শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৩৪

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৩৪
নূরজাহান আক্তার আলো

_’শুদ্ধ! ওহ শু..দ্ধ! কই তুই বাপ? জলদি বের হয়ে আয় আব্বা!’
উক্ত কথাটি বলতে বলতে দোতলার দিকে হন্ন হয়ে ছুটে চলেছেন সিমিন চৌধুরী। দু’চোখের পানিতে ঝাপসা দেখছেন সবকিছু। পা জোড়া চলতে চাচ্ছে না যেন। কান্নাভেজা কন্ঠস্বরের সাথে হাত-পাও থরথরিয়ে কাঁপছে উনার। তবুও শুদ্ধকে ডেকেই যাচ্ছেন। রমজান মাস, সকলে দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে। খাওয়া-দাওয়ার ঝামেলা নেই বিধায় কেউ ডাকাডাকিও করেন না। যাদের কাজ থাকে করে বাকিরা ঘুমায়। এখন কেবল সকাল দশটা। শারাফাত ও সাওয়ান চৌধুরী আজ দেরি করে অফিসে গেছেন।

কিছুক্ষণ হলো সিরাত সাম্য আর সৃজনকে নিয়ে গেছে কোচিং করাতে। রমজান মাস বিধায় এ একমাস সকাল নয়টায় ক্লাস হবে। বাচ্চা দুটোকে ঘুম থেকে টেনে তুলে নিয়ে গেছে। আজকে যাবে না বলে কত কী করল কিন্তু ছাড় পেল না তাই মুখ গোমড়া করে মায়ের সাথে গেছে তারা। শখ
গতরাতে জানিয়েছিল ল্যাবে কাজ আছে ফিরতে দেরি হবে। সময় মতো সেও কখন বেরিয়ে গেছে কেউ জানে না। সায়ন সেহরির খেয়ে মসজিদে গিয়ে বাড়িতেই আসে নি। কোথায় গেছে, কেন গেছে, কেবলই সে জানে।
স্বর্ণ, শীতল, শুদ্ধ যার যার রুমে ঘুমাচ্ছে বোধহয়। বাড়িতে আর তেমন কেউ নেই বিধায় সিঁতারা, সিমিন ভাবলেন হাতের কাজ সেরেই কুরআন
তেলাওয়াত করতে বসবেন। ইফতারে কী কী আইটেম বানাবেন। কখন রান্না শুরু করবেন। এসব নিয়ে দুই জা গল্প করতে করতে টুকটাক কাজ সারছিলেন। প্রতিবছর উনারা তিন জা কুরআন খতম দেন। শুধু উনারাই না শারাফাত চৌধুরীর, শুদ্ধও দেয়। বাদবাকিরা খতম দিতে না পারলেও
প্রত্যেকদিন দু’এক পারা করে কুরআন পড়ে। বলা বাহুল্য, সায়ন, শুদ্ধ, শখ, স্বর্ণ, শীতল কুরআন পড়া শিখেছে ছোটো কর্তা শাহাদত চৌধুরীর কাছে। আর শাহাদত চৌধুরী শিখেছিল উনার বাবা অর্থাৎ শুদ্ধর দাদার থেকে। চমৎকার করে কুরআন পড়তেন উনি।এত সুরেলা কন্ঠে কুরআন পড়েন শুধু শুনতেই ইচ্ছে করত।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এবং অতি গর্বের বিষয় চৌধুরী বাড়ির প্রত্যেকটা ছেলেমেয়ে সহি শুদ্ধভাবে কুরআন পড়তে পারে। আজ প্রথম রোজা। প্রত্যেকটা রোজাদার রোজা রেখেছে। সবার প্রার্থনা রমজানের ত্রিশটা রোজাই করবে। এটি পবিত্র মাস। পবিত্র এক একটি দিন। সবার মতো চৌধুরী নিবাসের সবাই চেয়েছিল দিনটা খুব ভালো কাটাতে। কিন্তু হঠাৎ বিপদ এসে হানা দিয়েছে দোর গোড়ায়। কেবলই সিরাতের নাম্বার থেকে সিমিনের কাছে কল এসেছে সাম্য, সৃজন এক্সিডেন্ট করেছে। দুই
ভাইয়েরই গুরুতর অবস্থা। মাথায় ভীষণ চোট পেয়েছে বাচ্চাদুটো। রক্ত বন্ধ হচ্ছে না দেখে পথচারীরাই ধরে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। দুচোখের সামনে ছেলেদের এক্সিডেন্ট দেখে সিরাত সেই মুহূর্তে জ্ঞান হারিয়েছেন।
পানি টানি ছিঁটিয়েও জ্ঞান ফেরানো যায় নি উনার। পরে উনাকেও দ্রুত হসপিটালের ভর্তি করানো হয়েছে। কোনো এক দয়াবান সিমিনকে ফোন
কল করে এসব জানিয়েছে। শুদ্ধর রুম সাউন্ডপ্রুফ। নিচের কোনো শব্দই তার রুম অবধি পৌঁছায় না।একথা স্মরণ হতেই দোতলার দিতে ছুটছেন তিনি।

এদিকে শুদ্ধও নামাজ পরে ঘুমায় নি। আপনমনে রুমের সঙ্গে লাগোয়া ল্যাবে কাজ করছিল। কিছুক্ষণ আগে ঐশ্বর্যের কল পেয়ে রেডি হয়ে রুম থেকে বের হচ্ছিল। ইমিডিয়েট কিছু জিনিসপত্র ঐশ্বর্যের কাছে পৌঁছাতে হবে। সেগুলো হাতে পেলে জরুরি কাজগুলো সারবে ঐশ্বর্য! হ্যাঁ বলতেই হয় মেয়েটার ধারালো ট্যালেন্ট। তার সঙ্গে কাজ করতে গেলে তা বোঝা যায়। শুধু ট্যালেন্ট না তার এটিটিউডও হাই লেভেলের। কাজের ক্ষেত্রে তার মতো সহকারী পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের। আর এখন অবধি তার ভাগ্য সর্বদা তার সাথেই ছিল। এখনো আছে!
আপনমনে কিছু ভাবতে ভাবতে রুমের দরজা লক করতে করতেই ঘাড়
ঘুরিয়ে তাকাল শীতলের রুমের দিকে। মহারানী এখনো ঘুমাচ্ছে হয়তো।

রোজা আছে সারাটাদিন চটে থাকবে তার মেজাজ। কিছু বললেই খ্যাক করে উঠবে। একটা কথা বললে দশটা কথা শোনাবে। ভুল করলে মারতে গেলে মায়া মায়া চোখে তাকিয়ে বলবে, ‘রোজাদারকে মারতে নেই শুদ্ধ ভাই। মাফ করে দিন। মাফ করা মহৎগুন।’ অথচ যত রাজ্যের আজাইরা কাজ করে বেড়াবে। এসব নতুন কিছু নয় প্রতিবছরই এসব হয়। সবটাই তার জানা। এসব কথার রেশ না কাটতেই হঠাৎ তার কানে এসে পৌঁছাল
সিমিনের কান্নারত কন্ঠস্বর। ছোটো মা এভাবে কাঁদছে কেন? হঠাৎ কার কী হলো? ওদিকে কিছুক্ষণ আগে ফ্রেশ হয়ে শুদ্ধকে বকতে বকতে চুলে বেনুনি করছিল শীতল। পরনে পার্পেল কালার থ্রি-পিচ। কোচিং আছে।
মন খারাপ বিধায় যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু শুধু শুদ্ধকে জ্বালানোর সুযোগ মিস করতে চায় না সে। ওই বিশুদ্ধ পুরুষ কি ভেবেছে? দু’একটা কড়া কথা বললেই সে আবেগ গ্রামের আবেশী সেজে পথে ঘাটে বিরহের গান গেয়ে বেড়াবে? দুঃখী সেজে শুয়ে বসে কাঁদতে কাঁদতে আমচূর হয়ে যাবে? না, মোটেও তা করবে না! বরং আগে যা জ্বালাতো তার থেকেও
এখন বেশি করে জ্বালাবে। সে জানে মহামানব এখনো বাড়িতেই আছে।

তার কাছে গিয়ে এখন থমথমে সুরে বলবে,’এ্যাই শুদ্ধ ভাই গাড়িতে করে আমাকে কোচিংয়ে সামনে রেখে আসেন। এত রোদের মধ্যে হেঁটে যেতে পারব না আমি।’ একথা শোনামাত্রই যখন না বলবে তখনই কেঁদে কেটে একাকার করে ফেলবে। বড় আব্বুকে ফোন করে বলবে একথা। গতদিন খোঁচা মারা হয়েছিল না? তারই শোধই তুলবে সে। কী ভেবেছে কী সে যা বলবে সব মেনে নেবে? এসব ভাববে ভাবতে বিনুনীতে পাক দিচ্ছিল সে।
হঠাৎ মায়ের কান্না শুনে বেনুনিতে রাবাব বাঁধতে পারল না তার আগেই
দৌড়ে বের হলো। এইদিকে ঘটনা জানতে শুদ্ধও এগোচ্ছিল ফলস্বরুপ আচমকা শীতলের সাথে ধাক্কা লাগে তার। বিরক্তিতে চোখ, মুখ, কুঁচকে আসে। প্রশ্বস্ত বুকের সাথে নাকে বারি লেগে শীতলের মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে ব্যথাতুর শব্দ। তবে অপ্রস্তুত ঘটনায় কেউ কিছু বলার সুযোগ পায় না। হন্তদন্ত হয়ে সিমিন উপস্থিত হয় সেখানে। ওদের দেখে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন। উনি কাঁদতে পারে না। একটু কাঁদলেই শ্বাসকষ্ট শুরু হয় উনার। শুদ্ধও বুঝল সিরিয়াস কিছু ঘটেছে নতুবা এভাবে কাঁদার মানুষ নন তার ছোটো চাচী। উনাকে আশ্বস্ত করতে সে এগিয়ে একপেশে মা তুল্য চাচীকে বুকে জড়িয়ে ধরল। তারপর খানিকটা নরম সুরে বলল,

-‘ কি হয়েছে? এভাবে ছুটছো কেন পড়ে ব্যথা পাবে তো?’
-‘ ব..বাপ ও ও..ই।’
-‘ছোটো চাচ্চু ঠিক আছে?’
-‘হুম।’
-‘তাহলে?’
-‘একজন কল করেছিল সাম্য, সৃজন নাকি এক্সিডেন্ট করেছে। চল বাপ। এক্ষুণি আমাদের হাসপাতালে যেতে হবে।’
-‘কে কল করছিল? চেনো তাকে? পরিচয় দিয়েছে?’
-‘তাকে চিনি না তবে বলল পথচারী।’
শুদ্ধ ভ্রুঁ কুঁচকাল। সিমিনের হাতে থাকা ফোনটা নিয়ে কললিস্টের প্রথমে থাকা সিরাতের নাম্বারে কল দিলো। তবে কল রিসিভ করল এক মহিলা।
শুদ্ধ বিনয়ীভাবে কথা বলে জেনে নিলে পুরো ঘটনা। কোন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে তাও শুনে নিলো। ততক্ষণে বাড়ির সকলে দৌড়ে এসে হাজির। মুহূর্তেই বাড়িতে কান্নাকাটির হিড়িক পড়ে গেল। জায়ের সন্তান বলে বাড়ির কোনো ছেলে-মেয়েকেই কখনো আলাদা নজরে দেখেন না চৌধুরী গিন্নিরা। তাদের মতে, সবগুলোই বাড়ির সন্তান। তাদেরই সন্তান।

বাড়ির ছোটো সদস্য হিসেবে শীতল, সাম্য, সৃজন সবার কাছেই একটু
বেশি আদরের, আহ্লাদের। বলা বাহুল্য তারাই এ বাড়ির প্রাণ। বিনোদন পর্বের মূল উৎসও। অথচ আদরের বাচ্চা দুটোর এ ঘটনায় চৌধুরী বাড়ি স্তব্ধ হয়ে গেল। শারাফাত ও সাওয়ান চৌধুরীর কাছেও খবর চলে গেল।
উনারা অফিস থেকে ছুটলেন হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। তাদের সবাইকেও যেতে হবে কারণ সাম্য, সৃজনের রক্ত লাগবে। শুদ্ধ আর সময় নষ্ট করল না। শুধু মা-চাচীর উদ্দেশ্যে বলল,
-‘ গাড়ি বের করি দ্রুত এসো।’
একথা বলে গাড়ির চাবি নিয়ে দ্রুতপায়ে পার্কিংলটের দিকে ছুটল। তার গাড়ি বের করতে করতেই সিঁতারা, সিমিন, শীতল, স্বর্ণ এসে দাঁড়িয়েছে।
তারা যাবে হাসপাতালে। শুদ্ধ ড্রাইভিং সিটে বসে কাঁদতে থাকা শীতলের দিকে একবার তাকাল। কাঁদতে কাঁদতে চোখ, মুখ লাল করে ফেলেছে।

রিতিমতো ফোঁপাচ্ছে এখনো। কান্না আর প্যারা দেওয়া ছাড়া এই মেয়ে পারেই বা কী? তাছাড়া ওকে কিছু বলা না বলা সমান। তাই শীতলকে কিছু না বলে স্বর্ণকে বলল,
-‘বাড়ি খালি করে দলবেঁধে যাওয়ার প্রয়োজন দেখছি না। ওকে নিয়ে বাড়িতে থাক আমি আপডেট জানাব।’
স্বর্ণ সম্মতি জানালেও শীতল শুদ্ধর কথা তোয়াক্কা না করে আগে শুদ্ধর পাশের সিট দখল করে বসে পড়ল। ধমকে তাকে গাড়ি থেকে নামানোর
আগেই শীতল জেদী সুরে বলল,
-‘গাড়িতে না নিলে রিকশা করে যাব তাও যাবোই।’

তর্ক করার মতো সময় নেই দেখে কেউ কথা বাড়াল না। শুদ্ধ গাড়ি স্টার্ট করে দ্রুতগতিতে চৌধুরী নিবাসের গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল। অগত্যা স্বর্ণ একাই বাড়িতে থেকে গেল। আচ্ছা, সায়ন কোথায়? সে শুনেছে ঘটনা?
সাম্যের নাকি রক্ত লাগবে। তার আর সায়নের রক্ত এক। সাম্যকে রক্ত দিতে গেলে সায়নকে প্রয়োজন। কিন্তু সেই বান্দা এখন কোথায়? বাড়ি ফিরছে না কেন এখনো? একবার কল করে দেখবে? এসব ভেবে ফোন হাত নিতেই দারোয়ান কাকা দৌড়ে এলো তার কাছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
-‘আম্মা, সর্বনাশ হই গেচে। কেরা জানি সায়ন বাবার পার্টি অপিস চুরচুর কইরালাইছে। সায়ন বাবা কারে জানি খুব পিডাইতাছে।’

-‘কাকে মারছে?’
-‘মুই তারে চিনি না। তয় হুনলাম ওই গোলামের পুঁত নাকি পার্টি অপিসে আগুন দিতে আইছিল।’
-‘ওহ।’
-‘আপনে যাইবেন আম্মা? চলেন আপনেরে নিয়া যাই?’
-‘না। আমি গিয়ে কি করব?’
-‘সায়ন বাবা মারপিট করতেছে তাও যাইবেন না?’
-‘ তারা পুরুষ-পুরুষ মারামারি করছে। সেখানে আমি অবলা মেয়ে গিয়ে কি করব? যাই হোক, কাকা আপনি বার বার গেট ছেড়ে বাইরে যাবেন না। আমি একা বাসায়। আর আপনিও যদি বারবার এদিক-ওদিক যান তাহলে বাবার কানে গেলে ভালো কিছু হবে না।’

-‘আর যামু না আম্মা। ‘
-‘ঠিক আছে।’
একথা বলে স্বর্ণ সোজা বাড়ির ভেতর চলে এলো। তার এমন কাঠখোট্টা জবাবে দারোয়ান কাকা অবাক হলেন না। কারণ উনি এ বাড়িতে চাকরি করেন তাও পাঁচ সাত বছর হবে। বাড়ির সবাইকে পুরোপুরি না চিনলেও মোটামুটি চিনেন, জানেন। চৌধুরী নিবাসের এতগুলো সদস্যদের ভিড়ে সবাই হাসিখুশি হলেও এই মেয়ে বরাবরই একটু অন্যরকম। অবাক করা ঘটনাগুলোতেও কেন জানি অবাক হয় না এই মেয়ে। যেমন, ছোটো ভাই এক্সিডেন্ট করেছে তারা কী উচিত না কেঁদেকেটে একশা হওয়া? যেমন শীতল হয়েছে। কিংবা সায়নের পার্টি অফিস কে বা কারা ভেঙ্গেছে এটা নিয়েও একটু চিন্তিত হওয়ার কথা। কিংবা সায়ন কাকে মারছে এটাশুনে ছুটে গিয়ে দেখার কথা। কিন্তু না, সে বরাবরের মতো শান্ত। তার হাবভাব এমন যেন কিছুই ঘটে নি, সব স্বাভাবিক। সব!

পার্টি অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে কিছুতেই সায়নকে ছাড়াতে পারছে না রুবাব। বারবার ছাড়তে বলেও কাজ হচ্ছে না। সে সমানে একটা ছেলের মুখে ঘুষি মেরেই যাচ্ছে। তাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে ওরা পূর্ব পরিচিত।
তাহলে কিসের বশে শত্রুতা? শত্রুই যখন তখন খালি হাতে পায়ে লাগতে আসার মানে কি? যদিও বুঝতে পারছে সায়ন এমনি এমনিই মারছে না ছেলেটাকে। সে মার খাওয়ার কাজই করেছে।যখন একথা বুঝেছে তখন সায়নকে বাঁধা না দিয়ে আরাম করে বসেছে। রোজা না থাকলে চিপস খেতে খেতে আর একটু মজা নেওয়া যেতো। একথা ভেবে সে আইফোন বের করে সেলফি নিলো। সেলফিতে দেখা যাচ্ছে তার পেছনে সায়নরা মারামারি করছে। এমন সময় কারো সেলফির কথা মনে আসতে পারে? তার আসে। তার ফোনের অনেক ছবিই উদ্ভট পরিস্থিতিতে তোলা সেই তুলে যাতে স্মরণ করতে সুবিধা হয়।

ঘড়িতে তখন বেলা সাড়ে দশটা। চড়া রোদ। গায়ে রোদ পড়তেই সারা গা চিটমিটিয়ে উঠছে দেখে রুবাব ছায়ায় দাঁড়িয়ে দেখতে থাকল সায়নের মার। ভাইটা তার ভালোই মারপিট পারে। রাজনীতি টাজনীতি না করে সরাসরি সিনেমার হিরো হলেও পারত। দেখতে শুনতে হিরোমার্কা। বেশ ভালো অভিনয়ও জানে। তাহলে হিরোর চরিত্রে অভিনয় করতে তার কী সমস্যা? সে কি কোনো ডিরেক্টর কিংবা প্রডিউসরের সাথে একবার কথা বলে দেখবে? দেখা উচিত। কারণ এসব ট্যালেন্ট কাজে লাগানো উচিত।
এরা দেশের এক একটি রত্ন। এদের যত্ন করা আবশ্যিক। এসব ভেবে সে সময় দেখল। সেহরির পর মসজিদে নামাজ পড়ে বাড়ির দিকে যায় নি কেউই। দুই ভাই বাইক নিয়ে টইটই করে ঘুরেফিরে পার্টি অফিস দেখাতে এনেছিল সায়ন। কিন্তু এসে দেখে পার্টি অফিসের ভেতর ভাঙচুর করছে কনক। তার রাগ যেন আকাশচুম্বী। যা সামনে দেখছে তাই ভাংছে।

কনক বোনের কবর জিয়ারত করে ছুটে এসেছে সায়নকে মারতে। কারণ তার ভাষ্যমতে সায়নই ওর বোনের মৃত্যুর জন্য দায়ী। তাই সায়নকে না পেয়ে তার জিনিস নষ্ট করছে। সব ভাঙ্গা হলে যখনই আগুন দিতে যাবে তখন সেখানে সায়ন আর রুবাব উপস্থিত হয়।আজ প্রথম সেহরি বিধায় ছেলে পুলেও যে যার বাড়িতে সেহরি সেরেছে। আজ কেউ ছিল না এদিকটায়।তবে তালা মারা ছিল অফিসের মূল ফটকে। তালা ভেঙ্গে ঢুকেছে কনক।
দূরে দাঁড়িয়ে তার পাগলামি দেখছিল সায়ন। কিন্তু তাকে যখন আগুন দিতে দেখল তখনই দৌড়ে এসে আঁটকায় সায়ন। স্বাভাবিক স্বরে বলে,

-‘দেখ ভাই আমি ভদ্র হয়ে গেছি। রোজা আছি। নামাজে যাওয়ার আগে না হওয়া বউকে ছুঁয়ে কথা দিয়েছি এই একটামাস গালি টালি দেবো না। অকারণে কাউকে মারব না। তবে হ্যাঁ, যেই চো’দ’না অকারণে আমার পেছনে সুড়সুড়ি দিতে আসবে তাকে সুস্থভাবে ফিরতেও দেবো না। তুইও দুষ্টুমি করিস না মায়ের ছেলে মায়ের কোলে ফিরে যা। বারবার এককথা বলতে পারব না। যা, যা, বাড়ি যা।’
-‘বাড়ি যাব? যাব তো! আগে তোর তিনবোনের এক বোনেকে দে খেয়ে কবরে শুঁইয়ে আসি।’
-‘এই বালের বাল রাগ উঠাস না বলে দিচ্ছি। তুমি আমার বিয়ে করা বউ না যে আদর করার লোভে ঘরে আঁটকাতে তোমার আচু’দা কথাবার্তা গোগ্রাসে গিলে যাব।’

-‘হা হা, আমার কথা গিলবি কেন? আর গিলতে পারলে তো গিলবি? যে ছেলে দিনের বেলা বোন বোন করে মুখে ফ্যানা তুলে ফেলে রাতের বেলা আবার ঠিকই বোনের সাথে খোলাখুলি, লাগালাগির বাদ রাখে না কিছু, সে আমার কথা এত সহজে গিলতে পারবে না। তবে তুই জিনিয়াম রে সায়ন। তুই গিলতেও পারোস।’
বোনদের নিয়ে নোংরা কথা সহ্য হয় না সায়নের। মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। মেজাজ সামলানো দায় হয়ে পড়ে। এখনই হচ্ছে। তাই সে চোয়াল শক্ত করে পুনরায় সাবধান করল,
-‘লাস্টবার বলছি মুখে লাগাম দে।’

কনক যেন এবার আরো ক্ষীপ্ত হয়ে উঠল। বোনের কবরে অনবরত হাত বুলানোয় তার হাতে এখনো মাটি লেগে আছে। সেই মাটি হাতে সায়নের টি-শার্টের কলার চেপে ধরে বলল,
-‘ওই মা’দা’রচো’দ কেন লাগাম দেবো? বল কেন? আমার সাথে শত্রুতা, আমাকে খুন করতি আমার বোনের দিকে কেন হাত বাড়ালি? কেন এত কষ্ট দিয়ে মারলি আমার বোনটাকে? কেন মারলি বল? আমি তোর তিন বোনের কাউকে অসন্মান করেছি? বাজে টোনে কথা বলেছি? তবে তুই কেন করলি? আজ কয়েকটা দিন আমার বোনটা আমাকে ভাইয়া বলে ডাকে না। ঘরে ফিরলে ছুটে আমার কাছে আসে না। আমার মা আমার সাথে কথা বলে না। ‘ভাইয়া’ ডাক শোনার জন্য বুক জ্বলে যাচ্ছে। আমার পুরো দুনিয়া অন্ধকার করে দিয়েছিস তুই। তোকে আমি ক্ষমা করব না। কখনো না। আজ এক অসহায় ভাই হয়ে অভিশাপ দিচ্ছি তুইও জীবনে একবার হলেও আমার জায়গায় এসে দাঁড়াবি। আল্লাহ যেন তোকে দাঁড় করায়। আমার চোখের পানি যেন তোর জীবনে অভিশাপ হয়ে আসে। আমার মতো তুই একবার ‘ভাইয়া’ ডাক শোনার জন্য পাগল হয়ে যাস। তোকেও যেন বোনের নগ্ন দেহের সামনে দাঁড়াতে হয়। চোখে দেখতে হয় আদরের বোনের ক্ষত বিক্ষত লাশ। বোনকে দেওয়া নামটা রেখে সবাই যখন ধর্ষিতা নামে ডাকবে তখন শুনতে কেমন লাগে তুইও যেন বুঝিস।

তোর জীবনেও যেন এমন তিক্ত অভিজ্ঞতা আসে।’
সায়ন আর সহ্য করতে পারল না। শক্ত হাতে ঘুষি মেরে দিলো কনকের নাক বরাবর। গলিগলিয়ে রক্ত বেরিয়ে এলো। পাল্টা আক্রমণ কনকও করল। সেও বসাল আরেক ঘুষি। তবে সায়ন একের পর এলোপাথারি মারতে শুরু করলে রুবাব তাদের আঁটকাতে চাইলেও পারল না। আজম শিষ বাজাতে বাজাতে এসে দাঁড়িয়েছে কেবল। ঘটনা বুঝে দৌড়ে গেল তাদের কাছে। সায়ন যেন উন্মান। ভিড়ে জমে গেছে পথচারীদের। রুবাব আর আজম কোনোমতো ছাড়াতে গেলে সায়ন বলল,

-‘এ্যাই শুয়োরের বাচ্চা এ্যাই কতবার বলব তোর বোনকে রেপ করি নি।শালা বা’ই’নচোদ আমার কী মেয়ের অভাব রে? আমাকে কী তোর মতো ভদ্রমাসের কুকুর পেয়েছিস যাকে তাকে লাগিয়ে বেড়াব? আমার এক ইশারায় যথেষ্ট তোর বোনের থেকেও শতগুন সুন্দরী মেয়েকে বিছনায় তোলার। রেপ রেপ করে আমাকে তুমি রোজ রোজ একই ভোজনগান শোনাও? আজ তোমার ভোজনগান তোমারই পেছনে ভরব শালা।’
একথা বলে সায়ন কনককে ধাক্কা মেরে অফিসরুমে ঢুকল। তারপর ড্রয়ার খুলে একটা পেনড্রাইভ এনে কনকের মুখের উপর ছুঁড়ে মেরে বলল,
-‘ভ্যাড়াচুদা এটা দেখ কে তোর বোনকে রেপ করিয়েছে। সেই সাথে শুনে নাও তোদের চো’দার সময় নেই এই সায়নের। আমার রুচিও এত জঘন্য না। সর চোখের সামনে থেকে, যা সর। আজকের পর থেকে যদি আমার চোখের সামনে পড়িস তাহলে তুই শেষ।’
একথা বলে কনককে আরেকটা কিক মারতেই রুবাব কানে ফোন ধরা অবস্থায় চিৎকার করে উঠল। সায়ন ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালে রুবাব বলল,

-‘ভাই শুদ্ধ কল করেছে দ্রুত হাসপাতালে চলো। তোমার আর সাম্যের নাকি একই ব্লাড।’
-‘হুম, তো?’
-‘জুনিয়রদের এক্সিডেন্ট হয়ে গেছে ভাই, দ্রুত চলো।’
এরপর সংক্ষিপ্ত আকারে পুরো ঘটনা শুনে সায়ন প্রাণপণে বাইক নিয়ে ছুটতে শুরু করল। তাদের যেতে দেখে কনক মুখভর্তি রক্ত থু করে ছুঁড়ে ফেলল। তারপর হাত দিয়ে নাক মুছে মাটিতে শুয়ে বলল,

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৩৩

-‘মৌমাছির চাকের মতো তোর বিপদ ঘুরঘুর করছে রে সায়ন। কতদিক সামলাবি তুই? কতবার সেভ করবি বোনদের? তোর বাগানের সেরা ফুল
টাকে তুলবেই ইয়াসির। দুমড়ে মুচড়ে শেষ করবেই সে। আজকাল তোর সময়টা খুব ভালো যাচ্ছে রে। তবে ভালোর পরে মন্দের আসন তা ভুলে যাস না? আমার বিশ্বাস তোদের নাকানিচুবানি খাওয়াতে শুধু ইয়াসিরই যথেষ্ট! রেডি থাক একে একে সব ব্যথা ফিরিয়ে দেওয়া হবে তোদের।’

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৩৫