদ্রঘরের ছেলের এতরাতে বাসায় ফিরে? দিন দিন
বোধবুদ্ধি লোপ পাচ্ছে নাকি তোমাদের?’
তখন সায়ন জবাব দিলো,

-‘একটা কাজ ছিল বাবা।’
-‘মধ্যেরাতে কিসের কাজ? আর মানুষ রাজনীতি করে না? নাকি দেশে
তুমিই একমাত্র রাজনীতিবিদ?’
সায়ন মাথা চুলকে কথা বাড়াল না। বাবা যে তার উপর ভীষণ বিরক্ত সে জানে। আজকে সুযোগ পেয়েছে কথা শুনাতে একবিন্দুও ছাড় দেবে না।
ছেলেদের চুপ থাকতে দেখে শারাফাত চৌধুরী এবার শুদ্ধকে বললেন,
-‘আর শুদ্ধ, তুমি শীতলকে রাত জেগে বসে থাকতে বলেছো কেন? ও বাচ্চা একটা মেয়ে রাত জাগলে শরীর খারাপ করবে না? এসবও বলে দিতে হবে আমাকে?’
বাবার কথা শুনে শুদ্ধ কপাল কুঁচকে তাকালে শারাফাত চৌধুরী বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন,
-‘খবরদার বলছি ওর দিকে চোখ গরম করে তাকাবে না। নিজেরা রাত বিবেরে ফিরবে আর বাচ্চাটাকে খেতে দেওয়ার জন্য রাত জাগিয়ে বসে রাখবে? আজ দেখলাম এরপরে যেন এসব না দেখি।’

একথা বলে শীতলকে রুমে যেতে বলে উনিও চলে গেলেন। ছেলেরা বড় হয়েছে এখন কী আর কড়া শাষণ মানবে? তবুও যতটুকু না করলে নয়!বাবার জেরার হাত থেকে ছাড়া পেয়ে সায়ন জানাল খাবে না। প্রচুর ঘুম পাচ্ছে তার। একথা বলে দ্রুতপায়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেল। ভেবে নিলো স্বর্ণের রুমে খোলা পেলেই ঢুকে পড়াবে। বুকের ভেতরটা কুটকুট করছে। হাত নিশপিশ করছে কাউকে বুকের মধ্যে জাপটে ধরার জন্য।
ঠোঁটটাও কেমন করে জানি চুলচুল করছে কারো ঠোঁটের ডুব দেওয়ার বাহানায়। কিন্তু স্বর্নের রুমের বন্ধ দেখে বিরক্ত হলো। দু’বার নক করল। তারপর ফিসফিস করে ডাকল,

-‘জান! এ্যাই জান! দরজা খোল।’
-(…)’
-‘আরে বাল দরজাডা খুল। দুটো চুমু খেয়েই চলে যাব। শরীরের শক্তি পাচ্ছি না সোনা, কাছে আয় একটাবার। কতক্ষণ দেখি নাই তোকে। ওই হারামজাদা সিদ্দিকের বউয়ের কসম, তোর কপালে, দুচোখে, দুই গালে, নাকে, ঠোঁটে, থুতনীতে, গলায়, আর কাঁধে একটু চুমু খাব। এইটুকুতেই হয়ে যাবে আমার। খোল সোনা।’
-‘(…..)’
-‘ঘুমের ঢং মারাও? আমি জানি তুই ঘুমাস নি। স্বর্ণ! এ্যাই স্বর্ণকোমল!
বালের বউ আমার, তোর ঘুমের মায়েরে ভালোবাসা দিবসের শুভেচ্ছা। এবার তো খোল।’
-‘(…..)’
-‘চুমুর জন্য ক্ষুধার্থ আমি। তুই একজন ক্ষুধার্থ মানুষকে খেতে দিলি না।
পাষাণী কোথাকার। বদদোয়া করলাম তোকে তোর বাচ্চারা যেন ল্যাংটা হয়ে জন্মায়।’
এত ডেকেও সাড়াশব্দ না পেয়ে বকতে বকতেই নিজের রুমের দিকে পা বাড়াল সায়ন। আর স্বর্ণ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসছিল।

ওদিকে শুদ্ধ গা এলিয়ে সোফায় বসেছে। গা ঘামার কারণে পিঠের সেই ক্ষততে প্রচন্ড জ্বলছে। জংলীটা তখন সর্বশক্তি দিয়েই খামচি বসিয়েছে।
কী মনে করে শীতল পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলেও নিলো না। তাই দেখে
শীতল মুখ বাঁকাল। মনে মনে গালি দিলো। তখন শুদ্ধ বলল,
-‘আবার নালিশ করেছিস?’
-‘না, না, আমি কিছুই করি নি।’
-‘এটাও বিশ্বাস করতে হবে?’
-‘আমি টিভিতে মুভি দেখছিলাম। বড় আব্বু পানি নিতে এসেছিলেন।
আমাকে বসে থাকতে দেখে ঘুমাতে যেতে বললে আমি বলেছি সায়ন ভাইআর শুদ্ধ ভাই এখনো ফিরে নি। উনারা এলে খেতে দিতে হবে।’

-‘খেতে দে।’
-‘আচ্ছা।’
শীতল খাবার গরম করে খেতে ডাকলে শুদ্ধ খেতে বসল। তার পাশের চেয়ারে আইসক্রিম নিয়ে বসল শীতল। তারপর পটানোর সুরে বলল,
-‘শুদ্ধ ভাই, আপনি ওই হাদিসটা জানেন?’
-‘কোন হাদিস?’
-‘ শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকানোর আগে পারিশ্রমিক দেওয়ার কথা বলা হয়েছে ‘ ওই হাদিসটা।’
-‘চ্যালাকাঠ রেখে এসেছিস?’
-‘সেই কক্ষণ।’
-‘যা, ঘুমাতে যা।’
-‘যাব তো। আমার পারিশ্রমিক দেন। আমরা মুসলিম ঘরের ছেলে-মেয়ে, আমাদের উচিত অক্ষরে অক্ষরে হাদিস পালন করা, তাই না?’

-‘হুম, হুম, তা তো অবশ্যই। আমার কাছে টাকা নেই রুমে চল দিচ্ছি।’
-‘ এতক্ষণ বসে ছিলাম একটু বাড়িয়ে দিয়েন। জানেনই তো শ্রমিকদের খুশি করলেও আল্লাহও খুশি হোন।’
-‘ ও নিয়ে ভাবিস না। তোকে খুশির চূড়ান্ত লেভেল অবধি ঘুরিয়ে আনার দায়িত্ব আমার।’
-‘ বলছিলাম যে, দেশে ফিরলেন আমাদের জন্য কিছু মিছু আনেন নি?
না মানে প্রতিবারই তো আনেন।’
-‘তারমানে আবার আমার ট্রলি হাতিয়েছিস তুই?’
-‘ ইয়ে মানে একটু হাতিয়েছিলাম। কই চকলেট টকলেট পেলাম না তো।’
একথা শুনে শুদ্ধ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। এত মারে, বকে, তাও শুধরানোর নয় এই মেয়ে। এই কী কখনো বড় হবে না? বুদ্ধি সুদ্ধি হবে না? জবাবের অপেক্ষায় তাকিয়ে থাকতে দেখে সে বলল,
-‘প্রতিবার তোদের জন্য আনি এবার শুধু আমার জন্য এনেছি। একটা পারফিউমও তো আস্ত রাখিস নি। তাই আরো ভালো ভালো পারফিউম এনেছি।’

-‘এগুলোর দাম কী ওগুলোর চেয়েও বেশি?’
-‘হুম।’
-‘আমি গিয়ে দেখি তাহলে?’
-‘যাবি? যা। খবরদার নষ্ট যেন না নাহয়।’
-‘আচ্ছা।’
একথা বলে শীতল খুশিতে গদগদ হয়ে দৌড়ে চলে গেল। শুদ্ধ ধীরে সুস্থে খেয়ে রান্নাঘরে সব রেখে রুমের দিকে গেল। পাখি খাঁচায় ঢুকে পড়েছে বাড়তি তাড়া নেই যদিও। তখন পাখিকে একটু শিক্ষা দেওয়া যাক। মনে মনে এসব ভেবে রুমে গিয়ে দেখে শীতল ট্রলি নিয়ে বিছানার মাঝখানে বসেছে। দুটো ট্রলি থাকায় প্রথমে যেটা খুলেছে সেটা শুদ্ধর কাপড়ের। সেখানে কিছু না পেয়ে কাপড় চোপড় এলোমেলো করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে। আরেকটা খুলে পারফিউমের মোড়ক খুলে দেখছে। পুরো রুম পারফিউমের গন্ধে মৌ মৌ করছে। শুদ্ধ আপাতত কিছু বলল না, রুমের দরজা লক করে স্টাডি টেবিলের উপর বসল। খাতা ও কলম টেনে নিয়ে ঘসঘস করে কিসব লিখল। তারপর ঝরঝরে হাতের লেখায় পূর্ণ খাতাটি শীতলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

-‘এখানে পনেরোটা ব্যাকটোরিয়া ও কোন ব্যাকটোরিয়ায় কোন রোগ হয় লেখা আছে। এগুলো মুখস্ত করে, লিখে, এরপর রুম থেকে বের হবি।’
শীতল হতবাক। এই মধ্যরাতে কোন দুঃখে ব্যাকটোরিয়ার নাম মুখস্ত করতে যাবে? নিজের পড়া ধরে ছুঁয়ে দেখে না অথচ..! সে খাতাতে চোখ বুলিয়ে দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকাল। তারপর বলল,
-‘এতরাতে ব্যাকটোরিয়ার নাম মুখস্থ করব কেন শুদ্ধ ভাই?’
-‘ কোন ব্যাকরোটিয়ার কারণে কোন রোগ হয়। কোন ওষুধে রোগ সারে।
একটা মেডিসিন তৈরি করতে কত খাঁটুনি খাঁটা লাগে। এসবও তো জানা দরকার, তাই না? তাছাড়া মেডিসিন ট্রায়াল দিতে ইঁদুরের হোগ..না মানে বামে ইনজেনশন মারি কেন এর পেছনের কাহিনীও জানতে পারবি।’
শীতল মুখ লটকে তাকিয়ে রইল। মধ্যরাতে এসব অত্যাচার সহ্য হয়? সে খাতাতে চোখ বুলিয়ে নিলো। এত বড় বড় ইংলিশ বানান উচ্চারণ করবে কীভাবে? পড়তে গিয়ে দাঁতগুলো না ঝরঝর করে পড়ে যায়। সে খাতা থেকে নজর সরিয়ে বিছানা থেকে নামতে নামতে বলল,

-‘ অনেক রাত হয়েছে। বড় আব্বু রাত জাগতে বারণ করেছে। শরীরটাও খারাপ লাগছে শুদ্ধ ভাই। কাল মুখস্ত করে দেবো।’
একথা বলে দরজার কাছে গিয়ে দেখে দরজা লক করা। পার্স ইন করলে দেখাচ্ছে রং পার্সওয়াড৷ সে বিষ্ফোরিত দৃষ্টিতে পেছনে ঘুরে দেখে শুদ্ধ নেই। ওয়াশরুম থেকে পানি পরার শব্দ আসছে। অর্থাৎ জব্দ করার সব পথ ঠিকঠাক করে সে গেছে ফ্রেশ হতে। শীতল পুনরায় পার্স দিলো। না, তাও হলো না বরং শুদ্ধর ফোনে এর্লাট নোটিফিকেশন আসতে থাকল। শীতল কাঁদো কাঁদো হয়ে পুনরায় বিছানায় বসল। এবার কি হবে? বিশ মিনিট পর শুদ্ধ মাথা মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলো। কালো টাউজার আর সাদা টি-শার্ট। তাকে মলিন মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শুদ্ধ শুধাল,
-‘মুখস্ত? বল দেখি?’

-‘শুদ্ধ ভাই আর কখনো আপনার অবাধ্য হবো না। টাকাও লাগবে না। যেতে দিন প্লিজ।’
একথা শুনে শুদ্ধ এগিয়ে তার মুখোমুখি দাঁড়াল। ঠান্ডা হাতে শীতলের কপাল স্পর্শ করে তাপমাত্রা দেখে বলল,
-‘জ্বর নেই তো। তাহলে ভুল বকছিস কেন?’
-‘সত্যি বলছি।’
-‘এই সত্যি এই অবধি কতবার বলেছিস?’
-‘বুঝতে শেখার পর থেকেই তো বলছি। তাও ধরেন হাজার দশেক পার হয়েছে বলা।’
-‘রেখেছিস কথা?’
-‘না।’

-‘তাহলে এবারও রাখতে হবে না। তুই এটা মুখস্ত করতে করতে আমার জামা কাপড়গুলোও দ্রুত গুছিয়ে ফেল। পারফিউমগুলোর জানপ্রাণ খেয়েছিস না? এবার নিজ দায়িত্বে নতুন পারফিউমগুলো সাজা দেখি।
আর চ্যালাকাঠ কই?’
-‘খাটের নিচে।’
শুদ্ধ সেটা বের করে দেখে লাল মেহগুনি গাছের শক্তপোক্ত চ্যালাকাঠ। বিড়াল মারার কথা শুনে মোটাসোটাই এনেছে। সে চ্যালাকাঠটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে বলল,
-‘ কাজে হাত দেওয়ার আগে চ্যালাকাঠটাকে ঝটফট সালাম কর দেখি।’
-‘আর করব না বললাম তো।’
একথা বলেই শীতল ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে দিলো। না মারতেই কেঁদে কেঁটে একাকার অবস্থা। তখন শুদ্ধ বলল,
-‘সন্ধ্যায় খামচি মেরেছিলি কেন? জানে ভয় নেই? একবারও মনে হয় নি
এর ফল কি হতে পারে?’

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ২৭

শীতল এবার বুঝল তখনকার রাগ তোলার জন্য তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে এখানে এনেছে। সে ভেজা চোখে পিটপিট করে তাকাল। বুঝল কিছু না বললে মার হজম করতে হবে। কিন্তু বিনাবাক্যে মার না খেয়ে তার ভুলও চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া দরকার। তাই আর কিছু না ভেবে সে পেছনে ঘুরে কামিজের চেনের কিছুটা নামিয়ে দিলো। সাথে সাথে শুদ্ধর নজর আঁটকাল শীতলের ফর্সা মসৃণ পিঠে চেপে লেগে লাগা কালো রঙা অন্তবার্সের চিকন ফিতায়। শীতলের বোকামিতে শুদ্ধ নিজে খৈই হারিয়ে ফেলল। এক ধাপ পিছাতে গিয়ে হাত থেকে চ্যালাকাঠ পড়ে গেল। তখন শীতল কান্নামিশ্রিত গলায় বলল,
-‘দেখুন আপনার জন্য মৌমাছি কামড়ে কী করেছে। ওহ নিজের ব্যথাটা ব্যথা আর আমারটা বুঝি শরীর না? আমার বুঝি ব্যথা লাগে না? কষ্ট হয় না, না?’

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ২৯