শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ১৪

শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ১৪
আলিশা

শীতের মৌসুমে হঠাৎ বৃষ্টি। ঠান্ডা পৌঁছে গেছে আরো এক ধাপ উঁচুতে। ছোঁয়াকে হাত মোজা, পা মোজা পরিয়ে দিয়ে ড্রয়িং রুমে বসে টিভি দেখছিলাম। স্মরণ কোথাও বেরিয়েছে। গতকাল একাধারে নির্বুদ্ধিতার কান্ড ঘটানোর পর আমি আর স্মরণের কাছে সরি বলার সাহসটা যোগাতে পারিনি।
— খেয়া, এক কাপ কফি দে তো মা।

হঠাৎ বাবার আবদার। আমি উঠে চলে গেলাম রান্নাঘরে। চুলোয় চায়ের পানি বসিয়েছে তাকিয়ে রইলাম ছোট জানালা দিয়ে বাইরে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে বাড়ির সামনের বাগান সতেজ লাগছে। আজ কুয়াশা নেই। কেবল মেঘ আছে। তারাও ঘনকালো নয়। রান্নাঘরের জানালার নিচেই শিউলি ফুলের গাছ। পছন্দের ফুল। সহসা হাত বাড়ালাম ফুলের দিকে। অনেক পরিশ্রমের পর একটা ফুল হাতে পেলাম।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আরো একটা ফুল নেয়ার লোভ সামলাতে না পেরে আবারও হাত বাড়িয়ে দিলাম বাইরে। ঠিক তখনই নজরে এলো স্মরণের গাড়ি। গেইট দিয়ে প্রবেশ করছে। আমি চটজলদি হাত সরিয়ে নিলাম। আবার যদি তার নজরে পরি। আবার যদি দেখে আমি জানালা দিয়ে বৃষ্টি উপেক্ষা করে ফুল হাতড়ে পারছি। না জানি কি বলে ধমকে ওঠে। ডরই লাগে। চুপটি করে ভদ্র সেজে একটা ফুল নিয়েই সন্তুষ্ট থাকার চেষ্টা করলাম।

চায়ের পানিতে নজর দিলাম। ভেজা ফুল মুঠোয় নিয়ে প্রথমবার বন্ধ চোখে উপলব্ধি করতে চাইলাম বাবুকে। ভাবতে লাগলাম কি হতে পারে? মেয়ে না ছেলে? আমার ভাবনার মাঝেই আচমকা চিৎকার করে উঠলো স্মরণ। কাউকে শাসিয়ে কিছু বলার হুংকার। চমকে উঠলাম আমি। তড়িঘড়ি করে গ্যাস অফ করে ছুটলাম স্মরণের কন্ঠ অনুসরণ করে। তাকে ড্রয়িং রুমেই পেয়ে গেলাম। বিধ্বস্ত চেহারায়, শক্ত চেয়ালে, রক্তচক্ষুতে। বাবা তার পাশে দাড়িয়ে আছে। স্মরণের দৃষ্টি নিবদ্ধ ফেনের স্ক্রিনে। আমি এগিয়ে গেলাম। স্মরণের পাশ ঘেঁষে দাঁড়াতেই অক্ষিপটে ভেসে উঠলো একটা কালো মতন স্বাস্থ্যবান পুরুষের চেহারা। অতঃপর কানে এলো তার রাশভারি কন্ঠ

— অফিসার… তোমার ধমক দেখে আমি ভয় পেয়েছি। খুব ভয় পেয়েছি। বিশ্বাস করো কেঁদে দিচ্ছি আমি।
মিথ্যে অভিনয় তার। আমি উৎসুক হয়ে দেখতে লাগলাম। বাবাও দেখছেন। স্মরণ ফুসে উঠছে। হাতে পায়ে মৃদু কাঁপন ধরেছে তার। স্মরণের থেকে চোখ সরিয়ে ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই লোকটার আনন্দে ঝিলিক দেওয়া মুখখানা দেখতে পেলাম। তার খুশিতে গদগদে কন্ঠ

— তোমার বউ আমার কাছে। সেদিন তো মা*রি*নি রে। বাচিয়ে রেখেছি। তোর কাল করে। আমার হাতিয়ার করে। তুই বেডা বহুত চালাক বুঝলি….
কথার মাঝে লোকটা একটা পান মুখে পুরলো। সামনে তার ইয়া বড় থালা কেউ রাখলো। পাশে নজর করে দেখলাম একটা বন্দুক রাখা। লোকটার পেছনে বড় একটা টেবিল। তাতে আছে ছোট বড় ছুড়ি, চাকু, দা। বুকের ভেতরটা ছ্যাত করে উঠলো। এমন দৃশ্য টিভি, সিনেমা বৈ অন্য কোথাও দেখিনি আমি।

— এতো বার তোর বউয়ের কন্ঠ শুনালাম…. এতোবার শুনালাম তারপরও তুই বিশ্বাস করলি না? মনে সন্দেহ রাখলি….. অফিসার আমি এতোবড় নিমকহারাম না রে। তোকে ঠকাচ্ছি না। তোর বউ সত্যি আছে আমার কাছে। দেখবি?

শেষোক্ত কথায় স্মারণ হাশফাশ করে উঠলো। তার বুকের ঢিপঢিপ শব্দ যেন আমি অনুভব করতে পারছি। চোখের নিচে তার বিন্দু বিন্দু ঘাম জমলো। মুখাবয়বে ফুটে উঠলো অসহ্যকর এক পরিস্থিতি। যেন তার বুকের ক্ষত কেউ তাজা করছে। লবণ ছিটিয়ে দিচ্ছে। আমি কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে আছি। স্মরণ হা না জবাব দিলো না। নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলো ফোনের স্ক্রিনে।

লোকটা কাউকে আদেশ করলো পেছনের ক্যামেরা চালু করতে। কেউ আদেশ মানলো ঝটপট। যতটা দ্রুত সে ক্যামেরা চালু করলো ঠিক ততটা দ্রুতই স্মরণ কেমন যেন হয়ে বসলো। চোখের সামনের দৃশ্য দেখল সে হাতের শক্তি হারিয়ে ফোন ছেড়ে দিতেই আমি খপ করে ধরলাম তার হাত। এলোমেলো চুলের শ্যমলা রমণীকে দেখে আমারও অন্তর আত্মা কেঁপে উঠলো। কিছুসময়ের জন্য স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম ফোনের দিকে। স্মরণের চোখে জল জমেছে। জলজ্যান্ত অথৈ যে তাকিয়ে কাঁদছে। স্মরণ এপাশ হতে ডেকে উঠলো নরম সুরে অবাক কন্ঠে

— অথৈ…
অথৈ কান্না মিশ্রিত স্বরে বলল
— স্মরণ, তোমাকে ওরা আনতে চায় এখানে। আমার যাই হয়ে যাক তুমি কিন্তু আসবে না। আমাকে মেরে ফেললেও এসো না। ওরা তোমাকে মেরে ফেলতে চায়।
একথা বলতেই দৃশ্য পরিবর্তন হলো। আবারও সামনে এলো কালো লোকটা। তার দাবি এবার সে ব্যক্ত করলো
— বউয়ের জন্য দরদ উতলাচ্ছে? বউ চাস? বউ চাইলে তুই কেইস ছেড়ে দে। তোর কাছেই আমার সব ডিটেইলস আছে। ফাঁস করিস না। আজকের মধ্যে তুই কেইস ছাড়বি। আমার লোক যা করার করবে। বাঁধা দিবি না। কেইসে তুই কাউকে সাহায্য করতে পারবি না।
স্মরণ ভাবলো কিছু সময়। অতঃপর শুঁকনো ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলল

— কোন অফিসার কে কিনে রেখেছিস?
ফোনের স্ক্রিনের লোকটা হো হো করে হাসতে হাসতে হঠাৎই ফোন কাটলো। জবাব দিলো না স্মারণের প্রশ্নের। ফোন কাটতেই স্মরণ নিজের মাথায় হাত রেখে মুঠোভর্তি চুল টেনে ধরলো। চোখে মুখে হাত রেখে দাপিয়ে উঠলো। আচমকা ধুপ করে বসে পরলো সোফায়। কিছুসময় অশান্ত হয়ে কাটিয়ে সে ছুটলো ঘরের পানে। দরজা বন্ধ করলো। আমি তার যাওয়ার পানে নিষ্পলক তাকিয়ে রইলাম।

চোখে জল জমে টইটম্বুর হতেই বাবা পেছন হতে আমার মাথায় হাত রাখলেন। দু ফোঁটা অশ্রু তখন চোখ ছেড়ে স্থান নিলো আমার শাড়ির ভাঁজে। দৌড়ে চলে গেলাম নিজ ঘরে। চোখে পানি আসায় নিজেকে নিজে ধিক্কার দিলাম। একটা সন্তান তার মাকে পাবে। একজন ক্ষত বিক্ষত হৃদয়ের স্বামী তার স্ত্রী কে পাবে। আমার খুশি হওয়া উচিত। শুকরিয়া আদায় করা উচিত। আমি খুশি হলাম। জোর করে মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে আবারও চলে গেলাম চা বানাতে।

স্মরণ বন্দ ঘরের দরজা খুলল প্রায় তিন ঘন্টা পর। তখন এশার আজান পরছে চারদিকে। আমি ছোঁয়ার সঙ্গে বসে ওর পুতুল খেলা দেখছিলাম। স্মরণ এঘরে এলো। চোখ দু’টো তার ফোলা। নাকের ডগায় জমে আছে রক্ত। আলমারি থেকে নিঃশব্দে জ্যাকেট বের করে গায়ে চাপিয়ে সে আবারও প্রস্থান করলো। আমি তার পিছু নিলাম। নিজের রিডিং রুম পেরিয়ে সে কেন যেন পৌঁছে গেলো আমার রুমে। আঁধারে আচ্ছাদিত রুমের বেলকনির দরজা খুলে বসলো চেয়ারে। হাতের দু আঙ্গুলে মাথার ভর ছেড়ে অনড় হয়ে বসে রইলো। আমি পাশে দাড়ালাম তার। কাঁধে হাত রাখতেই মুখ তুলে চাইলো। অতঃপর আমার হাত ধরে বসে রইলো প্রায় মিনিট পাঁচেক। কম্পমান কন্ঠে বলল

— আমি এখন কি করবো খেয়া? একদিকে আমার আনন্দ। অন্যদিকে বিপদ।
— রাজি হয়ে যান ওদের শর্তে। বেশি কিছু তো চাইছে না ওরা। শুধু চাইছে আপনি যেন কেইস সলভ না করেন। কোনো তথ্য যেন না দেন।

শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ১৩

স্মরণ আমার কথার পিঠে ঘন আঁধারের মাঝে দৃষ্টি ফেলে রাখলো। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস বুকের ভেতর হতে মুক্ত করে দিয়ে ভাবলাম, এই কঠিন সময়ে স্মরণ আমায় পাশে চাইছে, একটু সাহস কামনা করছে। তবে অথৈ ফিরে এলে সে আমাকে ভুলে যাবে না তো? অবহেলায় দূরে ঠেলবে না তো?

শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ১৫