শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ১৩

শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ১৩
আলিশা

একগঙ্গা চিন্তা মনে রেখে বাসায় ফিরতেই বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠলো। রিকশা থেকে নেমে বাড়ির গেইট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখি ড্রয়িং রুমে স্মরণ বসে আছে অনিমিখি চাহনিতে। মেঝেতে দৃষ্টি আবদ্ধ তার। থমথমে পরিবেশ। আমার পরিস্থিতি ভুলে মনোনিবেশ করলাম স্মরণের প্রতি। ধুকপুক করা বুক নিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম তার নিকট। কিছুটা ভয় মনে ছেয়ে রইলো। তার গাম্ভীর্য বড্ড ভয় লাগে আমার। তবুও ঢোক গিলে শুকনো গলায় শুধালাম

— কিছু হয়েছে?
আমার কন্ঠ বাতাসে ছড়িয়ে বোধ হয় এঘর ওঘর ছোটাছুটি করলো। তবে স্মরণের কানে যেন পৌছালো না। সে পূর্বের ন্যায় স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। আমি আবরও মুখ খোলার পূর্বেই সে আকস্মিক হাতের কাছের ফুলদানি ধাক্কা দিয়ে উঠে দাড়িয়ে অগ্নি ঝরা দৃষ্টি নিয়ে চেচিয়ে বলে উঠলো

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— তোমার কোনো কমন সেন্স আছে খেয়া? তোমার কোনো ধারণা আছে তুমি কি করেছো?
চমকে উঠলাম আমি। শখের ভাঙা ফুলদানি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে স্মরনের পানে নিক্ষেপ করতেই তার কঠিন দৃষ্টি যেন ঝলসে দিতে চাইলো আমাকে। চোখ নামিয়ে নিলাম। আবারও ভাঙা ফুলদানিতে তাকিয়ে বললাম
— কি করেছি আমি?
আমার মিনমিনে কন্ঠস্বরের বিপরীতে তার কঠিন স্বরের প্রশ্ন
— কোথায় গিয়েছিলে?

আমি দাপিয়ে উঠলাম ভেতর থেকে। কি জবাব দেবো? ভাবনার মাঝেই স্মরণ আমার হাত ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে ফোন খুঁজে বের করলো। লক ছাড়া ফোনটা অন করে কল অপশনে গিয়ে আমার সামনে ফোন উঁচু করে ধরে বলল
— কত বার ফোন করেছি আমি? একশো এক বার।
একথা বলেই সে ফোনটা ছুড়ে ফেলল সোফার ওপর। আমি নত মাথায় দাড়িয়ে রইলাম। ফোন মিউট করা থাকলে তো আমার পক্ষে বোঝা অসম্ভব যে ফোন করেছে কেউ। আর দুই ঘন্টার ব্যবধানে এতো অস্থির হওয়ার কারণ খুঁজে পেলাম না আমি।

— খেয়া, তোমাকে রাতে এতোকিছু বললাম। এরপরও তুমি কিভাবে আজ বাড়ির বাইরে যাওয়ার সাহস পাও? তাও আমাকে না জানিয়ে? বলছি তো ওরা আমার পিছে লেগেছে। যে কোনো মুহূর্তে আমার ক্ষতি করবে। তুমি বুঝতে পারছো না আমি কেন ওদের বিরুদ্ধে স্টেপ নিচ্ছি না? পুলিশ, টিম নিয়ে ওদের ধরা আমার দু সেকেন্ডের কাজ। কিন্তু কেন আমি ধরছি না? তোমার জন্য, ছোঁয়ার জন্য। বিরোধটা ওদের সাথে আমার ব্যাক্তিগত হয়ে গেছে।

আমি চমকে উঠলাম। বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম সে কথা। স্মরণ আরো কিছু বলল। চড়া মেজাজ নিয়ে সে শেষ মুহূর্তে গটগট করে চলে গেলো নিজের রুমে। আমি ধপ করে বসে পরলাম সোফায়। সত্যি তো! যদি আজ আমাকে তুলে নিয়ে যেতো অথৈয়ের মতো? ভাবতেই গায়ে কাটা দেয়। মগজে খেলে যায় একটা কথা। ‘আমি এখন একা না’।

রাগের দরুন আমার সাথে কথা বন্ধ হলো তার। পাশ দিয়ে আওয়াজ তুলে হেঁটে গেলেও সে যেন শুনতে পায় না। তার পাশে বসলেও সে চোখ তুলে তাকায় না। ছোঁয়াকে স্কুলে পাঠাবে না একথা আমাকে না জানিয়ে জানালো খালাকে। আমি ভেতরে ভেতরে অনুতপ্ত হলাম। তবে যে কারণে গিয়েছিলাম হসপিটালে সে কারণ যে তাকে বলতে চাই না। মন সায় দেয় না। অনিশ্চিত পরিস্থিতি, দ্বিধান্বিত তাকে আবারও নতুন কোনো চিন্তা দিতে মন চাইছে না।

আমি না হয় অপেক্ষায় রইলাম এই পরিস্থিতি কেটে ওঠার। অতঃপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবো যে আসছে তার কথা তার বাবাকে জানাবো কিনা। এখন আপাতত আমার পতির রাগ ভাঙানো অতিব জরুরি। পাশে বসে তাকে আশ্বাস দেওয়া দরকার। ভাবনা মতন চলে গেলাম স্মরণের কাছে। সে বেলকনিতে বসে ব্যাস্ত নগরি দেখছিলো অপারদর্শী হয়ে।

আমার হাতে এক কাপ কফি ছিলো। একটু শব্দ করে তার পাশের টুলে রাখলাম কফির মগ। সে যেন ভুল করে একবার আমার পানে চাইলো। অতঃপর পড়িমরি করে চোখ সরিয়ে নিয়ে দৃষ্টি ফেলল অজানায়। আমি গলা পরিষ্কার করলাম। সে চাইলো না তবুও। আমি হাটাহাটি করলার বেলকাণি জুড়ে। হাঁটতে গিয়ে তার কলাপাতা রঙের চেয়ারের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটালাম ইচ্ছে করে। এবার সে একটা চাহনি দিলো। যে চাহনিতে ছিলো রাগ, রাগ ও রাগ। আমি বরাবরের মতোই মিহি সুরে বললাম

— আমার হাঁটতে সমস্যা হচ্ছে। কেউ যদি সরে বসে ভালো হয়।
স্মরণ বিনাবাক্যে চেয়ার থেকে উঠলো। অতঃপর রাগের সামান্য বহিঃপ্রকাশ ঘটালো ঠাস করে চেয়ার প্রতিস্থাপন করে। তবুও মুখ খুলল না। আমি কিছুটা পরাজিত সৈনিকের মতো মনঃক্ষুণ্ন হয়ে দাড়িয়ে রইলাম বেলকনিতে। তবুও তার ভাবান্তর হলো না। উপায়ন্তর না পেয়ে আমি রুম থেকে চেয়ার এনে তার পাশে রেখে বসলাম । সে এবারেও দৃঢ় পাহাড়ের মতো, রোবটের মতো। নড়চড় করা যেন তার মানা।

— সরি।
ছোট করে বললাম। স্মরণ এবার মুখ খুলল
— আমার হাতের আঙ্গুলে চেয়ারের চাপ লেগেছে?
চিবিয়ে বলা কথা। আমি হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে রইলাম স্মরণের দিকে। অতঃপর যখন ভোঁতা মস্তিষ্ক আচমকা তীক্ষ্ণ হয়ে বলে উঠলো আমার চেয়ার আর তার চেয়ারের হাতের মাঝখানে তার নখ অসহায় হয়ে চাপায় পরেছে তখন আমি তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়াই।

দুই চেয়ারের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করতেই স্মরণ তার রক্তজমা শাহাদাত আঙ্গুল বের করে। আমি অস্থির চোখে বেয়াক্কেল চাহনি নিয়ে তাকিয়ে রইলাম স্মরণের দিকে। মুখে শাড়ির আচল রেখে কামড়াতে লাগলাম। যে কেউ আমার এহেন দশা দেখে বলবে, নিশ্চয়ই আমার শাড়ির আঁচলে অমৃত আছে। স্মরণ হাত ঝাকাঝাকি করছে। বার কয়েক চোখ বন্ধ করছে ব্যাথার তীব্রতায়।

হঠাৎ আমার মনে হলো তাকে বরফ এনে দেওয়া দরকার। ছুটলাম রান্নাঘরে। ফিরে এলাম বুলবুলি ঝড়ের বেগে। স্মরণের হাতে বরফ চেপে ধরতেই সে অসহ্য মুহূর্তের জানান দিলো ব্যাথাতুর শব্দ উচ্চারণ করে। আমি নিরুপায়, অবলা, অসহায় নারী ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। সে একবার আমার পানে তাকিয়ে পৃথিবীর সমস্ত আফসোস বুকে চেপে বলে উঠলো

— আল্লাহ, একটা বউ দিয়েও শান্তি হলো না।
একথা বলেই হনহন করে চলে গেলো রুমের বাইরে। আমি অতিষ্ঠ আমার প্রতি। অতিষ্ঠ আমার কান্ডকারখানার প্রতি। দুঃখে ভরা মন নিয়ে আমি একাই বসে রইলাম চেয়ারে। টুল থেকে কফির মগ হাতে তুলে তাতে চুমুক দিয়ে বুদ্ধি খুলতে চাইলাম। কিভাবে আবার সরি বলা যায়?

কিভাবে তার তিক্ত মুহূর্তকে পরপর দু’বার ঘেঁটে দেওয়ার জন্য মাফ চাওয়া যায়? উপায়ন্তর খুঁজবো বলে কফির মগে চুমুক দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে আমার আরো একটা নির্বুদ্ধিতা প্রকাশ পেলো। কফির কণা বিক্ষোভ, প্রতিবাদ, মিছিল শুরু করলো আমার জিহ্বার ওপর। তাদের এই হট্টগোল, হর্তালের রেশ পৌঁছে গেলো আমার তলপেটের তলদেশে। পড়িমরি করে কফি মুখ থেকে ছিটকে ফেলি। তার স্বাদ কেবল নোনতা, নোনতা আর নোনতা। চিনির জায়গায় লবণ দিয়েছি? ইয়াক! হে আল্লাহ, আমার মাথার ব্রেন কোথায় খুলে পরে গেছে?

— মা, বাবা কফিটা চায়?
আমার ইয়াক দশার মাঝে ছোঁয়ার কন্ঠ। এই কফি? স্মরণ চায়? তড়িঘড়ি করে বেলকনি দিয়ে কফি ফেললাম। অতঃপর শূন্য মগ নিয়ে ছুটতে ছুটতে বললাম
— কফি তো আমি খেয়ে ফেললাম।

শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ১২

এবার স্মরণের কন্ঠ হতে ধ্বনিত হলো
— আমিও তো দেখলাম বেলকনি দিয়ে কি কালো বৃষ্টি হলো।
থমকে গেলো আমার পা। চোরাচোখে সামনে তাকাতেই দেখি খচ্চর লোকটা আয়নায় সামনে দাড়িয়ে শার্টের বোতাম লাগাচ্ছে।

শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ১৪