শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৩২

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৩২
নূরজাহান আক্তার আলো

-‘কুত্তার বাচ্চা বাইক থামা! এ্যাই….এ্যাই ভাই এক্সিডেন্ট হয়ে যাবে তো। পায়ে পড়ি ভাই থাম…থাম না। শু….দ্ধ!’
সায়নের ব্যাকুল কন্ঠস্বরে শুদ্ধর মন গলল না। শুনেও শুনল না ভাইয়ের আর্তনাদ। শুধু চোয়াল শক্ত করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে রইল । তার মস্তিষ্কে তখনো এলোমেলোভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে কিছুক্ষণ আগের ঘটনা। চোখের পাতায় জ্বলজ্বল করে ভাসছে কারো কান্নাভেজা চোখ। কানে বাজছে কম্পিত স্বরে বলা ‘শুদ্ধ ভাই, আপনার নামে কলঙ্ক মাখতে চাই।’

এদিকে সায়ন তখনো অনুরোধ করেই যাচ্ছিল। বার বার বলছিল বাইক থামাতে। বসে কথা বলতে। শুদ্ধ নিজেও অনুভব করল তার শরীর অবশ হয়ে আসছে। হাত কাঁপছে। কাঁপা হাতে ব্রেক ধরে রাখা মুশকিল। তখন তার বাইক হাইওয়ে পেরিয়েছে। এরপর এলো নির্জন এক রাস্তা। এরপর ছুটে চলেছে বিজ্রের উপর দিয়ে। বিজ্রের নিচে নদীর পানি অশান্তভাবে বয়ে চলেছে। বইছে অবাধ্য বাতাস। মাথার উপরে নক্ষত্রভরা আকাশ।
ব্রিজের উপর দুভাইয়ের বাইক তীব্র গতিতে ছুটে চলেছে। কেউ থামছে না। কারো থামার ইচ্ছেও নেই বোধহয়। তখন একটি মালভর্তি ট্রাক দ্রুত গতিতে ছুটে এলো। তাদের দেখে বারবার হর্ণ বাজাচ্ছে ট্রাক ড্রাইভার।
ট্রাক দেখে সায়নের গলা শুকিয়ে কাঠ। এত বাতাসে কপালে সুরু ঘাম।
শুকনো গলায় সায়ন তখনো প্রাণপণে চেঁচাচ্ছে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-‘ট্রাক আসছে ভাই। স্পিড কমা। আল্লাহর দোহায় লাগে কথা শোন।’
শুদ্ধ শুনল কী না বোঝা গেল না। তবে তাকে অবাক করে দিয়ে ব্রেক থেকে দুই হাতই সরিয়ে নিলো। ব্যাপারটা খেয়াল করে সায়ন চিৎকার করে বলল,
-‘আমার কসম পাগলামি করবি না শুদ্ধ। তোর কারণে আমার মায়ের একফোঁটা চোখের পানিও যদি পড়ে তোকে মাফ করব না, কখনো না!’
একথা শোনামাত্রই শুদ্ধর কী হলো কে জানে সে আচমকা ব্রেক কষল ।একটুর জন্য ট্রাকের সাথে বাইকের ধাক্কা লাগে নি। ট্রাকওয়ালা খেঁকিয়ে বাংলা গালি দিতে দিতে চলে গেল। শুদ্ধ তখনো দুচোখ বন্ধ করে অনড় হয়ে বসে আছে। সায়ন দ্রুত বাইক থামিয়ে নেমে পড়ল। বাইক স্ট্যান্ড করার সময় হুঁশে নেই। বাইক আছড়ে পড়ল মাটিতে। সেসব পরোয়া না করে দ্বিকবিদিক ভুলে এগিয়ে এলো শুদ্ধর কাছে। শুদ্ধর শার্টের কলার ধরে বাইক থেকে নামিয়ে স্বজোরে এক ঘুষি বসিয়ে দিলো নাক বরাবর।

দ্বিতীয় ঘুষি বসানোর আগে খপ করে ধরে ফেলল শুদ্ধ। হঠাৎ গায়ে হাত তোলায় সেও রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বড় ভাইয়ের দিকে। তীব্র
রাগে সেও ফুঁসছে। তখন সায়ন শুদ্ধর বুকে স্বজোকে ধাক্কা দিতেই শুদ্ধ দু’পা পিছিয়ে গেল। সায়ন এক ধাপ এগিয়ে আরেক ধাক্কা মেরে চেঁচিয়ে বলল,
-‘কুত্তার বাচ্চা ভাব মা’রা’ও আমার সাথে, ভাব? তোমার ভাবকে চু’দা’র সময় নাই আমার। কখন থেকে ডাকছি? কতবার ডাকলাম! কথা কানে যায় না? বড় হয়ে গেছো? খুব বড়? এতই বড় হয়েছ বড় ভাইয়ের কথা
শোনার মুড আসে না তোমার? তাহলে শুনো রাখো, তোমার বালমার্কা মুডের মাকে চু’দে দফারফা করার ক্ষমতা আমি রাখি।”

-‘ভাষা ঠিক করো।’
-‘কিসের ভাষা ঠিক করব? করব না। মারবি? মার। আয়!’
শুদ্ধ চোখ বন্ধ করে রাগ সংবরণ করার চেষ্টা করছে। রাগে মাথা থেকে পা অবধি জ্বলছে। সায়ন যদি তাকে মেরে টুকরো টুকরো করে ফেলেও তবুও সে ভাইয়ের গায়ে হাত উঠাতে পারবে না। কখনো না! তাকে চুপ
দেখে সায়ন পুনরায় চেঁচিয়ে বলল,
-‘সামান্য ব্যাপারে এত সিনক্রিয়েট করার কি আছে?কি এমন হয়েছে যে এত রাগ দেখাতে হবে? মানুষ চাচাতো বোনকে ভালোবাসে না? আমি বাসি নি? আমি মরে গেছি নাকি আমার দেহ পঁচে গেছে?’
-‘তোমার কাছে সামান্য হলেও আমার কাছে তা নয়।’
-‘তাহলে তোর কাছে কি, বল? কি সমস্যা তোর? শীতল তোর যোগ্য না? কোনদিক থেকে কম সে? পেশার ভিত্তিতেও কম মেয়ে তো দেখিস নি।
আমার বোন কি ওইরকম? আজকাল কার যুগে ওর মতো সরল, নরম কাঁদা মাটি আর পাবি? ভালো জিনিস জুটাতে চাচ্ছি গায়ে লাগছে না, না?’

-‘তোমার বোন বিশ্বসুন্দরী হোক। রুপে, গুনে, অনন্য হোক তাতে আমার যায় আসে না। যে মেয়ে সর্বসম্মুখে আমাকে চাইতে পারবে না সেই মেয়ে আমার না হোক!’
-‘সে ছোটো মানুষ। তোমার মতো বাল পাকনা বুদ্ধি নিয়ে ঘুরে না এটা বুঝো না? আগে সময় দিয়ে দেখতি তারপর নাহয় যা সিধান্ত নেওয়ার নিতি।’
-‘ ছোটো। অবুজ। সরল বলে এতদিন ছাড় দিয়েছি। কিন্তু তোমরা আজ যা করেছো যথেষ্ট করেছো। এবার থামো নয়তো আমাকে বাড়ি ছাড়তে হবে। ‘
ভাইয়ের কথা শুনে সায়ন থমকে গেল। হতবাক তাকিয়ে রইল ভাইয়ের কঠিন মুখের দিকে। দুই ভাইয়েরই চোখ লালবর্ণ। দু’জনই হাত মুঠিবদ্ধ করে চোখে চোখ করে কথা বলছে। দু’জনেরই জেদী ও কঠিন কন্ঠস্বর।
শুদ্ধ কথায় সায়ন কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল,
-‘সত্যিই কি শীতলের প্রতি তোর কোনো ফিলিংস নেই?’
-‘(….)’

-‘যদি না থাকে তাহলে তাকে এত প্রশ্রয় দিস কেন? এত বকিস, মারিস তবুও মেয়েটা তোর কাছেই যায়। কেন যায়? কারণ তুই শাষণের সাথে প্রশ্রয়ও দিস। তোর রুমের পার্স আমি ভাই হয়ে জানি না কেন?ফোনের লক আমাকে দিস নি কেন? তোর পছন্দের পারফিউম ভেঙ্গেচুড়ে শেষ করার পরও তুই নীরব কেন? তোর রুমে অন্য কারো ঢোকার পারমিশন নেই, তাহলে শীতল ইচ্ছেমতো ঢুকে কেন? ঢুকতে দিস কেন? জবাব দে। শীতলকে কিডন্যাপ করার পর এত উন্মাদ হয়েছিলি কেন? সামান্য জ্বর এলে বকতে বকতে সবার আগে তুই ডাক্তারের কাছে ছুটিস কেন? কেন তুই ব্যাতীত অন্যকেউ তাকে বকলে কড়া ভাষায় অপমান করতে ছাড়িস না? এসবের উত্তর দিতে পারবি? বুকে হাত রেখে বলতে পারবি তুই শখ, স্বর্ণের মতো শীতলকেও একই নজরে দেখিস? বল, মুখে একটাবার হ্যাঁ বল। তাহলে আমিও কথা দিচ্ছি আর কখনো এ ব্যাপারে কথা বলব না। আর না শীতলকে তোর চোখের সামনে থাকতে দেবো।’

-‘(….)’
-‘তবে কি ধরে নেবো নীরাবতায় সম্মতির লক্ষণ?’
-(…..)’
শুদ্ধর কাছে জবাব নেই। সে নিশ্চুপ। বলা বাহুল্য সে ছোটো থেকে নিজ মর্জিতে চলা ছেলে। আজ অবধি তার উপর কেউ কখনো কারো সিধান্ত চাপিয়ে দিতে পারে নি। ভদ্রতা কিংবা অন্য কিছুর অজুহাতে সেও কারো সিধান্ত মুখ বুঝে মেনে নেয় নি। যদি নিতো তাহলে আজ সাইন্টিস্ট নয় মেরিনার পেশায় কর্মরত থাকতে হতো। দিনের পর দিন থাকতে হতো শিপে। পরিবার-স্বজন ছাড়াই সময় কাটত সমুদ্রের শান্ত/অশান্ত পানির উপর। অথচ সে বরাবরই চাইত সাইন্টিস্ট হতে। নতুন কিছু তৈরির নেশা তাকে জেঁকে ধরত। কিছু করার জন্য হাত নিশপিশ করত। মোটকথা, সে বরাবরই একরোখা। জেদি। যা করবে ঠিক করে করেই ছাড়ে। এবং যা আমার সেটা কেবল আমারই’ এই নীতিতে বিশ্বাসী ছিল এখনো আছে। যেখানে সে অন্যের মতের ভিত্তিতে কখনো এক পা ফেলে নি। সেখানে জীবনসঙ্গী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তা মানবে কেন? আর কাকে মানার কথা আসছে? ওই বেয়াদব, অবাধ্য গাধীটাকে?

যে ভালোবাসার মানে বোঝে না? শাষণ বোঝে না? চোখের নিগূঢ় চাহনী বোঝে না! শাষণের আড়ালে আগলে রাখা বোঝে না। যার নিজের অনুভূতি সম্পর্কে সামান্য জ্ঞানটুকু নেই তাকে চাইবে? তাকে? না,কখনো না! মোদ্দাকথা, যে মেয়ে মুখ ফুটে তাকে চাইতে পারে না। যার চোখমুখে বিন্দু পরিমান ভালোবাসার লেশ মাত্র থাকে না। যে বাবা-মায়ের মারের ভয়ে ভালোবাসার কথা জানাতে ভয় পায়, পিছিয়ে যায়, তাকে চাইবে সে? তাহলে বলতেই হয় এটা ভুল ধারণা। কারণ সে সস্তা না। তাকে পেতে হলে অবশ্যই সর্বসম্মুখে দাঁড়িয়ে মুখ ফুটে চাইতে হবে। চোখে চোখ রেখে বলতে হবে ‘ শুদ্ধ ভালোবা..সি।’

নয়তো তাকে পাওয়া তার জন্য অসম্ভবই। বলা বাহুল্য, আজ যদি কেউ
একফোঁটা শুদ্ধ ভালোবাসার দাবী নিয়ে মুখোমুখি দাঁড়াত। আর সে যদি তা অনুভব করতে পারত ওই ভালোবাসাটুকু তাহলে সে চাওয়ার আগেই নিজেকে বিলিয়ে দিতো। শুধু পরিবার নয় পুরো পৃথিবী দুই হাতে সামলে নেওয়ার দায়িত্ব নিতো। কিন্তু তা হয় নি! হয় নি! কি হয়েছে? কেউ মিথ্যা ভালোবাসার দাবি নিয়ে সামনে এসেছে? যেখানে ভালোবাসা, ভরসা, বিশ্বাস বলে কিছু ছিল না। তাহলে কেন গ্রহন করবে মিথ্যে ভালোবাসা? সে কি এতই ঠুনকো? নাকি এতই সস্তা? পৃথিবীর বুকে এমন কেউ আছে যে মিথ্যে ভালোবাসার কথা জেনেও গ্রহন করে? কিংবা করতে পারবে?

তাও আবার এসবে সাহায্য করে তারই বড় ভাই। সেও একবারও ভাবল না এভাবে ভালোবাসা হয় না। এসব সম্পূর্ন মনের ব্যাপার। দু’ একদিনের কোনো গেম নয়! ভাবনার মতো জীবন এত সহজও নয়। মন এত বোকা নয় যে ওকে ভালোবাস বললেই ভালোবাসা হয়ে গেল। এরা যা করেছে
মোটেও ভালো করে নি। মোটেও না। মনে মনে এসব ভেবে শুদ্ধ বাইকের উপর বসতেই সায়ন তার বাইকের চাবি কেড়ে থমথমে সুরে বলল,
-‘কথা শেষ করে যা।’
-‘কিসের কথা?
-‘সমস্যা কি তোর?
-‘আমার কোনো সমস্যা নেই।’
-‘তাহলে জবাব দিয়ে যা।’
-‘চাবি দাও।’
-‘শীতলকে মেনে নে।’
-‘(….)’

এতকিছু বলার পরও শুদ্ধর নীরাবতা সহ্য হলো না সায়নের। সে পকেট হাতড়ে তার ফোন বের করে আজকের তোলা শীতলের একটা ছবি বের করল। তারপর সেই ছবির উপর শুদ্ধর একহাত চেপে ধরে তেজি সুরে বলল,
-‘এবার বল ভালোবাসিস না। তার প্রতি কোনো ফিলিংস কাজ করে না। যদি মিথ্যা বলিস তাহলে শীতল যেখানেই থাকুক যে অবস্থাতেই থাকুক ধড়ফড়িয়ে মরুক। আমি গিয়ে দাফন করব তাকে।’
একথা শুনে শুদ্ধ হাত ছাড়াতে গেলে সায়নের জেদটা যেন বেড়ে গেল।

সে শুদ্ধর হাতটা আরো শক্ত করে চেপে ধরল। সে উত্তর জেনেই ছাড়বে। ভাইয়ের ছেলেমানুষি দেখে শুদ্ধ বিরক্ত হলো। তবে কোনো ভাবেই তার হাতটা শীতলের ছবির উপর ধরো রাখা গেল না। এবার উত্তরও সুস্পষ্ট।
সায়ন বুঝে আচমকা হো হো করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে মাটিতেই বসে পড়ল। চোরের ধর্ম চুরি করে বলা, ‘ আমি চুরি করি নি।’ অথচ তলে তলে শিক কেটে বসে থাকে। অবশ্য চোরের ধর্মে একটু হেরফের না হয়ে একপক্ষে ভালোই হয়েছে। নতুবা ‘ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না’, এ প্রবাদটির একটু হলেও কদর কমে যেতো। সে খুব ভালো করে জানে এই ছেলে ভাংবে তবুও মচকাবে না।হঠাৎ কিছু মনে হতেই সায়ন তড়িৎবেগে দাঁড়িয়ে গেল। এগিয়ে এসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল শুদ্ধকে। ইশ! তখন
রাগের মাথায় মেরে, বকেছে দিয়েছে। পরক্ষণেই শুদ্ধর গালে চুমু এঁকে বলল, ‘সরি ভাই!’
শুদ্ধ বিরক্তমুখে নিজেকে ছাড়িয়ে বাইকের চাবি নিয়ে ওর বাইক স্টার্ট করল। তাকে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে দেখে সায়নও হাসতে হাসতে বাইক টেনে তুলে। তারপর ধীরে সুস্থে বাইক স্টার্ট করল। দুজনেই স্বাভাবিক গতিতে যাচ্ছে। তখন সায়ন বলল,

-‘বাড়ি চল। ‘
-‘কাজ আছে তুমি যাও।’
-‘দেরি হবে?’
-‘হুম।’
-‘ যেখানে যাচ্ছি যা প্রথম সেহরিতে যেন বাড়িতেই হয়।’
শুদ্ধ জবাব দিলো না। অনেকটা পথ দুই ভাই একসাথে এসে হাইওয়ে থেকে ভিন্ন পথ ধরল। কিছু কথা, কিছু প্রশ্ন, অপ্রকাশিত থেকেও প্রকাশ হয়ে গেল আজ। তবে একটা কথা না বললেই নয় মাঝে মাঝে নীরাবতা রাগ বাড়ায়। রাগে বাড়ে অভিমান। অভিমানে বাড়ে দুরত্ব। শুদ্ধ জানে না আজকের পর থেকে শীতলের সাথে ঠিক কতটা স্বাভাবিক হতে পারবে। আর শীতলই বা সেটা কীভাবে নেবে। তবে যেটাই হোক এর শেষও দেখে ছাড়বে।

‘বড় মামী! মেজো মামী! ছোটো মামী! শখ! স্বর্ণ! ছুটকি! কই রে সব?’
ট্রলি হাতে দরজা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে সমানে চেঁচাচ্ছে রুবাব। ড্রয়িংরুমে কেউ নেই দেখে তার কন্ঠস্বর সমানে বাড়ছে। সারাদিনের ধকল কাটিয়ে সবাই ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম করছিল। আজ রাতে প্রথম সেহরি।আগামীকাল প্রথম রোজা। বাড়ির সবাই রোজা থাকবে। ছোটো, বড়, সবার পছন্দের দিকটাও খেয়াল রাখতে হবে। বাচ্চাগুলো ঘুম থেকে উঠে ঝাল তরকারী খেতে পারে না। তারা খাবে দুধ-ভাত। একে একে সেসবকিছুরই যোগাড় করতে হবে। তাই তিন গিন্নি বিশ্রাম নিয়ে একটু পরে নিচে নামতেন। কিন্তু খুব পরিচিত কারো হাঁকডাক শুনে একে একে সকলে ছুটে এলেন। সাম্য
কোথা থেকে দৌড়ে এসে রুবারের গলা ধরে ঝুলে পড়ল। সৃজন পিঠের উপর উঠে বসল। গলায় টান খেয়ে রুবাব ওমা গো বাঁচাও! বাঁচাও! করে চেঁচাচ্ছে। সিরাত এসে বাদর দুটোকে কোনোমতে সরাল। রুবাব কাশতে কাশতে অভিযোগ ছুঁড়ল,

-‘চৌধুরীর এক একটা ছানা একেক রকমের বজ্জাত। পেছন পাকা সব ক’টা। ছোটো দুটোকে দেখছি বড় দুটো কই? শালারা কল ধরছে না।’
একথা বলে সিরাতকে দেখে গালভর্তি হেসে বলল,
-‘আরে শাশুড়ি মা যে কেমন আছো, বলো!
সিরাত হেসে রুবাবের মাথাভর্তি কোঁকড়াচুলো এলোমেলো করে দিলো।
বলা বাহুল্য, এটা উনার বহু পুরনো অভ্যাস! উনি যখনই রুবারের চুল এলোমেলো করে দিতেন রুবাব গাল ফুলিয়ে সোজা অভিযোগ জানাত সাওয়ান চৌধুরীর কাছে। আদুরে সুরে সাওয়ান চৌধুরীর গলা জড়িয়ে ধরে বলত,
-‘মেজো মামা, ওহ মেজো মামা, মামী আমার চুল নষ্ট করে দিচ্ছে। আমি কিন্তু খুব রেগে যাচ্ছি। বড় হলে তোমার মেয়ে নিয়ে পালালে দোষ দিবে না কিন্তু।’
ছোটো রুবারের কথা শুনে সবাই হেসে লুটোপুটি খেতো। শতরুপা ছোট্ট রুবাবের গালে চুমু এঁকে বলতেন,
-‘পালানোর ভাড়া আমি দেবো বাপ। তুই শুধু বড় হো আর দোয়া কর যেন ভুল করে হলেও তোর না হওয়া বউ পৃথিবীতে ল্যান্ড করে।’

মায়ের কথা শুনে ফোঁকলা দাঁত বের করে সে কী হাসি রুবারের। আনন্দ যেন ধরে না। এরপর থেকে যখনই সিরাত চুল এলোমেলো করে দিতো তখনই দাঁত করে হেসে বলত,
-‘ওহ মেজো মামী, আমার চুল এলোমেলো করার অপরাধে তোমাকে একদিন আমার শাশুড়ী বানাবোই বানাব।’
রুবার যতবার একথা বলতো সিরাতও ততবারই শব্দ করে বলতেন, ‘আমিন!’
কিন্তু বছর ঘুরে যেদিন সাম্য সজৃন হলো সেদিন রুবারের সে কী রাগ!
কারণ তার বউ পৃথিবীতে ল্যান্ড করে নি। বউয়ের জায়গায় দুটো বাদড় এসেছে। বলতে গেলে এই পাজিদুটোই তার প্ল্যান বরবাদ হয়ে দিয়েছে।

এতদিন পর রুবাবকে দেখেই সিরাত চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলল,
-‘এতদিন পর মনে পড়ল? তা কেমন আছিস বাপ?’
-‘আমি তো বিন্দাস আছি। তোমরা কেমন আছো বলো?’
-‘আমরাও ভালো আছি।’
তারা কথা বলতে সিঁতারা এসে দাঁড়াতেই রুবাব উনাকে দেখামাত্র ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল। গালে গালে লাগিয়ে চমৎকার করে বলল,
-‘বড় মামী আমার ভাগের আচার আছে তো? নাকি শীতল একাই সবটা ঝেড়েছে? ভাগে কম পেলে ওর কান ছিঁড়ে ফেলব বলে দিলাম?’
-‘আছে বাপ। অনেক আচার আছে। এবার বল দেখি এত শুকিয়ে গেছিস কেন? খাওয়া দাওয়া করিস না? এবার কিন্তু সহজে ছাড়ছি না তোকে, মনে রাখিস?’
-‘উপর মহল সেসব শুনবে মামী? টাইমমতো ঠিকই জয়েন করতে হবে।’
-‘ দরকার নাই ওসব ছাঁইপাশের চাকরি। ছেড়ে দে ওই চাকরি। পানিতে ভেসে বেড়ানো চাকরি করতে হবে না। দরকার হলে দুই মামার অফিসে বসবি।’

-‘হা, হা, তা বললে হবে। তা ছোটো মামী কই, ফোনকলে মামার সাথে প্রেম করছে নাকি?’
তখন সিমিন তার পেছন থেকে কান টেনে ধরে বললেন,
-‘না রে পাজি ছেলে প্রেম করছি না। আমার সাথে প্রেম করার সময় নেই তোর মামার।’
-‘বলো কি! তাহলে এই স্বামীকে টেনে বেড়ানো কি দরকার? ডাস্টবিনে ফেলে দাও, আমি তোমাকে নিউ ব্র্যান্ডের স্বামী এনে দেবো।’
একথা শুনে সিমিন হাতের চাপ বাড়াতেই রুবাব মুচড়ামুচড়ি করে কান ছাড়াল। শখ, স্বর্ণ এলে তাদের সাথেও কথা হলো। গল্প হলো। মজার সব গল্পে হাসাহাসিও হলো। কথায় কথায় একগাদা নাস্তা সামনে রাখা মাত্রই রুবাব খেতে শুরু করল। তখন শিষ বাজাতে বাজাতে বাইকের চাবিটা কায়দা করে আঙ্গুলের ডগায় ঘুরাতে ঘুরাতে সায়ন এলো। রুবাব তাকে দেখে দ্রুত উঠে কোলাকুলি করে বলল,
-‘বড় ভাই ভালো আছেন? রাজ কার্য সেরে ফিরলেন বুঝি? বিয়ে সাদি কী করবেন না? আর কত কচি সেজে থাকবেন?’

একথা শোনামাত্র সায়ন ওর কানে কানে কিছু একটা বলতেই সে ছিঁটকে
সরে গেল। নাক, মুখ কুঁচকে বলল,
-‘ ছিঃ! তুমি একটা অশ্লীল।’
সায়ন রুবাবের কাঁধ জড়িয়ে ধরে একই সোফায় বসল। তিন গিন্নি তখন রান্নাঘরে। ডায়নিং টেবিলে শখ, স্বর্ণ, সাম্য সৃজন রুবাবের আনা পিজ্জা ভাগাভাগি করতে বসেছে। এদিকে আর কেউ নেই দেখে সায়ন রুবারকে বলল,
-‘ভাই সন্মান নিবা, সন্মান?’
রুবাব কলার ঝাঁকিয়ে ভাব মেরে বলল,
-‘অবশ্যই নেবো। আমার বোন নিবা অথবা আমাকে সন্মান দিবে না তা তো হবে না।’
-‘কে বলেছে তোমাকে সন্মান দেবো না সোনা? এসো, সন্মান নাও। তা সন্মান কোথায় নিবা? সামনে নাকি পেছনে? তা ঠিকঠাক লোড নিতো পারবা তো?’
একথা শুনে রুবাব এক লাফে উঠে রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বলল,
-‘বড় মামী সায়ন ভাইয়ের দ্রুত বিয়ে দাও। এর বিয়ে দেওয়া ফরজ হয়ে গেছে।’
একথা শুনে সিঁতারা পেঁয়াজ কাটতে কাটতে জবাব দিলেন,

-‘ও একবার নিজের মুখে বিয়ের কথা বলুক দু’দিনের মধ্যে ওকে বিয়ে করাব আমি।’
সিঁতারার কথা শুনে সায়ন ঠোঁট কামড়ে হেসে স্বর্ণের দিকে তাকাল। স্বর্ণ কিছু অনুভব করে তাকাতে চোখাচোখি হয়ে গেল দু’জনের। সায়ন চোখ
ইশারা করে উপরে যাওয়ার কথা বললে স্বর্ণ যেন শুনেও শুনল না। ঠাঁই সেভাবেই বসে রইল। অগত্যা সায়ন চুলে ব্যাক ব্রাশ করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে উঠতে গান ধরল,
কইতে আমার শরম লাগে
প্রেম আগুনে পুঁইড়া ছাই।
সানডে মানডে ক্লোজ কইরা দিতে একজন মানুষ নাই।
ও ভাইরে ভাই..!
বড় ভাইয়ের গান শুনে শখ মুখ টিপে হাসতে হাসতে বেচারী একসময়
ভীষম খেলো। তবুও তার হাসি থামছে না। তাকে এভাবে হাসতে দেখে সাম্য, সৃজন একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। কিন্তু কিছু বুঝতে না অগত্যা খাওয়াতে মন দিলো।

সবার সাথে টুকটাক কথা হলেও এখন অবধি শীতলের সাথে দেখা নি রুবাবের। যেটা অতি আশ্চর্যের ব্যাপারও বটে। সে বাড়িতে নেই? নাকি
তার উপস্থিতি এখনো বুঝতে পারে নি? তবে যায় হোক তার জন্য দেখা করাটা ফরজ। তাই সে শীতলের খোঁজ নিয়ে নিজেই গেল দেখা করতে। গিয়ে দেখে শীতল রুমে নেই। রাত তখন সাড়ে দশটা। এত রাতে মেয়েটা গেল কোথায়? সে চিন্তিত হয়ে কপালে ভাঁজ ফেলে বের হতেই সায়নের মুখোমুখি হলো। সায়নকে কথাটা জানাতেই সায়ন শুদ্ধর রুমের দরজায় হাত রেখে দেখে দরজা ভিজিয়ে রাখা।দরজা খোলা রাখার তো কথা না।
কৌতুহলবশত দরজা সামান্য খুলে উঁকি মারতেই দেখে আলুথালু বেশে শীতল বসে আছে। পরনে এখনো শাড়ি। কেঁদে কেটে একাকার অবস্থা।

চোখ ফুলে লাল হয়ে আছে। মেঝেতে বসে হাঁটুতে মুখ গুঁজে থাকায় সে এখনো দেখে নি। তবে একটুপরে রুমে কারো উপস্থিতি বুঝে চোখ তুলে তাকাতেই দেখে রুবাবা, সায়ন দাঁড়িয়ে আছে। তাদের দেখামাত্রই শীতল ঠোঁট উল্টে ভ্যাঁ ভ্যাঁ কেঁদে দিলো। কান্নার দমকে কথা বলতেও পারছে না সে। সায়ন দ্রুত হাঁটু গেঁড়ে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
-‘কি হয়েছে পাখি কাঁদছিস কেন?’
রুবাবও বসল। সেও ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে আছে। তারপর সায়নের থেকে শীতলকে ছাড়িয়ে আলতো করে শীতলের দু’চোখের পানি মুছে দিলো।
তারপর মাথা নাড়িয়ে কাঁদতে বারণ করে বলল,
-‘কি হয়েছে ছুটকি? বল আমাকে?’
-‘শু..শুদ্ধ ভাই।’

-‘ওর সাথে কথা হয়েছে আমার জরুরি কাজ পড়ে গেছে ফিরতে দেরি হবে।’
-‘র..রেগে আছে খুব।’
-‘রাগিয়েছিস কেন? তোকে শিখিয়ে দেই একটা তুই করিস আরেকটা।’
-‘তোমার কথামতোই তো কানের দুই ইঞ্চি নিচে কিস করলাম। তাতেই তো আরো রেগে গেল।’
একথা শুনে সায়ন ভ্রুঁ কুঁচকে তাকাল রুবাবের দিকে। কিস এলো কোথা থেকে? সে তো এসব করতে বলে নি। ওয়েট, ওয়েট, শীতল শুদ্ধকে কিস করেছে? কিন্তু এই বুদ্ধি কে দিলো? সে এবার বিষ্ময়ভরা দৃষ্টিতে শুধাল,
-‘কি? কী বললি আবার বল? তুই ভাইকে কিস করেছিস?’
শীতল মুখ কাঁচুমাচু করে সম্মতি সূচক মাথা নাড়িয়ে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল,
-‘রু রুবাব ভাইয়াই তো শিখিয়ে দিলো। আমি তো রাজি ছিলাম না। কিন্তু ভাইয়া বলল, এটা করলে শুদ্ধ ভাই দ্রুত পটে যাবে। পটে গেলে আমার মিশন সাকসেস হবে।’
এতক্ষণে সায়ন বুঝল শুদ্ধর রাগের কারণ। যেখানে ভালোবাসার শুরুই হয় নি সেখানে এসব। আর শুদ্ধ যে ব্যক্তিত্বের ছেলে সে কখনোই এসব ছ্যাবলামি পছন্দ করবে না। এটা তো জানা কথা। সায়ন এবার রুবাবের দিকে তাকিয়ে দাঁত কটমট করে বলল,

-‘শালা বলদ, কি করেছিস এটা? আমাকে একবার জানাতে পারলি না?
রুবাবও দাঁত খিশমিশ করে বলল,
-‘আমি কী করে জানব ওই শালা এতটা রেগে যাবে? কোনো মেয়ে যদি ভালোবাসার কথা বলে কিস করে আমি তো কুপোকাত। আমি আমার কথা ভেবে বুদ্ধিটা দিয়েছিলাম। কে জানত পাশা উল্টে যাবে?’
সায়ন দীর্ঘশ্বাস। সে শীতলের মাথায় হাত রেখে আদুরে সুরে ডাকল,
-‘শীতল! জানবাচ্চা আমার। এভাবে কাঁদে না পাখি। আমরা তোর সাথে আছি না, হুম?’
-‘শুদ্ধ ভাই খুব কষ্ট পেয়েছে ভাইয়া।’
-‘তা পেয়েছে। শোন আজ থেকে আমরা আর কোনো প্ল্যান করব না। সব সময়ের হাতে ছেড়ে দিবো। এরপর যা হয়, হবে, কেমন?’

-‘কিন্তু..!’
-‘উহুম আর কোনো কিন্তু না। ধরে নে, আমাদের মিশন সাকসেস।’
-‘ সাকসেস? কীভাবে? আমি উনাকে পটাতে পারলাম না। ভালোবাসার জীবাণু শুদ্ধ ভাইয়ের রন্ধে রন্ধে ছড়াতে পারলাম না। আর প্রাপ্তি হিসেবে তাকেও তো পেলাম না।’
-‘ওই যে বললাম সময় কথা বলবে।’
-‘ঠিক আছে। তাহলে শুদ্ধ ভাই ফিরলে কি আমি সরি বলব? ভাইয়া খুব রেগে আছে আমার উপর।’
-‘তা বলতে পারিস।’
শীতল ঘাড় কাত করে তাদের কথায় সম্মতি জানাল। শুদ্ধ ওভাবে রেগে বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকে তার মন ভার হয়ে আছে। কেঁদে কেটে যাচ্ছে তাই অবস্থা। অপরাধবোধ কাজ করছে নিজের মধ্যে। বুঝতেও পারছে, মিথ্যে ভালোবাসার দাবী নিয়ে শুদ্ধর সামনে দাঁড়ানো উচিত হয় নি তার। কেননা মিথ্যে ভালোবাসা বিষের মতো। শুদ্ধ ভাই বুঝে নিয়েছে হয়তো।

এজন্য রাগ দেখিয়ে চলে গেল। কিন্তু গেল কেন? তাকে মারত। মেরে ওর ভুল ধরিতে দিতে পারত। বরাবরের মতো একটু বকতে পারত। ধমকাতে পারত। এতদিন শুদ্ধর মারা, বকা, ধমাকানোয় কষ্ট পেতো অথচ আজ এসব না করাতে এত কষ্ট পাচ্ছে। এসব ভেবে তার চোখের পানি ঝরঝর করে গড়িয়ে গেল। আবার ওকে কাঁদতে দেখে দুই ভাই উতলা হয়ে গেল।
শীতল সায়ন আর রুবাবের হাত দুটো আঁকড়ে ধরে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল,
-‘কিভাবে সত্যি সত্যি ভালোবাসতে হয়? সত্যিকারের ভালোবাসা কেমন হয়? প্লিজ শেখাও আমাকে। আমি শিখতে চায় ভাইয়া। আমার বারবার মনে হচ্ছে আমি শুদ্ধ ভাইকে খুব কষ্ট দিয়ে ফেলেছি? বড্ড ভুল করেছি।
এই ভুল শুধরাতে হবে আমাকে।’

রুবাব সায়নের দিকে তাকালে তাদের চোখাচোখি হলো। তারা শীতলকে বোঝাল,
-‘ভালোবাসা শেখানো যায় না পাগলি। এটা মনের কারবার। একদিন মন বলে দেবে তুইও কাউকে ভালোবাসিস। যার দেখা পাওয়ার জন্য ছটফট করবি। যার কথা শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকবি। হাজার হাজার, লক্ষ কোটি মানুষের ভিড়ে তোর দু’চোখ খুব প্রিয় একটা মুখই খুঁজে বেড়াবে।
তার হাসিতে আনন্দরা ঝুমঝুম করবে আবার তার সামান্য কষ্টে বুকটা দুমড়ে মুচড়ে যাবে। যাকে কোটি কোটি বার ‘ভালোবাসি’ বললে বিতৃষা আসবে না। অরুচি হবে না। বিরক্ত লাগবে না। এটাই হচ্ছে ভালোবাসা।’
শীতল কথাগুলো মন দিয়ে শুনে ভাবতে লাগল। তবে এখন ভাবার সময় দিলো না দুভাই। তাকে রুমে পাঠিয়ে ফ্রেশ হয়ে দ্রুত নিচে নামার তাগাদা দিলো। তবে শীতল কথাগুলো মাথা থেকে সরাতে পারল না। ফ্রেশ হয়ে চুল মুছতে ভাবল। সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে ভাবল। সবার সাথে এক টেবিলে বসে রাতের খাবার খেতে খেতে ভাবল। সবাই আছে শুদ্ধ নেই।
রাত বাড়ছে সেহরিতে আবার উঠতে হবে তাই সকলে ঘুমাতে চলে গেল।

তবে শীতলের চোখে ঘুমের রেশমাত্রই নেই। সে ভেজা চুল ছেড়ে দিয়ে অন্ধকার বেলকনিতে বসে আছে। কেন বসে আছে জানে না। তবে বসে থাকতে ভালো লাগছে। আচ্ছা, শুদ্ধ ভাই এখনো ফিরছে না কেন? এত রাত করে বাইরে থাকা কিসের? কি এমন জরুরি কাজ করছে যে এত রাত হচ্ছে? এসব ভাবতে ভাবতে বাইকের শব্দ পেল। মূল ফটক দিয়ে শুদ্ধ বাইক নিয়ে পাকিংলটে গেল। সেখানে বাইক রেখে বাড়িতে প্রবেশ করলে কলিংবেল চাপতে হবে। তাতে সবার ঘুম ভেঙ্গে যেতে পারে ভেবে সে দৌড়ে নিচে গেল। কলিংবেল চাপার আগে দরজা খুলে দিলো। শুদ্ধ কেবল হাত বাড়িয়েছিল কলিংবেল চাপার জন্য। তার আগে দরজা খুলে শীতলকে দেখতে পেল। ফোলা ফোলা চোখে ঠোঁটে মিষ্টি হাসি এঁটে তার দিকে তাকিয়ে আছে শীতল। শুদ্ধ তার পাশ কাটিয়ে যেতে গেলে শীতল মিনমিন করে বলল,

-‘খাবার বাড়ব?’
শুদ্ধ হ্যাঁ/না কিছু না বলে উপরে উঠতে গেলে শীতল পুনরায় বলল,
-‘মুরগীর মাংসের তরকারীটা খুবই মজা হয়েছে। গরম করে খাবার রুমে দিয়ে আসি?’
এবারও শুদ্ধ নীরবে সিঁড়ি দিয়ে উপরে চলে গেল। শীতল ছলছল চোখে তাকিয়ে সেও শুদ্ধর পিছু পিছু যেতে যেতে আবার ডাকল,
-‘শু..শুদ্ধ ভাই।’
শুদ্ধ নিজের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে পার্স দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে গেল। একবার পেছন ফিরে তাকালে দেখে পেতো অপরাধবোধে কাতর হওয়া এক মানবীকে। যে অশ্রুভেজা চোখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
শুদ্ধ চলে গেলে শীতলের মনে পড়ল সরি বলা হয় নি। সে চোখজোড়া মুছে দরজায় পার্স ইন করতেই ইনকারেক্ট পার্স দেখাল। একবার দুইবার
তিনবার করে একই পার্স দিলে বারবার ইনকারেক্ট পার্স দেখাল। অবাক হলো। চতুর্থবার পার্স দিতে দরজায় হাত লাগানো মাত্রই কারেন্টের শক
লাগল। শকে গোটা শরীর ঝাঁকুনী দিয়ে উঠল ওর।দ্রুত হাত সরিয়ে দু’পা পিছিয়ে অবাক হয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে রইল। আগে কখনো এমন হয় নি। একবার পার্স দেওয়া মাত্রই দরজা খুলে যেতো। তবে কি পার্স বদলে দিয়েছে শুদ্ধ ভাই? কিন্তু পার্স বদলাল কেন? তাকে রুমে ঢুকতে দিবে না তাই? ছোটো একটা ভুলের কারণে এত বড় শাস্তি? এভাবে কী দূরে সরিয়ে দেবে?

ওদিকে বন্ধ রুমের বিছানায় বসে ফোন হাতে নিয়ে বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে আছে শুদ্ধ। হাতে থাকা ফোনে একের পর এক বার্তা আসতেই আছে। বারবার ভুল পার্স ইন করায় কারেন্টের শক লেগে পার্স ইন করা থেমে গেছে। শীতল থামতেই নোটিফিকেশন আসাও থেমে গেছে। শুদ্ধ নোটিফিকেশনে দিকে তাকিয়ে মলিন হাসল। শক খেয়ে খুব বেশি কষ্ট পেল নাকি? পেলে যাক! মাঝে মাঝে কষ্ট পাওয়া ভালো। নিজে একটু কষ্ট অনুভব করলে অন্যের কষ্টটা খুব সহজে উপলদ্ধি করতে পারবে।
তাছাড়া কেবল তো শুরু। এসব ভেবে সে ফোনটা বিছানার উপর ঢিল ছুঁড়ে ফেলল। তারপর দুই হাতে মাথার চুল খামছে ধরে বিরবির করে আওড়াল,

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৩১

-‘ সোনা যত পোড়ানো হয় তত নাকি খাঁটি হয়। আজকে থেকে তোকে পোড়ানোর দায়িত্ব আমার। আমাকে চাওয়ার কথায় যেভাবে পিছিয়ে গেলি একদিন তুই নিজেই সর্ব সম্মুখে আমাকে চেয়ে নিবি। চাইতেই হবে মিলিয়ে নিস। আমিই চাইতে বাধ্য করব তোকে। যদি না পারি না তবে আমার নামও শোয়াইব শুদ্ধ নয়। রেডি থাক চৌধুরী কন্যা, রেডি থাক।’

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৩৩