বুকে যে শ্রাবণ তার সিজন ২ পর্ব ৭

বুকে যে শ্রাবণ তার সিজন ২ পর্ব ৭
নিশাত জাহান নিশি

ইশ, কি রোমান্টিক মুহূর্ত। বড়ো ভাইয়ের চেয়ে ছোটো ভাইয়ের তাড়া বেশি। বলছি কি বিয়েটা আমার হচ্ছে, তোদের নয়।”
সাহিলের আকষ্মিক আগমনে ও টিটকারিপূর্ণ কথাবার্তায় তৎক্ষণাৎ সামান্তা ও মিশাল দুজন দুজনকে ছেড়ে দাঁড়ালো।

জীবদ্দশায় এই প্রথম সামান্তা “লজ্জা” নামক বিষয়টির মুখোমুখি হলো। কেননা, এই প্রথম কেউ তাকে এতোটা অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখতে পেল। সামান্তা নিজেও বুঝে ওঠতে পারেনি মিশালের সাথে সে এতোটা ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে লিপ্ত হবে। আবেগ তাকে আঁকড়ে ধরবে। লজ্জায় শিওরে ওঠে সামান্তা মাথা নুইয়ে দৌঁড়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল। সাহিলের দিকে মিশাল ইতস্তত দৃষ্টিতে তাকালো। মাথা চুলকে শুধালো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“তোমরা কি আজই বাসর করবে?”
“হোয়াট আর ইউ টকিং ব্রো? বিয়ে হবে আজ, তো বাসর কবে হবে?”
“না মানে, বাসরটা কয়েকদিন পরে করলে হয়না?”
“মানে?”
“আরে বুঝতেছনা?”
“কি বুঝব?”

নিগূঢ় অসহায়ত্ব ফুটে ওঠল মিশালের চোখে-মুখে। ঠোঁট উল্টে ভোলাভালা ভাব নিয়ে সে সাহিলের দিকে তাকিয়ে রইল। ইঙ্গিতে কিছু একটা বুঝালো। মিশালের মনের ভাব বুঝতে কিঞ্চিৎ সময়ের ব্যয় ঘটলেও সাহিল অবশেষে তা বুঝতে পারল! ক্রুর হাসল সাহিল। শার্টের কলারটি পেছনের দিকে ঝেরে ফেলে রঙ ঢঙ করে হেঁটে এগিয়ে এলো মিশালের দিকে। ধপ করে বিছানার ওপর বসে গেল সে। অগত্যা,হাতের কব্জির সাহায্যে হেলান দিয়ে বসল। বেশ ভাবজড়িত গলায় বলল,

“কেন রে? তোর কি খুব জ্বলছে? বাসর রাতওয়ালা ফিলিংস হচ্ছে তাইনা? ফিলিংস হচ্ছে হোক, আমি তোর ফিলিংসের বারোটা বাজানোর লোক!”
ভ্রু যুগল কুঁচকে এলো মিশালের! কপালেও ভাঁজ পরল। মিশালকে আরও একটুখানি উস্কে দিতে বেহায়া ভাব নিয়ে সাহিল ঠোঁট কামড়ালো! বেশরম গলায় বলল,
“উফ, আজ যা মজা হবেনা!”

চটে গেল মিশাল! রাগান্বিত ভাব নিয়ে সাহিলের পাশে বসল। ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বলল,
“হেই লিসেন? এসব নটাংকি ভাব করা ছাড়ো। আমি ‘গে’ নই যে তুমি আমার সামনে ঠোঁট কাঁমড়াবে, আর আমি তোর প্রতি ইমপ্রেস হবো! লাস্ট টাইম বলছি আমি তোমাকে আজ কিছুতেই বাসর করতে দিবনা ভাইয়া। আমরা দুইভাই একসাথে মিলে বাসর করব, আর একসাথেই বাচ্চার বাপ হবো! এন্ড দিস ইজ ফাইনাল।”
আকাশ থেকে যেনো টুপ করে পরল সাহিল। মেজাজ বিগড়ে গেল তার। মিশালের কথার সাথে একমত হতে পারলনা সে। তিরিক্ষিপূর্ণ গলায় বলল,

“চাল হাট! আইছে, একসাথে বাসর করবে। আমি তোর বড়ো ভাই ওকে? তোর আগে আমার বাসর করা প্লাস বাপ হোনা বানতা হে! জানিস? এই মহা আকাঙ্ক্ষিত রাতটির জন্য আমি কতো কাল ধরে তপস্যা করেছি। আর তুই কিনা এসেছিস আমার দুর্বল জায়গায় বেগড়া দিতে?”
“ঐ দুর্বল জায়গাটা একটু সামলে রাখোনা ভাইয়া! কয়েকটা দিনেরই তো ব্যাপার! অন্যভাবে ম্যানেজ করে নাও!”
“হোয়াট? কয়েকটা দিনের ব্যাপার মানে?”
“মানে, কয়েকদিন পরেই তো আমি বিয়ে করছি!”
“রিয়েলি?”

“হ্যাঁ। আমি অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছি ভাইয়া, আমার বিয়েটা করে ফেলা উচিৎ। আজকাল আমার বিশ্বাস হতে শুরু করেছে যে বিয়ে এমন একটা চমৎকার জিনিস, এই বিয়ের পরই সব মুসকিল আছান হয়ে যায়! আমার মনে হচ্ছে আমার সব সমস্যাগুলোর সমাধান বিয়ের পরেই হবে। যদিও এসব মুরুব্বিদের কথা। মাঝে মাঝে মুরুব্বিদের কথাও কিন্তু সত্য হয়ে যায়।

এখন যেমন আমি ভবঘুরেভাবে চলি, এটা ওটা খেয়ে বেড়াই, শুধু মা-বোনের চিন্তা মাথায় রেখে চলি তখন কিন্তু আমার ওপর আরেকটি গুরু দায়িত্ব পরবে, আমার নিজের একটি সংসার হবে, নতুন একজন মানুষ আমার জীবনে আসবে, তার সাথে আরও কিছু নতুন প্রাণের জন্ম হবে, সর্বক্ষণ যাদের উপস্থিতিতে আমার মধ্যে নতুন কিছু করার স্পৃহা জাগবে, নতুন এক আমিকে আবিষ্কার করতে পারব, একটি সুশৃঙ্খল নিয়মের মাঝে আমার জীবন বাঁধা পরবে। আর এটাই তো জীবন ভাইয়া। এমন জীবন তো প্রত্যেকেই চায়। তো আমি কেন এর ব্যতিক্রম হবো? আমি বিশ্বাস করি আমার সামান্তা আমার জীবনটাকে পুরোপুরিভাবে বদলে দিবে। আমার মধ্যে যেসব খামতি রয়েছে তা শুধু সামন্তাই ঠিক করতে পারবে।”

দরোজার আড়াল থেকে আড়ি পেতে সব শুনছিল সামান্তা। চোখে তার আনন্দ অশ্রু! অবশেষে এই কঠিন মানুষটি গললো বলে। দ্বিধাহীনভাবে কেমন স্বীকার করল তার জীবনে সামান্তার প্রয়োজন ঠিক কতখানি। এই মিষ্টি স্বীকারোক্তির জন্যই তো সামান্তা বছরের পর বছর অপেক্ষা করে গেছে। আজ তার দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটল। চোখ বুজে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ালো সামান্তা। দুচোখের কোটর বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরছিল তার। ইতোমধ্যেই সাইফা পাশের রুম থেকে বের হতে গিয়ে সামান্তাকে কান্নাজড়িত অবস্থায় দেখে ফেলল। উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠল সে। দৌঁড়ে এলো সামান্তার নিকট। সামান্তার মুখোমুখি দাড়িয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,

“কি ব্যাপার আপু? তুমি কাঁদছ কেন?”
তৎক্ষণাৎ সামান্তা চোখ খুলে সাইফার মুখ চেপে ধরল। থতমত খেয়ে মিনিমিনিয়ে বলল,
“চুপ। মিশাল ভাইয়া টের পেয়ে যাবে।”
এই বলে নির্বোধ সাইফাকে নিয়ে সামান্তা জায়গা পরিত্যাগ করল। দ্রুত পায়ে হেঁটে পাশের রুমে চলে গেল। জেনিয়াকে নব বৌয়ের বেশে সাজানো হয়ে গেছে প্রায়। এবার শুধু শাড়ি পরানো বাকি। আর এজন্যই সামান্তাকে খুঁজছিল সাইফা। তাদের মধ্যে কেবল সামান্তাই ভালো শাড়ি পরাতে পারে। ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় সামান্তাকে দেখে তৎক্ষণাৎ পিছু ঘুরে তাকালো জেনিয়া। সামান্তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসল। আবদার সূচক গলায় শুধালো,
“তুমি রেডি হবেনা আপু?”

মুখ ফুলিয়ে সামান্তা প্রত্যত্তুর করল,
“বিয়ে তো তোমার, আমি কেন সাজব?”
“তার মানে বুঝাচ্ছ তোমারও বিয়ে করা দরকার?”
“বর পাব কোথায়? বিয়ে করার জন্য তো বর প্রয়োজন!”
“কেন? আমাদের মিশাল ভাইয়া আছেনা? তুমি বললে তো সদা প্রস্তুত সে তোমাকে বিয়ে করার জন্য।”
ইতোমধ্যেই সামান্তার মা জেসমিন বেগম তাদের মাঝে এসে উপস্থিত হলেন। জেনিয়ার মুখের কথা টেনে নিয়ে তিনি কেমন কর্কশ গলায় বললেন,

“শুধু বিয়ের জন্য প্রস্তুত থাকলে তো হবেনা। চাকরী বাকরীও কিছু একটা জোগাড় করতে হবে! আমার মেয়েকে তো এখন শুধু খাওয়ালেই হবেনা। তার তিনবেলা ঔষধের খরচও চালাতে হবে! কোটি টাকা ঢালতে হয়েছে আমার মেয়ের চিকিৎসার পেছনে। এখনও তো সার্জারি করাও বাকি!”

মুখ ভার করে তিনি কথাগুলো বললেন। শুকনো হেসে জেনিয়াকে বললেন,
“কাজী সাহেব এসে গেছে জেনিয়া। তুমি তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিচে চলে এসো।”
প্রস্থান নেওয়ার পূর্বে তিনি সামান্তার মুখের দিকে একবার ফিরে তাকালেন। মুখ অন্ধকার করে রেখেছে সামান্তা। যেন ঘোর অমবস্যা নেমেছে। তাকানো যাচ্ছেনা তার দিকে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলেননা তিনি। হেঁটে চলে গেলেন পাশের রুমে। পাঞ্জাবি পরতে ব্যস্ত সাহিল। পাশেই দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে মিশাল! পাঞ্জাবির কলার ঠিক করতে ব্যস্ত থাকা সাহিল বেশ তৎপর গলায় মিশালকে বলল,

“তোর ডিসিশন আমার খুব পছন্দ হয়েছে মিশাল। মামার কাছে প্রস্তাব রাখতে পারিস তুই। দেখ মামা কি বলে। আশা করি তোকে ফেরাবেনা মামা। কজ তোদের প্রেম কাহিনী তো মামা জানেই। এবার শুধু বিয়েটা বাকি।”
“কার বিয়ের কথা হচ্ছে এখানে?”

বেশ রগচটা গলায় জেসমিন বেগম সাহিলের মুখের কথা টেনে নিলেন! পেছন থেকে দাঁড়িয়ে তিনি দুই ভাইয়ের কথোপকথন অতি মনোযোগের সহিত শুনছিলেন। হুড়োহুড়ি করে মিশাল তার মুখ থেকে সিগারেটটি ছুঁড়ে ফেলে দিলো। পেছনের দিকে ফিরে মুখ থেকে ধোঁয়া নির্গত করতে লাগল। এই সময়ে সিগারেট ধরানোটা উচিৎ হয়নি তার। যদিও দুঃশ্চিন্তা দূর করার জন্য সে সিগারেটটি ধরিয়েছিল। রাগী ভাব নিয়ে জেসমিন বেগম সাহিলের দিকে এগিয়ে এলেন। বুকের উপর হাত গুটিয়ে ভার গলায় বললেন,

“বিয়ে মুখের কথা নয় বুঝেছ? যে ছেলে এখনও সিগারেট খাওয়াই ছাড়তে পারলনা, তার কাছে আমার মেয়ে সুস্থ থাকবে কিভাবে? সিগারেটের ঘ্রাণ আমার মেয়ের জন্য কতোটা ইফেক্টটিভ হবে সেটাই তো জানা নেই তার! সে আগে নিজেকে বদলাক, টাকা পয়সা ইনকাম করুক, ক্যারিয়ার গুছিয়ে নিক এরপর দ্যন তার প্রস্তাব আমরা গ্রহণ করব! তাকে বলো অতি আশায় বুক বেঁধে না রাখতে!”

রাশভারি গলায় কথাগুলো বলে জেসমিন বেগম প্রস্থান নেওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালেন। তখনি মিশাল অতি নমনীয় গলায় জেসমিন বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“বিয়েটাকে এতো কঠিন করে দিবেননা চাচী। প্লিজ একটু সহজ করে ভাবুন। আমি জানি আমি খুবই কর্মঠ ও আত্নবিশ্বাসী মানুষ! আমি যদি একবার ভেবে নিই যে আমি আমার ক্যারিয়ার গোছাবো তা আমি গুছিয়েই ছাড়ব। এবার তা যেকোনো ক্রমেই হোক। আর সেই উদ্দেশ্যে আপনার মেয়েকে পাশে পেলে আমি আরও বেটার কিছু করতে পারব। সেখানে সিগারেট ছেড়ে দেওয়াটা কি এমন কঠিন জিনিস? অনেক ঝড় ঝাপ্টার পর আমরা এক হয়েছি চাচী। প্লিজ আমাদের আর দূরে ঠেলে দিবেননা। এবার অন্তত আমাদের একসাথে থাকতে দিন।”

“এসব ডায়লগ সিনেমাতেই ভালো লাগে মিশাল। বাস্তবে নয়। বাস্তবে তো দুজনের একবেলা খাবার জোগাড় করতেই কতো ঠোক্কর খেতে হয়। সেখানে আমার মেয়ের ঔষধ চালানোর খরচ তো বাদই দিলাম! বিয়ের পর আমার মেয়ে নিশ্চয়ই চাইবেনা তার বাপের বাড়ি থেকে ঔষধের খরচ নিতে। কারণ, এমন মেয়ে তৈরি করিনি আমি। যেখানে সে নিজে এবং তার স্বামীকে ছোটো করবে। মুখ লজ্জায় আমার মেয়েটা তো তখন ঔষধ না খেতে পেয়েই মরে যাবে! সার্জাবির কথা তো এখনও বলিইনি তোমাকে! বাদ দাও এসব। নিজের ক্যারিয়ারে ফোকাস করো। আর এতেই সকলের জন্য মঙ্গল হবে।”

হন্তদন্ত হয়ে হেঁটে চলে গেলেন জেসমিন বেগম। মিশাল তার রাগ সংযত করে রাখতে পারলনা। সামনে থাকা চেয়ারটিতে জোরে এক লাথ দিলো। রুমের জিনিসপত্র উলোট পালোট করতে লাগল। সাহিলও তাকে সামলাতে পারছিলনা। ইতোমধ্যে পাশের রুম থেকে সামান্তাও ধেয়ে এলো। মিশালের পাগলামি দেখে সে হয়রান হয়ে গেল। উত্তেজিত হয়ে মিশালের দিকে এগিয়ে এলো। ভীত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,

“কি হয়েছে তোমার? এমন করছ কেন তুমি?”
জেসমিন বেগমের ওপর জমা সমস্ত রাগ মিশাল অতি উগ্রতার সহিত সামান্তার ওপর ঝারতে লাগল। চোয়াল উঁচিয়ে মৃদু চিৎকার করে বলল,

বুকে যে শ্রাবণ তার সিজন ২ পর্ব ৬

“তোর মাকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর কি হয়েছে। যতবারই আমি তোকে “আমার” করে পেতে চাই, ঠিক ততবারই একটা না একটা বাঁধা ঘাড়ে এসে পরবেই। সবাই শুধু আমার অসহায়ত্বটাকেই দেখল, আমার ভেতরটাকে দেখলনা। আমার ভেতরে যে একটা মন আছে, ছোট্টো একটা হৃদয় আছে, সেই হৃদয়ে যে আমারও আঘাত হয়, ব্যথা হয় সেটা কেউ বুঝলনা?”

বুকে যে শ্রাবণ তার সিজন ২ পর্ব ৮