শেষ বিকেলে তুমি আমি পর্ব ১৯

শেষ বিকেলে তুমি আমি পর্ব ১৯
আলিশা

মনে এক ঝাঁক প্রশ্ন, পাশে কথার ফোয়ারা চালিয়ে রাখা চঞ্চল প্রিয়াকে নিয়ে হাজির হই চাচার বাড়িতে। বাবার বাড়ি তো আর বলতে পারছি না। সূত্র টেনে চাচার বাড়ি বলে সম্বোধন করলাম। যেহেতু বিয়ের পর আর মেয়েদের ঘরবাড়ি বলে কিছু থাকে না। এখানে এসে আমি সামান্য নয়। বেশ খানিকটা অবাক হই। ভাবনার জোয়ারে ভেসে যাই। এত্তো কিসের আয়োজন? রান্নঘরে যেন এলাহি কারবার।

খাবার টেবিলটা সাজানো হয়েছে যেন রাজকীয় সজ্জায়। বাড়ির দেয়াল থেকে শুরু করে আসবাবপত্র ঝকমক করছে এমন করে, মনে হচ্ছে যেন আজ কোনো বিশেষ দিন। আমি খোঁজ করতে শুরু করলাম ওয়ারেসিয়ার। এঘর, ওঘর ড্রয়িং রুম উঁকিঝুঁকি দিয়ে রান্নাঘরের দিকে এগোলাম। প্রিয়া তখন শরীরের ভার ছেড়ে সোফার মধ্যে গড়াগড়ি খাচ্ছে ড্রয়িং রুমে বসে। সে যে সদর ঘরে ওমন করে গা এলিয়ে বসে আছে তা যেন তার ভাবনাতেই নেই। প্রথম রোজা তাকে কাবু করে ছেড়েছে বেশ। তার সুন্দর ছিপছিপে মিষ্টি মুখটা জুড়ে নিস্তেজ ভঙ্গির ছোটাছুটি চলছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আমি রান্নাঘরে উঁকি দিতেই নজর বন্দী হলাম চাচি আম্মার। সে যেন এবারই প্রথম আমাকে দেখে ভীষণ খুশি হলো। প্রফুল্ল চিত্তে, একগাল হাসি নিয়ে তিনি বললেন
— কখন এলি? যা তোর ঘরে গিয়ে বোস। চুলোর কাছে থাকিস না। ওয়ারেসিয়ার কাছে যা।
— ও কোথায় চাচি আম্মা?
— তোর ঘরে।

এরপর আমি একটু কুশল বিনিময় করলাম। তার সাথে রান্নার কাজে হাত লাগানোর ইচ্ছেটাও ব্যাক্ত করলাম কিন্তু সে ছিটেফোঁটাও প্রাধান্য দিলো না আমার ইচ্ছেকে। আমি ফিরেই আসছিলাম রান্নাঘর থেকে। দু কদম সামনে এগিয়েছিলাম এমন সময়ই হঠাৎ চাচি আম্মা ডেকে উঠলেন। পিছু ফিরে চাইলাম। সে অদ্ভুত অভিব্যাক্তি মুখে এঁটে হাতে চামচ নিয়ে দাড়িয়ে ছিলেন। আমি কুঞ্চিত কপাল নিয়ে তাকে পরখ করে বললাম
— বলেন।
— আজ অঙ….

পুরো কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই হঠাৎ দরজার ওপাশ থেকে কেউ বাঁধা দিলো। সুর তুলে বেজে উঠলো কলিং বেল। চাচি আম্মা তাড়া দিলেন আমাকে। দ্রুত দরজা খোলার তাড়া। আমিও চলে গেলাম। তার অসমাপ্ত কথাখানি যেন ছিলো দরজার ওপাশে। আমি বিস্মিত, অবাক। অবুঝ চোখে তাকিয়ে রইলাম দরজার ওপাশে দাড়ানো মেরুন রাঙা পাঞ্জাবি পরিহিত অঙ্কনের পানে। চমকে উঠলাম যেন।

— আরে আপু? ভেতরে যেতে দেবে না নাকি? দরজা থেকেই আমাদের সাথে চলে যাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে বুঝি? কিন্তু আমি তো আমার একমাত্র ভাইয়ের বিয়ের আগা টু গোড়া, গোড়া টু আগা না খেয়ে ছাড়বো না।
মুহূর্তেই অট্টাহাসির রোল পরলো। ওরা মোটে প্রায় দশজন। আমি যেন কাঠের পুতুলে রূপান্তরিত হলাম। যে মেয়ে ভীষণ শখের বসে গড়গড় করে বলল ভাইয়ের বিয়ে খাবে, তার পানে একবার দৃষ্টি রাখলাম। হাত পা যেন অবস হয়ে আসছে আমার। মেয়েটার কথা মস্তিষ্কে পুনরাবৃত্তি করলাম। তৎক্ষনাৎ শরীর অবস হওয়ার পথ ধরলো। চাচি আম্মার প্রতি রাগে কিংবা ভীষণ দুঃখে চোখ নালিশ করতে আহ্বান জানালো অশ্রুবিন্দু কে। এমন কিছু করাটাই বুঝি বাকি রেখেছিল আম্মা?

— তোরে কি আমি অঙ্কনের সাথে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছি? এমন করছিস কেন? আমি তোকে ছোট থেকে বড় করলাম এর বিনিময়ে একটা কিছু চাইছি তোর কাছে। তুই এমন করছিস।
অবাকের আরো কয়েক ধাপ ওপরে পৌছে গেলাম আমি। অতিথিরা আসন পেতে বসতেই আমি ঝটপট এসে চাচি আম্মার কাছে জবাব চাইতেই সে এমন কথা বলে দিলো নিরদ্বিধায়। ওয়ারেসিয়া আমার পাশেই ছিলো। ও জোর মিনতি করে আমাকে বলল

— আপু তুই আম্মুকে বোঝা প্লিজ। আমি রিফাতকে ভালোবাসি।
চাচি আম্মা ফুঁসে উঠলেন। উনি তেড়ে এসে ওয়ারেসিয়ার গায়ে হাত তুলতে চাইলেন। আমি ওকে আড়াল করে দিলাম। আমার ওপর এবার শুরু হলো তর্জন-গর্জন।
— তুই সরে দাঁড়া। ও আমার মানসম্মান নষ্ট করবে। একটা বস্তির ছেলের সাথে প্রেম করছে। দুনিয়ায় ছেলের অভাব ছিলো? বেকার, বেয়াদব, লাফাঙ্গা, গুন্ডার সাথে সে…

আমি তাদের মা মেয়ের মাঝে দাড়িয়ে ভীষণ অসহায়ত্ব অনুভব করলাম। মুখের ভাষা, শরীরের শক্তি আর মনের জোর সবই হারিয়ে যেন সর্বশান্ত হয়ে গেছি। অঙ্কন আমাকে ভালোবাসে। আমার সমস্ত খোঁজ খবর নিয়ে সে আমার চাচার বাড়ি অব্দি পৌছে গেছে। বিয়ের প্রস্তাব দিতেও তার দেরি হয়নি। পরিবার সমেত আজ প্রথম রোজায় উপস্থিত। এতোকিছু ঘটে গেছে আমার চোখের আড়ালে। কিছুই জানি না আমি। চাচি আম্মা এখানে স্বার্থ খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমার এখন অঙ্কনের সামনে গিয়ে বলতে হবে

” আমি বিবাহিত। আমাকে বিয়ে না করে আপনি ওয়ারেসিয়াকে বিয়ে করে নিয়ে যান। সুখী হবেন। ”
এমনই পরিস্থিতি তৈরি করার জন্য তাড়া দেওয়া হচ্ছে আমাকে। আমার কথা সে জীবন বাজি রেখেও মানবে। এমনই ধারণা মনে পুষে রেখেছে ওয়ারেসিয়ার মা। আমি মনে মনে খুঁজে গেলাম ছোট আব্বুকে। এই একটা মানুষই পারে পারতো আমাকে এমন অপ্রতিভ অবস্থা থেকে বের করতে। কিন্তু আফসোস। উনি নেই। হয়তো চাচি আম্মা ইচ্ছে করে তার অনুপস্থিতে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করছেন।

দম বন্ধ হয়ে আসার জোগাড় ছিলো আমার। হাশফাশ করে গেলাম পুরোটা সময়। ঘরে ওয়ারেসিয়ার কান্না। আমার মাথা ভার্তি চিন্তা। একটা সময় গিয়ে মনে পরলো স্মরণের কথা। আপনা আপনি দোষগুলো একে একে চেপে গেলো তার ঘাড়ে। সে যদি সেদিন আমাকে ‘দুঃসম্পর্কের বোন’ বলে পরিচয় না দিতো তবে আজ এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না। সেই মানুষটা যদি আজ এসে সব খোলাসা করে দিতো তবে সব ধোয়া উবে স্বচ্ছ হতো পরিস্থিতি। আমার লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। আমি কিভাবে যাবো এরপর অঙ্কনের সামনে? কিভাবে বলবো, কি বলবো আমি তাকে? প্রিয়ার মুখের দিকে তাকালাম একটু আশা নিয়ে। নীরবে আমি প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম

” কি করবো এখন?”
ও যেন নীরবে পাল্টা উত্তর দিলো
” আমি বুঝতে পারছি না।”
চোখ মুখ শুকিয়ে উঠছে আমার। একটু পর মাগরিবের আজান পরবে। ইফতারের সময় ঘনিয়ে আসছে। আমি হুট করে চাইলাম আমার হাতের দিকে। স্মরণের পরিয়ে দেওয়া চুড়ি। মোটা দু’টো চুড়ি। মনে পরে গেলো গত রাতের কথা। স্মরণ কি তবে জানতো? সে কি জানতো আজ এমন কিছু হবে? ভাবতে গিয়ে মনে হলো সে অবশ্যই জানতো। আর জানতো বলেই সে আমার হাতে অস্বাভাবিক দুটো চুড়ি আর নাকে ফুল পরিয়ে দিয়েছে। জানতো বলেই আমি বাড়ি থেকে বের হওয়ার মুহূর্তেই সে গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে।

— খেয়া….. তুই এটা কি করলি?
আচমকা কানে পৌঁছালো চাচি আম্মার ক্ষুব্ধ কন্ঠ। তিনি শুকনো মুখ নিয়ে এগিয়ে আসছেন আমার দিকে। আমার কানের নিকটে মুখ দিয়ে চাপা গলায় বললেন
— তুই স্মরণকে আসতে বলেছিস কেন? তুই কি ওয়ারেসিয়ার ভালো চাস না?

আমি চমকে উঠলাম। স্মরণ এসেছে? চাচি আম্মাকে পাশ কেটে আমি ছুটলাম সদর ঘরের দিকে। মনে মনে স্থির করেই বসলাম আজ নিজের পরিচয় দেবোই আমি। মাঝের দু’টো ঘর পেরিয়ে যেতে হয় ড্রয়িং রুমে। মনে সাহস সঞ্চয় করতে করতে চলছিলাম পথে। আচমকা যেন ধাক্কা খেলাম আমি। কিছুটা চমকে অগোছালো মন মস্তিষ্ক নিয়ে সামনে তাকাতেই চোখে পরলো স্মরণকে। মুখে তার কিঞ্চিৎ বিরক্তি। আচমকা তার দেখা পাওয়ার কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম আমি। পরক্ষণেই আবার সে অপ্রস্তুত ভাব উবে দিয়ে তার কাছে প্রশ্ন করে বসলাম

— ‘দুঃসম্পর্কের বোনের’ বিয়ে খেতে এসেছেন বুঝি?
মনে থোকা থোকা রাগ চেপে রেখে একথা বলতেই সে মুখে জমাতে চাইছিল কোনো এক অভিব্যাক্তি। কিন্তু তৎক্ষনাৎ ভেসে এলো আজানের ধ্বনি। সে এই মুহূর্তে একটা অকল্পনীয় কাজ করে বসলো। প্রথমে নিজের মুখে কিছু একটা নিলো অতঃপর তার একাংশ আচমকা দিয়ে দিলো আমার মুখে। আমি মুহূর্তেই হতভম্ব হয়ে গেলাম। স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম তার পানে। সে পাঞ্জাবির হাতা গুটানোর কাজে ব্যাস্ত হয়ে হয়ে গিলো বলল

শেষ বিকেলে তুমি আমি পর্ব ১৮

— যাক, প্রথম রোজা এক খেজুর দিয়ে ডান। তোমার মনে হয় এমন একটা ইচ্ছেই ছিলো তাই না? এজন্যই দৌড়ে আমার কাছে যাচ্ছিলে। নট ব্যাড।
একথা বলেই সে পা বাড়ালো সামনের দিকে। দুকদম এগিয়ে গিয়ে আবার হঠাৎ পিছু ফিরে বলল
— নামাজ পরে এসে হিসাব বুঝিয়ে দিচ্ছি। আমি দুঃসম্পর্কের বোনের নয় দুঃসম্পর্কের বউয়ের বিয়ে ভাঙতে এসেছি।

শেষ বিকেলে তুমি আমি পর্ব ২০