শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ১৫

শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ১৫
আলিশা

ওদের শর্তে স্মরণ রাজি হলো। রাতের সমাপ্তির অপেক্ষায় নির্ঘুম রাত কাটলো তার। ভোর হতেই বেরিয়ে গেলো অফিসে। আমায় বলল কোনো এক বাহানায় কিছুসময়ের অবসর নেবে। হতে পারে সে বাহানা অসুস্থতার। যতোদিন না অথৈকে ফিরে আনতে পারে এবাড়িতে ততদিন সে কাজে ফিরবে না। আমার মন ভয়ে কুঁকড়ে উঠলো। কি হবে আগামী দিনগুলোতে? ওরা যে অথৈকে ফিরে দেবে এমন কোনো নিশ্চয়তা কোথায়?

বাবা কিছুটা মনঃক্ষুণ্ন স্মরণের কাজে। শুনেছি তিনি স্মরণের পেশার ঘোর বিরোধী। ওনার ভাষ্যমতে এ যেন চাকরি নয়। এহলো খাল কেটে ঘরে কুমিরের আগমন ঘটানো। ব্যাবসা এখন রসাতলে যাওয়ার উপক্রম। সামলাবে কে? বৃদ্ধ বয়সে তার যেতে হবে অফিসে। ম্যানেজার হিসাবে গন্ডগোল করেছে। বাবা ভীষণ ক্ষুদ্ধ। স্মরণ লুকিয়ে এ চাকরিতে জয়েন না করলে আজ অনেক সমস্যাই তাড়া করতে পারতো না। একটা সুখী জীবন হতো সকলের। বাবা অনেক কথাই বললেন। আমি চুপচাপ শুনলাম।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বাড়িটা ফাঁকা হলো। বাবা নেই, স্মরণ নেই, জয়নব খালাও আসবেন না বলে জানালেন। তার ভীষণ জ্বর। ইচ্ছে হলো দেখতে যাই খালাকে। একা মানুষ! কিন্তু পা যেন আমার অদৃশ্য শিকলে বন্দী। জীবন ছিলো সকালের ঝলমলে আলো, আচমকা তা রূপ নিলো গুমোট কালো মেঘে ঢাকা আকাশে।

সময় গেলে সাধান হয় না। মা হলো স্বার্থপর প্রাণী কেবল তার সন্তানের জন্য। কথা দু’টোকে আমার মস্তিষ্কে কবে কখন কিভাবে খোদাই করা হয়েছে কে জানে? মা হওয়ার অনুভূতি আকস্মিক জেগে উঠলো মনে। কম্পমান হাত রাখলাম নিজের পেটে। অতঃপর কিছুসময় তাকে নিয়ে ভাবনা। তার ভালো মন্দ ভেবে নিয়ম মাফিক চলতে চাইলাম। খাওয়া দাওয়ার বিশেষ নিয়ম নিজেই তৈরি করছিলাম। তখনই কলিং বেলের শব্দ কানে এলো। বসা ছিলাম আমার ঘরের টেবিলে। আস্তে করে ড্রয়িং রুম দিয়ে হেঁটে পৌছালাম দরজার নিকট। অতঃপর দরজা খুলতেই তড়বড়িয়ে ঘরে ঢোকে স্মরণ। আমার পানে ব্যস্ত ভঙ্গিতে এক নজর তাকিয়েই সে হড়বড় করে বলল

— ব্যাগ গোছাও তো খেয়া। জলদি। হারি আপ। তিন ঘন্টা পর প্লেন।
আমি পুরোদমে অবাক। স্মরণ থেমে নেই। সে ছুটেছে আমাদের ঘরে। অর্থাৎ যে ঘরে আমি, ছোঁয়া ও সে থাকে। আমি পিছু নিলাম। এক হাতে শাড়ির কুঁচি আর অন্য হাতে চাদর সামলে তড়াক করে ঘরে ছুটতে পারছি না। তার নাগাল আমি পেলাম না। দূর হতেই উচ্চ গলায় শুধালাম
— কেন? কার ব্যাগ? কিসের টিকিট?

স্মরণ ঘরে পৌঁছে স্থির হলো। কেবল তার পা দু’টো স্থির। হাত চলছে আলমারি খুলে ব্যাগ খুঁজতে।
— ওখানে পাবেন না। আমি দিচ্ছি।
আমার কথায় সে আলমারি ছেড়ে হাঁক ছাড়লো ছোঁয়ার উদ্দেশ্যে। হুলস্থুল কান্ড। সে অস্থির, এলোমেলো, ভয়াবহ চিন্তিত। আমি ব্যাগ খুঁজে বের করে বিছানায় রাখলাম। ইতিমধ্যে ছোঁয়া এসেছে ঘরে। স্মরণ ছোঁয়ার হাতে একটা শীতের ফ্রক ধরিয়ে দিয়ে বলল

— তৈরি হও ছোঁয়া।
— কোথায় যাবে ছোঁয়া?
আমি আবারও প্রশ্ন ছুড়লাম স্মরণের দিকে। স্মরণের জবাব
— শুধু ছোঁয়া না, তুমিও যাবে। ব্যাগ গোছাও।
— কোথায়?
— কানাডা। প্রিয়া আর অঙ্কন যাচ্ছে। ওদের সাথে তোমরাও যাবে।
আমি অবাক হলাম। হতবাক হয়ে জানতে চাইলাম

— কেন? আমরা বিদেশে কেন যাবো? আর আপনি কি দেশে থাকবেন?
— খেয়া, আমি যেতে বলেছি তাই যাবে ব্যাস। এতো প্রশ্ন কেন?
কঠিন তার গলার স্বর। স্বাভাবিক ভাবেই আমার চাপা রাগ হলো। ক্ষোভ হলো কেন সে আমার সাথে এভাবে কথা বলল? আমি কারো ধমক, আঘাত, অবহেলা সহ্য করতে পারি না তা কি সে জানে না?
— আমি যাবো না।

নিচু অথচ দৃঢ় কন্ঠে একথা বলেই বিছানার এক কোণে বসে পরলাম। স্মরণীয় আড় চোখে দেখলো একবার। অতঃপর রাগ সংবরণ করার বৃথা চেষ্টা চালিয়ে বলল
— মিনহাজ এসে তোমাকে ধরে নিয়ে গেলে তোমার ভালো লাগবে?
আমি একটা কথাও ব্যয় করলাম। তাকে উপেক্ষায় রাখলাম আপাতত। সে ভীষণ রেগে মেয়েকে তৈরি করলো। অতঃপর যখন আমার কাপড়ে হাত লাগাতে গেলো তখন আমি মুখ খুললাম। বললাম
— আমার ভিসা নেই। তাছাড়া আমি যাবোও না।
স্মরণ দমে গেলো। আমার পরের কথাটুকু মাথায় না নিয়ে সে কেবল ভিসার বিষয় টুকুই মাথায় রাখলো।

ছোঁয়া স্মরণের সঙ্গে বেশ ক’বার দেশের বাইরে যাওয়ার দরুন এবারে তার টিকেট নিয়ে কোনো ঝঞ্জাট হলো না।
স্মরণ এক ঘন্টার মাঝে মেয়েকে পরিপাটি করিয়ে আমায় সঙ্গে নিয়ে গাড়িতে উঠলো। অতঃপর ড্রাইভ করে ব্যাস্ত সরকে ছুটে চলল এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। মাঝখানে আধ ঘন্টার জ্যাম আমাদের পথ রোধ করলো। দুপুর তিনটায় ফ্লাইট। ঘড়ির কাটা দুইটা চল্লিশের নাগাল পেতেই অঙ্কনের ফোন। অতঃপর স্মরণের দ্রুত বেগে গাড়ি চালানো। এয়ারপোর্টে পৌছালাম ঠিক পৌনে তিনটায়। অঙ্কন আর প্রিয়া আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত। স্মরণ ছোয়াকে ছোট একটা চুমু দিয়ে দ্রুত অঙ্কনের হাতে ধরিয়ে দিলো। আবেগ ঘন কন্ঠে কেবল বলল

— ভাই, দেখে রাখিস।
অঙ্কন আশ্বাস দিয়ে বলল
— আল্লাহ দেখবে। তুই টেনশন নিস না। ছোঁয়া ভালো থাকবে।
আমার চেখে জল জমলো। জন্ম না দিলেও আমি ওর মা। ও আমার সন্তান। আমার স্নেহের পুরোটা জুড়ে ওর বসবাস, ওর অধিকার। আবার কবে দেখা হবে মেয়ের সঙ্গে? ভাবতেই চোখের জল গাল বেয়ে নামলো। প্রিয়া আমাকে জড়িয়ে ধরলো সেকেন্ড পাঁচেকের জন্য। অঙ্কন তখন হাঁটা দিয়েছে সম্মুখে। ছোঁয়া লাফিয়ে চলছে অঙ্কনের হাত ধরে। অঙ্কন বলতে পাগল মেয়েটা।

— সাবধানে থাকিস।
প্রিয়া বলে উঠলো। মাতৃত্বের সঙ্গে এবার বন্ধুত্বের মায়া উঁকি দিলো মনে। কান্না বুকের ভেতর হুটোপুটি খেতে লাগলো। চাপা স্বরে শুধু বলতে সক্ষম হলাম
— তুইও। নিজের খেয়াল রাখিস।

প্রিয়া কথা বাড়ালো না। আমার থেকে মুখ ঘুরিয়েই চোখের জল হাতের পিঠে স্থান দিলো। আর ফিরে চাইলো না ও। আমি কখন যেন স্মারণের পাশ ঘেঁষে দাড়িয়ে গেছি। শক্ত করে তার হাতটা ধরে তাকিয়ে আছি ওদের পানে। যেন কালবৈশাখী ঝড়ের মতো বিদায় দিলাম। স্বপ্নের চেয়েও সংক্ষিপ্ত সময়ে। হুট করেই, অবিন্যস্তভাবে।
— খেয়া, বাসায় চলো।

স্মরণের কন্ঠ কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই ফিরে চাইলাম তার দিকে। সে আমার হাতটা ধরে হাঁটতে লাগলো। মাঝপথে একহাত আমার চোখে রেখে চলতি দশায় মুছে দিলো চিবুকে লেপ্টে থাকা অশ্রু। তার যেন পা থমকে আসে মেয়ের মোহে। আমি যেন পায়ে শক্তি পাই না প্রিয়া ও ছোঁয়াকে অস্বাভাবিক ভাবে বিদায় দিয়ে।
— ছোঁয়াকে দেশের মধ্যেই কোথাও রাখা যেতো না? যখন তখন দেখতে পারতেন।
— রিস্ক নিতে চাইনা।
আমি নিশ্চুপ হলাম। স্মরণও নির্বাক। প্রিয়া আবার কবে আসবে? নাকি ও আসবে না? ওর শশুর শাশুড়ি দেশ ছেড়েছে দুমাস আগে। তাহলে কি প্রিয়াকে নিয়ে অঙ্কন একেবারে পারি জমালো বিদেশে? ভাবতেই বুকের মাঝে হাহাকারের ধ্বনি ওঠে।

বাসায় ফিরে স্মরণ তমসাচ্ছন্ন মুখে বসে রইলো কিছুক্ষণ। ইতিমধ্যে বাবা এলেন নিজ ঘর হতে। চোখে তার রাগ স্পষ্ট। আমি কিছুটা ভরকে গেলাম। স্মরণকে তিনি প্রথমে গমগমে কন্ঠে শুধালেন ‘ছোঁয়া কোথায়?’ অতঃপর যখন স্মরণ বলল ছোঁয়াকে অঙ্কনের সঙ্গে কানাডায় পাঠানো হয়েছে। তখন বাবা ক্ষুব্ধ হয়ে স্মরণ কে বেশকিছু কথা শোনালেন।

ব্যাবসা থেকে শুরু করে স্মরণের চাকরি, অথৈ সকল কিছু। স্মরণ কেবল নিশ্চুপ হয়ে শুনে গেলো। বাবা মিনিট দশেক পর বিদায় নিলেন। স্মরণও তখন ড্রয়িং রুম ছেড়ে টালমাটাল পায়ে ঘরের দিকে এগোলো। আমি এগোলাম আমার ঘরের দিকে। ঘরে পৌঁছাতেই প্রথমে নজর গেলো আমার বিছানার ওপর। এলোমেলো, অগোছালো। ছোঁয়া ঘরে বসে খেলছিলো বিধায় এই দশা।

শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ১৪

পরিপাটি করে গা এলিয়ে দেবো বলে ছোঁয়ার পুতুল সরিয়ে রাখতে গিয়ে আমি কিছুটা অবাক হলাম। পুতুলের পাশে রাখা অথৈয়ের একটা ছবি। হয়তো ছোঁয়ার মায়ের কথা মনে হওয়ায় সে ছবি দেখেছে। বিষয়টা এখানে শেষ নয়। অথৈয়ের পোষাকে আটকে গেছে আমার চোখ। সবুজ ধুতি পাজামার সাথে সবুজ ব্লাউজের ন্যায় এক জামা তার শরীরে। কোমরে বিছা, গলায় ভারি মালা, কানে ঝুমকো, মুখ ভর্তি মেকআপ-এ।

শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ১৬