শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ১৮

শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ১৮
আলিশা

গ্রাম বলে আজানের সুর বাঁধাহীন ভাবে এসে ধাক্কা দিলো কানে। চোখ মেলে তাকিয়েই দেখি স্মরণ ঘুমে কাতর। গত রাতের কথা অনুযায়ী ধাক্কা দিলাম তাকে। সে তড়িঘড়ি করে উঠে বসলো। কোনো মসিবত হয়নি। বন্ধ চোখে ঢুলতে ঢুলতে সে চলে গেলো টিউবওয়েলে। ততক্ষণে কানে এলো দাদির কন্ঠ। তারাও হয়তো উঠে গেছে। স্মরণ ওজু করে রওনা হলো দাদার সঙ্গে মসজিদ প্রাঙ্গণের দিকে। পরনে তার লুঙ্গি, শার্ট ও জ্যাকেট। নতুন রূপ। আমি যেন হেঁসেই কুল পেলাম না।

নামাজ আদায় করে উঠনে বসে আশপাশ দেখছিলাম। শীতার্ত ভোরে পাখিদের গান নেই। টিনের চাল বেয়ে পরা ফোঁটা ফোঁটা শিশির বিন্দু ছুঁয়ে দেখছিলাম। পূর্ব আকাশে উঁকি দেওয়া সূর্যের অসহায় রূপ দেখছিলাম। কুয়াশার ভীরে প্রভা বিকিরণ করতে বড্ড অসুবিধা হচ্ছে তার। মনোযোগ নিবন্ধ ছিলো উঠোনের রঙ বেরঙের ঘাস ফুলের পানে। ক্ষীণ আলোর মাঝে দেখতে তাদের আদুরে লাগছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

শিশিরসিক্ত ফুলগুলোতে হাত ছোঁয়াতেই হঠাৎ উঠোনে হুড়মুড় করে কেউ যেন এলো। বেশ খানিকটা চমকে উঠলাম। শিশিরাবৃত হাত নিয়ে অতি সত্বর পেছন ফিরতেই চোখে পরলো এক মেয়েকে। ঘাবড়ানো দৃষ্টি, আমায় দেখে যেন অবাক সে। আমি ভ্রুকুটি করে চেয়ে রইলাম তার দিকে। পরনে তার ধুতি ধরণের পাজামা। পায়ে আলতা, মাথা জুড়ে ছড়িয়ে আছে টিকলি। কানে বড় দুল।

দৃষ্টি আমার সরু হলো। এমন সাজ কোথাও দেখেছি বলে মনে হলো। ভাবতে লাগলাম কোথায় দেখেছি এমন সাজসজ্জা? ভাবনার মাঝেই মেয়েটা ছুটে ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে আমাদের জন্য বরাদ্দ করা ঘরটাতে ঢুকলো। অতঃপর তার দরজা বন্ধ করার তাড়া। ততক্ষণে আমার মনে পরে গেলো এমন সাজসজ্জায় সজ্জিত অথৈকে আমি ছবিতে দেখেছি গতকাল। কিছুসময় সব ভুলে তাকিয়ে রইলাম বন্ধ দরজার দিকে। আশপাশ তখন আঁধার কেটে ফকফকা হওয়ার চেষ্টায় মত্ত। আর আমি মত্ত মেয়েটাকে নিয়ে। এটাই কি দাদির নাতনি? হয়তোবা। তবে সে নাকি গেছে বান্ধবী বাড়িতে? বান্ধবী বাড়ি, সাজসজ্জা, ভোরে বাড়ি ফেরা! বিষয়গুলো কি আজগুবি হয়ে গেলো না?

স্মরণ মসজিদ থেকে ফিরে এসেই ব্যস্ত হলো বাসায় ফেরার জন্য। জাহিনকে ফোন করা হলো। সে গাড়ি নিয়ে রওনা হয়েছে। আমরা নিজেদের তৈরি করতে রত হলাম। দাদ-দাদি চাইলেন আমরা যেন সকালের নাস্তাটা করে যাই। তবে সে আর সম্ভব হবে বলে মনে হলো না। স্মরণ হঠাৎ বলল সে বাজারে যাবে। জাহিন আসার ফাঁকে নাকি তার বাজারে অতি প্রয়োজন। অতঃপর দাদার সঙ্গে রওনা হলো বাজারের পথে। এই ফাঁকে আমি বসলাম দাদির পাশে। মেয়েটা তখনও ঘর থেকে বের হয়নি৷ নিজেকে বন্দিনী দাবি করে সে বসে রইলো ঘরে। আমি ইনিয়ে বিনিয়ে, গল্পের ফাঁকে শোনার চেষ্টা করলাম মেয়েটার নাম পরিচয়। দাদি বললেন

” ও তো মাঝে মাঝে বান্ধবী বাড়ি যায়। আইছে নি, তুমি দেখছোনি? ও খাইরোন…. খাইরোন…. দেহো হুনতো না। কাইত হইয়া ঘুমাইছে মনে হয়। ইতিম খানা থাইকা নিয়ে আইছি গো। ওর তো মা বাপ কেউ নাই। আমরা পায়ে বেড়ি পরাই নাই। বড় আদরে রাখি। কিন্তু দেহ… সুন্দর মানুষ। এই যে কই রাত কইরা, সাঝ বেলা, কালের পয়লা বেলা বাইরে বাইর হবি না। কিন্তু হুনেই না”

গল্পের মাঝেই স্মরণ বাজার থেকে ফিরলো। উঠোনে এলো একটা ভ্যান গাড়ি। ব্যাগ ভর্তি বাজার, ভ্যান ভর্তি মাছ, সবজি, দুধ, কলা। হরেক পদের মাছ। বড় ছোট সবের বাহার। আমি অম্লান,খুশি স্মরণের কান্ডে। সঙ্গে খানিকটা অবাক। তালে বেচারা ঠিকঠাক। সত্যিই সে প্রশংসার দাবিদার। দাদি খুশি প্রকাশ করার পূর্বে প্রকাশ করলেন আফসোস। এতো বাজার? আয় হায়! কি কান্ড করেছে বাছা! মানুষ তারা তিন জন। কি করবে এতো বাজার দিয়ে? কত টাকা না জানি খরচ হলো! আমি এগিয়ে গেলাম দাদির কাছে। দাদা তখন ভ্যান থেকে বাজার নামাতে ও দাদির সঙ্গে কথা বুনতে ব্যস্ত। দাদির পাশ ঘেঁষে দাড়িয়ে বললাম

” আশেপাশে ফ্রিজ নেই? কারো বাড়িতে টুকটাক কিছু রাখবেন। আর এখন তো শীতের দিন। কিচ্ছু নষ্ট হবে না। ”
স্মরণও সায় জানালো। অতঃপর আমার নিকট এসে আবারও মনে করিয়ে দিলো বাসায় ফেরার কথা। জাহিন নাকি নিকটেই। এসে পড়বে জলদি। দাদির নাতনি তথা খায়রোনের রুমে আমার ফোন ছিলো, স্মরণের পোষাক ছিলো। দরজার কড়া নারলাম। বেশি অপেক্ষা করতে হলো না। ভেতর থেকে দরজা খোলা হলো। আমি ভেতরে প্রবেশ করতেই মেয়েটা কাচুমাচু হয়ে দাড়িয়ে রইলো দরজার পাশে। গায়ে জড়িয়ে রেখেছে একটা শীতের চাদর। এখন তার পোষাক সালোয়ার-কামিজ। আমি সহজ হতে চেষ্টা করলাম। মেয়েটার পানে তাকিয়ে মুচকি একটা হাসি ঠোঁটে নিয়ে বললাম

— তোমার ঘরে গতরাতে আমরা থেকেছি। হয়তো এলোমেলো করে রেখে গেলাম তোমার ঘর।
মেয়েটাও সহজ করে উত্তর করতে চাইলো
— আচ্ছা, সমস্যা নেই।
— একটু বাইরে যাবে? আসলে রেডি হতাম আমরা।
মেয়েটা বিনাবাক্যে ঘর ছেড়ে বাইরে গেলো।

জাহিন গাড়ি নিয়ে পাকা সরকের মাথায় দাড়িয়ে আছে বলে স্মরণ আমাকে তাড়া দিয়ে সকলের থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পরলো। অচেনা, অজানা মানুষকে হুট করে গতরাতে ঘরে আশ্রয় দেওয়ায় আমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে রওনা হলাম। বাসায় পৌছালাম সকাল আটটায়। আসার পথে স্মরণ ও জাহিনের কথোপকথন থেকে জানতে পারলাম গতরাতে মাঝ রাস্তায় ফেলে আসা গাড়িটা জাহিন নিয়ে এসেছে।

বাসায় পৌঁছে গোসল সেরে প্রথমেই ব্যস্ত হলাম অথৈয়ের সেই ছবিটা নিয়ে। একই সাজসজ্জা। কোনো নির্দিষ্ট স্থানের জন্য নির্দিষ্ট সাজসজ্জা নয় তো? নাকি মেয়েটা থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত। গ্রামের লোকেদের চোখ ফাঁকি দিয়ে সে স্বপ্নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে? ভাবনা গুলো গুলিয়ে দিলো আমাকে। অতঃপর হঠাৎই ভাবলাম, এতো কেন মাথা ঘামাচ্ছি আমি? সামান্য এক সাজসজ্জা নিয়ে?

হয়তো মেয়েটা থিয়েটারের সঙ্গেই যুক্ত। বৃদ্ধ দাদা দাদির চোখ ফাঁকি দিয়ে সে যায় হয়তো শুটিং করতে। কিংবা দারিদ্র্য হওয়ার লুকিয়ে কোনো যাত্রাপালার দলের সঙ্গে জড়িত। গ্রামে তো শীতের সময়ে কত যাত্রাপালাই হয়। ভাবনা সব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে ফোন হাতে বসলাম। প্রিয়ার সঙ্গে টুকিটাকি ম্যাসেজ করলাম। জানতে পারলাম সে আসবে দেশে।

তবে একেবারে কখনো আসা হবে কিনা তা সন্দেহের। হঠাৎ করে দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে বিপদে পরে। বাচ্চা পেটে আসার কারণে তার কোনো সমস্যা হতে পারে এমন আশঙ্কা অঙ্কনের। আবার এমন সময়ে সে বাসায় একা থাকবে। শশুর, শাশুড়ী, ননদ সবাই বিদেশে। যদি অঙ্কন বাসায় না থাকে তবে তাকে দেখবে কে? পেশার দরুন অঙ্কন তো প্রায় সময়টাই ঘরের বাহিরে থাকে। এমন নানান চিন্তা ভাবনা থেকে অঙ্কন বউকে নিয়ে উড়াল দিয়েছে কানাডায়। হয়তো তারা সেখানেই সেটেল্ড হবে। তবে বাঁধ সাধে প্রিয়ায় লেখাপড়া। এবিষয়ে অঙ্কন নাকি এখনো মুখ খোলেনি।

সকাল সকাল গোসল দেওয়ার ফলস্বরূপ পেলাম আমাকে জমিয়ে দেওয়ার মতো ঠান্ডা। স্মরণ ঘরে নেই। সে কোথায় গেছে কে জানে? আমি আলমারি ঘেঁটেও আমার কোনো শীতের জামা পেলাম না। আমার যে এবাড়িতে আসার পর শীতের জামাই কেনা হয়নি! মাথায় হাত পরলো। একটা চাদর টেনেই শীত পার করার ইচ্ছে ছিলো আমার। শীতের জামা গায়ে জড়ালে হাজারো সমস্যা আমায় জেঁকে ধরে।

শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ১৭

শুধুই বিরক্ত লাগে। মনে হয় ঘাড় বাঁকা হয়ে গেলো, হাতে ব্যাথা পেলাম। সঙ্গে জামা বা ব্লাউজের হাতা ওপরে ওঠার মতো বিচ্ছিরি কান্ডটা তো আছেই। উপায়ন্তর না পেয়ে দেখেশুনে স্মরণের একটা জ্যাকেট নিলাম। ছেলেদের জ্যাকেটের প্রতি আমার অন্যরকম এক দূর্বলতা কাজ করে। জ্যাকেট গায়ে জড়িয়ে নিয়ে আলমারির পাল্লা বন্ধ করার মুহূর্তে হঠাৎ থমকে গেলো আমার হাত। কৌতুহল মনে নাড়া দিলো। জ্যাকেটের বড় তাকের নিচেই ছোট তাক। দুই তাকের মাঝখানে উঁকি দিচ্ছে সাদা একটা কাগজ।

শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ১৯