শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৩

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৩
নূরজাহান আক্তার আলো

এখন নিশুতি রাত। ধীরে ধীরে ঘড়ির কাঁটা এগোচ্ছে তিনের ঘরে। গাঢ় আঁধারে ডুবে আছে ধরাধাম। আকাশে উঠেছে মস্ত বড় পূর্নিমার চাঁদ। বইছে মৃদু বাতাস। আশেপাশে কোথাও একদল কুকুর ডাকছে নিজস্ব স্বরে। দু’একটা জোনাকির দেখা মিলেছে অদূরের ঝোপে। তারা নিজস্ব আলো জ্বালিয়ে উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে স্বাধীন মনে। থেমে থেমে ঝিঁঝি পোকাও তাল মেলাচ্ছে অদ্ভুত স্বরে। ঠিক সেই মুহূর্তে বাসা থেকে বেরিয়ে এলো শখ আর স্বর্ণ। হাঁটছে ধীর গতিতে। ভয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে সর্তক দৃষ্টিতে। তাদের থেকে মাত্র কয়েক হাত দূরে অন্ধকারে
দাঁড়িয়ে আছে একটি পুরুষ অবয়। দারোয়ান কাকাকে দেখা যাচ্ছে না।

বেঘোরে ঘুমাচ্ছে বোধহয়। আর একটু সামনে এগিয়ে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির দেখা পেয়ে দ্রুত এগিয়ে গেল তারা। আর্তনাদ করে জাপটে ধরল সেই অগন্তুককে। আঘাতপ্রাপ্ত শরীরে হালকা স্পর্শও জান বেরিয়ে যাওয়ার যোগাড়। তবুও অগন্তুক ব্যথাতুর শব্দ না করে নিজেকে সামলে নিলো।
জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করল। দু’জনকে জাপটে ধরে কিছু বলার চেষ্টা করল। কিন্তু অতিরিক্ত জ্বরে কাঠ হয়ে আসা কন্ঠস্বরে কোনো শব্দই বের হলো না। কয়েকবার শুকনো ঢোক গিলেও চেষ্টায় ব্যর্থ হলো। তাকে এই অবস্থায় হাসতে দেখে শখ কান্নাভেজা স্বরে বলল,
-‘একি অবস্থা তোমার? কোথায় ছিলে তুমি? ফোন বন্ধ ছিল কেন?’
ছোটো বোনের কথা শুনে বুজে আসা চোখ দু’টো পুনরায় খুলল সায়ন।
আশেপাশে তাকাল। তারপর ধীরে ধীরে বলল,
-‘আমাকে ধর বোন। মাথা ঘুরছে। হাঁটতে পারছি না। মনে হচ্ছে এক্ষুণি
পড়ে যাব।’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ভাইয়ের কথা শোনামাত্রই স্বর্ণ আর শখ দ্রুত তাকে ধরল। তাদের চোখে পানি দেখে সায়ন কাঁদতে বারণ করল। ফিসফিস করে জানাল, সে ঠিক আছে। এবং বাড়ির কেউ জানার আগে তাকে এখুনি রুমে নিয়ে যেতে।
ভাইয়ের অবস্থা দেখে কেউ কথা বাড়াল না ধীরে ধীরে দো’তলায় নিয়ে
যেতে সামনে পা বাড়াল। চৌধুরী নিবাসের দো’তলার রুমগুলো বাড়ির ছোটো সদস্যদের দখলে। বড়রা থাকে নিচ তলায়। দো’তলার সায়নের পাশে শুদ্ধর রুম। শুদ্ধর পাশটায় শখের রুম। শখ, স্বর্ণ এক রুমে থাকে। ওরা দু’জন ঘুমায়ও একসাথে। কিন্তু শীতলকে নেয় না কারণ শীতলের ঘুমানোর ভঙ্গিমা ভালো না। সে ঘুমের ঘোরে পাশের জনের বুকের উপর পা তুলে দেয়। ঘুমের ঘোরে বকবক করে। হাসে। পাশের ঘুমন্ত মানুষটা যদি হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠে তাহলে কেমন লাগে? তাছাড়া শখ
আর স্বর্ণ দু’জনই রাত জেগে ফোনে কথা বলে। তারা এখন বড় হয়েছে। ব্যক্তিগত মানুষও রয়েছে এসব শীতল জানলে সবাইকে জানিয়ে দেবে। এই মেয়ের পেট পাতলা, তার পেটে কথা থাকে না। অগত্যা শীতল একা একটা রুমে থাকে। তার রুমের দরজা সব সময় হাট করে খোলা থাকে।

বলা বাহুল্য, ইচ্ছে করে দরজা খোলা রাখে যাতে ভয় পেলে দৌড়ে বের হতে পারে। শখ, স্বর্ণ বের হওয়ার আগেও দেখে এসেছে শীতল হাত পা ছড়িয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। কথা বলার সময় শীতলের গলার স্বর আস্তে হয় না। তার ফিসফিস করা কথাও পাশের জন্য শুনে ফেলে তাই তাকে ডাকার ভুল করে নি তারা। তাছাড়া সায়ন তাদের কল করে বলেছে যেন
কেউ বুঝতে না পারে এমনভাবে বাসার বাইরে আসতে। কারণ তার এই অবস্থা দেখে তুলকালাম ঘটে যাবে। যা হবে সকালে দেখা যাবে এ মুহূর্তে তার বিশ্রামের দরকার। শরীর ছেড়ে দিচ্ছে। অসহ্য ব্যথায় দু’চোখ বুজে আসছে। তাছাড়া এবারই যে প্রথম তা নয়, এভাবে প্রায়দিনই মধ্যেরাতে বাসায় ফিরে সে। আর তাকে চুপিচুপি বাসায় ঢুকতে সাহায্য করে তারই ছোটো বোনেরা।

তারা চারজন বাইরে থেকে সিঁড়ির কাছে আসতেই হঠাৎ ড্রয়িংরুমের লাইন জ্বলে উঠল। অন্ধকার কেটে আলোর মাঝে দেখা গেল শাহাদত চৌধুরী দাঁড়িয়ে আছেন। দৃষ্টি তাদের দিকে নিবদ্ধ। ছোটো চাচ্চুকে দেখে চারজন ধরা পড়ে মাথা নিচু করে নিলো। তবে মনে মনে খানিকটা স্বস্তি পেলো শারাফাত চৌধুরী কাছে ধরা না পড়ায়। উনার কাছে ধরা পড়লে খবর ছিল তাদের। শাহাদত চৌধুরী আঘাতপ্রাপ্ত সায়নের আপাদমস্তক তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। ছেলেটার মাথায়, হাত-পায়ে ব্যান্ডেজ করা। এই ছেলেকে কতবার বুঝিয়েছেন এসব রাজনীতি টাজনীতে না জড়াতে কিন্তু এই ছেলে কথা শুনলে তো? শুধু একবার নয় বার বার বাড়ির সব সদস্যরা তাকে বুঝিয়েছে এসব না করতে, কিন্তু সে শোনে নি। বরং জেদ দেখিয়ে দলনেতা হয়েছে। তার চ্যালাপেলারা তাকে ভাই ভাই করে ডেকে মুখে ফ্যানা তুলে ফেলে। মিছিল, মিটিং করে। মারামারিতেও দেখা যায়।

যত দিন যাচ্ছে রাজনীতির সঙ্গে আরো জড়িয়ে যাচ্ছে সে। এবং আজ
জানা গেছে আবু সিদ্দিক নামের একজন রাজনীতিবিদের ডান হাত সে।
নির্বাচনের জন্য যত দৌড় ঝাপ করতে হয় করছে আবু সিদ্দিকের হয়ে।
একথা শোনামাত্র শারাফাত চৌধুরী ভীষণ ক্ষেপেছে তার উপর। কারণ চৌধুরী নিবাসের কেউ সরাসরি রাজনীতিতে জড়ায় নি কখনো। সায়ন’ই
এই দুঃসাহস দেখিয়েছে। এসবের চক্করে কবে যে মার খেয়ে ম’রে রাস্তায় পড়ে থাকে কে জানে! ভালো স্টুডেন্ট সে। রেজাল্টও ফার্স্টক্লাস। অথচ আবেগের বশে ভুল ডিসিশন নিয়ে ক্যারিয়ার নষ্ট করতে রাজনীতিতে নাম লিখিয়েছে। তাকে কোনোভাবেই বোঝানো যাচ্ছে না রাজনীতি এত সোজা নয়। রাজনীতিতে টিকতে গেলে নোংরা সাফ করার সঙ্গে নিজের গায়ে নোংরা লাগাতে হয়। লয়্যাল পারসোন হয়ে আর যায় হোক কখনো রাজনীতি করা যায় না। করলে জান, মানসহ, ক্ষমতা স্থায়ীত্ব থাকে না। এসব ভাবতে ভাবতে উনি এগিয়ে এলেন। ড্রয়িংরুমের দেওয়ালে সেটে রাখা বড় দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময়টা দেখে নিলেন। একবার তাকালেন বড় ভাইয়ের রুমের দিকে। ওই মানুষটা কিছুক্ষণ আগে রুমে গিয়েছে। ছেলের টেনশনে অস্থির হলেও কাউকে বুঝতে দিতে রাজি নন তিনি। সায়ন পরশুদিন দুপুরে সবার সঙ্গে খেয়ে বের হয়েছিল। এরপর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না তার। ফোনও বন্ধ ছিল। তার ফ্রেন্ডারাও খোঁজ দিতে পারছিল না। দলেন চ্যালাপেলাদের জিজ্ঞাসা করেও লাভ হয় নি।

মধ্যখানে একদিন পর এতরাতে বাড়ি ফিরেছে সে। ছেলেটা বাড়ি ফিরে নি দেখে বড়দের কারো খাওয়া নেই, চোখে ঘুম নেই। অথচ এই ছেলের মধ্যে একফোঁটা অনুশোচনা নেই। খারাপ লাগার রেশ নেই। মনে মনে এসব ভেবে উনি শখ ও স্বর্ণকে সরতে বলে নিজে সায়নকে ধরে উপরে নিয়ে যেতে যেতে বললেন,
-‘নিজের জানের মায়া না করো বাবা মায়ের কথা অন্তত মাথায় রাখতে পারো। তাদের বয়স হচ্ছে। আর কত?’
সায়ন বরাবরের মতোই নিরুত্তর! রোজ এক কথা শুনতে শুনতে কানের পোকা বের হয়ে গা সওয়া হয়ে গেছে। এখন কেউ কিছু বললে তার গায়ে
লাগে না। খারাপও লাগে না। বরং বেহায়া মনে আনন্দ হয়। কারণ ভীষণ
শখের পেশায় নিজের নামতৈরি করতে পেরেছে। ক্ষমতা অর্জন করেছে।
তার নাম, শাহরিয়ার চৌধুরী সায়ন। রাজনীতির মাঠে তাকে শাহরিয়ার ভাই নামে পরিচিত সে। এটা তার কাছে গর্বের, অহংকারের।

শাহাদত চৌধুরী তাকে ধরে রুমে পৌঁছে দিয়ে সাবধানে বিছানায় শুঁইয়ে দিলেন। কিভাবে এই অবস্থা হলো সরাসরি জিজ্ঞাসাও করলেন। সায়ন জানাল, বিপক্ষ দলের ছেলে-পুলেরা একা পেয়ে দু’ঘা বসিয়েছে। একা থামাতে পারে নি কাউকে ফলস্বরূপ আধমরা হতে হয়েছে। রাজনীতি মানেই তো একদিন মারো তো আরেকদিন মার খাও। এ আর নতুন কি!
মাঝখানে একদিন হসপিটালে ছিল। বাসায় জানলে দুঃচিন্তা করবে তাই কাউকে জানায় নি সে। ফোনটা হারিয়ে গেছে বিধায় কাউকে জানাতেও পারেনি। দুঃচিন্ততার কারণ নেই সে একদম ঠিক আছে। একের পর এক
সায়নের দূর্বল যুক্তি শুনে শাহাদত চৌধুরী শুধু শুনলেন। তারপর কিছু লাগবে কি না জানতে চাইলেন। সায়ন বালিশে মাথা রেখে না বোধক মাথা নাড়লেও মনে মনে ঠিকই বলল,
-‘ছোটোবেলার মতো প্যান্ট খুলে আমাকে হিসু করিয়ে আনো চাচ্চু। বড্ড চাপে আছি।’

এখন বড় হয়েছে এ কথা কী আর মুখে বলা যায়? তবুও দুহাতে ব্যান্ডেজ
দেখে শাহাদত চৌধুরী নিজে থেকেই জানতে চাইলেন ওয়াশরুমে যাবে কী না। মনের কথা বুঝে ফেলায় সায়ন একটু লজ্জাও পেলো। তবে মুখে বলল যাবে না। একথা শুনে উনি চলে গেলেন। উনি যাওয়ার পরপর শখ আর স্বর্ণ খাবার হাতে রুমে ঢুকল। শখ নিজে হাতে বড় ভাইকে খাইয়ে মেডিসিন খাইয়ে দিলো। এদিকে খাওয়ার পর পর প্রেসাবের চাপ আরো বেড়েছে। ছোটো বোনদেরও বলতে পারছে না ওয়াশরুমে নিয়ে যাওয়ার কথা। যতই হোক বোন তো! এদিকে ঘড়িতে কাটা এসেছে তিনের ঘরে।
সময় কাটছে যেন বাতাসের গতিতে। অনেক রাত হয়েছে দেখে বোনদের ঘুমাতে যেতে বলে কাঠ হয়ে পড়ে রইল সে। শখ ভাইয়ের গায়ে চাদর টেনে পা বাড়াতেই সায়ন চোখ বন্ধ করা অবস্থায় বলল,

-‘শুদ্ধ কি বাসায় আছে নাকি চলে গেছে?’
-‘ ছোটো ভাইয়া বাসাতেই আছে।’
-‘ওকে ডেকে দিয়ে যা। আস্তে ডাকিস কেউ যেন না শোনে।’
-‘আচ্ছা ভাইয়া।’
একথা বলে শখ আর স্বর্ণ শুদ্ধর রুমের দরজায় নক করল। দু’বার নক করতেই শুদ্ধ বেরিয়ে এলো। সম্ভবত পড়ছিল। এতরাতে দু’জনকে দেখে কিছু বলার আগে স্বর্ণ জানাল সায়ন ডাকছে। এতরাতে সায়নের ডাকা মানে আহত হয়ে বাড়ি ফিরেছে। সে কথা না বাড়িয়ে তাদের যেতে বলে নিজেও পা বাড়াল বড় ভাইয়ের রুমে। শুদ্ধ সায়নের রুমে গিয়ে কেবল দাঁড়াতেই সায়ন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ছোটো ভাইয়ের দিকে তাকাল। রাগে মুখ থমথম করছে তার। এতক্ষণ নিজেকে সামলালেও শুদ্ধকে দেখামাত্রই চড়চড় করে রাগ বাড়ছে। ইচ্ছে করছে নাক বরাবর ঘুষি বসিয়ে দিতে। শুদ্ধ বড় ভাইয়ের দৃষ্টির মানে বুঝেও নির্বাক। সে জানে তাকে ডাকার মূল কারণ। সে নিজেও ভাইয়ের দিক থেকে দৃষ্টি সরাল না। বরং চোখে চোখ রেখে সামনের সোফায় রাজকীয় ভঙ্গিমায় বসল। তাকে এভাবে বসতে দেখে সায়নের মেজাজ আরো বিগড়ে গেল। সে ব্যথা শরীরের চট করে উঠে বসল। তারপর রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,

-‘যেটা করছিস ভালো হচ্ছে না এখানেই থেমে যা।’
-‘কোনটা ভালো হচ্ছে না?’
-‘কিসের কথা বলছি ভালো করেই জানিস। মিষ্টি কথার বাউয়াল বাদ দিয়ে ঝেড়ে কাশ।’
-‘তুমি কি আমার গফ যে মিষ্টি বাউয়াল ঝাড়ব? কেন, ডেকেছো বলো?’
-‘তুই আমার পিছু পিছু কৃষ্ণনগর কেন গিয়েছিল?’
শুদ্ধ সঠিক জবাবের ধারে কাছেও গেল না। বরং ত্যাড়া কন্ঠে তাচ্ছিল্য করে বলল,
-‘ ভুল পথ ছেড়ে সঠিক পথে এসো। এতে তুমি,আমি দু’জনেই ভালো থাকব।’
-‘আমি সঠিক পথেই আছি।’
-‘না নেই। তুমি ভুল মানুষের সঙ্গ পেয়ে ভুলকে সঠিক বলে চালিয়ে দিলে হবে না। তোমাকে আগেও বলেছি চোখ, কান, খোলা রেখে আগে মানুষ চিনে পা বাড়াও।’

-‘এখন তোর থেকে আমাকে মানুষ চেনা শিখতে হবে? আমি বোকা, তুই চালাক এটাই বোঝাতে চাচ্ছিস?’
-‘বোঝাতে চাচ্ছি না সরাসরি বলছি, তুমি বোকা। বোকা বলেই যে কেউ সহজে তোমার ব্রেণ ওয়াশ করতে পারে। তুমি না ভেবেই ভুল মানুষকে বাঁচাতে বুলেটের সামনে বুকে পেতে দাঁড়িয়ে যাও। শেইম অন ইউ ভাই!’
-‘শুদ্ধ!’
ভাইয়ের ধমক শুনেও শুদ্ধ দমল না। বরং সে আগের তুলনায় তীক্ষ্ণসুরে পাল্টা জবাব দিলো,
-‘চেঁচিয়ে সত্যকে মিথ্যা প্রমাণের বৃর্থা চেষ্টা করে এনার্জি লস কোরো না।
এখনো সময় আছে মানুষ চেনা শিখে নাও। নয়তো চরম মূল্য দিতে হবে তোমাকে। আজ তোমার দলের একজনকে মেরেছি একই কাজ করলে
আগামীতে আরো দশজনকে মারব। একজন রিসার্চার হিসেবে শুধু নাম
কামিয়েছি তা কিন্তু নয়; ঘাড়ত্যাড়া হিসেবেও নামডাক রয়েছে আমার। আর সেটা তোমার থেকেও কেউ ভালো জানে না নিশ্চয়ই!’

-‘ঢাকায় ফিরে যা। এসবের মধ্যে নিজেকে জড়াস না। এক কথা বারবার বলতে পারব না। এর আগে তোর গায়ে হাত তুলি নি আর তুললেও চায় না। ফিরে যা। নিজের কাজে মন দে। আমার পার্টি অফিসের আশেপাশে তোকে যেন না দেখি। সবার কাছে তুই ভালো ছেলে, তাই হয়েই থাক।’
-‘বড় ভাই যদি ভুল পথে পা বাড়ায় তাকে সঠিক পথে আনার দায়িত্বটাও আপনাআপনিই ছোটো ভাইয়র ঘাড়ে চলে আসে। আমি সর্বদা আমার দায়িত্ব পালনে অটল থাকি। আছি। তাই থাকব। আর তোমাকে আগেও বলেছি সিদ্দিক ভালো মানুষ নয়। তার সঙ্গে কাজ করতে পারবে না তুমি।’
-‘কেন পারব না?’
-‘আমি বারণ করছি তাই।’
-‘তুই বারণ করার কে?’
-‘আমি কে সেটা নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করো উত্তর পেয়ে যাবে। তবে আমি যখন বলেছি তুমি সিদ্দিকের হয়ে কাজ করতে পারবে না মানে পারবে না। আমি তোমাকে করতে দেবো না।’

-‘এবার বাড়াবাড়ি করছিস তুই।’
-‘হয়তো। তবে আমি ততক্ষণ ভালো যতক্ষণ আমার আপনজন নিরাপদ থাকে। তোমার ছেলেদের মানা কোরো চৌধুরী নিবাসের দিকে ভুলেও
যেন চোখ তুলে না তাকায়। নয়তো রিসার্চের কাজে ব্যবহার করা ইঁদুরের পরিবর্তে তাদের জলজ্যান্ত শরীর ব্যবহার করব। এতে একটুও খারাপ লাগবে না আমার। বরং কয়েকটা নিরহ ইঁদুর বেঁচে যাবে বলে ভালোই লাগবে।’
একথা বলে শুদ্ধ উঠে চলে গেল। সায়ন দাঁতে দাঁত চেপে তাকিয়ে রইল তার যাওয়ার দিকে। রাজনীতি করে সে আর তাকে কি না দাপট দেখায় এই ছেলে। এত বড় সাহস, ছোটো হয়ে বড় ভাইকে থ্রেট দেয়! শুনবে না। কারো কথাতেই রাজনীতি থেকে সরবে না সে৷ সেও এবার দেখবে শুদ্ধ ঠিক কি করে, কতদূর অবধি যেতে পারে। এদিকে রুম থেকে বের হয়েও আবার ফিরে এলো শুদ্ধ। সায়নের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,

-‘চলো।’
-‘কোথায়?’
-‘ছোটো হয়েও বহুবার বড় ভাইকে ছোট কাজ সারতে সাহায্য করেছি। আজও দায়িত্ব পালন করি। হাত ধরো।’
একথা শুনে সায়ন দাঁত কটমট করে তাকিয়ে রইল। জেদ দেখিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলো ভাইয়ের থেকে। তাকে মুখ ফিরাতে দেখে শুদ্ধও এক ভ্রুঁ
উঁচু করে ত্যাড়া স্বরে বলল,
-‘মুখ ফিরিয়েও লাভ হবে না। এখন আমার সঙ্গে তোমাকে ওয়াশরুমে যেতে হবে আর আমার কথাতেই তোমাকে সিদ্দিকের সঙ্গ ছাড়তে হবে। একথার নড়চড় হবে না। চাইলে চেষ্টা করে দেখতে পারো তবে ফলাফল যা আসবে আমার কথামতোই । প্রয়োজন লিখে রাখো। আমি শুদ্ধ যে, এককথার মানুষ সেটা মনে করিয়ে দিতে হবে না নিশ্চয়ই!’
একথা বলেই শুদ্ধ ভাইয়ের হাত শক্ত করে চেপে ধরে উঠে দাঁড় করাল।
এদিকে তলপেটের চাপ অন্যদিকের ভাইয়ের জেদের কাছে হার মেনে সায়নকে উঠতেই হলো।

শারাফাত চৌধুরীর তিন সন্তান সায়ন, শুদ্ধ, শখ। তারা বরাবরই মেধাবী স্টুডেন্ট। তাদের সঙ্গে পড়াশোনা নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করতে হয়নি কাউকেই।বরং তারা ফার্স্ট ক্লাসে উত্তীর্ণ হয়েছে প্রতিটা পরীক্ষায়। ক্লাস টেন অবধি শুদ্ধ, সায়ন সময় বের করে ছোটো বোন শখকে পড়িয়েছে। তার জটিল সমস্যাগুলো যত্ন করে বুঝিয়েছে। বুঝাতে গিয়ে কখনো মেরেছে কখনো
বকেছে। শখ মার বকা খেয়ে তাদের কাছেই পড়া শিখেছে। শখ সায়নের কাছে পড়ত ইংলিশ, শুদ্ধর কাছে ম্যাথমেটিক্স। তাদের পড়ানোর ধরণে
আলাদা করে টিউশনির ব্যবস্থা করে দিতে হয় নি কখনো। বোনের জন্য
প্রয়োজনীয় সাজেশন, নোটস্, তারা নিজেরা কালেক্ট করে এনে দিতো।
কার থেকে আনত এই প্রশ্ন করার সাহস হয় নি শখের। সে শুধু মন দিয়ে পড়ত।তাকে পড়ানোর মূল শর্ত ছিল ভালো রেজাল্ট। কিভাবে করবে কী সে জানে। শুদ্ধ, সায়ন দু’জনই মাসে দু’টো করে পরীক্ষা নিতো।কোশ্চেন করত জটিল করে। এতটা জটিল যে মাঝে মাঝে কোশ্চেন দেখে শখের ঘাম ছুটে যেত। ভুলেও যেত এটা কোনো বোর্ড পরীক্ষা নাকি অন্যকিছু।

তবে পরীক্ষায় ভালো করলে যখন দু’ভাই তার আবদার পূরণ করত খুব খুশি হতো। মনে হতো কষ্ট সার্থক! এমন কষ্ট করতে ইচ্ছুক সে। পরীক্ষায় ভালো ফল করে সায়নের কাছে তার প্রথম আবদার ছিল, ‘ভাইয়া, আমি ফানুস উড়াতে চাই। এত ফানুস উড়াতে চাই যেন আকাশটা পুরো ফানুস ফানুস দেখায়।’
সপ্তাহ খানিক পর তার আবদার পূরণ করেছিল সায়ন। সে অনেকগুলো ফানুস এনে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে হইহই করে ফানুস উড়িয়েছিল। কি যে চমৎকার ছিল সেই মুহূর্তটুকু। রাতের বেলা ছাদে গিয়ে আকাশের দিকে তাকালেই সেদিনের কথা পড়ে যায় তার। সায়ন এই বাড়িতে বড় ছেলে হলেও বাড়িতে সবার সঙ্গে হাসি মুখে কথা বলে। মজা করে। বোনদের পেছনে লাগে। হাতভর্তি জিনিস এনে দেয়। ছোটো খাটো আবদার পূরণ করে। তবে তার থেকে শুদ্ধ একটু ব্যক্তিক্রম। সহজে হাসতে দেখা যায় না তাকে। হাসলেও মুচকি হাসি অবধি সীমাবদ্ধ। এই স্বভাব পেয়ে তার বাবার শারাফাত চৌধুরী থেকে। শারাফাত চৌধুরী যুবককালের কার্বন কপি যেন শুদ্ধ। কথায় কাজে একই রকম ত্যাড়া স্বভাবের। যা পছন্দ নয় কখনো করবে না। তাকে দিয়ে সেকাজ কেউ করাতে পারবে না। আবার যা পছন্দ তার থেকে কেড়ে নিতে পারবে না। যেটা তার শুধু তারই। যেটা করবে বলে ঠিক করবে, সেই করবেই। তাকে আঁটকানো মুশকিল প্রায়ই।

স্বাভাবিক কথা বলার সময়ও তার দৃষ্টি দেখে আচমকা বুকটা ধক করে ওঠে। মনে হয় এই বুঝি মনের গোপন কথা পড়ে ফেলল। সায়নের সঙ্গে সব ভাইবোনের সম্পর্ক খুনশুঁটিপূর্ণ হলেও শুদ্ধর সঙ্গে বনিবনা পড়ে না কারো। শারাফাত আর শুদ্ধ বাড়ির এই দুই পুরুষ একটু আলাদায় বলা
চলে। নিজের আপন ভাই হলেও শখ তাকেও একটু ভয় পায়। পরীক্ষায় ভালো ফল করে সে ভয়ে ভয়ে শুদ্ধর কাছে আবদার করেছিল, ‘ ভাইয়া তোমার কাছে আমি কিছু চাই। ‘
খাতাতে ম্যাথ করতে করতে শুদ্ধ চোখ তুলে বোনের দিকে তাকালে শখ
থতমত খায়। কথা ভুলে যায়। কথার খৈ হারিয়ে সে ভুলে যায় কি বলতে
চেয়েছিল। বোন ভয় পাচ্ছে দেখে শুদ্ধ নরম সুরে জিজ্ঞাসা করেছিল,
-‘কি চাস বল?’
-‘রিসার্চার শোয়াইব চৌধুরী শুদ্ধ’র বোন হিসেবে সবার কাছে এক্সট্রা সন্মান পেতে চাই। তোমাকে সফল রিসার্চার হিসেবে দেখতে চাই আমি।’

একথা শুনে শুদ্ধ জবাব দেয় নি। হাসেও নি। শুধু বোনের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়েছিল। রিসার্চার হওয়ার তারও স্বপ্ন ছিল কিন্তু শারাফাত চৌধুরী চাইতেন সে মেরিনার হোক। বড় বড় শিপে শিপে ঘুরে বেড়াক দেশ হতে দেশান্তর। যখন বোনকেও সাপোর্ট পেতে দেখল সেও
সিদ্ধান্তে অটল রইল। এরপরেই পড়াশোনার তাগিদে চলে গেল ঢাকায়।

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ২

সায়নের ব্যস্ততা বেড়ে গেল। দুই ভাইয়ের কাউকেই না পেয়ে শখ টিউশন টিচারের ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য বাবাকে জানাল। শারাফাত চৌধুরী নিজে মেয়ের জন্য হোম টিউটর ঠিক করে দিয়েছিলেন। শখ অনেকদিন
উনার কাছে পড়ত। এরিমধ্যেই আনাগোনায় শোনা গেল সায়ন মিছিলে যায়। রাজনীতি করা ছেলেপুলের সঙ্গে ঘুরে। ভার্সিটিতে যার তার সঙ্গে হাতাহাতি করে। এভাবে প্রায় দিনই তার নামে অভিযোগ আসতে লাগল।
শারাফাত চৌধুরী খোঁজ নিয়ে জানলেন সত্যিই ছেলে রাজনৈতির সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। মেরে ধরেও তাকে রাজনীতি ছাড়ানো গেল না। বরং তার মধ্যে অদম্য জেদের সৃষ্টি হলো। ঝুঁকে পড়ল রাজনীতিতে। এভাবেই দিন
যেতে যেতে ক্ষমতার জোরে পেয়েছে দলনেতার পদ। কিন্তু তার হঠাৎ’ই
পাওয়া ক্ষমতার ব্যাপারে একটা ঘাপলা রয়েছে। আর এ খাপলাটা ঠিক সর্ষের মধ্যে ভূত থাকার মতোই রহস্যময়।

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৪