শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৪৩

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৪৩
নূরজাহান আক্তার আলো

-‘আমি শীতলকে বিয়ে করতে চাই। কবে, কখন, জানি না তবে সে বউ হলে আমার বউ হবে।’
অকপটে বলা শুদ্ধর কথা শুনে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন সকলে। এ ছেলে কি বলে এসব? বলা নেই, কওয়া নেই, ডিরেক্ট বিয়ে! তাছাড়া এরা চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে বিশ ঘন্টায় পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করে। মারামারি করে, সুযোগ খুঁজে বেড়ায় কে কাকে বকা খাওয়াবে। কিছুদিন আগেও শুদ্ধ শীতলকে চ্যালাকাঠ দিয়ে মারল। মার খেয়ে শীতল শুদ্ধর সিগারেট খাওয়া ছবি সবাইকে দেখাল। মরা কান্না কেঁদে সিঁতারা শুদ্ধকে না বকা অবধি থামলই না। কথা খোঁচাখোঁচি করার ব্যাপারটা নাহয় বাদই রইল!
তাহলে কিভাবে কি..? নাকি দু’জনে মিলে প্রাঙ্ক করছে? আজকালকার ছেলে-মেয়েরা যা বিচ্ছু হার্ট অ্যাটাক করার মতো কাজবাজ করে বলে, ‘প্রাঙ্ক।’ এজন্য আগ বাড়িয়ে কিছু না বলে সকলেই আগে ঘটনা বোঝার চেষ্টা করছেন। তবে শুদ্ধর কথা শুনে সিমিন খেঁকিয়ে উঠে বললেন,

-‘এ হয় না এটা রক্তের অপমান!’
-‘কেন হয় না?’
-‘কারণ তোমরা ভাই-বোন..!’
একথা শুনে শুদ্ধ ফিচেল হেসে ভুল সংশোধন করে দিলো,
-‘উহুম, একটু ভুল হলো যে ছোটো আম্মু? হ্যাঁ, আমরা ভাই-বোন তবে চাচাতো ভাই-বোন। আর চাচাতো ভাই-বোনের বিয়ে স্বয়ং ইসলাম ধর্মে জায়েজ আছে। যা ধর্মে জায়েজ সেখানে বাড়তি কথার কারণ দেখছি না।’
-‘ধর্ম নিয়ে যখন এতই জ্ঞান রাখো তাহলে সম্পর্কে জড়ালে কেন? ধর্মে কি বলা নাই প্রেম ভালোবাসা হারাম?’
-‘কাউকে মন থেকে ভলোবাসা হারাম না বরং অবিবাহিত অবস্থায় দীর্ঘ দিন সম্পর্ক চালিয়ে যাওয়া হারাম। মন থেকে কাউকে ভালোবেসে বিয়ে করতে চাওয়া হারাম না বরং গোপনে প্রেমের নামে স্পর্শ করাটা হারাম। আমি যেসব কিছুই করি নি। বরং হারাম কিছু যেন না ঘটে তাই আজকে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব রাখছি।’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-‘কেমন সাধু তা তো চোখেই দেখলাম। আমি না দেখলে…।’
সিমিনের কথা আঁটকে গেল। উনি ফোঁস ফোঁস করতে করতে অন্যদিকে তাকালেন। রাগে শরীর জ্বলে যাচ্ছে উনার। তবে ভাসুরের সামনে উনি
থামলেও শুদ্ধ থামল না। সে অকপটে উত্তর দিলো,

-‘ কি দেখেছো? ওহ, জড়িয়ে ধরেছিলাম তোমার মেয়েকে এটা? বুকে জায়গা দিয়েছি তবে আমার মনে কোনো নোংরা চিন্তা ছিল না আর না হাতের স্পর্শে ছিল অবাধ্যতা। হয়তো ভাবছো তুমি দেখেছো বলে আমি সবাইকে জানালাম। তা কিন্তু নয়! বরং আজ ইদের দিন আমার গোপন
ভালোবাসা উন্মুক্ত করেছি ওর জন্য। কেন জানো? কারণ তোমার মেয়ে সালামি হিসেবে আমাকে চেয়েছে আমার টাকা নয়! তার চাওয়াটুকুকে পূরণ করতে আজই আমি বিয়ের কথা জানাতাম কারণ লুকোচুরি প্রেম করার মতো ধৈর্য্য আমার নেই৷ আর ধৈর্য্য নেই বলেই তোমার হাঁটাচলার শব্দ শুনেও আমি ওকে বুক থেকে সরাই নি। ভদ্র সেজে দাঁড়িয়ে যায় নি তোমাকে দেখে। যদি সেরকম ইচ্ছে থাকত তবে ধরতে পারতে না তুমি। যেমনটা এতদিন পারো নি…!’

একথা বলে শুদ্ধ থেমে সায়নের দিকে তাকাল। তবে তার এই তাকানোর মানে কেউই বুঝল না। আর বুঝল না বলেই এবার সিরাত মুখ খুললেন,
-‘মানলাম ধর্মে জায়েজ তবুও মানুষ কি বলবে?’
-‘বাইরের মানুষের ধাঁর কবে ধরলাম মনে পড়ছে না। আর তোমরা বলে দাও নি কেন চাচাতো ভাই-বোনের মধ্যে কিছু হওয়া যাবে না। এখানে মূলত ভুলটা আমাদের নয়, তোমাদের!’
একথা শুনে পুনরায় সিমিন রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন,
-‘এত যুক্তিতর্ক শুনতে চাই না। আমি মানি না তোমাদের সম্পর্ক,ব্যস!’
-‘সেটা তোমার ব্যাপার। জানানোর দরকার তাই জানালাম মানলে ভালো নয়তো আমাদের পথ আমরা বেছে নেবো।’
-‘পথ বেছে নেবে মানে?’
-‘মানে হলো এটাই যে, তুমি যা ভাবছো একদম তাই।’

এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুই পক্ষের কথা শুনছিলেন শারাফাত চৌধুরী। ছেলের কথার ভঙ্গিমা বলে দিচ্ছে সে এই ব্যাপারে ভীষণ সিরিয়াস। তবে যাকে নিয়ে এত কথা হচ্ছে তার মতামতও জানা দরকার। তাই উনি হাত উঠিয়ে সবাইকে থামতে বললেন। তারপর শুদ্ধর পেছনে লুকিয়ে থাকা শীতলকে ডাকলেন,
-‘মা এদিকে এসো।’
উনার ডাক শুনে শীতল ইঁদুরের মতো উঁকি দিয়ে বলল,
-‘ যেতে গেলে আম্মু খপ করে ধরে খুব মারবে তুমি বলো আমি শুনছি।’
-‘শুদ্ধকে কি কোনো কারণে তোমাকে ফোর্স করেছে? কোনো কিছু নিয়ে ভয় দেখিয়ে এসব বলাচ্ছে? নাকি দুজন প্ল্যান করে আমাদের সাথে প্রাঙ্ক করছো?’

শারাফাত চৌধুরীর কথা শুনে শুদ্ধর ভ্রুঁ কুঁচকে তাকাল। ফোর্স? এখানে ফোর্সের কথা কোথা থেকে এলো? ফোর্স করলেই মানবে এত সরল নয় নিশ্চয়ই চৌধুরীকন্যা? যেখানে সে নিজেই চুমু টুমু খেয়ে, শরীরে জীবানু ছড়িয়ে, একা একাই তার নামে গায়ে কলঙ্ক টলঙ্ক মেখে একাকার করে ফেলেছে, সেখানে সে নাকি ফোর্স করবে, হাস্যকর! তবে শুদ্ধ আর কথা বাড়াল না শীতলের মুঠোয় থেকে পাঞ্জাবি ছাড়িয়ে হাতটা টেনে সামনে দাঁড় করিয়ে দিলো। আর মুখে বলল,

-‘প্রাপ্তি আর মুক্তি তোর হাতে যা করবি ভেবে করিস।’
শীতল ভয়ে ভয়ে তাকাল রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা মায়ের দিকে এরপর শারাফাত চৌধুরীর দিকে। তবে কানে একই সুরে বাজতে থাকল কিছুক্ষণ আগের বলা শুদ্ধর কথা,
‘এবার সবার সামনে আমাকে গ্রহন করতে যদি পিছিয়েও যাস তাহলে আমায় চিরতরে হারাবি। ওয়াদা করে বলছি, সত্যিই হারাবি। কেঁদে মরে গেলেও আমাকে পাবি না। যেন না পাস এজন্য তোকে আমার বিয়েতে প্রধান সাক্ষী করে অন্য মেয়েকে নিয়ে বাসরে ঢুকব আমি।’ একথা স্মরণ করতেই মনে হলো কেউ যেন তার কলিজায় ভয়াল থাবা বসাল। রক্তাক্ত করে দিলো বক্ষপাশ। তার আক্ষিপট অশ্রু ছলকে গড়াতে লাগল। শুদ্ধর দিকে একবার তাকাতে গিয়ে সায়নের দিকে নজর পড়ল। চাহনিতে যেন বলছে, ‘ওহ ভাইয়া বাঁচাও!’ সায়ন বোনের চাহনি বুঝে দুই কদম এগিয়ে এলো। মাথায় হাত রেখে গুরুগম্ভীর সুরে জিজ্ঞাসা করল,

-‘ শুদ্ধর নামে কবুল পড়বি? কাজি ডাকব?’
শীতল মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ চুপ থেকে মৃদুভাবে মাথা নাড়াল কেবল।
অর্থাৎ রাজি। তা দেখে সায়ন বোনের মুখ উপরে তুলে সুস্পষ্টভাবে বলে বসল,
-‘ভালোবাসলে সর্ব সম্মুখে ভালোবাসা প্রকাশের সৎ সাহস থাকতে হয়। যদি না থাকে সে ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য নয়! এই আমি যেমন তোর বোনকে ভালোবাসি। পুরো পৃথিবীর সামনে গর্ব করে বুক ফুলিয়ে বলতে পারি ,আমি স্বর্ণকে ভালোবাসি। বিয়ে ওকেই করব। সে হবে চৌধুরীদের বড় পুত্রবধূ। আমার বিশ্বাস, হাত বাড়ালে আমার স্বর্ণও এগিয়ে আসবে।

প্রয়োজনে আমার বাড়ানো হাত ধরতে সে এই বাড়ি ছেড়ে দেবে। তাহলে তুই আমাদের বোন হয়ে ভালোবাসা প্রকাশে ভয় পাচ্ছিস কেন? একবার শুনিয়ে দে, তুই হলি শোয়াইব শুদ্ধর হবু বউ!’
সায়নের এ কথা শুনে সকলে যেন আরেকবার আকাশ থেকে পড়লেন।
শুদ্ধর সঙ্গে শীতলের কথা মানলেও সায়ন-স্বর্ণের কথা মানতে পারলেন না কেউই। থমথমে মুখে তাকিয়ে রইলেন সকলে। এটা সম্ভবই নয় কারণ
লোক সমাজে উনাদের চলতে-ফিরতে হয়। যখন বাইরের সবাই জানবে তখন কিছুর বলার আগে ভাববে বাড়িতে নিশ্চয়ই অঘটন ঘটেছে।নতুবা
এক ভাইয়ের ছেলেদের সঙ্গে আরেক ভাইয়ের দুই মেয়ের বিয়ে বা দেবে কেন? দিলে একজনের দিক, তাই বলে দু’জনের? এমন না যে চৌধুরীরা
খারাপ কিংবা ছেলে-মেয়েরা খারাপ যার জন্য বিয়ে আসে না। বিয়েতো অহরহ আসে, যদি আসে তাহলে বাড়িতে কেন আত্মীয়তা করতে হবে?

মোদ্দাকথা, ছেলে-মেয়েরা যদি এতই সাধু হয় তাহলে বাইরে আত্মীয়তা করতে সমস্যা কোথায়? নাকি মেয়ে দুটোর চরিত্রে দোষ আছে? যদিও
তারাই নিষ্পাপ হয় তাহলে কি ছেলে দুটোর মাঝে খাপলা আছে। নতুবা সচারাচর এমন তো দেখা যায় না। এসব প্রশ্নকে সাইডে রেখে এটা যদি বলা হয়, তারা নিজেরা পছন্দ করে বিয়ে করেছে। এটা কি গ্রহনযোগ্য?
তাও কিন্তু নয়। বরং হাসাহাসির কারণ পেয়ে বলবে আজকাল চৌধুরী নিবাসে পরিকল্পনা করে ভালোবাসবাসি চলে। এসব কথার কে জবাব দেবে? এদিকে স্বর্ণ চুপ করে তাকিয়ে আছে সায়নের মুখপানে। দেখছে একজন অধৈর্য্য প্রেমিক পুরুষকে। দেখছে তার প্রতি অগাধ বিশ্বাস বুকে নিয়ে আধা পাগলকে। যাকে এতদিন বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাখলেই আজ সে
অঘটনটা ঘটিয়েই ফেলেছে। আচ্ছা, সে কী আন্দাজ করতে পারছে তার কথায় এখন সব সম্পর্কের বাঁধন নড়বড়ে যেতে পারে। শুদ্ধ-শীতলের
পূর্নতার মাঝে অপূর্নতার শক্ত দেওয়াল হয়ে ওঠার কারণও হতে পারে।

এদিকে সায়নের কথা শেষ হতেই সিমিন দু পা পিছিয়ে গেলেন।অশ্রুসিদ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলেন মেয়েদের দিকে। তারা জানে আজ তারা তাদের মাকে গো হারান হারিয়ে দিয়েছে? এটাকে শুধু হারিয়ে দেওয়াই বলে না বলে একেবারে শিরদাঁড়া ভেঙে দেওয়া। গোপনে থাকা আতঙ্ক অবশেষে সত্যি হয়েই গেল? উনাকে পেছাতে দেখে স্বর্ণ এগোতেই উনি হাত উঠিয়ে বারণ করলেন। আর কিছু বলারও নেই, শোনারও নেই, মেয়েরাও এখন অনেক বড় হয়ে গেছে, নিজেদের পথ নিজেরাই বেছে নিতেও শিখেছে।

এবার তাহলে ছুটি নেওয়ার পালা। যদিও ছুটি বলে না এটাকে বলে চুপ করে পালিয়ে যাওয়া। উনি কিছুক্ষণ থম মেরে লালবর্ণ চোখে তাকালেন শাহাদত চৌধুরী দিকে। তারপর আঁচলে চোখ, মুছে ভাঙ্গা ভাঙ্গা কন্ঠে বললেন,
-‘এতদিন তোমার সঙ্গে যেতে রাজি হই নি। এই সংসার ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবতে পারি নি৷ আজ যেতে চাচ্ছি। সঙ্গে নেওয়া সম্ভব হলে নিও নয়তো একেবারে তিন তালাক দিয়ে আমাকে মুক্ত করে দিও। যদি তাও না পারো তবে আমার দাফনের জন্য তৈরি থেকো।’
সিমিনের কথা শুনে শাহাদত চৌধুরী কথার খৈই হারিয়ে ফেললেন। শুধু অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন সহধর্মিণীর দিকে। এ যেন অচেনা কেউ।

এতগুলো বছরে উনি জেনে এসেছে সিমিনের কাছে উনি পুরো পৃথিবী।
আর মেয়েরা হলো পৃথিবীকে ঘিরে রাখা অনাবিল সুখ। আজকে পৃথিবী আর সুখ দুটোকেই সিমিন অনায়াসে বিসর্জন দিয়ে দিচ্ছে? দাফন করা, তালাক দেওয়ার কথা বলতে একবারও বুক কাঁপল না? মনে পড়লো না সামনে দাঁড়ানো মানুষটা সহ্য করতে পারবে কী না? এদিকে শুদ্ধ, সায়ন, আর দরজায় দাড়ানো রুবাব যেন বাকহারা। তারা কল্পনাও করতে পারে নি তাদের নরম সরম ছোটো আম্মু একথা বলতে পারে। কিন্তু এই ঘটনা অন্যদিকে মোড় নিচ্ছে দেখে এবার সায়ন এগিয়ে এলো। শিনা উঁচু করে সরাসরি সিমিনকে বলল,
-‘ এতটাই অযোগ্য আমরা?’
সিমিন জবাব দিলো না মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। সায়নও তখনো গো ধরে দাঁড়িয়ে পুনরায় জিজ্ঞাসা করল,

-‘যতক্ষণ না আমাদের অপরাধ চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে পারবে ততক্ষণ বাড়ি ছাড়ার কথা মুখে এনো না। কেন মানবে না, কী অপরাধ ণ
আমাদের স্পষ্ট করে জানাও।’
সিমিন চলে যেতে নিলে এবার স্বয়ং সিঁতারা চৌধুরী সিমিনের মুখোমুখি দাঁড়ালেন। ছোটো জায়ের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বললেন,
-‘তোর স্বামীর সঙ্গে তুই যেতেই পারিস কিন্তু আমার ছেলেদের অপরাধ জানিয়ে যা। কেন অদৃশ্য আঙুল তুলছিস আমার ছেলেদের দিকে? ঠিক কোন কারণে মানতে পারবি না? আমার তো মানতে সমস্যা নেই। তাহলে তোর কিসের সমস্যা?’
-‘আমার সমস্যা একটাই আমি খারাপ মা। আমার শিক্ষা খারাপ। যদি শিক্ষা ভালো হতো তাহলে একসাথে দু’জনই বিপথে যেতো না। আমাকে সকলের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করতে কাঁটার পথ খুলে দিতো না।’
-‘আমার ছেলেরা তোর পথের কাঁটা? বিপথ? কি বোঝাতে চাচ্ছিস তুই?
এতদিন তো তোরা আমার সন্তান বলে কিছু ছিল না, তবে আজ কেন? নাকি এতদিন ছল করেছিস?’
-‘যা ভাববে তাই। আজ থেকে ধরা নাও আমি মরে গেছি। তবে তোমাকে
স্বার্থপর দুটোর দায়িত্ব দিয়ে গেলাম যা ইচ্ছে করার কোরো। যে মেয়েরা মায়ের কথা ভাবে না আমিও আর তাদের কথা ভাবব না।’

একথা বলে সিমিন জাকে সরিয়ে চলে যেতে নিলে শীতল মায়ের আঁচল টেনে ধরল। মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-‘যেও না আম্মু। আমরা তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না।’
-‘তাহলে দু’দিনের ভালোবাসা পায়ে পিষে চলে আমার সঙ্গে।’
একথা শুনে শীতল থমকে গেল। ঠোঁট ভেঙে কেঁদে ফোঁপাতে ফোপাঁতে বলল,
-‘মেনে নাও না আম্মু আমরা চারজনে অনে..ক….।’
শীতল কথা শেষ করতে পারল না তার আগে সিমিন স্বজোরে দুই থাপ্পড় মেরে বসলেন শীতলের গালে। এবার শুদ্ধ যেন রাগের মাত্রা হারাল। সে চোখ বন্ধ করে তেড়ে যেতে নিলে আঁটকে ফেলল রুবাব। তবুও থামল না সে কঠিনসুরে বলল,
-‘যখন তখন গায়ে হাত তুলে কি বোঝাও মেয়ে তোমার একারই আছে?আর কারো মেয়ে নেই? আর কেউ মেয়েকে শাষণ করে না? অহেতুক
কথা আসছেই বা কেন? আমাদের মানতে সমস্যা থাকলে বলতে বাঁধা কিসের?’

-‘ওহ এখন কি আমি আমার মেয়েকেও শাষণ করতে পারব না? শাষণ করতে গেলে তোদের পারমিশন নিতে হবে?’
-‘শাষনেরও লিমিট থাকে। কথা হচ্ছে সবার সাথে ওর গায়ে হাত তুললে কেন? মেইন কালপ্রিট হচ্ছি আমি আমাকে মারতে? ওকে কেন মারলে?
কেন বার বার, কারণে-অকারণে ওর গায়ে হাত তোলে তুমি? কি সমস্যা তোমার! আর কতবার বারণ করব তোমাকে যে ওর গায়ে হাত তুলবে না। আমি সহ্য করতে পারি না!’
-‘আমি লিমিট বুঝি না বোঝার যোগ্যতাও আমার নেই। আমি সরে যাচ্ছি এবার থেকে যার যা ভালো লাগে করুক।’
শুদ্ধ রুবাবের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে সিমিনের মুখোমুখি দাঁড়াল। বুক উঁচিয়ে শীতল চাহিনীতে তাকিয়ে থমথম সুরে বলল,

-‘তুমি মেইন টপিকে না এসে বার বার পিছলে যাচ্ছো যা বলার সরাসরি বলো। আমি শুনতে চাই তোমার সমস্যার কথা। বলো, কোন দিক থেকে আমরা অযোগ্য? কি নেই আমাদের? আমরা বাউন্ডুলে? নেশাখোর?
মেয়েবাজ? নাকি বেকার, কোনটা? নাকি আগে থেকে কাউকে জামাতা হিসেবে খুঁজে রেখেছো? বলো কোনটা? আচ্ছা, তারা আমাদের থেকেও হাই লেভেলের? নিশ্চয়তা নিয়েছো তোমার মেয়ে তাদের কাছেই ভালো থাকবে?’
শুদ্ধর কথা যেন সিমিনের গায়ে জ্বালা বাড়িয়ে দিলো। উনি দাঁতে দাঁত চেপে অগ্নিদৃষ্টি ছুঁড়ে বললেন,
-‘ সেই কৌফিয়ত আমি কাউকে দেবো না।’
-‘কেন দেবে না? না দিলে কিসের এত বিরোধিতা? ওকে মানলাম যাও দিও না কৌফিয়ত, তাহলে মেয়ে দাও। দু’দিকেই যদি মুঠো এঁটে রাখো তাহলে তো হবে না। হয় বলো কেন মানবে না আর নয়তো মেনে নাও।
উপযুক্ত কারণ ছাড়া আমাদের দিকে আঙুল তুললে আমরাই বা কেন মানবো?’
-‘আমার সমস্যা তোমরা চৌধুরী বাড়ির ছেলে। আমার সমস্যা তোমরা সিঁতারা চৌধুরীর ছেলে আর প্রধান সমস্যার কথা যদি বলি তাহলে বলব যে বাড়ির বউ আমি সে বাড়ির বউ হবে না আমার মেয়েরা। যদি হয় তো আমি থাকব না সে বাড়িতে।’

-‘কেন থাকবে না? তুমি করবে তোমার স্বামীর সংসার, তোমার মেয়েরা করবে ওদের স্বামীর সংসার তাহলে সমস্যাটা কোথায়? কেন অযৌক্তিক কারণে এত কথা, এত তর্ক?’
সিমিন আর একথা কথাও বলল না পাশ কাটিয়ে রুমে চলে গেল। উনার
যাওয়া দেখে শাহাদত চৌধুরীও গেলেন সহধর্মিণীকে বোঝাতে। আজকে সিমিন যেন বোঝার অবস্থায় নেই উনি আধাঘন্টার মধ্যে লাগেজ টানতে টানতে বেরিয়ে এলেন। শাহাদত চৌধুরী কথাও মানতে নারাজ। সিঁতারা, সিরাতও পারলেন না উনাকে বোঝাতে ফলে ব্যর্থ হয়ে কাঁদতে লাগলেন।

শারাফাত চৌধুরী শুধু নীরবে তাকিয়ে দেখতে থাকলেন সোনার সংসার ভেঙে যাওয়ার দৃশ্য! সিমিন কিসব ভেবে যেন পুনরায় ফিরে এসে উনার সামনে দাঁড়ালেন। হাতজোড় করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-‘আমাকে ক্ষমা করে দেবেনভাইয়া। কারো কোনো দোষ নেই কারো প্রতি আমার কোনো অভিযোগও নেই। ফলের ঝুঁড়িতে যখন একটা আম পঁচে যায় তখন বাকি আম ভালো রাখতে পঁচা আমটাকে সরিয়ে ফেলতে হয়। আমি সেই পঁচা আম তাই নিজে থেকে সরে যাচ্ছি। সবাইকে নিয়ে ভালো থাকবেন, আসছি।’

একথা বলে উনি দাঁড়ালেন না গটগট করে বেরিয়ে গেলেন। শীতল এক ছুটে মায়ের কাছে পা আঁকড়ে ধরে বসে পড়ল। সিমিন আজকে পাথর বনে গিয়ে শীতলের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। শাহাদত চৌধুরীও বেরিয়ে এলেন বেশ দেখে মনে হচ্ছে উনিও চলে যাচ্ছেন। ভাইয়ের দিকে তাকানো সাহস হলো না দেখে চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেলেন। বাবা মাকে যেতে দেখে স্বর্ণ এবার শীতলকে উঠিয়ে দরজার দিকে এগোতেই
সায়ন পথ আঁটকে দাঁড়াল। স্বর্ণের চোখে চোখ রেখে বলল,
-‘এক পাও কোথাও যাবি না।’
স্বর্ণ সায়নের থেকেও দ্বিগুন তেজ নিয়ে বলল,

-‘ যাব।’
-‘বারণ করেছি আমি!’
-‘শুনতে বাধ্য নই আমি। আমাদের বাবা-মা যেখানে আমরাও সেখানেই। ভালোবাসি মানে এই যে বাবা-মায়ের সঙ্গ ত্যাগ করব? যদি তাই করতে হয়ে তাহলে দরকার নেই এই ভালোবাসার।’
কথাখানা যেন সায়নের পুরো মস্তিষ্ক এলোমেলো করে দিলো। তার স্বর্ণ তাকে ছেড়ে চলে যাবে? একথা মুখ ফুটে বলছেও? এত বড় স্পৃধা ওর?
সায়ন রাগে দিকশূন্য হয়ে স্বর্ণের গলা চেপে ধরে দেওয়ালের সাথে চেপে ধরল। তারপর চিৎকার করে বলল,
-‘এ্যাই বেইমানের বাচ্চা কি বললি আবার বল, বল, বল? আমায় রেখে
কোথায় যাবি? কোথায় যাবি তুই!’
প্রচন্ড ব্যথায় স্বর্নের গালের হাঁড় যেন ভেঙে এলো। রুবাব, সাফওয়ান চৌধুরী দ্রুত গিয়ে কোনোমতে তাকে সরালেন। ছাড়া পেতেই স্বর্ণ আর কোনোদিকে না তাকিয়ে বোনের হাত ধরে বেরিয়ে যেতেই শীতল খপ করে শুদ্ধর পাঞ্জাবি আঁকড়ে ধরল। হাউমাউ করে কাঁদকে থাকল করুন সুরে। শুদ্ধ লালবর্ণ চোখে শুধু তাকিয়ে দেখল শীতলের কান্নারত মুখ। স্বর্ণ বোনের হাত ছেড়ে টানতেই সায়ন আবার তেড়ে যেতেই গেল স্বর্ণর দিকে। এবার শুদ্ধ সায়নকে আঁটকে ধরে বলল,

-‘যেতে দাও।’
একথা শুনতেই সায়ন অবাক চোখে তাকাল শুদ্ধর দিকে আর শুদ্ধ ঘাড় ঘুরিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়েই রইল স্বর্ণের শীতলকে টেনে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্যের দিকে। বোনরা চলে যাচ্ছে দেখে সাম্য, সৃজনও কাঁদতে কাঁদতে ছুটল ওদের পিছু পিছু। সিরাত, সাফওয়ান, রুবাব, শখও দৌড়ে গেল তাদের ফেরাতে। শাহাদত চৌধুরী কেবলই গাড়ি স্টার্ট করেছেন। হুইল ঘুরাতেই দেখে স্বর্ণ আর শীতলও কাঁদতে বেরিয়ে আসছে বাড়ি থেকে।
হাত থেমে গেল উনার সেই সঙ্গে উনার বুকটা যেন ভেঙে খান খান হয়ে গেল। হুইলে মাথা ঠেঁকিয়ে দু’চোখ বন্ধ করতেই চোখের তারায় ভাসতে থাকল বড় ভাইয়ের মুখ। যার ছায়ায় এতদিন চৌধুরী নিবাসের প্রতিটা সদস্য ছিল সুরক্ষিত। বাবা-মা মারা যাওয়ার পরে যেই ভাইয়ের স্নেহে বাঁচার শক্তি খুঁজে পেয়েছিলেন, আজ সেই ভাইয়ের বুকে যন্ত্রণার ছুরি বসিয়ে চলে যাচ্ছেন স্বার্থপরের মতো। এদিকে সহধর্মিণীকেও ছাড়তে পারবেন না কারণ পৃথিবীর বুকে উনি ছাড়া আর কেউ নেই সিমিনের।
যারা আছে তারা সুসময়ের মাছি। এদিন বাড়িতে এমন ঘটনা ঘটে নি যার কারণে সাম্য, সৃজন ভয়ে কুঁকড়ে গেছে। তবে যখন বুঝল তাদের বোনরা ছেড়ে যাচ্ছে তখন যেন তাদের হঁশ ফিরল। হাউমাউ করে কেঁদে সিমিনের আঁচল ধরে বলতে লাগল,

-‘ওহ ছোটো মা, যেও না, তুমি গেলে আমাদের কে টিফিন বানিয়ে দেবে? আম্মুর মারের হাত থেকে কে বাঁচাবে? আমরা কার হাতের রান্না খাব?’
একথা শুনে সিমিন গাড়ি থেকে নেমে বাচ্চা দুটোকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। তাদের ছোটো ছোটো মুখ চুমুতে ভরে ধরে সিরাতের বললেন,
-‘মেরো না একটু বুঝিয়ে বোলো।’
সিরাত একটা কথাও বলল না একরাশ অভিমান নিয়ে তাকিয়ে রইলেন ছোটো জায়ের দিকে। তবে না বলেও থাকতে পারলেন না তাই বললেই ফেললেন,

-‘ বড় ছেলে দুটোকে একেবারে ভেঙে চুরে ছোটো ছেলে দুটোকে আর ভালোবাসা না দেখালেও চলবে ছোটো৷ আজ প্রমাণ করে দিলি রক্তের সম্পর্ক ছাড়া কোনো সম্পর্ক আপন হয় না। এই যে আমরা তোর আপন হতে পারি নি৷’
একথা শুনে সিমিন শুধু হাসল। তারপর রুবাবের মাথায় হাত বুলিয়ে
মলিন হেসে গাড়িতে উঠতে গেলে রুবাব উনার হাতটা আঁকড়ে ধরল। তারপর হাতের উল্টো পিঠ কপালে ঠেকিয়ে কান্না ভেজা বলল,

-‘ একটু ভালোবাসা পাই বলেই মাকে ছেড়ে তোমাদের এখানে পড়ে থাকি। দেশে আর আছিই বা ক’দিন? আমরা তো তোমারই ছেলে তাই না? আমাদের ভুলগুলো নাহয় এবারের মতো মাফ করে দিয়ে কোলে টেনে নাও।’
-‘খুব ভালো থাকিস আব্বা। আমার দোয়া সব সময় সঙ্গে থাকবে।’

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৪২

একথা বলে সবার দিকে একবার তাকিয়ে গাড়িতে উঠে বসলেন। স্বর্ণ, শীতলও ততক্ষণে উঠে বসেছে। শীতল এখনো দুহাতে মুখখানা ঢেকে হাউমাউ করে কাঁদছে। তার বুক ফেঁটে যেন চৌচির হয়ে যাচ্ছে। শুদ্ধকে ছাড়া থাকবে কিভাবে সে? তার বিশুদ্ধ পুরুষটাকে না দেখে বাঁচবেই বা কিভাবে? আজকাল তাকে ছাড়া দমটা যেন আঁটকে আসে।
এদিকে সব বাঁধন ছেড়ে যেতে যখন হবে শাহাদত চৌধুরী দেরি করলেন না। নিজেই ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট করলেন। ধীরে ধীরে গাড়িটাও চলতে চলতে মূল ফটক পেরিয়ে বেরিয়ে গেল। সেই সঙ্গে খান খান হয়ে গেল তিলে তিলে গড়া চৌধুরী নিবাসের সুখে মোড়া সুখসম্রাজ্য।

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৪৪