শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ১৭

শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ১৭
আলিশা

আকাশে অর্ধ চাঁদের গলে পড়া সোনালী রশ্মিতে দু’জনে পথ অতিক্রম করে চলে এলাম অচেনা এক এলাকায়। ফোনের ফ্লাশের আলোয় দৃশ্যমান চারচালা বাসগৃহ। ইট সিমেন্টের আকা বাঁকা সরক। ল্যাম্পপোস্ট হীন। স্মরণ আমাকে নামিয়ে দিলো সরকে। এগোতে লাগলো সামনের পথে। আমি তার পিছু পিছু হাঁটতে লাগলাম। কিছুটা লজ্জার আঁচ আমার চোখে মুখে বসে রইলো। হাঁটতে গিয়ে অনুভব করলাম নতুন অশান্তি। হাড় কেঁপে উঠছে শীতে। চিবুক ঘনঘন কেঁপে উঠে দু চোয়াল এক করে ফেলছে। শব্দ হচ্ছে দাঁতের সঙ্গে দাঁতের সংঘর্ষে।

— চাদর এনেছো কেন? রেখে এলেই পারতে। শুধু শুধু কষ্ট! ইশ কত গরম।
হন্টন দশায় স্মরণের বাঁকা উক্তি। আমি প্রত্যুত্তর করতে পারলাম না। কেবল থমথমে মুখ নিয়ে হাঁটতে লাগলাম তার পাশ ঘেঁসে। যদিও একটু তফাতে ছিলাম। অত্যধিক শীতের কবলে নাজেহাল হয়ে একটু উষ্ণতা খুঁজতে তার বাহু ঘেঁষে চলতে আরম্ভ করলাম। গ্রামে সত্যিই ভয়ঙ্কর শীত। আকাশ পানে চাইলাম।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

একটা তারা দেখা যায় কুয়াশার মাঝে। অনুজ্জ্বল লাগছে কুয়াশার ভীরে। আমার মাথার চুলে বিন্দু বিন্দু জলকণা জমেছে। ভাবনার মাঝে হঠাৎ অনুভব হলো গায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে কিছু। অবাক হয়ে পাশ ফিরে চাইলাম। স্মরণ জ্যাকেট শূন্য। গায়ে কেবল আছে শার্ট।

আমার কাঁধে জ্যাকেট রেখে সে ফোল্ড করা হাতা নামিয়ে দিতে ব্যস্ত হলো। বিষ্ময়ে আমি স্তব্ধ হলাম। তার এহেন আচরণ আমার কল্পনাতেই যেন মানানসই ছিলো। সেদিন, সমুদ্র সৈকতের কথাটা আজও মনে ভাসে। ভেজা শরীর নিয়ে দাড়িয়ে ছিলাম। বোকার মতো তার কাছে শার্ট চেয়ে বসলে সে ক্ষিপ্ততা দেখিয়ে আমাকে দমিয়ে রেখেছিল। আজ আমি শীতে কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে লুটিয়ে পরলেও তাকে বলতাম না।

” আপনার জ্যাকেটটা একটু দেবেন?”
খুশিতে মুখ ঘুরিয়ে হাসলাম নিঃশব্দে। পথ চলতে চলতে পাকা সরক ছাড়িয়ে পৌঁছে গেলাম কাঁচা মাটির রাস্তায়। আশপাশের কোথাও হতে ভেসে আসছে কড়া মিষ্টি সুঘ্রাণ। হয়তো কোনো পুষ্প রূপ মেলে ধরার পাশাপাশি ছড়িয়ে দিয়েছে তার সুগন্ধি। আমি স্মরণের দিকে দৃষ্টি তাক করে বললাম

— আপনার শীত লাগবে না?
— নাহ! আমি লোহার তৈরি মানুষ।
হেসে উঠলাম তার কথায়। আবার পরক্ষণেই ঠোঁট উল্টে বললাম
— আসলে বাসায় তো এতো শীত লাগে না আমার। একটা চাদর দিয়েই হয়ে যায়।
— হুম, এজন্য এখন শীতে মাড়ি কাঁপছে।

স্মরণের কথার পিঠে ঠোঁট উল্টিয়ে হাঁটতে লাগলাম। পারা ছেড়ে তফাতে একক, অযুগ্ম বাড়ি খুঁজে দুজনে উপস্থিত হলাম সে বাড়ির দরজায়। ভয়ে ছিলাম অনাকাঙ্ক্ষিত আমাদের দেখে কেমন প্রতিক্রিয়া দেয় তারা। তবে সৌভাগ্যের বিষয় তারা আমাদের খাতির করলো। যত্নে ঘরে তুলল। এজন্যই বুঝি আমরা জাতিগত ভাবে অতিথি আপ্যায়নে সেরা। টিনের চারচালা ঘরের মাঝে আরেকটা টিন দিয়ে দুটো কক্ষ করা হয়েছে।

ছোট দুই কক্ষের এক কক্ষ আমাদের দেয়া হলো। বাড়িতে সদস্য মাত্র দু’জন। বৃদ্ধ যুগল। তারা আজ ছোট খাটো পিঠা উৎসব করছে যেন। উঠোনে বানাচ্ছে ভাপা পিঠা। আমি এগিয়ে গেলাম। সাহায্য করলাম বৃদ্ধাকে। বৃদ্ধ বসে ছিলো টুলে। আগুনের লাল শিখায় হাত মেলে ধরে উষ্ণতা কুড়াচ্ছিলো। হঠাৎই মাখোমাখো ভাব জমলো আমার তাদের সঙ্গে। গল্প হলো অনেকদিন পর এমন করে। সেই ছোট বেলার মতো। গ্রামে গেলে যেভাবে গল্প হতো উঠোনে। আমি মানুষ দেখলে পিছিয়ে যাই। ভাব জমাতে হিমশিম খাই। তবে বৃদ্ধ আর শিশুদের সাথে মিশে যাই ভোরের শিশিরের মতে। গাঢ় হয় বন্ধন গভীর কুয়াশার মতো।

বাকি পিঠাগুলো আমি তৈরি করলাম। দাদি বসে দেখলো। নালিশ করলো সঙ্গীর নামে।
” এই বুড়া বয়সেও তার পিঠা খাওন লাগে? ভাইজ্জা খায় আমারে।”
আমি হাসলাম। কথা, সাক্ষাতের এক পর্যায়ে জানলাম তারা নিসন্তান। কেবল একটা কুড়িয়ে পাওয়া নাতনি আছে। সে নাকি গেছে কোনো বান্ধবীর বাড়িতে। সেখানেই মাঝে মাঝে রাত্রিযাপন করে।

বারান্দায় হলুদ আভা বিকিরণ করা একটা ছোট লাইট ছিলো। তারই নিচে বিছিয়ে দেওয়া হলো একটা ছোট পাটি। তাতে বসলো আমার আর দাদিমার পতি। আমি বসলাম টুলে আর দাদিমা বসলো পিঁড়িতে। সামনে বড় এক থালায় রাখা হলো ভাপা পিঠা। খাওয়া মাঝে নজরে এলো স্মরণের গায়ে জড়িয়ে রাখা বড় চাদর। সাদার মাঝে ঈষৎ লালচে ভাব। আমি ভ্রু উঁচিয়ে নীরবে শুধালাম

” কোথায় পেলেন? ”
সে পাশে তাকিয়ে বুঝিয়ে দিলো দাদিমার পতি দিয়েছে। আমি আবারও আমার গায়ে দৃষ্টি রেখে বুঝালাম
” জ্যাকেট লাগবে?”
মাথা নাড়িয়ে তার উত্তর হলো
“নাহ”

অতঃপর আমি নীরবে বসে পিঠা খেতে লাগলাম। কিছু একটা মনে হতেই আবারও স্মরণের পানে তাকিয়ে পিঠা উঁচিয়ে নীরব প্রশ্ন ছুড়লাম
” পিঠা কেমন লাগছে ”

সে মুখভঙ্গি কুঁচকে ফেলল। আমি অবাকে হা হলাম। ভালো হয়নি? স্মরণ হাতে পিঠা নিয়ে চুপটি করে বসে ছিলো। আমি উঠে দাঁড়ালাম। তখনই দাদি গেলো পানির জগ ভরতে। সুযোগ বুঝে দাদার চোখ ফাঁকি দিয়ে স্মরণের সঙ্গে পিঠা বদল করে ফেললাম। তার হাতের পিঠা নিজে নিয়ে আমার হাতের পিঠা তার হাতে ধরিয়ে দিলাম। অতঃপর তার পিঠা পরীক্ষা নিরীক্ষার করে তুলে আনলাম ভালো না লাগার রহস্য।

পিঠাতে গুড়ের ছিটেফোঁটা নেই। বেচারা কষ্ট করে বোধহয় তিন ভাগের একভাগ গলাধঃকরণ করেছে। আমি নিশ্চিত এই পিঠা আমিই তৈরি করেছি। এরকম বুকপিঠ ছাড়া ভুল খেয়া বৈ অন্য কারো দ্বারা হওয়া সম্ভব নয়। অসহায় চোখে স্মরণের পানে চাইতেই আমি ঝটকা খেলাম। বড়সড় এক ঝটকা। সে আমার খাওয়া পিঠা খেয়ে নিয়েছে। এঁটো খেয়ে বেচারা এমন রিয়্যাকশন দিলো যেন ভয়ঙ্কর স্বাদ। আমার এঁটোর জন্যই এতো স্বাদ। আমি বোকা বনে গিয়ে যেন বোবা হয়ে গেলাম। সে কি আদৌও খেয়াল করেছিল যে ওই পিঠা আমার এঁটো ছিলো?

খাওয়া পর্ব শেষ হতেই দাদা-দাদি চলে গেলেন ঘুমানোর উদ্দেশ্যে। ভাতের আয়োজন তারা করবেন না ঠিক করেছিলেন। অতঃপর আমাদের কথা ভেবে ভাত রান্নার প্রস্তুতি নিতে গেলে আমি আটকে দিলাম। পিঠার দরুন পেট কানায় কানায় পূর্ণ।
— কখন গেছিস? ছোঁয়া কি ডিসটার্ব করছে?
বারান্দার নিচে দাড়িয়ে স্মরণ ফ্যাকাশে মুখে মেয়ের খোঁজ জানতে ব্যস্ত। ভিডিও কলের ওপাশ হতে অঙ্কনের কন্ঠ হতে শোনা গেলো

— খুব ডিসটার্ব করছে। ডিসটার্ব করতে করতে আমার সাথে হাসাহাসি করছে। খেলছে।
স্মরণ ঠোঁট প্রসারিত করলো। আমি বারান্দার সিমেন্টে নির্মিত খামে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে দেখলাম স্মরণ কে। কান পেতে রেখেছিলাম তার হাতের ফোনে।
— বাবা, আজ এখানে আসার পরই আঙ্কেল আমাকে কোথায় ঘুরতে নিয়ে গিয়েছিল জানো? একটা পার্কে। প্রিয়া আন্টিও গিয়েছিল। এত্তগুলো চকলেট কিনে দিয়েছে আমাদের। আন্টি আর আমি আইস ক্রিমের জন্য বয়না করেছিলাম কিন্তু আঙ্কেল দেয়নি।

শেষোক্ত কথায় অভিমান। আমি এগিয়ে গেলাম। ছোঁয়া আমাকে দেখেই আরো কিছু নালিশ জানালো। প্রিয়াও অবুঝের মতো ক্যামেরার বহির্ভূত থেকে ছোঁয়া কে শিখিয়ে দিলো, মনে করিয়ে দিলো অঙ্কনের দোষত্রুটি। বেচারা অঙ্কন ভ্যাবাচাকা খেয়ে তাকিয়ে রইলো স্মরণ ও আমার পানে। বেশি কথা হলো না। অঙ্কন বউয়ের কাণ্ডজ্ঞান নিয়ে বিপাকে পরে তড়িঘড়ি করে ফোন কাটলো। আমি এপাশে মুখ চেপে হাসতে ব্যস্ত হলাম। স্মরণ ফোন কেটে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। অতঃপর আমি হাসি দমিয়ে তার পাশাপাশি দাড়ালাম। সে আকাশ পানে তাকিয়ে কিছু ভাবতে ব্যস্ত হলো। আমি আগ বাড়িয়ে প্রশ্ন করলাম

— তারা গুনছেন?
— হুম। দেখো ওই তারাটা তোমার মতো লজ্জাবতী। নিভু নিভু করে আলো দিচ্ছে।
— আমি লজ্জাবতী? এখন আমি কি লজ্জার কাজ করলাম শুনি?
— নিজের লজ্জার পরিচয় চাও?
— হুম, বলেন দেখি আমি এখন কি এমন লজ্জার কাজ করেছি।

স্মরণ ফিরে চাইলো আমার দিকে। ঘোর লাগানো দৃষ্টি। উঠোনে বারান্দায় লাগানো লাইটের ছিটেফোঁটা আলো আমার চোখকে দেখালো সে ক্রমশ এগিয়ে আসছে আমার দিকে। আমার বুকে শুরু হলো ঢোল, তবলা, দামামা বাজানোর হাঙ্গামা। ভরকে গিয়ে এক পা পেছনে সরাতেই তার হেঁচকা টান। অতপর ঠান্ডা হাত আমার কোমরে রেখে আমার শরীর অবশ করে দিয়ে বলে উঠলো

— তোমার এঁটো পিঠা গুড়ের চেয়েও মিষ্টি ছিলো, খেয়া।
তার কথা ও কান্ডের দরুন আমি লজ্জায় লাল নীল হয়ে গেলাম। আমি নিশ্চিত আমার কানে লাল রঙের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠেছে। ত্রপায় স্মরণের চোখে চোখ রাখতে পারছি না। অচিরেই তাকে বড়সড় এক ধাক্কার দরুন সরিয়ে দিয়ে মুখ খর্ব করে রইলাম। তখনই স্মরণ হেঁসে উঠলো শব্দ করে। কুচুটে হাসিতে আমার পানে তাকিয়ে বলল
— দেখলে তোমার লজ্জা? আরো দেখবে?
আমি আগুনের ফুল্কি চোখে ধারণ করে বললাম

— আপনার না বউ হারিয়ে গেছে। তারপরও কুট বুদ্ধি মাথায় আসে কিভাবে?
তার উত্তর
— আবার তো ফিরে পাবো তাকে।
আমি হাঁটতে শুরু করেছি ততক্ষণে ঘরের পানে। সেও আমার পিছু পিছু ছুটতে ছুটতে বলল
— ছোট বউ, রাগ কোরো না। ছোট বউ, শোনো আমি এই ড্রেসআপে ঘুমাতে পারবো না।
আমি চলতি দশায় বললাম

— বউয়ের শাড়ি কেটে দেই পরবেন?
— ছিহ! খেয়া, এতোটা অবনতি কবে হলো তোমার?
— এই যে এখন। আপনার সাথে থেকে থেকে।
স্মরণ কথা বাড়ালো না। হয়তো আমার কথার দরুন নাক মুখ কুঁচকে আমার পিছু নিলো। আমাদের জন্য বরাদ্দ করা রুমে একটা লুঙ্গি পাওয়া গেলো। স্মরণ অসহায়, ছলছল চোখে আমার দিকে ক্ষণকাল তাকিয়ে থেকে সব রাগ আমার ওপর ঝেড়ে দিতে শেষ মুহুর্তে বলে উঠলো

— আদব ছাড়া বউ! বাইরে যাবে নাকি আমি তোমার সামনে চেঞ্জ করবো?
আমি তড়িঘড়ি করে চলে এলাম বাইরে। লোকটার হায়া পর্দা বেশি পুরু নয়। লজ্জা একটু কমই বটে। এ কান্ড শেষ হওয়ার পর আবার ঘুমনোর আগ মুহূর্তে। ব্লাঙ্কেটের ভেতর শয্যারত অবস্থায় বন্ধ চোখে বলে ওঠে

শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ১৬

— তোমার যদি আগে ঘুম ভাঙে। উঠবে না ঠিক আছে? আমাকে ডেকে উঠাবা। জানি না কাল সকাল অব্দি…..
বাকিটুকু শোনার আগেই আমি নিজের কান সর্বশক্তি প্রয়োগ করে চেপে ধরলাম। কিছুটা শব্দ করেই বললাম
— আস্তাগফিরুল্লাহ, নাউজুবিল্লাহ। আল্লাহ মাফ করো।
স্মরণ বোধ হয় কানে তুলল না আমার একথা। ঘুমিয়ে গেলো অবিলম্বে।

শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ১৮