শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৫০

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৫০
নূরজাহান আক্তার আলো

বেশ বড় সড় আবছা অন্ধকার রুমের বেডে শুয়ে আছে শীতল। পিটপিট করে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে নিজের অবস্থান। কিন্তু রুমটা অচেনা
লাগছে তার কাছে। এটা কোথায়? কার বাড়ি? কার রুম?আর স্বর্ণ আপু কোথায়? সে এখানে শুয়ে আছে কেন? মাথায় আঘাত পেয়ে স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিল নাকি? তা নাহলে ঘুম থেকে উঠে কিছু চিনতে পারছে না কেন? আর্মি হাউজের রুম হলে চিনত, চৌধুরীর নিবাসের রুমগুলো তার চেনা, হসপিটালের রুম এমন হয় না, তবে? এসব ভেবে সে ভালো করে দেখল পুরো রুমটা। আবছা আলোয় দেখা যাচ্ছে দেওয়াল ঘড়ির কাঁটা, এখন বাজে আড়াইটা। কিন্তু দুপুর নাকি রাত? রাত দিনের তফাৎ বুঝতে সে জানালায় তাকিয়ে দেখল রাত। বাইরে সব ঘুটঘুটে অন্ধকার।
এত অন্ধকার কেন? সে কি জঙ্গলের আশেপাশে নাকি? বাবা, মা কই?

তারা আসছে না কেন? আর শুদ্ধ ভাই যদি জানে কার না কার বিছানায় শুয়ে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিল সে,তাহলে মেরে কঙ্কাল করে রোদের শুকাতে দেবে। কিন্তু তার আগে তাকে জানতে হবে এটা কোথায়, কার বাড়ি?
এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে তাড়াতাড়ি চোখজোড়া বন্ধ করে নিলো। তারপর অবচেতনের মতো কাঠ হয়ে পড়ে রইল। আগে বুঝতে হবে নিজের অবস্থান বোকামি করা যাবে না। আগেরবার যখন কিডন্যাপ হয়েছিল তখন বোকামি করায় মার খেয়েছিল। এখন সেসব করা যাবে না। আচ্ছা এবারও কি কিডন্যাপ হলো নাকি? কার এত সময় যে অযথা ঘুরে ফিরে তাকেই কিডন্যাপ করতে আসে? তার জীবনে কি কাজকাম নাই? সে কি চোখে ঠুলি পরে থাকে আর কাউকে চোখে দেখে না? জীবনটা আজকাল সিনেমার মতো হয়ে যাচ্ছে। হিরোইন, ইরোইন ফিল পাচ্ছে, এসব ভাবতে ভাবতে কান খাড়া করে মাত্রই রুমে প্রবেশ
করা মানুষটার উপস্থিতি বোঝার চেষ্টা করল। কিন্তু কারো পদধ্বনি বা উপস্থিতি টের না পেয়ে চোখ এদিক-ওদিক তাকাতেই আচমকা একটা ভারী পুরুষালি কন্ঠস্বর কানে বিঁধল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-‘বাবুই, ঘুম ভেঙেছে তোমার?’
অন্ধকার বেলকনি থেকে আদুরে কন্ঠে ভেসে আসা কন্ঠস্বর শুনে চমকে উঠল শীতল। কে ওখানে? কে কথা বলল? কন্ঠস্বর চেনা লাগছে কেন?
অচেনা একটা ভয়ে থরথর করে কাঁপার কথা থাকলেও শীতল ভয় দূর চিন্তিতও হলো না। বরং ধীরে সুস্থে উঠে বসল। কন্ঠস্বরের মালিক উঠে এসে রুমের লাইট অন করতেই ঝকঝকে আলোয় ভরে গেল পুরো রুম। এতক্ষণ অন্ধকারে থাকায় হঠাৎ চোখে আলোর পড়ায় সে চোখ কুঁচকে পিটপিট করে তাকাল। দেখল রেস্টুরেন্টে পরিচয় হওয়া নীল চোখের মালিক দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। কিন্তু এই লোক এখানে কেন? সে ভ্রুঁ কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল,
-‘আমি এখানে কেন? আপনি কি আমাকে কিডন্যাপ করেছেন?’
শীতলের কথা শুনে ইয়াসির যেন আকাশ থেকে পড়ল। সে অবাক চোখে চেয়ে বিষ্ময়ভরা কন্ঠে বলল,

-‘তাওবা, তাওবা, কি বলো এসব? তোমার মতো বাচ্চা একটা মেয়েকে কিডন্যাপ করব? আর..আর আমাকে দেখে কিডন্যাপার মনে হয়?’
-‘করেন নি তো আমি এখানে কেন? আমার আপু কোথায়?’
-‘আয় হায় তোমার দেখি কিছুই মনে নেই!’
ইয়াসির কথা শুনে শীতল এবার আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল,
-‘কি মনে নেই? কিসের কথা বলছেন?’
-‘তোমার আপু যাওয়ার পর জুবায়েরও কথা বলতে চলে গেল। তখন তো সেখানে একদল ডাকাত এসেছিল। কি একটা স্প্রে করায় হুটহাট করে সবাই অজ্ঞান হয়ে গেল। অবেচেতন মানুষের ফোন কেড়ে নিলো। আমার ফোনও তো নিয়ে গেছে শালারা। আমার জ্ঞান ফেরার পর দেখি তুমি আমার পাশে পড়ে আছো। তবে তোমার বোন বা মেজরকে পাই নি তাই তোমাকে আমার বাসায় এনেছি। কারণ আমি তো তোমার বাসার ঠিকানা জানি না।’

একথা বলে ইয়াসির গোঁ বেচারা মুখ করে তাকিয়ে রইল শীতলের মুখের দিকে। এদিকে শীতল ভাবছে, একটা মানুষ আর যাই হোক গটগট করে মিথ্যা বলবে না নিশ্চয়ই? কারণ মিথ্যা বললে তো মানুষ গলা কাঁপে বা তোঁতলায়। কিন্তু এই লোক তো নিষ্পাপ চাহনি নিয়ে কথাগুলো বলছে।
তাকে ভাবতে দেখে ইয়াসির মনে মনে হাসল। নিজেকেই নিজে বাহবা দিলো। এভাবেই আপাতত অবুজ পাখিটাকে বুঝ দিয়ে রাখবে হবে। যেন
কান্নাকাটি না করে তার সঙ্গে সময় কাটায়৷ শীতল কিছু বলছে না দেখে ইয়াসির মাথা চুলকে কিছু একটা মনে করার ভাণ করে বলল,

-‘ওহ হো তোমার নামটাই তো ভুলে গিয়েছি। বাবুই বোধহয়.., রাইট?’
-‘না, শীতল।’
-‘ কিন্তু বাবুই নামটা তোমার সঙ্গে খুব যায়, জানো? আচ্ছা শীতল আমি যদি তোমাকে বাবুই ডাকি তুমি কি মাইন্ড করবা?’
-‘করব।’
-‘কেন?’
-‘কারণ এসব নামে ডাকলে শুদ্ধ ভাই চ্যালাকাঠ দিয়ে ধুনাবে।’
-‘ধুনাবে মানে? বুঝলাম না ঠিক তোমার কথাটা?’
-‘ধুনাবে মানে, মারাকে বুঝাচ্ছি আর কি।’
-‘ওহ, কিন্তু কাকে মারবে?’
-‘আমাদের দু’জনকেই। মার তো খান নি জানেন না চ্যালাকাঠের মার কত মজা।’
-‘শুদ্ধ তোমাকে মারে? কেন মারে?’
-‘ আপনার বাড়িতে খাবার টাবার নেই? গেস্ট এনেছেন অথচ খেতে দিচ্ছেন না, এটা তো ঠিক না।’
-‘ওহ তাই তো! সরি সরি বাবুই গল্পে গল্পে ভুলে গেছি, এখন বলো তো
কি খাবে?’

-‘উম, আমার এখন নুডলস খেতে ইচ্ছে করছে।’
-‘ওকে চলো দু’জন মিলে রান্না করি।’
একথা বলে ইয়াসির শীতলকে নিয়ে রান্নাঘরে গেল। ভুলেও রান্নাঘরে না আসা ছেলেটা রান্নাঘরে এসেছে ঠিকই কিন্তু রান্নার র ও জানে না। সে এমন ভাব করছে যেন রান্নায় বেশ পটু। শীতল ইয়াসিরের পাশে দাঁড়িয়ে আশেপাশে দেখছে। বাড়িটা নীরব। বাড়িতে আর কেউ নেই নাকি? সে এবার একটু সচেতন হলো তবে ঘাবড়ে না গিয়ে বলল,
-‘সমশের ভাইয়া আপনার বাড়িটা কোথায়? না মানে বাবাকে ফোন করলে এসে নিয়ে যেতো।’
ইয়াসিরের হাত থেমে গেল। তার নাম সমশের কবে হলো? বলে কি এই মেয়ে? নাকি ওর নামটা ভুলে যাওয়ার ভাণ করেছে বলে শোধ নিচ্ছে?
তাই হবে! একথা ভেবে সে কোনোমতে হাসি আঁটকে বলল,

-‘আমার নাম ইয়াসির খান! মানুষ জবাই করে আমার নামের আকিকা করেছি আমি।’
-‘কিহ? কি বললেন? কি জবাই করে?’
-‘ বড় বড় দুটো গরু জবাই করে।’
-‘প্রথমে কি বললেন?’
-‘এই কথায় তো বললাম কেন তুমি কি শুনেছো?’
-‘শুনেছি মানুষ জবাই করে আকিকা করেছেন? কিন্তু মানুষ জবাই করে মানুষের আকিকা হয় নাকি? হয় না তো! বাদ দেন আমিই বোধহয় ভুল শুনেছি।’
একথা শুনে ইয়াসির ফিচেল হাসল তারপর বিরবির করে উত্তর দিলো,
-‘মানুষের আকিকা মানুষ দিয়ে না হলেও জানোয়ারের আকিকা মানুষ দিয়ে হয় বাবুইপাখি। তবে বলতেই হয়, তোমাকে যতটা বোকা ভেবেছি তুমি ততটা বোকা নও। খাবারের নাম করে রুমের বাইরে এসে দেখলে বুঝি বাড়িতে আর কেউ আছে কী না? কারো সাহায্য নিতে পারবে কী না? পালানোর জন্য কোনো পথ খোলা আছে কী না? বাবুইপাখি, যত চালাকি করো না বের হতে পারবে না সোনা। তুমি কল্পনা করতে পারবে না আমরা এখন কোথায় আছি।’

এদিকে শীতল নিজের মতো বকবক করেই যাচ্ছে। ইয়াসির ইউটিউব দেখে নুডলস রান্নার ট্রাই করছে কিন্তু তার কাজের আনাড়ি ভাব দেখে শীতল যা বোঝার বুঝে গেল। এতেও সে আগ বাড়িয়ে কিছু বললই না।
বরং আবার জিজ্ঞাসা করল,
-‘বললেন না, আপনার বাড়ির লোকেশনটা কোথায়? আর একটা ফোন দিন না বাবাকে কল করি? নাহলে বাবা চিন্তা করবে তো নাকি?’

-‘ আচ্ছা বাবুই নুডলসে কি ঝাল কম দেবো নাকি বেশি দেবো?’
-‘বেশি।’
-‘কতটা বেশি?’
-‘যতটা দিলে কেঁদে ফেলব।’
-‘কেন, কাঁদতে ইচ্ছে করছে বুঝি?
-‘না। তবে আমি ঝাল বেশি খাই।’
-‘ওহ আচ্ছা।’
-‘বাড়িতে আর কেউ থাকে না? ভূতের বাড়ির মতো এত সুনশান কেন?’
-‘পৃথিবীতেই আমার কেউ নেই সেখানে বাড়িভর্তি মানুষ কোথায় পাব?’
-‘বিয়ে? বিয়ে টিয়ে করেন নি..আপনার বউ নেই?’
-‘হা হা হা, না নেই, তবে হবে শীঘ্রই হবে।’
-‘আমাকে দাওয়াত দিবেন কিন্তু আমি উপহার নিয়ে বিয়ে খেতে আসব।’
-‘হুম হুম তা তো অবশ্যই। কিন্তু কি উপহার দেবে?’

-‘একদিনের ইঁদুরের বাচ্চা। সাইন্টিস্টদের কাছে ইঁদুর অনেক ইমপোর্টেন্স জিনিস। কেন, ইঁদুর দিলে খুশি হবেন না?’
-‘না। ওসব ইঁদুর টিঁদুর আমার লাগবে না তুমি বরং ওসব তোমার শুদ্ধ ভাইকে দিও। তুমি শুধু, আমার বিয়ের ক্ষণে হাসিমুখে থেকো ওটাই হবে আমার জন্য বিশাল পাওয়া।’
-‘আচ্ছা। ভীষণ ক্ষুধা লেগেছে আর কতক্ষণ, হয় নি রান্না? খেয়ে তো বাড়ি যেতে হবে। ইয়ে মানে ওয়াশরুমে যাব, আচ্ছা ওয়াশরুমটা যেন কোন দিকে?’
-‘যেই রুমে ছিলে ওই রুমেই ওয়াশরুম আছে, যেতে পারবে?’
-‘হুম।’

একথা বলে শীতল রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ওই রুমে গিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকল। ইয়াসির হাতের ওয়াচের দিকে তাকিয়ে দেখল রুমে খোঁজাখুজি না করে শীতল সত্যিই ওয়াশরুমে ঢুকেছে। সেটা দেখে ইয়াসির নুডলস টেস্ট করে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘নট ব্যাড..উম চলে। বাবুই পাখি হয়ে গেছে তোমার নুডলস, খাবে এসো।’ এইটুকু বলে সে দুষ্টু হেসে নিচুস্বরে বলল, ‘প্রথমে তুমি আমার হাতের নুডলস খাবে এরপর আমি তোমায় খাব..ওকখে? ইয়াহ্ ওকখে!’
একথা বলে একটা বাটিতে নুডলস ঢেলে শিষ বাজাতে বাজাতে রুমের দিকে পা বাড়াল। এদিকে ওয়াশরুমের দরজায় পিঠ ঠেঁকিয়ে শীতল থরথর করে কাঁপছে। কারণ সে বুঝে ফেলেছে সে আবার বাজে কারো চক্করে পড়েছে। কারণ ইয়াসির যখন সূচ ফুটিয়েছিল সে স্বজ্ঞানে ছিল। সে অনুভব করে কাজটা সেই করেছিল, পরের ঘটনা মনে না থাকলেও এইটুকু তার স্পষ্ট মনে আছে। কিন্তু কথা হচ্ছে, সে এখান থেকে বের হবে কীভাবে? এটার লোকেশন তো জানে না আর কিভাবে কি করবে? শুদ্ধ! শুদ্ধ ভাই আসছে না কেন? তার কানে কি নিঁখোজের খবর গিয়ে পৌঁছায় নি? শুদ্ধর কথা মনে হতেই সে হাতের অনামিকা আঙুলে থাকা
রিং এর উপর চুমু খেলো। চট্টগ্রামের আসার রাতে শুদ্ধ খুব গোপনে তাকে রিংটা পড়িয়ে দিয়েছিল। স্বর্ণ তার হাতের রিংটা দেখে বলেছিল,

-‘পৃথিবীর যেই প্রান্তেই যাস রিং টা ভুলেও খুলবি না। যদি খুলিস, তোর
বিপদে তোর শুদ্ধ তোর কাছে কখনোই পৌঁছাতে পারবে না। যদি শুদ্ধ ভাইয়ের সঙ্গ চাস তাহলে যত যাই কিছু ঘটে যাক রিং যেন আঙুল থেকে না সরে। মনে থাকবে, আমার কথা?’
জবাবে সে মাথা নাড়িয়েছিল। এমনিতেও সে খুলত না কারণ এটা তার বিশুদ্ধ পুরুষের দেওয়া বিশেষ উপহার। সে এবার ঠোঁট কাঁপিয়ে রিং এর উপর চুমু খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে লাগল। তারপর মনে মনে বলল,
-‘আসুন না শুদ্ধ ভাই? একটু তাড়াতাড়ি আসুন, ভয় লাগছে তো।’
হঠাৎ রুম থেকে ইয়াসিরের কথা ভেসে আসায় সে জলদি হাত মুখ দেখে বের হলো। শুদ্ধ না পৌঁছানো অবধি তার অভিনয় চালিয়ে যেতে হবে।

শীতল কিপন্যাপ হওয়ায় চৌধুরী বাড়িতে পড়েছে শোকের ছায়া। এবার সিঁতারা নিজের রাগ সামলাতে পারলেন না। কল দিয়ে যাচ্ছে তাই বলে
অপমান করলেন সিমিনকে। কারণ সাম্য সৃজনের এক্সিডেন্টের পরপর শুদ্ধ, সায়ন, রুবাব বাড়ির সবাইকে বারবার বুঝিয়েছিল তাদের পেছনে গোপন শত্রু লেগেছে, সাবধান হতে। যে যেখানেই যাক চোখ কান খোলা রাখতে। তবুও সিমিন বারণ শোনে নি রাগ দেখিয়ে মেয়ে দুটোকে নিয়ে চলে গেল। সে না গেলে আজকের এ দিনটি দেখতে হতে না। এখন যদি মন্দ কিছু ঘটে তাহলে নিজের মেয়ে বলে সিমিনই কী কষ্ট পাবেন নাকি বুকে,কোলে করে মানুষ করায় মেয়েটার জন্য উনাদেরও সমান কষ্টে বুক ঝাঁঝরা হবে?

জন্ম দিয়েছে বলে কী মেয়ে দুটোর জন্য উনার মনেই মায়া আছে, আর কারো নেই? এখন যদি কোনো অঘটন ঘটেও সিমিন পারবে নিজেকে ক্ষমা করতে? যে ছেলেদের সাথে মেয়েদের বিয়ে দিবে না বলে এত কান্ড করল, শীতলকে খুঁজতে সবার আগে এরাই প্রাণপনে দৌড়ে বেরিয়েছে। আজকে বাড়িতে মাছের ডিম রান্না হয়েছে। শীতলের পছন্দ মাছের ডিম। রান্না করতে দেখলে একটা বাটি হাতে পাশে দাঁড়িয়ে থাকত। তোতাপাখির মতো করে বলতো, ‘হলো, বড় মা? দাও না একটু লবণ দেখি? বেশি ভালো করে রান্না করতে হবে না সবাই খেলে নিলে, আমার ভাগে কম পড়বে।’ সেসব মনে করে মাছের ডিম দেখে চোখের পানি ভর ধরছিল না বলে রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উনি কাঁদছিলেন।

সেটাই আচমকা চোখে পড়ল শুদ্ধর। বুঝল মায়ের মনের কথা। তাই সে মায়ের কান্না থামাতে ছোটো করে বলল, ‘ক্ষুধা লেগেছে খেতে দাও তো আম্মু।’ ছেলের ক্ষুধা লেগেছে তড়িঘড়ি করে খাবার বেড়ে দিলেন। ছেলে
মলিন মুখে তার পাশের চেয়ারে একবকর তাকিয়ে খেতে বসেই শুনল দুঃসংবাদটা। মুখের কাছে ভাত নিয়েও খবর শুনে ভাতের প্লেট সরিয়ে স উঠে চলে গেছে। অথচ সারাদিন পর, বাড়ি এসে মাত্রই খেতে বসেছিল ছেলেটা। খবর শুনে ছেলে পেটের ক্ষুধাকে গুরুত্ব দিলো না মনের ক্ষুধা মিটানোর মানুষটার জন্য উতলা হয়ে উঠল। আর মা হয়ে উনার কানে ভাসতে থাকল ‘ ক্ষুধা লেগেছে..খেতে দাও তো আম্মু।’ মায়ের অবুজ মনে তখন থেকে পিনের মতো শীতলের জন্য যেমন কাঁদছে। তেমনি ছেলের জন্য কলিজায় ফুটছে ‘আহারে আমার ছেলেটার পেটে ক্ষুধা!’ আমার ছেলেটা খায় নি।’

মোদ্দাকথা, শুদ্ধ, সায়ন খারাপ! তারা সিঁতারার ছেলে, ওদের সাথে কী মেয়েদের বিয়ে দেওয়া যায়? যায় না তো! যায় না যখন তখন মেয়েকে খুঁজতে তাদের লাগছে কেন? সেদিন তো ছেলে দুটোর মলিন মুখ দেখে
মায়া করেন নি। তাহলে আজ কেন তাদের লাগছে?
শুধু তাই’ই নয় সিমিন আরো জরুরি কথা গোপন করেছেন। যেটা কেউ স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারছেন না। সিমিন বাড়িতে থাকাকালীন ডয়িংরুমের ঝুল ঝাড়তে গিয়ে ক্যামেরা পেয়েছিলেন এবং সেটার কথা গোপন করেছেন। কিন্তু ক্যামেরা এলো কিভাবে? কে লাগাল ক্যামেরা? এসব নাহয় পরের কথা উনি গোপন করল কেন? কি ভেবেই বা গোপন করলেন? এর উত্তরও দিতে পারলেন না সিমিন। তখন সিরাতের মনে পড়ল বেশ কিছুদিন আগে ওয়াইফাই-এর সমস্যা দেখা দিয়েছিল? তখন বাড়িতে কিছু লোক এসে ঠিক করে দিয়েগিয়েছিল ওয়াইফাই, তারা কী লাগিয়েছিল নাকি ক্যামেরা? ভিডিও কলে থাকা সিমিন এবারও নিশ্চুপ।

সিমিনের নামে এত অভিযোগ হচ্ছে শুনে মুখে হাত দিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল শখ। ড্রয়িংরুমে উপস্থিত থাকা সকলে তার দিকে তাকালে শখ ঠোঁট ভেঙে অসহায় সুরে কেঁদে উঠল। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-‘ ছোটো মা আর চুপ করে থেকো না এবার অন্তত মুখ খোলো।তোমাকে এত কথা শুনতে দেখতে পারছি না আমি। অনেক হলো এবার সত্যিটা বলো সবাইকে।’
একথা বলে সে সবার দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘বাবা-মা ড্রয়িংরুমে ক্যামেরা লাগিয়েছে আহনাফ। শুধু ড্রয়িংরুমেই না
আমাদের তিনবোনের ওয়াশরুমে ক্যামেরা লাগানো। এবং.. এবং তিন বোনের..তিনবোনের..গোসলের ভিডিও আহনাফের কাছে আছে।’

ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ইয়াসিরকে কোথাও না দেখে তাকে আশপাশে খুঁজল শীতল। কিন্তু না দেখে ডাকল দু’একবার। কিছুক্ষণ বসে অপেক্ষা করেও তাকে না দেখে উঠে ড্রয়িংরুমে এলো। পুরো বাড়িতে লাইন অন থাকায় সে ঘুরে ঘুরে দেখল। বিলাশ বহুল সজ্জায় সজ্জ্বিত পুরো বাড়ি।
তবে এত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার ধৈর্য্য নেই শীতলের। বুক ভয়ে নিয়ে এত খুঁটিয়ে কিছু দেখাও যায় না। সে আরেকবার পেছনে তাকিয়ে ইয়াসিরের উপস্থিতি না পেয়ে ধীর পায়ে দরজার কাছে এগিয়ে গেল। দরজা টানতে
বুঝল লক করা। লক ধরতেই পিকপিক করে পার্সওয়াড চাইল।

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৪৯

সে তো পার্সওয়াড জানে না তাই অহেতুক আর টিপাটিপিও করল না। করলে দেখা যাবে শব্দ করে উঠবে। শুদ্ধর রুমের দরজা যেমন বৈদ্যুতিক শখ দেয়। কিন্তু এখান থেকে বের হবে কিভাবে? শীতল দরদর করে ঘামছে। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ঘাম মুছে এক পা পেছাতেই কারো বুকে ধাক্কা খেলো। তখন তার পেছন থেকে কেউ ফিসফিস করে বলল,
-‘ হেই বাবুই পাখি পালাচ্ছ বুঝি?

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৫১