শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৩৫

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৩৫
নূরজাহান আক্তার আলো

‘RLRC’ নামের এক উন্নতমানের হাসপাতালের ওটির সামনে বসে আছে চৌধুরী নিবাসের প্রত্যেকটা সদস্য। চোখভর্তি জল নিয়ে চাতক পাখির ন্যায় তাকিয়ে আছে ওটির দরজার দিকে। সাম্য, সৃজনের অপারেশন এখনো চলমান। গাড়ির কাঁচ ঢুকে গেছে বাচ্চা দুটোর মাথায় ও বুকে।
গুরুতর আঘাত পাওয়ার সাথে সাথেই জ্ঞান হারিয়েছিল তারা। পথচারী মানুষটি সিমিনকে ভুল তথ্য জানিয়েছিল। জানিয়েছিল সিরাত তেমন আঘাত পায় নি। অথচ হাসপাতালে এসে দেখা গেছে সবচেয়ে সে বেশি
আঘাতপ্রাপ্ত। অসহায় মা হয়ে যখনই বুঝেছে গাড়িটা তাদের দিকে ধেয়ে আসছে তখনই সে বাচ্চা দুটোকে বুকে আগলে নিয়েছে। ফলস্বরুপ তার পিঠে লেগেছে সম্পূর্ণ আঘাত। ডাক্তারদের ধারণামতে মেরুদন্ডের হাঁড় ভেঙ্গে গেছে উনার। পরীক্ষা করা হয়েছে রিপোর্ট পেলে জানা যাবে মোট কয়টা হাঁড় ভেঙ্গেছে।

এদিকে সাম্য আর সৃজন জমজ। জন্মগত ক্রুটি থাকায় কম বয়সে বেশি পাওয়ারের চশমা পরে তারা। এখন আবার এত বড় এক্সিডেন্ট! মাথায় নাকি আঘাত পেয়েছে। তিনজনেরই ক্রিটিক্যাল অবস্থা। তাদের চিন্তায় সকলে অস্থির। পথচারীরা প্রথমে যে হাসপাতালে ভর্তি করেছিল সেখান থেকে ইমিডিয়েট এখানে আনা হয়েছে। এই হসপিটালে সবসময় বিদেশী
ডাক্তারদের আনা গোনা থাকে। চিকিৎসার মানও অনেক উন্নত। তাছাড়া
এই হাসপাতালে শুদ্ধসহ তার সব ফ্রেন্ডদের শেয়ার আছে। কাজের সূত্রে
চেনাজানা পরিচিত ডাক্তারও আছে। তাদের মধ্যে অর্থোপেডিক সার্জন,
নিউরো সার্জন, স্পাইন স্পেশালিস্টদের জরুরি মিটিং বসেছে। উনারা সবাই একেকজন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালির নামকরা ডাক্তার।
রিপোর্টে সিরাতের অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেবেন। আর সাম্য আর সৃজনের মাথায় জন্য নিউরোলজিস্ট মি. জুম এবং নিউরোসার্জন ইমালিনিয়ার তত্ত্বাবধানে সাম্য আর সৃজন। সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া অবধি উনারাই বেস্ট চিকিৎসা করে যাবেন।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তিনজন গুরুতর আহত হওয়ায় তিনজনেরই ইমিডিয়েট রক্ত প্রয়োজন।
হাসপাতাল কতৃপক্ষ চেষ্টা করে যাচ্ছেন সবদিক সামাল দেওয়ার। কিন্তু সাম্যের শরীরে অন্যের রক্ত শ্যুট করছে না। এক ব্যাগের খানিকটা রক্ত তার শরীরে প্রবেশ করা মাত্রই তার শরীরে দেখা দিচ্ছে লাল লাল গুঁটি।
ডাক্তাররা ব্যাপারটা খেয়াল করামাত্রই রক্ত দেওয়াও বন্ধ করে দিয়েছে।
একথা জানামাত্রই শুদ্ধ রুবাবকে কল করে জানিয়েছে সে আর সায়ন সেখানেই থাকুক হাসপাতালে যেন উপস্থিত হয়। তার কল পেয়ে ঝড়ের গতিতে উপস্থিত হয়েছে দুই ভাই। রোজা অবস্থাতেই শুয়ে পড়েছে ছোট ভাইদের রক্ত দেওয়ার জন্য। সাম্যকে রক্ত দিলো সায়ন। সৌভাগ্যবশত এবার আর কিছু হলো না সাম্যের। সৃজনের রক্ত মিলে শীতলের সাথে।

বাড়িতে এই দু’জনের রক্ত আবার ও পজেটিভ। কিন্তু শীতলের বয়স কম। ওজন কম। এর আগে কাউকে রক্ত’ও দেয় নি সে। তাছাড়া বাচ্চা মেয়েটা রোজা আছে তাই শীতলের রক্ত নিতে কেউ রাজি না। শীতল
বারবার অনুরোধ করেও কাউকে রাজি করাতে পারল না। তখন সে
শুদ্ধর সামনে দাঁড়িয়ে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল,
-‘আমার ছোটো ভাইরা কষ্ট পাচ্ছে। তাদের রক্ত প্রয়োজন। আমার দেহে অনেক রক্ত থাকার পরেও যদি ভাইদের দিতে না পারি তাহলে নিজেকে মাফ করতে পারব না শুদ্ধ ভাই। প্লিজ আমাকে রক্ত দিতে দেন।’
শুদ্ধ নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তখন থেকে সমানে কেঁদেই যাচ্ছে।
শীতলের কথা শুনে বড়রা এগিয়ে এলেন। সাওয়ান চৌধুরী চোখ মুছে শীতলের দুইহাতে চুমু এঁকে ভেজা কন্ঠে বললেন,

-‘সোনা মা আমার তুমি নিজেও তো বাচ্চা। রক্ত দিলে তুমিও অসুস্থ হয়ে যেতে পারো। রক্ত ম্যানেজ হয়ে যাবে মা।’
-‘আমার কিছু হবে না চাচ্চু। তোমার বোঝার চেষ্টা করো সত্যি বলছি, আমার কিচ্ছু হবে না। আমাকে রক্ত দিতে দাও। আমি রক্ত দেবো।’
শীতল নিজের কথায় অটল। সে রক্ত দেবে। এসময় মেয়ের জেদ দেখে সিমিন দুম করে একটা কিল বসিয়ে দিলেন শীতলের পিঠে। শীতল ঠোঁট উল্টে কেঁদে কেঁদে বলল,
-‘নিবা না তো আমার রক্ত? সত্যি নিবা না? তাহলে আমিও বলছি, এখন আমার রক্ত না নিলে আমি এক্ষুণিই বাসায় যাব। তারপর ধারালো ছুরি দিয়ে হাত কেটে রক্ত ঝরাব। যে রক্ত আমার ভাইয়ের গুরুতর অবস্থাতে কাজে লাগে না সেই রক্ত শরীরেই রাখব না।’

একথা শুনে অনেকে তাকে বোঝালেও কাজ হলো না। জেদী একরোখা শীতলের জেদের কাছে সবাইকে হার মানতেই হলো। সে ছোটো ভাইকে রক্ত দিবেই দিবে। তার এমন পাগলামিতে শুদ্ধও আর বারণ করল না। নার্সকে ইশারা করে শীতলকে ভেতরে নিয়ে যেতে বলল। একটুপরে এক
মেয়েকেও সেখানে পাঠাল। মেয়েটি নার্সকে যেতে বলে শীতলের সাথে টুকটাক কথা বলতে বলতে রক্ত নেওয়ার প্রসেস শুরু করল। গল্পে গল্পে
বোকা শীতলটা খেয়াল করে নি শুদ্ধর ইশারায় হাফ ব্যাগেরও কম রক্ত নেওয়া হয়েছে। এবং সেটা যেন শীতলের চোখে না পড়ে তাই অন্য ব্যাগ ভর্তি রক্ত রেখে দেওয়া হয়েছে। ব্যাগভর্তি রক্ত দেখে শীতল ভেবেছে ওর রক্ত। তাই রক্ত দেওয়া শেষে তার মুখে হাসি ফুটেছে। কিন্তু উঠতে গিয়ে মাথা ঘুরে উঠে চোখ অন্ধকার দেখছে। দূর্বলতায় পড়তে গেলে শক্ত এক জোড়া হাতের মালিক তাকে আগলে ধরেছে। শীতলের মাথা ঠেঁকেছে এক মানবের প্রশ্বস্ত বুকে। শীতলের চোখ বন্ধ করে আঁকড়ে ধরেছে সেই মানুষটাকে। নাকে বিঁধছে পরিচিত Creed Aventus নামের আইকনিক ও বিলাসবহুল পারফিউমের সুঘ্রাণ। যেটা ফ্রুটি-উডি-স্মোকি এবং খুবই ব্যালেন্সড। তাদের বাড়িতে শুদ্ধই ভাই এটাই ব্যবহার করে। সেই হিসেবে
নেত্রজোড়া না খুলেই আত্নবিশ্বাসের সাথে বলে দিতে পারবে এটাই তার শুদ্ধ ভাই। পড়তে নিলে শুদ্ধ এখন নিশ্চয়ই তাকে ঝাঁড়ি মারবে। সেকথা ভেবে সেভাবে বুকে মাথা ঠেঁকিয়ে বিরবির করে বলল,

-‘ একদম ঠিক আছি শুদ্ধ ভাই। সামান্য এই একটু মাথা ঘুরছে এই যা।’
একথা শুনে শুদ্ধ বেশ কিছুক্ষণ সেভাবে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর পাশের একটা কেবিন দেখিয়ে সিমিনকে বলল শীতলকে শুইয়ে দিয়ে আসতে।
কিছুক্ষণ রেস্ট নিক সেখানে। শুদ্ধর কথা শুনে সিমিনও তাই করলেন।
এদিকে শুদ্ধর কল পেয়ে ছুটে এসেছে হাসান, কামরান, অর্ক। কিছুদিন ধরে বিশেষ কাউকে নজরজারীতে রাখতে গা ঢাকা দিয়েছিল ওদেরকে।
কাজের কাজ হয়ে গেছে। এবং পাকাপোক্ত খবর এনেছে আজকের এই ঘটনাটা পরিকল্পনামাফিক। এসব ঘটিয়েছে মাফিয়া কিং ইয়াসির শেখ।
তবে কারো কাছে সেটা প্রকাশ করল না নিজেদের মাঝে গোপন রাখল।তারা ম্যাজিকের মতো ব্যাগ ব্যাগ রক্তের ব্যবস্থাও করে ফেলল। তাদের একেক জনের উপস্থিতিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ডাক্তাররা, নার্সরা। চৌধুরীরা
এতদিন ভেবেছিল সাধারণ বেশে চলা ছেলেগুলো হয়তো খুব সাধারণ।

কিন্তু আজ বুঝল তারা একেক জন্য বড় মাপের মানুষ। তারা যা সেটা কাউকে বুঝতে দেয় না।
দুই ঘন্টা পেরিয়ে গেলে ওটির লাল বাতি নিভে গেল। রক্তমাখা ডাক্তারী পোশাকে বেরিয়ে এলেন কয়েকজন ডাক্তার। বিপদ এখনো না কাটলেও জানালেন গা, মাথা থেকে কাঁচ বের করা হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে যা হবে ভালোই হবে। তবে অবজারভেশনে থাকবে তারা। সিরাতের অবস্থা পূর্বের মতোই আশঙ্কাজনক। ডাক্তারদের রিকুয়েস্ট করে বাড়ির সবাই
দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে এক নজর সাম্য, সৃজনকে দেখলেন। জানবাচ্চা দুটোর সারা শরীরে ব্যান্ডেজ নিয়ে নিথর হয়ে শুয়ে আছে। চোখজোড়া বন্ধ। কখন খুলে সেই চোখ? পূর্বে মতো চেঁচিয়ে ডাকবে সবাইকে? গলা ফাটিয়ে কানমাথা ঝারাপালা করে দেবে? টাকা নেওয়ার আবদার নিয়ে ঝুলে পড়বে শুদ্ধ সায়নের গলা ধরে? খাবার নিয়ে শীতলের সাথে ঝগড়া করবে কখন? আজ প্রথম রোজা। প্রথম ইফতার। হরেক রকমের ইফতার নিয়ে শেষে মারামারি করবে না ভাই-বোনরা? আলুর চপ, কে কার ডিমের চপ কেড়ে খেতে পারে এই নিয়ে দুষ্টু বুদ্ধি আঁটবে না? কবে হবে এসব? কখন হবে? এসব ভাবতে ভাবতে সবাই কাঁদতে কাঁদতে মন থেকে দোয়া করলেন। রোজাদারের দোয়া মহান আল্লাহ ফেলবেন না নিশ্চয়ই!

ঘড়িতে তখন বিকাল সাড়ে চারটা। শীতল চুপ করে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে কেবিনের বেডে। এখনো মাথা ঘুরছে তার। খুব দূর্বল লাগছে।রক্ত দেওয়ার আগে বুঝে নি এত খারাপ লাগবে। রোজা থাকায় কিছু খেতেও পারছে না। ঘুমও আসছে না। সিমিনের থেকে শুনেছে সাম্য সৃজন নাকি ভালো আছে। ডাক্তার বলছে খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাবে।
একথা শুনে সে মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাচ্ছে প্রতিটি ক্ষণে।

কিন্তু চিন্তা হচ্ছে মেজো মার জন্য। বাড়িতে মায়েদের মধ্য সবচেয়ে বেশি ফ্রেন্ডলি সিরাত। তারা বোনরা পারসোনাল সব কথাগুলো আগে মেজো মাকেই জানায়। সমাধানও পায় জলদি জলদি। মেজো ঠিক হয়ে যাবে তো? এসব ভাবতে ভাবতে তার চোখের কোণ গড়িয়ে জল গড়িয়ে গেল। আঘাত পেয়ে কতই না কষ্ট পেয়েছে মেজো মা। চোখের উপর হাত রেখে নীরবে কাঁদতে কাঁদতে কারো উপস্তিতি টের পেল। কান্নার শব্দ যেন সেই ব্যক্তি বুঝতে না পারে তাই নিজেকে সামাল। কিন্তু লাভ হলো না। চোখ মুছতে না মুছতেই চোখ ভিজে উঠল। কেবিনের দরজা ভিজিয়ে রুবাব ভেতরে এলো। বসল বোনের শিয়রে। এক হাত শীতলের মাথায় রাখলে শীতল চোখ খুলল। জোরপূর্বক হাসার বৃর্থা চেষ্টা করল। তাকে চোখ মুখ দেখে রুবাব দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মেয়েটা কারো কষ্ট দেখতে পারে না। পর কিংবা আপন কাউকে কষ্ট পেতে দেখলে সেও কষ্ট পায়। এর নরম হলে কিভাবে হবে? এই পুতুলটাকে শুদ্ধ সামলাবে কিভাবে? কিভাবে দুনিয়া দারী বোঝাবে? মনে মনে এসব ভেবে সে শীতলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। তারপর বোনের মন ভালো করতে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল,

-‘শুদ্ধ পাঠাল তোর খোঁজখবর নিতে।’
-‘শুদ্ধ ভাই কোথায়?’
-‘কোথায় যেন গেল। যাওয়ার আগে বলে গেল তোর খেয়াল রাখতে।’
একথা শুনে শীতলের মুখ মলিন হয়ে গেল। ভেজা চোখের কোণে জমল অশ্রুকণা। সেদিনের পর থেকে শুদ্ধ তার সাথে কথা বলে না। সে বলতে গেলেও না। এইতো কিছুক্ষণ আগে রক্ত দিতে চাইলে সবাই বারণ করল। কত বকল। কিন্তু শুদ্ধ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনল। তার দিকে তাকালোও না কিছু বললোও না। অন্যসময় হলে ধমকে উঠত নতুবা চ্যালাকাঠের বারি বরাদ্দ রাখত। সামান্য একটা ভুল করেছেই নাহয় তাই বলে কথা বলায় বন্ধ করে দিতে হবে? সে জানে না তাকে না জ্বালালে, তার সাথে ঝগড়া না করলে তার দিন ভালো যায় না? একদন্ড শান্তিও পায় না। তবুও এত পাষাণ হতে হবে? কেন হতে হবে? একটু নরম হলে কি হয়? তার বেলায় এত কঠিন পানিশমেন্ট কেন? এসব ভেবে সে কান্না সামলাতে পারল না। ঠোঁট উল্টে শব্দ করে কেঁদে দিয়ে বলল,

-‘সেদিনের পর থেকে শুদ্ধ ভাই আমার সাথে কথা বলে না। উনার রুমেও ঢুকতে দেয় না। আমাকে একবারে পর করে দিয়েছে।’
শীতলকে এভাবে কাঁদতে দেখে রুবাব ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। হাসিও পেল খুব। তবে এখন হাসলে চলবে না তাই স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
-‘ আরে ধুর, কাঁদছিস কেন বোকা মেয়ে?শুদ্ধ খেয়াল রাখতে তো আর কমতি রাখছে না। জানিস কতবার দেখে গেছে তোকে? যাওয়ার আগে বারবার তোর দিকে খেয়াল রাখার কথা বলে গেছে।’
-‘যে খেয়ালে পর পর অনুভব হয় সেই খেয়াল লাগবে না আমার। তুমি শুদ্ধ ভাইকে বলো আবার আগের মতো হয়ে যেতে।’
-‘সেটা আর হবে না রে পাগলি।’
-‘কেন হবে না?’
-‘ ঘুমন্ত সিংহকে খুঁচিয়েছিস তুই অথচ তার হিংস্র থাবা হজম করবি না?’
-‘শুদ্ধ ভাই ঘুমন্ত সিংহ? কিসব বলছো ভাইয়া? কিছুই তো বুঝছিনা।’
রুবাব হাসল। এই পাগলিটাকে কী করে বোঝাবে তার শুদ্ধ ভাই শাসনের আড়ালে পৃথিবী সমান ভালোবাসা লুকিয়ে রেখেছে। সে ছোট। সরলমনা বিধায় ছেলেটা তার নিজের সুপ্ত অনুভূতিটুকু সন্তপর্ণে লুকিয়ে রেখেছে।
একবুক ভালোবাসা বুকে রেখে কখনো বুঝতে দেয় না এই চঞ্চলার প্রতি ভীষণভাবে দূর্বল সে। দূর্বল না হয়ে ও কী আর থাকা যায়? কথায় কথায় এত মারে। বকে। তবু এই মেয়েটা তার কাছেই যায়। তার আবদার শুদ্ধর কাছে। কারণে অকারণে রাগ-অভিমান দেখানোর মানুষটাও ওই শুদ্ধই।

শুদ্ধকে ভয় পায়না তাও না। ভয় পায় আবার তর্কও করে। এত মার খায় তবুও ঘুরে ফিরে তারই জিনিসপত্র ঘাটাঘাটি করে। কারণ তার শুদ্ধ ভাই তাকে প্রশ্রয় দেয়। শাসনের আড়ালেই থাকে প্রশ্রয়। এই অবুজ মেয়েটাও
বুঝে না সেসব। কবে বুঝবে আর? তবে একটা কথা না বললেই নয়। এই পাগলিটার মধ্যে এমন কিছু আছে যা যার জন্য শুদ্ধর মতো সংযমী এক ছেলেও মন হারিয়েছে। শীতল নিজের অজান্তে তার মনেপ্রাণে প্রেমপুষ্প ফুটিয়েছে। তবে সে সত্যিই সন্দিহান এই ছেলে আদৌও কখনো নিজের মুখে ভালোবাসার কথা প্রকাশ করবে কী না। শীতলের সৌভাগ্য হবে কী না শুদ্ধ মুখে ম্যাজিক্যাল শব্দ শোনার। মনে মনে এসব ভেবে রুবাবকে হাসতে দেখে শীতল মুখ ঘুরিয়ে নিলো। সে কষ্ট পাচ্ছে অথচ রুবাব ভাই হাসছে। সব ভাইগুলো কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। কেউ তাকে ভালোবাসে না। সব কষ্ট দেয়। শীতলকে মুখ ঘুরাতে দেখে রুবাব বোনের মুখটা ওর দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলল,
-‘নির্দিষ্ট একটা সময় সবার জীবনে প্রেম আসে। সেই প্রেম ধরা দেয় বসন্তরুপে। রঙ্গিন কিছু স্বপ্ন লুটোপুটি খায় নিদারুণ প্রেমানুভূতিতে। তবে এ বসন্তের কারণে, বারণে রয়েছে ভিন্নতা। মিশে রয়েছে মুগ্ধতা ও দগ্ধতা। এই বসন্ত ফাগুনের আগুনের ন্যায়। সেই আগুন নিজেকে যেমন পোড়ায় সেই সাথে অন্যকেও পোড়ায়।”

রুবাবের কথার আগা মাথা কিছুই বুঝল না শীতল। শুধু ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইল। রুবাবও বুঝল শীতল কিছুই বুঝে নি তাই কথা বাড়াল না বুদ্ধি খাঁটিয়ে অন্য প্রসঙ্গ তুলল। সেই মুহূর্তে দরজা খুলে হন্তদন্ত হয়ে শখ ছুটে এলো। কেঁদে ফেলল মুখে হাত চেপে। এসবের কিছু জানতে না সে।
ফোন বন্ধ রেখে ল্যাবে কাজ করছিল। পরীক্ষাও ছিল। বিকেলে বাড়িতে ফিরে স্বর্ণের থেকে সব শুনে তাৎক্ষণিকই ছুটে এসেছে। স্বর্ণও আসছিল হঠাৎ মাঝপথে কী কাজ পড়েছে বিধায় বাড়ির দিকে ফিরে গেছে। শখ শীতলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে দুবোন নীরবে কাঁদল। তখন রুবাব ওদের ধমকে থামাল। দুজনকে চোখ,মুখে পানি দিয়ে আসতে বলে উঠে দাঁড়াল। ইফতারের সময় হয়ে এসেছে বাড়ির সবাই রোজা আছে। এত এত টেনশনে ভুলে গিয়েছিল। তাই ইফতারের ব্যবস্থা করতে দ্রুতপায়ে
কেবিনের বাইরে যেতে হাসপাতাল ম্যানেজার এসে জানাল, সবার জন্য ইফতারের আয়োজন করা হয়েছে। ইফতার গ্রহন করলে খুব খুশি হবে।’

সবাই এটাও বুঝল শুদ্ধর কারণে স্পেশালভাবে সেবা পাচ্ছেন উনারা।
এদিকে শুদ্ধ, সায়ন, অর্ক, হাসান, কামরান কেউ নেই। আপাতত বাড়ির কয়েকজনই আছে হাসপাতালে। সেই মুহূর্তে শুদ্ধও জানাল হাসপাতালে ইফতার সেরে নিতে। এবং ইফতারের পর শীতলকে বাড়ি পাঠিয়ে দিতে।

‘অবলা গরুর গায়ে নাম্বার বসাতে চামড়া পুরিয়ে দেওয়া হয়। যাতে সেই নাম্বার কোনোভাবেই না ওঠে। তেমনি তোমার শরীরে আমি আমার নাম সেভাবেই খোদাই করব শীতল রাণী। যেন আমার নামটা তোমার শরীরে জ্বলজ্বল করে। সেই নামের উপর আমি চুমু খাব। চুমুতে চুমুতে ভিজিয়ে দেবে তোমার নরম কায়া। শিহরিত হবে তোমার সর্বাঙ্গ। আহা! সেদিনের অপেক্ষায়।’
একথা বলে ইয়াসির লেপটপের দিকে তাকিয়ে হো হো করে হেসে উঠল।
লেপটপে জ্বলজ্বল করছে শীতলের হাস্যেজ্বল ছবি। মেয়েটাকে দেখলেই খুব করে ছুঁতে ইচ্ছে করে। এত আদুরে কেন মেয়েটা? পবিত্র একটা ভাব রয়েছে সর্বাঙ্গে। আচ্ছা, মোমের মতো ফর্সা ত্বকে তার কঠোর স্পর্শ সহ্য করতে পারবে শীতলরানী? নাকি অসহ্য হয়ে আজ ভাইদের রক্ত দেখে যেভাবে কেঁদেছে সেভাবে কাঁদবে? কাঁদলে কাদুক না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কাঁদা ভালো। একা একা বিরবির করে সে রেড ওয়াইনের বোতল থেকে ঢকঢক করে ওয়াইন গিলল। বাম পা থেকে ঝরঝর করে রক্ত ঝরছে। এই আর নতুন কি? এসবে অভ্যস্ত সে। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার তাকে সুট করেছে একটি মেয়ে। মুখ ছিল কালো কাপড়ে বাঁধা। অদ্ভুত সুন্দর দুটো চোখ। হাতের নিশানা অবাক করার মতো। কে সে? সে কেন তার উপর হামলা করল? তাকে তো কখনো দেখে নি। চেনেও না। তবে একপলক দেখে মনে হয়েছে সে যেন এক_’অগ্নিকন্যা।’

তখন পালাতে গিয়ে গাছের কাঁটার আঁচড় লেগেছে বুকে, গালে, গলায়।
মেয়েটার পরে ঘন্টা খানিকের ব্যবধানে আরো দু’বার আক্রমন হওয়ায় বুঝতে বাকি নেই স্বয়ং শুদ্ধ এসেছিল এখানে। তবে ভীষণ মজাও পেল শুদ্ধ সব জেনে যাওয়ায়। প্রথমে আদরের বোন কিডন্যাপ এরপরছোটো ভাইদের গুরুতর এক্সিডেন্ট। আহারে! এখন সে যে ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের রুপ ধরবে একথা ভালো করে জানে। আচ্ছা ছানাদুটোকে একেবারে মেরে দিলে কেমন হয়? মারলে শুদ্ধ, সায়ন কতটা তড়পাবে? ধুর, ওদের কথা ভাবলে নেশা জমবে না। সেসব কথা আপাতত বাদ বলে চোখ বন্ধ করে হেলান দিয়ে বসলেও পুনরায় তার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল সাহসী মেয়েটির কথা। মেয়েটা কে? আচ্ছা, চৌধুরী বাড়িতে এমন কোনো মেয়ে আছে নাকি যার নিশানা এত নিঁখুত? এত চমৎককার! একথা ভেবে সে উঠে বসল। ঠোঁটে চিমটি কাটতে কাটতে ভাবতে লাগত ঘন্টা চারেক আগের ঘটে যাওয়া ঘটনা….!
রাত তখন আড়াইটা।অমাবস্যার রাত বিধায় ঘুটঘুটে অন্ধকার চারিপাশ।

এমন সময় ‘চন্দ্রবিন্দু নিকেতন’ নামে ভাঙ্গা বাড়ির নামনে দাঁড়িয়ে আছে এক মানবী। বয়স আন্দাজ করা না গেলেও ধারণা মতে উচ্চতা ৫.৫”। পরনে ব্ল্যাক জিন্সের সঙ্গে লেডিস লেদার জ্যাকেট। মাথায় হেলমেট। সে গত দুসপ্তাহ যাবৎ ঝাউবনের আড়ালে দাঁড়িয়ে বাড়ির দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখে। কেন রাখে? সে কে? এসব জানে না ইয়াসির। তবে অন্ধকার রুমে বসে গতকাল থেকে মেয়েটাকে দেখে মিটিমিটি হাসছে। লুকোচুরি খেলা পছন্দ করে না। আজ যাবে নাকি নারীটির মুখদর্শন করতে? গেলে মুখই দেখবে একথা দিতে পারছে না যদিও। কারণ সে নারীলোভী। নারীদেহ নেশার মতো টানে তাকে। রেড ওয়াইন আর নারীতে বিশ্রীভাবে আসক্ত সে। কী আর করার পুরনো অভ্যাস তো। ছাড়ার ইচ্ছে নেই যদিও।

মনে মনে এসব ভাবতে ভাবতে সে ভাঙ্গা বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে বের হলো। নিঃশব্দে চলাফেলা করায় পারদর্শী সে। কিন্ত গিয়ে দূরে থেকে খেয়াল করল মেয়েটি সেখানে নেই। পালিয়ে গেল নাকি? আশেপাশেও কেউ নেই। কাউকে না দেখে ইয়াসির শিষ বাজাল। মুহূর্তের তার মতো করে আরেকটা শিষ বাজল। অবাক হলো ইয়াসির। ওই মেয়েটা নাকি? শিষ বাজাতেও পারে? বাহ্, দারুণ তো। তা আর কী কী পারে সে? তবে শত্রুকে দূর্বলভাবে নেওয়ার বোকা সে নয়। তার প্যান্টের পকেট থেকে পিস্তল বের করে হাতে নিতেই একটা গুলি চলে গেল তার কানের পাশ দিয়ে। নিশানা দেখে হাসল সে। এর সাথে খেলাটা খুব জমবে মনে হচ্ছে। তবে খুঁকির বুকে পাটা আছে বলতেই হয়।

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৩৪

ইশ! তাকে একনজর দেখার মনটা আকুঁপাকু করছে…. একথা ভেবে পা বাড়াতেই জঙ্গলের শুকনো
গাছে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। আগুনের আলোয় দেখা গেল
কালো কাপড়ে মুখ বাঁধা এক নারীর মুখ। উফ! উফ! দারুণ দুটি চোখ। চোখেও যেন অগ্নিবর্ষণ হচ্ছে। ইয়াসির তাকে আপাদমস্তক দেখে জিহবা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে একটি বাক্যই উচ্চারণ করল, ‘অগ্নিকন্যা।’ তবে এই শব্দ উচ্চারণ করার আগেই মেয়েটি…!

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৩৬