আমার শহরে তোমার আমন্ত্রণ সিজন ২ পর্ব ২৯

আমার শহরে তোমার আমন্ত্রণ সিজন ২ পর্ব ২৯
Raiha Zubair Ripte

ছেলেবেলায় শহরে যেমন বৃষ্টি দেখা যেত, তেমন ঘনিয়ে বৃষ্টি বোধহয় এখন হয় না। বৃষ্টির তেমন সমারোহ নেই যেন, বৃষ্টি এখন যেন ইকনমিতে মন দিয়েছে – কোনরকম করে জল ছিটিয়ে চলে যায়। আগেকার মতো সে বজ্র বিদ্যুৎ বৃষ্টি বাতাসের মাতামাতি দেখা যায় না। আগেকার বৃষ্টির মধ্যে একটা নৃত্য ও গান ছিল, একটা ছন্দ ও তাল ছিল – এখন যেন প্রকৃতির বৃষ্টির মধ্যেও বয়স প্রবেশ করেছে, হিসাব কিতাব ও ভাবনা ঢুকেছে, শ্লেষ্মা শঙ্কা ও সাবধানের প্রাদুর্ভাব হয়েছে।

তবুও পরিবেশ টার সাথে আজকের দিন টা খাপে খাপ মিলে গেছে। ১৪ ফেব্রুয়ারী, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। এই দিন কে কেন্দ্র করে সহস্র যুগলবন্দী প্রেমিক প্রেমিকার অনেক প্ল্যান থাকে।
ছাঁদের কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সেসব হাজার কল্পনা জল্পনা করতে ব্যাস্ত তৃষ্ণা। না হোক তার আর রাফির প্রেম তাকে গোলাপ দিতে সমস্যা কোথায়? আজ না হয় একটু মিষ্টি মিষ্টি করে কথা বলবে। ভালোবাসার দিবসে ভালোবাসায় গা এলাবে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কথাগুলো ভেবেই তৃষ্ণা রাফির নম্বরে একটা মেসেজ পাঠায়।
রাফি কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে ছিলো। মেসেজে টুং টাং শব্দ কানে ভেসে আসতেই বিছানার পাশ থেকে ফোন টা নিয়ে দেখে তৃষ্ণার আইডি থেকে মেসেজ এসেছে। রাফি মেসেজ নোটিফিকেশনে ক্লিক করতেই দেখে ভালোবাসা দিবস নিয়ে একটা রচনা। এই রচনা টা সচারাচর ফেসবুকের মেসেজ অপশনে সবাই একাধারে ফরওয়ার্ড করতে থাকে। রাফি টাইপ করলো-

-“ এমন গরুর রচনা পাঠানোর মানে কি?
তৃষ্ণা রাফির এমন মেসেজ টা দেখেই ভ্রু কুঁচকালো।
-“ হার্টলেস নাকি আপনি?
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ওপাশ থেকে টাইপ হলো-

-“ হার্টলেস হলে এই মন এতো সহজে একটা পুচকি মেয়ে নিজের বশে নিয়ে যেতে পারতো না।
-“ আজ কি জানেন?
-“ রচনা দেখে বুঝলাম এখন আজ কি।
-“ তো আপনার কি উচিত না কিছু করার?
-“ হ্যাঁ বিয়ে টা করে ফেলা উচিত। ব্রো এর বিয়ে শেষ আমার ও তো বয়স হচ্ছে।
-“ পাত্রী দেখবো?

-“ সে তোমার ইচ্ছে। তুমি নিজেই পাত্রী হবে নাকি অন্য কাউকে তোমার পরিবর্তে দিবে।
-“ আচ্ছা শুনুন না।
-“ হুমম বলো।
-“ আজ ঘুরতে নিয়ে যান না।
-“ কোথায় যাবা?
-“ আগে বাসা থেকে বের হই। তারপর ভাবা যাবে কোথায় যাওয়া যায়।
-“ আকাশের অবস্থা তো ভালো না।
-“ তাতে কি।

-“ যদি বৃষ্টি হয় তখন?
-“ আরো ভালো হবে বৃষ্টি তে ভিজবো।
-“ আচ্ছা দুপুরে রেডি হয়ে থেকো।
-“ আচ্ছা। শুনুন ব্লাক স্যুট পড়বেন কেমন?
-“ আচ্ছা। এখন এক কাপ কফি দিয়ে যাও রুমে। মাথা ব্যাথা করছে।
তৃষ্ণা ছাঁদ থেকে নিচে নেমে গেলো।

চিত্রা আজ ডার্ক রেড কালারের শাড়ি পড়েছে। হাতে লাল রেশমি চুড়ি আখি জোড়া কালো কাজল দ্বারা রাঙায়িত চুলগুলো খোঁপায় বাধা। খোঁপায় আছে বেলি ফুলের গাজরা । তুষারের শরীরে ব্লাক শার্ট। কোলে ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করছে। চিত্রা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একবার নিজেকে দেখে নিলো। তার পর গলায় একটা ছোট্ট গয়না পড়ে তুষার সামনে দাঁড়িয়ে বলে-

-“ আমি রেডি।
তুষার একপলক তাকালো চিত্রার পানে। আজ সকালেই এসেছে চিত্রা দের বাসা থেকে। এখন বাজে দুপুর দু’টো। বায়না ধরেছে আসার পর থেকেই সে ঘুরতে বের হবে। তুষার ও আজ ফ্রী তাই নাকচ করে নি। কোল থেকে ল্যাপটপ টা নামিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে বা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে-
-“ চলো তাহলে।
চিত্রা মুচকি হাসে। তুষারের বা হাতে নিজের ডান হাত দিতেই তুষার শক্ত করে মুঠোবন্দি করে। তারপর বাসা থেকে বের হয়।

তুষার আজ নিরিবিলি প্রাকৃতিক পরিবেশে চিত্রা কে নিয়ে কাটাবো। তাই তার সেই পছন্দের জায়গায় চলে যায়। যেখানে নেই কোনো মানুষের সমাগম আছে শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য আর ঘ্রাণ। তুষার গাড়িটা নিয়ে শহর থেকে একটু দূরে অবস্থিত সেই খোলা মাঠ টায় আসে। যার একপাশে একটা কুঁড়েঘর আর তার পাশে ছোট্ট একটা নদী। তুষার গাড়ি থেকে নামে। চিত্রার কাছে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে চিত্রা কে বের হতে সাহায্য করে। চিত্রা বের হয়। পরিচিত সেই জায়গা টা দেখে মুখের হাসি চওড়া হয়।
তুষারের হাতের মধ্যে তার হাত। পায়ের সাথে পা মিলিয়ে হাঁটছে। চিত্রা লম্বা একটা শ্বাস নিলো। এক হাত দিয়ে তুষারের বাহু চেপে ধরে বলে-

-” আপনার আমার মিলে এখন জায়গা টা আমাদের তাই না?
তুষার স্মিত হাসলো। ইশারায় বলল হ্যাঁ। নদীর একপাশে একটা ঝুড়িতে রয়েছে ঝুড়ি ভর্তি লাল,হলুদ,সাদা গোলাপ ফুল। ঝুড়ি টা চিত্রার নজরে আসলো। ভ্রু কুঁচকে বলল-
-“ আপনি আনিয়েছেন তাই না?
তুষার কিছু বললো না। চিত্রা এগিয়ে গেলো ফুল গুলোর দিকে। একটু ঝুঁকে ফুল গুলোর কাছে মুখ নিয়ে সুবাস নিতে থাকে। গোলাপ ফুলের সুবাস আছে নাকি? এটা না ফুলের রাণী এর তো থাকা উচিত সুবাসিত ঘ্রাণ। যেনো ক্রোশ মাইল দূরে থেকেও ঘ্রাণ পাওয়া যায়।

কোনো ঘ্রাণ না পেয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। একটা হলুদ কালার ফুল নিয়ে তুষারের দিকে তাকিয়ে বলল-
-“ আপনার আনা ফুলে ঘ্রাণ নেই এমপি মশাই। এই ফুলটা বরং আমার খোঁপায় লাগিয়ে দিন তো।
তুষার এগিয়ে আসলো। ফুল টা নিয়ে যত্ন সহকারে খোঁপায় গেঁথে দিলো। চুলের ভাজে আলতো করে চুমু খেলো। নদীর পাশে থাকা বকুল ফুলের গাছের ছায়াতলের বেশ টাতে গিয়ে বসলো। নদীতে একটা পদ্মফুল আছে। রং টা বেশ গাঢ়। অকপটে আবদার করে তুষার কে বলে উঠলো-

-“ ফুল টা আমার চাই এমপি মশাই। এনে দিন না।
তুষার পকেট থেকে ফোন বের করে কাউকে আসতে বলল। মিনিট দশেক পর লিমন হাঁপাতে হাঁপাতে তুষারের সামনে দাঁড়িয়ে বলে-
-“ জ্বি ভাই বলেন।
তুষার পদ্মফুলের দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ ফুল টা এনে দাও তো লিমন।

লিমন পদ্মফুলের দিকে তাকালো। পাশেই তো পড়ে আছে এক গাদা হরেক রকমের গোলাপ ফুল। এখন আবার পানিতে থাকা পদ্মফুল ও লাগবে! ক্যাবলরামের মতো কিয়ৎ ক্ষন চুপ থেকে প্যান্ট গুটিয়ে পানিতে নেমে পদ্ম ফুল টা এনে দেয়। তুষার হাতে নেয়। ইশারায় চলে যেতে বলে। লিমন চলে যায়। তুষার লতি সহ পদ্মফুল টা চিত্রার দিকে বাড়িয়ে দেয়। চিত্রা পদ্মফুল টা হাতে নিয়ে তুষারের কাঁধে মাথা রাখে।
-“ আর কতক্ষণ লাগবে আপনার?

তৃষ্ণা অধৈর্য্য হয়ে উক্ত কথাটি রাফির মোবাইলে পাঠাশ। সেই কখন থেকে রেডি হয়ে বসে আছে কিন্তু রাফির আসার নাম গন্ধ নেই। মিনিট দশেক পরে হোয়াইট স্যুট পড়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামে। তৃষ্ণা বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। তাকে না বলেছিল ব্লাক স্যুট পড়তে? রাফি কাছে আসতেই তৃষ্ণা ভ্রু কুঁচকে বলে-
-“ ব্লাক স্যুট না পড়তে বলেছিলাম?
রাফি টাই টা ঢিলে করতে করতে বলে-

-“ বোতাম একটা খুলে গেছে সেজন্য আর পড়ি নি। আর তাছাড়া আমরা ম্যাচিং ম্যাচিং তো। তুমিও হোয়াইট আমি ও হোয়াইট।
-“ এবার চলুন যাই।
রাফি আগে আগে হাঁটা শুরু করে। তৃষ্ণা পেছন পেছন। রাফির পাশে গাড়িতে গিয়ে উঠে বসে। রাফি গাড়িটা নিয়ে সোজা ধানমন্ডির লেকের পাড় চলে যায়।
ঢাকা শহরের সবচেয়ে সুন্দর লেকগুলোর একটি ধানমন্ডি লেক। মানুষ মর্নিংওয়াকের জন্য এর ওয়াকওয়ে ব্যবহার করেন এবং অনেকে পার্কিং স্পেসে করেন ব্যায়াম। সামাজিকীকরণের স্থান হিসেবে ধানমন্ডি লেক রাজধানীবাসীর জন্য একটি জনপ্রিয় জায়গা।

ঘড়িতে সন্ধ্যা ৬টা ১২। লেকের ভেতরে অফিস ফিরতি সারি সারি গাড়ি, রিকশার টুং টাং শব্দ, সিএনজির কালো ধোঁয়া,শীতের সন্ধ্যা। আরো ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল আলো-আধারিযুক্ত আবহ। রাস্তার এক পাশে লেকের টলটলে পানি। পানির ওপর গাছের ছায়া আর দূর থেকে ভেসে আসা টীমটীমে আলোর চাদরে লেকের ভেতর সে এক অন্যরকম দৃশ্য। অন্য দিকটায় কিছুটা দূরত্ব পর পর বসেছে যুগলবন্দী প্রেমিক প্রেমিকার সমাগম। এসব অবলোকন করতে করতে হঠাৎ সামনে মিলে গেল পরিচিত কিছু মুখ।
রিয়া আর রায়ান এগিয়ে আসছে রাফি তৃষ্ণার দিকে। তৃষ্ণা ঘাড় ঘুরিয়ে রাফির দিকে তাকালো। মুখে লেগে আছে মৃদু হাসি। রায়ান এগিয়ে এসে রাফি কে জড়িয়ে ধরে।

-“ কেমন আছিস?
রায়ান রাফি কে ছেড়ে বলে-
-“ আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তোরা?
রাফি তৃষ্ণার দিকে একপলক তাকিয়ে বলে-
-“ এই তো আছি ভালো। তোরা এখানে যে?
-“ আজ কি?
-“ ফাগুন,বসন্ত।
-“ আরেক টা কি?
-“ নিব্বা নিব্বির প্রেম বিনিময় দিবস।

রায়ান হোহো করে হেঁসে উঠে। রাফির বাহুতে কিল দিয়ে বলে-
-“ হ্যাঁ সেটাই তো এর জন্যই এই সাঝ সন্ধ্যায় বেলা এসেছিস প্রেম বিনিময় করতে।
রিয়া রাফি আর তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ বাহ ম্যাচিং ম্যাচিং দু’জনে।
-“ হ্যাঁ।

তৃষ্ণা বোবার মতো চুপ রইলো। রাফি তৃষ্ণার হাত নিজের হাতের মুঠোয় বন্দী করে। রায়ান, রিয়া,তৃষ্ণা রাফি গিয়ে টঙের দোকানে যায়। চারজনে মিলে চা খায়।
এরমধ্যে ঝুম বৃষ্টি নামা শুরু করে। টঙের ছাওনিতে দাঁড়িয়ে ঝুম বৃষ্টি দেখে তারা।

কুঁড়েঘর কৃত্রিম আলোয় সজ্জিত। বিছানার উপর লাল টকটকে গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো। টেবিলের উপর কয়েকটা মোমবাতি জ্বালানো আর তার পাশে পাপড়ি দিয়ে লেখা- হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন্স ডে মাই লাভলি ওয়াইফ।
বেডের পাশে ছোট্ট টেবিলটায় রাখা তাদের বিয়ের ফটো।

চিত্রা মুগ্ধ হয়ে দেখছে সব। একটু আগেই বাহিরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছিল দেখে তুষার চিত্রা কে নিয়ে কুঁড়েঘরে আসে। আজ রাতে বাড়ি ফিরবে না তারা। সময়টা নিজেদের মতো করে একান্তে কাটাবে। খুব বেশি আসবাবপত্র নেই ঘরে। একটা বেড,একটা ড্রেসিং টেবিল, একটা আলমারি, এক জোড়া সোফা,একটা বুক সেলফ আর ছোট ছোট কয়েকটা শর্ট টেবিল।

-” পছন্দ হয়েছে?
চিত্রা চারদিকে তাকাতে তাকাতে বলে-
-“ ভীষণ। কে সাজিয়েছে এভাবে রুম টা?
-“ লিমন ছেলে টা।
-“ যে ফুল তুলে দিলো?
-“ হ্যাঁ।

কথাটা বলতে বলতে তুষার চিত্রাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। চিত্রা ভ্রু কুঁচকে বলে-
-“ কি করছেন।
তুষার চিত্রার কানের ললিতে অধর ছুঁয়ে বলে-
-“ এখন ও তো কিছুই করলাম না সোনা।
চিত্রা তুষারের থেকে নিজেকে ছাড়াতে ছাড়াতে বলে-

-“ আপনি বন্ধ দরজার ভেতরে এক রকম। আর বাহিরে আরেক রকম।
-“ যেমন?
-“ এই যে এখন আপনাকে অন্য কেউ দেখলে বিশ্বাস ই করবে না যে তুষার খাঁন বন্ধ দরজার ভেতরে এতোটা অসভ্য।
তুষার চিত্রা কে টেনে কাছে নিয়ে এসে বলে-

-“ তুষার খাঁন তার বউয়ের কাছে শুধু অসভ্য কেনো আরো কিছু হতে পারে। দেখতে চাও?
চিত্রা আমতা আমতা করে বলে-
-“ ম..মোটেও ন..না। ছাড়ুন আমায় বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে আমি বৃষ্টি দেখবো।
-“ বৃষ্টি দেখে কি হবে। বৃষ্টিময় প্রেমে পাড়ি জমাবো তোমাকে নিয়ে। আজকের পরিবেশ টা মারাত্মক রোমান্টিক। মিঙ্গেল দের জন্য পারফেক্ট।

আমার শহরে তোমার আমন্ত্রণ সিজন ২ পর্ব ২৮

কথাটা বলে তুষার চিত্রা কে পাঁজা কোলে তুলে নিলো। চিত্রা তুষারের গলা জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ লুকিয়ে আছে। চিত্রা কে আলতো করে বিছানায় শুইয়ে দেয়। কপালে অধর ছুঁয়ে ঘরের বাতি নিভিয়ে দেয়। ঘর জুড়ে একখণ্ড মোমবাতি জ্বলে রইলো। খোলা জানালার দমকা হাওয়া এসে সেই মোমবাতি টাকেও নিভিয়ে দিয়ে গেলো। রাত যত গভীর হলো কারো নিশ্বাস ফেলার শব্দ তত ভারী হলো।

আমার শহরে তোমার আমন্ত্রণ সিজন ২ পর্ব ৩০