শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ১২

শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ১২
আলিশা

ছোঁয়া আমার ঘর থেকে বিদায় নিতেই আমি ঘুমের রাজ্যে পারি জমিয়েছিলাম। এশার আজান শ্রবণ হতেই ঘুম ভাঙলো। বিছানা ছেড়ে ওযু করে নামাজ পরে এগিয়ে গেলাম খাবার টেবিলের নিকট। জয়নব খালা বিদায় নিয়েছেন। বাবা গেছেন মসজিদে। স্মরণের ঘরে উঁকি দিতেই দেখলাম সে ঘুমে বিভোর। ছোঁয়া তার বুকের ওপর। মেয়েটাও ঘুমিয়ে গেছে এলোমেলো ভঙ্গিতে। কাচুমাচু তার ছোট দেহ। জানালার পাল্লা তখনও খোলা, পর্দা উড়ন্ত মৃদু হাওয়ায়। আমি চটজলদি জানালা বন্ধ করলাম। শীতের পাতলা কম্বল বাবা মেয়ের ওপর ছড়িয়ে দিতেই চোখ মেলে চাইলো স্মরণ। বলে উঠলো

— কয়টা বাজে?
বলতে বলতেই সিথান হাতিয়ে ফোনের স্ক্রিনে সময় দেখলো। অতঃপর উঠে বসলো। সময় নিয়ে ছোঁয়াকে দেখে ফ্রেশ হতে চলে গেলো ওয়াশরুমে। আমি ততক্ষণ বসে রইলাম বিছানায়। স্মরণ ফিরে এসে আলমারি থেকে জ্যাকেট বের করে গায়ে জড়ালো। অতঃপর হাতে একটা চাদর নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বলল

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— ছোঁয়া কে নিয়ে আজ সারাদিন বাইরে ছিলাম। ওকে একটু রেস্টুরেন্ট, পার্ক, ওর নানুর বাসা দিয়ে ঘুরিয়ে আনলাম।
একটুকু বলেই স্মরণ বিরতি নিলো। তার বিরতির মাঝে আমি ঠান্ডা মস্তিষ্কে বলে উঠলাম
— অথৈয়ের বিষয়টা আপনার কি মনে হয়?
— তুমি আমার রিডিং রুমে গিয়েছিলে?
বুকের ভেতর ধুম করে যেন কিছু পরলো। কিছুটা থতমত খেয়ে গেলাম আমি। তবুও শান্ত থাকার মিথ্যা অভিনয়ে গা ভাসিয়ে বললাম

— হুম।
— দুদিন আগে মাঝ রাতে আমার কাছে একটা ফোনকল আসে। অথৈকে যারা…… ওইখান থেকেই। আমি…..আমি ফোনটা রিসিভ করার আগে জানতাম না ওটা ওদের নাম্বার। ফোন রিসিভ করতেই কান্নার শব্দ। তারপর অথৈয়ের কন্ঠ। আমার নাম ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ওকে ওরা আটকে রেখেছে। ওরা খুব অত্যাচার করছে। জেল থেকে বড় শয়তানকে জাবিন হয়েছে এই খবরটা আমি জানতাম না।

কথাটুকু রাগের সহিত ব্যক্ত করেই স্মরণ আমার দিকে ফিরে চাইলো। তার অনুভূতি তখন পাল্টে রূপ নিলো অসহায়ত্বে। পুনরায় আমার পাশে বসে অস্থির চিত্তে বলতে লাগলো
— খেয়া, আমি দিশেহারা। আমি বুঝতে পারছি না এগুলো কি হচ্ছে। আমার অথৈ সত্যিই যদি বেঁচে থাকে তাহলে ও এতোদিন কোথায় ছিলো? কেন যোগাযোগ করলো না আমার সাথে?

আমার কি করা উচিত এখন? গত দু’দিন হলো ভেবে যাচ্ছি কোনো ক্লু পাচ্ছি না। ওরা কোনো দাবি দেখাচ্ছে না। শুধু অথৈয়ের কন্ঠ শুনিয়ে আমাকে পাগল করে ছাড়ছে। টিম, ফোর্স কাউকে ইনফর্ম করতে পারবো না। যদি অথৈ থেকে থাকে আর যদি ওর ক্ষতি করে দেয়?

ছলছল চোখে কথাগুলো ব্যক্ত করে স্মরণ নিশ্চুপ হলো। আমি ভাবশূন্য হয়ে তাকিয়ে রইলাম স্মরণের পানে। কেমন অভিব্যাক্তি প্রকাশ করা উচিত আমার? ভুলে গেলাম যেন। শুধু স্মরণের হাতের ওপর হাত রেখে বললাম
— যদি অথৈ ফিরে আসে তাহলে আপনি অনেক খুশি হবেন তাই না?
স্মরণের জবাব হলো

— মেয়েটা মায়ের জন্য পাগল খেয়া। নতুন করে ওরা আশা দেখিয়ে দিলো ছোয়াকে। আমি সামলাবো কিভাবে?
স্মরণ হয়তো আমার প্রশ্নের পাশ ঘেঁষে জবাব দিয়ে দিলো। স্বইচ্ছায়? নাকি অনিচ্ছায়? জানা নেই। ভাবতে গেলাম না এবিষয় নিয়ে। মাপলাম শুধু তার বুকের কষ্ট। ভাবলাম ছোঁয়ার কথা। যদি ওরা মিথ্যে আশা দেয়? মেয়েটাকে কি সামলানো যাবে? ছোট হৃদয় ভেঙে যাবে। কাঁচের টুকরোর ন্যায় চূর্ণবিচূর্ণ হবে।

— আমি তোমাকে এসবের মধ্যে ইনভলভ করতে চাইছিলাম না খেয়া। তাই কিছু জানাইনি।
আমি হালকা হেঁসে স্মরণের হাতটা শক্ত করে ধরে ছোট করে বললাম
— হুম।

স্মরণ আর কথা বাড়ালো না। আমার পাশ থেকে উঠে দাড়িয়ে মেঝেতে বিছিয়ে নিলো জায়নামাজ। অতঃপর মন বদ্ধ করলো নামাজে। সানা পড়ে, নিয়ত করে এশার নামাজ আদায়ে মগ্ন হলো। আমি তাকিয়ে রইলাম তার পানে। আমার অভিমান যেন গলে গেলো। স্মরণের দোষত্রুটি মুছে গেলো মনের দেয়াল হতে। নিজের দুঃখ ছাপিয়ে এবার মন চলে গেছে অথৈয়ের কাছে। সে কি সত্যি বেঁচে আছে? সে কিভাবে খু*ন হয়েছিল? জাহিন বলেছিল ভিডিও কলে স্মরণের চোখের সামনে তাকে খু*ন করা হয়েছে। আচ্ছা যদি চোখের সামনে একটা মানুষ কে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় দেওয়া হয় তবে সে ফিরে আসে কি করে? ভাবনার মাঝে মন বলল, একবার জাহিনের সঙ্গে কথা বলতে হবে। আবারও বিস্তারিত শুনতে হবে।

— জাহিন ভাই, পাত্রীও দেখতে বলছেন না। বিয়ের দাওয়াত তো দিচ্ছেন না। আপনার স্যার পরপর দু’টো সংসার করলো। আর আপনি একটা সংসারও এপর্যন্ত বাঁধতে পারলেন না।
আজ আমার হসপিটাল থেকে রিপোর্ট সংগ্রহ করার কথা ছিলো। সে উদ্দেশ্যেই বাসা থেকে বের হলাম। তবে জাহিন ভাইয়ের থেকে পুরোনো ঘটনা পুনরায় শুনবো বলে তাকে আসতে বলেছি। বলেছি আমাকে ভার্সিটি পৌঁছে দেয়ার জন্য। সে আমাকে ভার্সিটি নামিয়ে দিলে আমি সেখান থেকে রিকশা ধরে পৌঁছে যাবো হসপিটালে। এমনই মতলব এঁটেছি মনে মনে।

— না ম্যাম, এখন বিয়ে করার ইচ্ছে নেই। সময় এখনো হয়নি।
মনে ষোলোকলা চিন্তা নিয়ে বাইরে মজা করার ভান করছিলাম আমি। আমার যেন পান থেকে চুন খসলেই জাহিন সংবাদ পাঠায় স্মরণের নিকট। হসপিটালে যাওয়া আসার বিষয়টা সম্পূর্ণ লুকায়িত। একথা কাউকে জানাতে চাইছি না আমি।

— বুঝলেন জাহিন ভাই, ছোঁয়া ইদানীং ওর মায়ের জন্য খুব কান্নাকাটি করে। সামলাতে পারি না মাঝে মাঝে। কারা ওটুকু মেয়েকে এমন করে অসহায় করলো? মানুষের কি বিবেক নেই? একটা পেশার জন্য এভাবে সব ওলটপালট হলো।

— হ্যা ম্যাম। তখন স্মরণ স্যার ডিউটিতে ছিলো। এদিকে অথৈ ম্যাম বাবার বাড়ি থেকে ফিরছিলো। রাস্তার মাঝ থেকে তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে প্রথমে রে**প, তারপর গ**লা কেটে হ*ত্যা করা হয়। গলা কাটার আগে স্যারকে ভিডিও কলে রাখা হয়। কিন্তু স্যার তো চোখ বন্ধ করে ছিলো। ওরা গলায় ছুড়ি ধরেছিল। তারপর ম্যামের একটা চিৎকার শুনেছে স্যার। গলা কা*টা*র দৃশ্য উনি দেখেননি।

জাহিন ফটাফট সব বলে দিতেই আমিও চিন্তার সাগরে হাবুডুবু খেতে লাগলাম। মৃ*ত্যুর দৃশ্য কেউ দেখেনি। আর যে লা*শ দা*ফ*ন করা হয়েছে তার অর্ধমুখ থেঁ*ত*লে গিয়েছিল। অতঃপর বলা যায় অথৈয়ের মৃ*ত্যু হয়েছে তা সুনিশ্চিত হয়ে বলা যায় না। বেচে থাকলেও থাকতে পারে। হাত পা মৃদু কেঁপে উঠলো আমার।

একটা মানুষের বেঁচে থাকার সংবাদে আমার খুশি হওয়া উচিত। তবে খুশি হয়েও যেন দুঃখের সহিত খুশি হবো আমি যদি অথৈ ফিরে আসে। ভাবনার মাঝে জাহিন ডেকে উঠলো। ভার্সিটি পৌঁছে গেছি। আমি গাড়ি থেকে নামলাম। জাহিন চলে গেলো। ঘুরিয়ে পেচিয়ে জাহিনের থেকে এতো শোনার একটাই কারণ ছিলো। ঘরের কথা বাইরে প্রকাশ করতে নেই। হয়তো স্মরণের খুব আপন কেউ জাহিন তবুও আমি বলতে দ্বিধা বোধ করলাম। যদি স্মরণ নিজেই না বলে থাকে অথৈ ফিরে আসার কথা?

শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ১১

হসপিটালে পৌঁছে রিপোর্ট হাতে পেতেই অসাড় হয়ে এলো হাত পা। রিপোর্ট পজিটিভ। মানে আমি অন্তঃসত্ত্বা। সাত সপ্তাহ চলছে। আমি কি খুশি হবো? নাকি আফসোস করবো তা বুঝে উঠতে পারলাম না। থম মেরে দাড়িয়ে রইলাম ক্ষণকাল। একথা স্মরণ কে জানালে তার অভিব্যাক্তি কেমন হবে? ভাবতে গিয়ে থমকে গেলাম। জানাবো তাকে? এমন পরিস্থিতিতে?

শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ১৩