বুকে যে শ্রাবণ তার সিজন ২ পর্ব ১৬

বুকে যে শ্রাবণ তার সিজন ২ পর্ব ১৬
নিশাত জাহান নিশি

“কারণটা জানার পর তুমি রুমকিকে বকবেনা তো?”
সামান্তার ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলা কথা মিশালের এই মুহূর্তে বিষের সমতুল্য মনে হচ্ছে। মেজাজ হারিয়ে ফেলছে সে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলল সে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা সামান্তার দিকে। অগত্যা কর্কশ গলায় বলল,
“যা বলার ডিরেক্টলি বল। শোনার পর ভেবে দেখব কাকে বকব আর কাকে বকব না।”
সব ধরণের ভনিতা পাশে রেখে সামান্তা হরহর গলায় বলতে আরম্ভ করল,

“রুমকি ও তৌহিদ দুজন দুজনকে ভালোবাসে। তাদের সম্পর্কটা বেশি দিনের নয়। গতকাল রাতেই আমি এই সম্পর্কে জানতে পারি। তাই এই বিষয় নিয়ে আর্জেন্ট কথা বলার জন্যই আমি তৌহিদের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তৌহিদকে আমি অনেক আগে থেকেই চিনি। স্পেশালি তার কাছ থেকে বিষয়টা ক্লিয়ার হওয়া জরুরি ছিল আমার। তৌহিদের কাছ থেকেই জানতে পারি তৌহিদের পরিবারের তরফ থেকে চাচীর কাছে বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল আজ। তবে চাচী তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। এই নিয়ে তৌহিদ খুব ফ্যাড আপ ছিল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আজ রুমকিরও আমাদের সাথে দেখা করার কথা ছিল। বাট খবরটা জানার পর তার মন খারাপ হয়ে যায়। কলেজ থেকেও বের হয়নি সে। এবার তুমি ভেবে দেখো কি করবে। যদি আমার মতামত নিতে চাও তো বলব, তুমি বা তোমরা চোখ বুজে ভরসা করে তৌহিদের হাতে রুমকিকে তুলে দিতে পারো। তৌহিদের মত ভালো ছেলে আর দুইটা হয়না। আর তার পরিবারের মত উদার মানুষ হয়না।”

স্থির হলো মিশাল। ভাবুক ভঙ্গিতে বিছানার ওপর পা ঝুলিয়ে বসল। এই বিষয়টা নিয়ে এভাবে বসে থাকলে চলবেনা। তৌহিদ সম্পর্কে মিশাল যতটুকু খোঁজ খবর নিয়েছে বেশ ভালো খবরই পেয়েছে। এমনকি সামান্তাও তৌহিদের পরিবারকে এপ্রিশিয়েট করছে। এই বিষয়টা নিয়ে শাহনাজ বেগমের সাথে শীঘ্রই কথা বলা উচিত তার। ভাবনা চিন্তা ভুলে সামান্তাকে নিয়ে মিশাল শাহনাজ বেগমের রুমে গেল। বিছানা গোছাচ্ছিলেন তিনি। মিশাল ও সামান্তাকে একসাথে তিনি মৃদু হাসলেন। মিশালের দিকে প্রশ্ন ছুড়লেন,

“কি ব্যাপার? তোরা দুজন একসাথে? কিছু বলবি নাকি?”
তৎপর ভঙ্গিতে শাহনাজ বেগমের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো মিশাল। শান্ত গলায় বলল,
“মা দেখুন? রুমকি যেমন আমার বোন, তেমনি আপনার মেয়ে। আমি যেমন আমার বোনের ভালোটা চাইব, তদ্রুপ আপনিও আপনার মেয়ের ভালোটা চাইবেন। পৃথিবীর সব ধনী লোকরাই কিন্তু খারাপ হয়না মা। কিছু কিছু নিরহংকার ও উদার মনের মানুষও কিন্তু হয়। আর তারা কখনও নিচু স্তরের মানুষদের অবজ্ঞা করেনা।

আত্নীয়তার মর্ম বুঝে তারা। একটু আগে রুমকির জন্য আসা যে বিয়েটা আপনি রিজেক্ট করলেন সেই ছেলে এবং তার পরিবার সম্পর্কে আমি খোঁজখবর নিয়েছি। খারাপ কোনো রিপোর্ট পাইনি। সামান্তাও ছেলেকে বেশ ভালোভাবে চিনে। সামান্তা পূর্বে যে অফিসে জব করত সেই অফিসের বসের ছেলে তৌহিদ। আর তাছাড়া রুমকি ও তৌহিদ দুজন দুজনকে ভালোবাসে। আমি একান্তভাবেই চাইব আপনি এই বিষয়টা ভেবে দেখুন এবং এই বিষয়ে কথা আগান। আগামী মাসেই কিন্তু আমার ইতালি ব্যাক করতে হবে। যা করার এই মাসের মধ্যেই করতে হবে।”

শাহনাজ বেগম চিন্তায় পরে গেলেন। বিষয়টি সময় নিয়ে ভাবলেন। অতঃপর অসহায় গলায় বললেন,
“কিন্তু মিশাল, আমাদের হাতে তো এখন কোনো টাকাই নেই। খালি হাতে কি করে বিয়েতে নামব?”
“সেই চিন্তা আপনার করতে হবেনা মা। টাকার ব্যবস্থা আমি করব। আমি শুধু এই সম্বন্ধে সম্মতি দিন। বাকিটা আমি বুঝে নিব।”

“আবার ধার করবি?”
“শোধ করে দিব মা। ইতালি গেলেই একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। সাহিল ভাইয়ার সাথে এই বিষয়ে কথা বলব।”
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন শাহনাজ বেগম। চোখের কোণে চিকচিক করা জল নিয়ে মিশালের মাথায় ও কপালে হাত বুলিয়ে বললেন,

“তোর যা ভালো মনে হয় কর। তোর ওপর আমার সম্পূর্ণ আস্থা আছে। রুমকি আমার মেয়ে হলে কি হবে? তুইতো তার বাবার ছায়ার মতো! এখানে তোর কথাই বেশি গ্রহণযোগ্য।”
প্রস্থান নিলেন শাহনাজ বেগম। পাশ থেকে প্রফুল্ল হাসল সামান্তা। মিশালকে জাপটে ধরল। মিশালের বুকে মুখ গুজে বলল,
“সবাই কত ভরসা করে আমার মিশালের ওপর। এমন একজন দায়িত্ববান পুরুষ মানুষকে আমার জীবনে পেয়ে আমি ধন্য।”

“ঐসময় যেন কি বলেছিলি? তৌহিদের মত ভালো ছেলে আর দুটো হয়না! ইনডিরেক্টলি বুঝিয়ে দিলি আমি খারাপ। তো এখন আমার গাঁয়ের সাথে এসে ঢলাঢলি করছিস কেন? হাট এখান থেকে!”
মৃদু ধাক্কা দিয়ে সামান্তাকে গাঁ থেকে সরিয়ে হনহন করে হেঁটে রুম থেকে প্রস্থান নিলো মিশাল। রাগে রি রি করে ওঠল সামান্তা। বিষধর সাপের ন্যায় ফোঁসফোঁস করতে লাগল সে। তাকে ধাক্কা দেওয়ার প্রতিশোধ সে হারে হারে শোধ করবে। ধীরে ধীরে সময় নিয়ে শোধ করবে। ঝগড়া করার আর কোনো টপিক না পেয়ে যে মিশাল বেহুদা কথা নিয়ে ঝগড়া লেগে গেল তা বুঝতে বেশি সময় নিলোনা সামান্তা।

আগামী একসপ্তাহের মধ্যেই বিয়ের সকল বন্দোবস্ত হয়ে গেল! ছেলের বাড়ি থেকে বিশেষ কোনো চাহিদা নেই। রুমকিকে স্বর্ণ গহনা দিয়ে সাজিয়ে নিয়ে যাবে তারা। মেয়ের পক্ষের কাছ থেকে কোনো চাওয়া পাওয়া বা কোনো আবদার নেই ছেলেপক্ষের। শুধু রুমকিকে বউ হিসেবে নিয়ে গেলেই হবে তাদের! তবুও বিয়েতে প্রায় দুই লক্ষাধিক টাকা খরচ হয়ে গেছে মিশালের। সাহিলের থেকে প্রায় দেড় লাখ টাকা ধার নিয়েছে সে!

একমাত্র বোনের বিয়ে জাঁকজমকভাবেই দিয়েছে সে। কোনোরকম ত্রুটি রাখেনি কিছুতে। যথারীতি সুষ্ঠুভাবে বিয়ে সম্পন্ন হলো রুমকি ও তৌহিদের। রুমকির বিদায়ে শাহনাজ বেগম ও মিশাল ভেঙে পরেছিল প্রায়। কান্নাকাটির রোল পরে গিয়েছিল। অজ্ঞান অবস্থায় রুমকিকে নিয়ে তৌহিদ তার বাড়ি ওঠেছিল। অবশেষে পুরো বাড়ি খালি করে রুমকি তার শ্বশুড় বাড়িতে পাড়ি জমালো। তার মা এবং ভাইকে দিয়ে গেল একরাশ বিষাদ।

ইতালি যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এলো মিশালের। হাতে গোনা প্রায় দশদিন পরেই তার ফ্লাইট। বেশ কিছুদিন যাবত সামান্তার সাথে সম্পর্ক ভালো যাচ্ছেনা তার! মিশালকে দেখামাত্রই সামান্তা তার মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে। কথা বলা তো দূর ফিরেও তাকাচ্ছেনা মিশালের দিকে। বিষয়টা নিয়ে মিশাল বেশ চিন্তায় পরে গেছে। তবে আজ সাহস করেই মিশাল সামান্তার বাড়ি গেল। সামান্তা বাদে বাড়ির সবাই সাইফার শ্বশুড় বাড়ি অর্থাৎ লাবিবদের বাড়িতে দাওয়াত খেতে গিয়েছিল। শাহনাজ বেগমও সাথে ছিলেন। আর সেই সুযোগে মিশাল সামান্তার সাথে বোঝাপড়া করতে গিয়েছিল।

বিছানার উপর বসে সামান্তা ল্যাপটপে মুভি দেখতে ব্যস্ত। ইতোমধ্যেই তার রুমে মিশালের আগমন ঘটল। দরোজা খোলার আওয়াজ পেয়ে সামান্তা চিৎকার করার পূর্বেই মিশাল দরজার খিল আটকে ছুটে এসে সামান্তার পাশে বসল। ল্যাপটপ বন্ধ করে সামান্তার মুখ চেপে ধরল। বলল,
“আওয়াজ নিচে। যেভাবে চিৎকার করতে যাচ্ছিলি মনে হচ্ছিল চোর ডাকাত ঢুকেছে তোর রুমে। আওয়াজ নিচে ওকে?”

সামান্তার মুখ থেকে হাতটি সরালো মিশাল। চোখ জোড়া বুজে বুকে হাত রেখে একের পর এক শ্বাস ফেলতে লাগল সামান্তা। একই সঙ্গে অস্থির গলায় শুধালো,
“নক না করে রুমে ইন করলে কেন? এতটুকু ম্যানারসও জানা নেই তোমার?”
“ওহ্ আই সি। তোর রুমে ঢুকতে হলেও আমার নক করে ঢুকতে হবে?”
“হ্যাঁ হবে! কারণ, তুমি আমার হাসবেন্ড নও যে নক ছাড়া অ্যানি টাইম তুমি আমার রুমে ঢুকতে পারবে।”
“আগেও অনেকবার নক ছাড়া তোর রুমে ইন করেছি আমি তখন তো এসব বলিসনি।”
“বলিনি কিন্তু এখন থেকে বলব! কি বলতে এসেছ বলো? তাড়া আছে আমার।”

“আমি সবসময় ভাবতাম তুই হয়ত আমাকে বুঝিস, কিন্তু ইদানিং মনে হচ্ছে তুই আমার অনেক অচেনা হয়ে গেছিস! আমার জন্য তোর কাছে কোনো সময়ই নেই!”
বিছানা ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালো সামান্তা। মিশালের মুখোমুখি না দাঁড়িয়ে বরং উল্টো পাশ ফিরে দাঁড়ালো। বুকের ওপর হাত গুজে মেজাজ চওড়া করে বলল,

“আরও তো একবছর সময় দিলাম! আর কত সময় দিব তোমাকে? একবছর পর ফিরে আসলে তোমার যদি মনে হয় আমাকে তোমার বিয়ে করা উচিত তো করো, না হয় ফরেইনার কাউকে দেখে ইতালিতে স্যাটেল্ড হয়ে যেও!”
কোথা থেকে যেন যত রাজ্যের রাগ, জেদ, দুঃখ এসে মিশালের ঘাড়ে ভর করল। সামান্তার ঠিক পেছনের দিকটায় দাঁড়িয়ে সে সামান্তার ঘাঁড় বরাবর জোরে একটি কামড় বসিয়ে দিলো! ব্যথায় সামান্তা কুকিয়ে ওঠতেই মিশাল চোয়াল উঁচিয়ে বলল,

বুকে যে শ্রাবণ তার সিজন ২ পর্ব ১৫

“হেই লিসেন? আজই তোকে আমি বিয়ে করব। মসজিদে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করব। সবাইকে বাতাসা খাইয়ে শুভ কাজ আদায় করে ফেলব! তোর ড্রিম ওয়েডিংয়ের বারোটা বাজিয়ে দিব।”

বুকে যে শ্রাবণ তার সিজন ২ শেষ পর্ব