বুকে যে শ্রাবণ তার সিজন ২ পর্ব ৬

বুকে যে শ্রাবণ তার সিজন ২ পর্ব ৬
নিশাত জাহান নিশি

“এই প্ল্যানিংয়ের ব্যাপারে আমাকে একবার জানালে কি হতো? জানেন এই দশদিন যাবত আমার ওপর দিয়ে কি বয়ে গেছে? আপনাকে মনে মনে অনেক অভিশাপ দিয়েছি আমি! প্লে বয় ভাবতে শুরু করেছিলাম আপনাকে।”

গম্ভীর হয়ে গেল সাহিলের মুখভঙ্গি। শেষমেশ কিনা প্রেমিকার কাছ থেকে “প্রেমিক পুরুষের” বদলে তাকে “প্লে বয়ের” উপাধি শুনতে হলো? কি অশুভ দিনকাল পরল তার। যদিও জেনিয়া তার জায়গা থেকে রত্তি পরিমাণ ভুল ছিলনা তবুও ভালোবাসার ওপর একটু ভরসা তো রাখতেই পারত! জায়গা থেকে কিঞ্চিৎ নড়েচড়ে বসল সাহিল। মনোক্ষুণতা বুঝালো না৷ নমনীয়ভাবে জেনিয়ার হাতে হাত রাখল। চোখে চোখ রেখে জেনিয়াকে আশ্বস্ত করল। ক্ষীণ স্বরে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আমার ওপর তুমি চোখ বুজে ভরসা রাখতে পারো জেনিয়া। এই জীবনে তোমাকে ছেড়ে যাওয়ার কোনো প্ল্যানিং নেই আমার। তোমাকে তখন আমাদের প্ল্যান সম্পর্কে না জানানোটাও প্ল্যানের একটি অংশ ছিল। এতে প্ল্যান লিক হওয়ার সম্ভাবনা ছিল! যেহেতু এটি একটি গ্রুপ ওয়ার্ক ছিল। কিন্তু এখন যেহেতু সব ঠিক হয়ে গেছে সো পূর্বে কি ঘটেছে না ঘটেছে এসব নিয়ে ভেবে আর মাথাব্যথা করে লাভ নেই। এবার যা হবে আমাদের মঙ্গলের জন্য হবে।”
সাহিলের প্রতি সর্বোচ্চ আস্থা রেখে জেনিয়া নিশ্চিন্ত হলো। মিষ্টি হেসে বাসের সিটে হেলান দিয়ে বসল। প্রশ্ন ছুড়ল,

“ওকে, বাট আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?”
জেনিয়ার পাশাপাশি সাহিলও মৃদু হেসে বাসের সিটে হেলান দিলো। জেনিয়ার মুগ্ধিত দু-চোখে হারিয়ে বলল,
“থানায় যাচ্ছি। ওখানের স্টেটমেন্ট শেষ হলে তোমাকে নিয়ে আমার বাড়িতে ওঠত। ওখানে বিয়ের সমস্ত ব্যবস্থা করে রাখবে সামান্তা!”
হকচকিয়ে ওঠল জেনিয়া! সাহিলের হাত দু’খানি অবিলম্বেই ছেড়ে দিলো। উত্তেজিত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,
“কি? বিয়ে?”

জেনিয়ার অস্বাভাবিক কার্যকলাপে অবাক হলো সাহিল। ভ্রু যুগল কুঁচকে সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,
“কেন? আমাকে বিয়ে করবেনা তুমি?”
“বাট, আমার পরিবার? তাঁদের ছাড়া বিয়ে করব?”
“আগে তো বিয়েটা হতে দাও। দ্যন কাল, পরশু আমরা তোমার গ্রামে যাব। তাছাড়া তোমার পরিবারই তো আমার হাতে তোমাকে তুলে দিয়েছিল! তাঁরাও নিশ্চয়ই বুঝে গেছে তাঁদের মেয়ে জামাই হিসেবে আমিই পার্ফেক্ট! গ্রামের জমিদারের ছেলে ঐ বা’স্টা’র্ড মেহেদি নয়।”

“মেহেদির জন্যই তো ভয় করছে সাহিল। গ্রামে গেলে সে যদি কোনো অনর্থ বাঁধিয়ে বসে?”
ভীতসন্ত্রস্ত জেনিয়া। চোখেমুখে তার অসহায়ত্ব। উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠল সাহিল। জেনিয়াকে বুকের মাঝে চেপে ধরল। সাহস জোগালো তাকে। শিথিল কণ্ঠে বলল,
“ডোন্ট বি সিলি জেনিয়া। এতো ভয় পাচ্ছ কেন? আই থিংক মিশালকে বেশ ভালোভাবেই চিনো তুমি! আমরা দুই ভাই থাকতে মেহেদি আমাদের কিছু ছিঁড়তে পারবেনা! বুকে বল রাখে। তুমি শুধু আমাদের সাহস জোগাবে, বাকিটা আমরা বুঝে নিব।”

সমস্ত প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে টুটুল চৌধুরীকে তার চাকুরী থেকে অব্যাহত করা হলো। শুধু তাই নয়, তার ওপর লিগ্যালি স্টেটমেন্টও নেওয়া হলো। খু’ন এবং হাফ মা”র্ডা’রের আরোপ লাগানো হলো তার ওপর। আগামী তিনদিন পর তাকে কোর্টে তোলা হবে। বোর্ড মিটিং থেকে মাত্রই এই সুখবরটি পাওয়া গেল। থানা থেকে উচ্ছ্বসিত মনে সাহিলও তার বাড়ি ফিরে এলো। সাহিল বাড়ি ফিরে বৃত্তান্ত বলার পূর্বেই আব্রাহাম খান সামান্তাকে ফোন করে বিস্তারিত বলে দিলো।

নিচে ড্রইংরুমে সাহিলের বিয়ের ছোটোখাটো প্রস্তুতি চলছে। তরুন চৌধুরীও রাজি এই বিয়েতে! জেনিয়াকে ছেলের বউ হিসেবে মানতে তাঁর আর কোনো দ্বিধা নেই। নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন তিনি। ছেলের নাটকীয় মৃত্যু তার চোখ খুলে দিয়েছে। নিজের ভুল বুঝতে সহযোগীতা করেছে। এখন ছেলের সুখেই তিনি সুখী। পরিবারের সুখেই তাঁর সুখ। শাহনাজ বেগমও আপত্তি করেননি এই বিয়েতে।

তাঁর বোনের মেয়ে যে এই পরিবারের বউ হলে সুখের কোনো কমতি থাকবেনা সেই বিষয়ে তিনি শতভাগ নিশ্চিত। তাই এখানে আপত্তি করার কোনো কারণ নেই। ফোনে জেনিয়ার মা-বাবাকে তিনি আশ্বস্ত করেছেন। যদিও মেহেদির অত্যাচারে জেনিয়ার পরিবার অতিষ্ঠ প্রায়! ভালোয় ভালোয় সাহিল ও জেনিয়ার বিয়েটা হয়ে গেলেই কাল মেহেদির রং দেখাবে সাহিল! যুদ্ধ ঘোষণা করবে মেহেদির বিরুদ্ধে!

তরুন চৌধুরী বার বার সুযোগ খুঁজছিলেন কখন তিনি মিশাল ও সামান্তার কাছে ক্ষমা চাইবেন! তবে সেই সুযোগটি হয়ে ওঠেনি এখনও। সামান্তা ও মিশালকে একসাথে পাওয়াই যাচ্ছেনা। তবে তিনি সুযোগ পেলে নিশ্চয়ই দুজনের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিবেন। তাই তক্কে তক্কে রয়েছেন তিনি।

বাড়ির প্রায় প্রত্যেকে বিয়ের জোগাড়ের কাজে ব্যস্ত। জেনিয়াকে টুকটাক সাজিয়ে দিচ্ছে সাইফা, সায়মা ও রুমকি মিলে। মিশালকে পাঠানো হয়েছে কাজী সাহেবকে ডেকে আনার জন্য। সামান্তা কিছুক্ষণ রেস্ট করার জন্য তার রুমে ফিরে এলো। যদিও আজ থেকে তার সাহিলের রুমটি শেয়ার করে থাকতে হবেনা। সাহিল ও জেনিয়ার বিয়ে হয়ে গেলেই সামান্তা আজই তার বাড়ি ফিরে যাবে।

রুমের দরোজা ভেজিয়ে সামান্তা ধীর পায়ে হেঁটে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ালো। শাড়ির আঁচল মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে তার। ছন্নছাড়া ও বিমর্ষ ভাব তার। কাঁপা কাঁপা হাতে সে আজ বেশ সাহস নিয়ে আয়নার পর্দাটি ওঠালো! অমনি ভড়কে ওঠল সে। চোখ দুটিতে ভরপুর আতঙ্ক ও জল চিকচিক করে ওঠল। মুখের বাঁ পাশের কুঁচকানো অংশটিতে সে আলতো হাত ছোঁয়ালো। অমনি মৃদু চিৎকার করে উল্টো পাশ ফিরে গেল সে। মুখ ঢেকে গোঙাতে লাগল। কিয়ৎক্ষণ কেটে গেল এভাবে। নিজেকে সন্তপর্ণে সামলে মুখ থেকে হাত সরিয়ে সে সামনে তাকাতেই কেমন নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মিশালকে তার দৃষ্টির সীমানায় দেখতে পেল!

তাৎক্ষণিক সামান্তা চোখের জল মুছে বিপরীত দিকে ফিরে গেল। মিশালের উপস্থিতি তাকে পোঁড়ালো। মিশাল তার চোখের জল সামলালো। শক্ত করল নিজের মনোবলকে। সামান্তার সামনে তার দুর্বল হওয়া চলবেনা। এতে সামান্তাও দুর্বল হয়ে পরবে। নিজেকে দুর্বল ভাবতে শুরু করবে। ধীর পায়ে হেঁটে সামান্তার ঠিক পেছনের দিকটিতে দাঁড়ালো মিশাল। মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে সামান্তা। মিশাল বুঝতে পারছিলনা সামান্তার সাথে কি বলে কথা আগাবে! ভেতরে ভেতরে ভীষণ লজ্জিত বোধ হচ্ছে যে তার। মিশালের ইতস্তততা দূর করে দিলো সামান্তা। বেশ শক্তপোক্ত গলায় শুধালো,

“তুমি এখানে কি করছ?”
“তোকে অভিনন্দন জানাতে এলাম।”
“কেন?”
“এইযে আমাকে এভাবে হারিয়ে দিলি। ছেলে হয়ে আমি যা করতে পারিনি, তুই মেয়ে হয়ে তা করে দেখিয়ে দিলি।”
“আমি যা করেছি নিজের জন্য করেছি।”

“আমি থোরাই না বললাম তুই আমার জন্য কিছু করেছিস! আমি কে হই তোর, যে তুই আমার জন্য কিছু করবি?”
“তোমার সাথে কথা বলতে ভালো লাগছেনা আমার! আমাকে একটু একা থাকতে দাও।”
“কিন্তু আমার যে আর একা থাকতে ভালো লাগছেনা। বুকে ব্যথা, হৃদয়ে ব্যথা, শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রতঙ্গে ব্যথা, আমার ভীষণ যত্নের প্রয়োজন।”

“বিয়ের যথেষ্ট বয়স হয়েছে তোমার, বিয়ে করে নাও।”
“কে বিয়ে করবে আমায়? বেকার ও জেল ফেরত ছেলেকে কে বিয়ে করবে? তবে একজন আছে, যে দয়া করে আমাকে বিয়ে করতে পারে!”
তাৎক্ষণিক পিছু ঘুরে দাঁড়ালো সামান্তা। উচ্ছ্বসিত দৃষ্টি তার। মিশালের নির্নিমেষ দু’চোখে তাকালো। অধীর গলায় শুধালো,

“কে সে?”
“নাম বললে পালাবি না তো?”
“আমি কিন্তু তোমাকে বিয়ে করবনা!”
মিশালের সামনে থেকে প্রস্থান নেওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো সামান্তা। পেছন থেকে সামান্তার হাত টেনে ধরল মিশাল। ডানপিটে হেসে বলল,

“জোর করে বিয়ে করব।”
“এতো বড়ো সাহস হয়নি তোমার!”
“নিজেকে খুব সাহসী ভাবছিস তুই?”
“আরও প্রুভ দেখাতে হবে বুঝি?”
“জোর করেনা। তোর সম্মতিতেই আমি তোকে বিয়ে করব!”

এই বলে সামান্তার হাতটি ছেড়ে দাঁড়ালো মিশাল। মুখ চেপে অট্ট হাসল সামান্তা। তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,
“এই কুৎসিত দেখতে মেয়েটাকে নাকি সে জোর করে বিয়ে করবে! আমাকে দেখলে তো এখন রাস্তার ছেলেরাও নাক সিঁটকায়! আর সে নাকি আমাকে…..
কথা সম্পূর্ণ করতে পারলনা সামান্তা। ইতোপূর্বেই মিশাল রাগে গজগজ করে সামান্তার মুখোমুখি দাঁড়ালো। চোখ দুটি লাল করে চোয়াল উঁচু করল। অনাকাঙ্ক্ষিতভাবেই সে আচমকা সামান্তার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো! হতভম্ব হয়ে গেল সামান্তা। হাত-পা ছেড়ে এলো তার। অতি ক্ষুব্ধ হয়ে মিশাল সামান্তার ঠোঁটে লাভ বাইট বসিয়ে জাপটে ধরল সামান্তাকে। ভরাট গলায় বলল,

“তুই আমার চোখে এখনও আগের মতই রয়ে গেছিস। যার চোখের দিকে তাকালে আমি নিঃস্ব হয়ে যেতাম। যার মায়াভরা মুখের পানে তাকালে আমি নিজেকে বার বার ফিরে পেতাম। যার হাসির ঝংকারে আমার বুকে উত্তাল ঝড় বইত। যার কথার প্রেমে পরে আমি এই অগোছালো আমিটাকে বার বার গুছিয়ে নিতাম। কিছুই বদলায়নি এখনও। আমি এখনও আগের মতোই তোকে অনুভব করি। বৃদ্ধ বয়সে গিয়েও আমি সেই ষোলো বছরের কিশোরী মেয়েটিকে ভুলতে পারবনা। আমার প্রথম প্রেমকে আমি ভুলতে পারবনা।”

ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠল সামান্তা। মিশালকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল। আবেগঘন গলায় বলল,
“আয়নায় তাকাতে আমার এখন ভয় হয় মিশাল। আমি নিজের নতুন এই ভয়ঙ্কর রূপকে মানতে পারিনা। যেখানে আমি নিজেকে মানতে পারিনা, সেখানে তুমি আমাকে কীভাবে মানবে?”
“এর অর্থ তুই নিজেকে ভালোবাসিস না। যে নিজেকে ভালোবাসতে জানে সে কখনও নিজের বাহ্যিক রূপ, গুন নিয়ে ভাবেনা। তুই যতোবার আমার চোখে তাকাবি, তোর সেই আগের রূপকে দেখতে পাবি। আমার চোখে তুই এখনও আগের সামান্তা রয়ে গেছিস।”

বুকে যে শ্রাবণ তার সিজন ২ পর্ব ৫

“আমাকে এসব বলে ভুলানো যাবেনা মিশাল! আমি জানি আমি এখন আর আগের মতো নেই।”
অভিমানী হয়ে সামান্তা মিশালের ঘাঁড়ে চুমু খেলো। ইতোমধ্যেই সাহিল বেশ হুড়োহুড়ি করে দরোজা ঠেলে রুমে ঢুকে গেল। মিশাল ও সামান্তাকে জড়াজড়ি অবস্থায় দেখে সাহিল জিভ কেটে অন্যপাশ ফিরে গেল। রসিক গলায় বলল,
“ইশ, কি রোমান্টিক মুহূর্ত। বড়ো ভাইয়ের চেয়ে ছোটো ভাইয়ের তাড়া বেশি। বলছি কি বিয়েটা আমার হচ্ছে, তোদের নয়।”

বুকে যে শ্রাবণ তার সিজন ২ পর্ব ৭